#হোম_পলিটিক্স
#আফসানানীতু
#পর্ব_১৫
অভিরূপকে তার খালার বাড়িতে নাফিসাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার প্রস্তাবে রাজি করাতে বেশ বেগ পেতে হয় নাফিসার। তাকে না নেবার পেছনে একশো একটা যুক্তি দেখাবার পরও নাফিসা প্রত্যেকটা যুক্তি ধৈর্যের সঙ্গে খন্ডন করে তাকে বোঝায় যে তাকে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরী। অগত্যা অভিরূপ তাকে নিয়ে খালার বাড়ি আসে।
বেল বাজতেই মোটামুটি সুন্দরী একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। চেহারায় অভিরূপের সঙ্গে মিল থাকায় নাফিসা আন্দাজ করে নেয় এটাই বোধহয় অভিরূপের খালাতো বোন পরী, যার সঙ্গে রুচিতার হাজবেন্ডের বিয়ে দেবার জন্য তার মা এত কেচ্ছা কাহিনী করছে। পরী দরজা খুলে দিয়ে অভিরূপের সঙ্গে নাফিসাকে দেখে কোন কথাই বলে না বরং গটগট করে হেঁটে ভেতরের ঘরে চলে যায়। অভিরূপ একটু অপ্রস্তুত বোধ করে। ব্যাপারটাকে হালকা করতে বোকা বোকা হাসি দিয়ে বলে,
– বলেছিলাম না বাড়ির ওয়েদার গরম হবে, আপনার না আসাই বেটার।
জবাবে নাফিসা মিষ্টি করে হাসে ছেলে ভুলানো হাসি। ভেতরে ঢুকে বলে,
– দরজাটা আটকে দিন।
অভি নাফিসাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে ভেতরের ঘরে চলে যায়। সামনাসামনি যতই সাহস দেখাক না কেন নাফিসা কিন্তু নিজেও ভেতরে ভেতরে ঘামছে। তবু সে মনকে শক্ত করে। আজ এখানে সে যে উদ্দেশ্যে এসেছে সেটা সে সফল করেই ছাড়বে। তার সন্দেহ যদি অমূলক না হয় তাহলে আজই রুচিতার সব সমস্যার সমাধান হবে।
খানিকক্ষণ বসে থেকে উঠে পাশের বারান্দায় আসে নাফিসা। এদের বারান্দাটা সুন্দর, ছিমছাম আর গোছানো। বারান্দার এক কোনে একটা বড় খাঁচায় একটা ময়না পাখিকে দেখে এগিয়ে এসে খাঁচার পাশে দাঁড়ায় নাফিসা। নাকি কন্ঠে বলে,
– কি করিস ময়না?
জবাবে তাকে চমকে দিয়ে কথা বলে ওঠে ময়না, যা শুনে নাফিসার আক্কেল গুড়ুম হবার দশা। সে বিস্মিত চোখে ময়নাটাকে দেখে। ময়নার কথা শুনতে তাকে আবারো কিছু জিজ্ঞাসা করবে কিনা ভাবছে,এমন সময় ভেতরের ঘরে উচ্চকণ্ঠের বাক্যবিতন্ডা শোনা যায়। নাফিসা কান খাড়া করে শুনে।
অভিরূপ ঘরে ঢুকে প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। ঘরে খাটের ওপর আনোয়ারা তার বোন মনোয়ারা আর পরীকে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন। ছেলেকে দেখেও তার অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন ঘটে না। অভি মায়ের কাছে এসে আদুরে কণ্ঠে বলে,
– বাড়ি চলো মা, তোমাকে নিতে এসেছি।
অভিরূপের কথা শেষ হতে না হতে আনোয়ারার গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। সে কোন কথা না বলে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। তার কান্না দেখে খাটের উপর বসে থাকা মনোয়ারা আর পরীও কান্না জুড়ে দেয়। তাদের কান্নাটা একটু বেশিই নাটকীয় লাগে অভির কাছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন তাদের কারো কান্না থামে না তখন সে বিরক্ত কন্ঠে বলে,
– কাঁদছো কেন মা? এখানে এতো কান্নাকাটি করার মতন কোন ঘটনাই ঘটেনি! তুমি আমার কাছে ব্যাপারটা খুলে বললেই পারতে। এভাবে আমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে চলে আসার কোন মানে হয়?
মনোয়ারা যেনো এর অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি আনোয়ারাকে সুযোগ না দিয়ে বলে ওঠেন,
– নিজের বাড়িতে সে থাকবে কি থাকবে না সেটাতেও তোদের অনুমতি লাগবে?
– আমার অনুমতি নিয়ে মা ওই বাড়িতে থাকবে এমন কথা আমি কখন বললাম খালা? তাছাড়া আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম…
মনোয়ারা অভির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
– মার সঙ্গে বলা আর খালার সঙ্গে বলা একই কথা। আমরা দুই বোন, তাই আমাদের কথা একই। ওই বেচারী তোকে কি বলবে? তার কি কিছু বলার শক্তি আছে? সে তো সকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে কিছু মুখে পর্যন্ত তুলতে পারেনি। আমি বলছি শোন… যতক্ষণ পর্যন্ত না তোর ভাই ওই বাজারের মেয়েটাকে ডিভোর্স না দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তোর মা এই বাড়ি ছেড়ে তোদের বাড়িতে যাবে না। আপা যেতে চাইলেও আমি তাকে যেতে দেব না।
অভি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। সে বুঝতে পারে তার মাকে বেশ ভালোভাবেই ঘরোয়া রাজনীতির প্যাচে ফেলা হয়েছে। আর তার মা বুঝে হোক কিংবা না বুঝে এসব কর্মকাণ্ডে সমর্থন যোগাচ্ছে।
– খালা শোন, আমি আমার মাকে নিয়ে যেতে এসেছি। এর মাঝে অন্য কোন ঝামেলা টেনে এনো না। সবচেয়ে বড় কথা আমার ভাবী এখনো ওই বাড়ির বউ, খালা শ্বাশুড়ি হিসেবে তাকে নাম ধরে ডাকতে পারো। এছাড়া অন্য কোন অপবাদ বা বাজে নামে ডাকার আগে একটু ভেবে নেয়া ভালো। সবকিছু ঠিকঠাক না জেনে কাউকে দোষারোপ করা বোকামি।
– ওরে বাবা! এ তো দেখছি ভাবীর আরেক চামচা! তা কি নামে ডাকবো তোর ভাবীকে? ম্যাডাম নাকি বড় আপা?
মনোয়ারা ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলেন।
– খালা, ভাবী দোষী না নির্দোষ সেটা আগে আমরা দেখি, তারপর না হয় তাকে উল্টোপাল্টা বলো। আপাতত আমাদের পারিবারিক ব্যাপারটা পারিবারিকভাবেই মেটাতে দাও।
– কি বলতে চাচ্ছিস তুই? আমি তোদের পরিবারের কেউ না? আমি বাইরের লোক?
– হ্যাঁ মা, তাইতো বলবে! আজকাল তো তার পাখা গজিয়েছে। চাকরি করছে, দুই হাতে কামাচ্ছে! তাই পরিবারের লোকজনকে তার বাইরের লোকই মনে হবে। শুধু তার মনের মতোরাই তার আপনজন হবে। যেমন তার পেয়ারের ভাবী। এদিকে এতো ঝামেলা চলছে অথচ আজকেও তো এক মেয়েকে নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। কে জানে সেও হয়তো তার পরিবারের কাছের কেউ।
পরীর কথা শুনে মনোয়ারা বিলাপ করে ওঠেন,
– দেখো আপা তোমার ছেলের কান্ড দেখো! বাড়ির এতো গন্ডগোলের মাঝেও সে বান্ধবী বগলে নিয়ে ঘুরছে!
– কি আশ্চর্য, আমি কখন বললাম নাফিসা আমার বান্ধবী? এসবের মাঝে ওকে টানছো কেন?
অভির কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের পর্দা সরিয়ে নাফিসা উঁকি দেয়। তাকে দেখে সবাই একটু হকচকিয়ে যায়। নাফিসা ভেতরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে।
– কিছু মনে করবেন না, পাশের ঘর থেকে হইচই এর আওয়াজ শুনলাম তাই ভাবলাম কোন সমস্যা হলো কিনা দেখে আসি।
তারপর আনোয়ারাকে বলে,
– আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি, ভালো আছেন? চিনতে পেরেছেন আমাকে? আমি নাফিসা, আপনাদের পাশের বাড়িতে থাকি। ওই যে সেদিন এসেছিলাম পিঠা দিতে।
একে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন তাদের পারিবারিক কলহের মাঝে ঢুকে পড়েছে, তার উপর এমন সময় নাফিসা এসেছে যখন তাকে নিয়েই চর্চা হচ্ছিল তাই সবাই কমবেশি অপ্রস্তুত বোধ করে। আনোয়ারা নাফিসাকে দেখে একটু অবাক হয়। এই মেয়ে এখানে কিভাবে এলো তার মাথায় আসেনা।
– তুমি? এখানে কিভাবে?
– আপনার ছেলের সঙ্গে এসেছি আন্টি। আমিই আসতে চাইছিলাম, আপনার বোনের বাসা চিনি না তাই ওনার সঙ্গে আসতে হলো।
– ওহ্ আচ্ছা! তা তোমার হঠাৎ কী এমন দরকার পড়লো যে একেবারে অভিকে নিয়ে এখানে আসতে হলো?
– আসলে আন্টি আজ সকালে রুচিতা আপু আমাদের বাসায় এসেছেন তো। তাই মা বললেন আপনাকে ব্যাপারটা জানাতে। শুনলাম আপনি নাকি বাসায় নেই, আপনার বোনের বাসায় গেছেন তাই আপু উনার অফিসের ঠিকানা দিয়ে বললেন উনাকে নিয়ে যেনো আপনার কাছে আসি।
– রুচিতা তোমাদের বাসায়? তা সে কিভাবে জানলো আমি আমার বোনের বাসায় এসেছি?
– সে তো জানতো না। আমি আপনাদের বাসায় আপনার খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পেরেছি। সে আমার কাছ থেকে যখন জানতে পেরেছে আপনি এখানে এসেছেন তখন আমাকে বলল ওনার অফিসে গিয়ে উনাকে নিয়ে যেন এখানে আসি। আর খুব করে বলেছে আপনার সঙ্গে দেখা হলে যেন আপনাকে সরি জানাই তার পক্ষ থেকে। আপনাকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেছে সঙ্গে করে। বেচারী আপনার জন্য কেঁদে কেঁদে শেষ!
– ও বাবা, এ তো দেখছি মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি! ছেলেরা থাকতে ছেলের বউ আরেক বাড়ি বসে থেকে সেক্রেটারি পাঠিয়েছে শাশুড়িকে ফিরিয়ে আনতে।
মনোয়ারা মাঝে ফোড়ন কাটতে ছাড়েন না।
– না না ঠিক তেমন কিছু না! আপু বলছিলেন আন্টিকে যেন আমাদের বাসায় নিয়ে যাই। ওখানে বসে দুজনে তাদের ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে নিবে আর কি! এটাকে অন্যভাবে নেবেন না।
– ওই মেয়েকে আমার খুব ভালো চেনা আছে। কোনটা কিভাবে নিতে হবে সেটা তুমি আমাকে শেখাতে এসো না মেয়ে।
অভিরূপ এবার বিরক্ত কণ্ঠে খালাকে বলে,
– খালা, আমার সঙ্গে যত খুশি যা খুশি বল। কিন্তু উনার সঙ্গে কথা বলার সময় একটু ভেবে চিন্তে কথা বলতো! উনি তো আর আমাদের পরিবারের কেউ না। ভাবীর অনুরোধে উনি এখানে এসেছেন। এখানে কিন্তু ওনার কোন স্বার্থ নেই।
– ও বাবা, আপা! তোমার ছেলে তো দেখি অনেক কিছু বুঝতে শিখে গেছে!
অভি এবার নাফিসার দিকে তাকিয়ে বলে,
– নাফিসা, আপনি একটু কষ্ট করে পাশের রুমে গিয়ে বসুন প্লিজ। মা আমাদের সঙ্গেই যাবে, আপনি ভাববেন না।
নাফিসা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে পড়ে বলে,
– ইয়ামিন ভাই বাসায় নেই?
পরী কন্ঠে উষ্মা প্রকাশ করে বলে,
– তুমি দেখছি ইয়ামিনকেও চেনো?
– না মানে ঐদিন হসপিটালে পরিচয় হয়েছিল।
– তো তাকে আবার তোমার কি দরকার?
– শুনেছিলাম উনিও বাসায় আছেন, অথচ এখন দেখছি না তাই…
– ও খালার জন্য পান আনতে বাইরে গেছে, এখনই চলে আসবে। তুমি গিয়ে বসার রুমে বসত এবার।
ঘরের উত্তপ্ত পরিবেশ কাটিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নাফিসা। মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে সাবাসি জানায়। যাক, পারফরম্যান্স খারাপ হয়নি একেবারে। তার তো আসল দরকার ইয়ামিনের সঙ্গে। ওই বেটা পান নিয়ে কখন ফিরবে কে জানে? এই বাসায় আসার পেছনে তার প্রধান কারণই হচ্ছে ইয়ামিন। একবার তাকে বাগে পেলে বাড়ির আর সবাই ঝগড়াঝাটি করে ম*রে যাক, তাতে তার কি এসে যায়!
সকালে রুচিতার সঙ্গে আলাপকালে হঠাৎ করেই ইয়ামিনের ব্যাপারটা তার সামনে আসে। সেই থেকে তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। আর এখন তো সেই সন্দেহ মোটামুটি বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে…
– আচ্ছা আপু, এই মেসেজ যখন আপনাকে আপনার বান্ধবী পাঠিয়েছেন তখন তো আপনার মোবাইলে স্ক্রিন লক করা ছিল না তাই না?
– ছিল, তবে সেটা প্যাটার্ন লক।
– এই লক সিস্টেম খুলে সে সময় কাউকে ফোন দিয়েছিলেন?
– মাঝে মাঝে মাকে ফোন দিলে সে আমার শাশুড়ি বা শফির সঙ্গে কথা বলতে চায়, এভাবে তো বহুবার আনলক ফোন দিয়েছিই। এছাড়া অন্য কেউ আমার ফোন ধরে না।
– আমি বলতে চাইছি এই মেসেজটা পাঠাবার পরপরের ঘটনাগুলো একটু মনে করে দেখেন। তাছাড়া ওনারা তো পরিবারের লোক, এর বাইরে কাউকে দিয়েছেন বা কেউ আপনার ফোনটা সন্দেহজনকভাবে নিজের কাছে কিছুক্ষণের জন্য রেখেছিল এমন ঘটনা ঘটেছিল কি?
রুচিতা খানিকক্ষণ ভেবে হঠাৎ করে বলে,
– একটা কথা মনে পড়ল।
পিয়া আর নাফিসা দুজনেই আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়,
– কী?
– এই মেসেজটা যেদিন আমাকে পাঠানো হয় সেদিন শফির খালাতো বোন জরীর ছেলের বার্থডে পার্টিতে আমাদের দাওয়াত ছিল।
– যে অনুষ্ঠানে আমি আর জাফরও গিয়েছিলাম। ওখানেই তো আপনার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়, তাই না ভাবী?
– সেদিন আমারও জন্মদিন ছিল। অনেকেই বার্থডে উইশ করছিল, আমি ফোন আনলক করে সেগুলো দেখছিলাম। তখন মা ফোন দিয়ে আমাকে উইশ করে। এরপর মা আমার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল তখন ওই আনলক অবস্থায় ফোনটা আমি তাকে দিয়েছিলাম। একটু পর জরীর ছোট ভাই ইয়ামিন ফোনটা আমাকে দিয়ে গিয়েছিল। দেওয়ার সময় ফোনটা লক ছিল, পার্টির হই হট্টগোলের মধ্যে আমিও আর ফোনটা আনলক করে চেক দেইনি তখন। রাতে বাড়ি ফেরার পর আমার ওই ফ্রেন্ড মেসেজ দিয়ে জানতে চায় আমি ওর উইশের জবাব দিলাম না কেন? চেক দিতে গিয়ে ভিডিওটা পাই।
– আপনাকে যখন ইয়ামিন মোবাইলটা দেয় তখনই কি উনি উইশ করেছিলেন?
– সেটা বলতে পারবো না, তবে ও যখনকার কথা বলছিল সে সময় আমি ওখানেই ছিলাম। তাছাড়া ও আমাকে মেসেজ দিয়েছে সেটার নোটিফিকেশন স্ক্রিনে শো করার কথা, কিন্তু করেনি বলে তখন একটু মনে খটকা লাগলেও ব্যাপারটাকে তেমন আমলে নেই নি।
অতটুকুতেই ইয়ামিনের উপর নাফিসার সন্দেহ হয়।
– আচ্ছা আপু, এমনও তো হতে পারে! আপনার মায়ের সঙ্গে আপনার শাশুড়ি কথা বলার পর হয়তো তিনি ইয়ামিনকে ফোনটা আপনাকে ফেরত দিতে বলেছিলেন। ইয়ামিন ফোনটা হাতে নিতেই হয়তো আপনার ফ্রেন্ড মেসেজ পাঠিয়েছে আর উনি সেই মেসেজটা দেখেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটা ওনার মোবাইলে নিয়ে নিয়েছেন। হতে পারে না? হয়তো তখনও ফোনটা আনলক ছিল।
– কিন্তু ইয়ামিন এমনটা কেন করবে?
– কারণটা খুব স্পষ্ট! আপনি নিজেই বলছেন আপনাকে আপনার খালা শ্বাশুড়ির বাড়ির কেউ পছন্দ করেনা কারন আপনার হাজবেন্ডের সঙ্গে তারা তাদের ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিল। হয়তো সেই কারণে আপনার ওপরে ইয়ামিনের রাগ আছে, আর সেজন্যই সে এই কাজটা করেছে।
সকালের ওই আলাপটা ছিল শুধুই নাফিসার অনুমান। আর সেই অনুমানকে যাচাই করার জন্য সে এমন একটা পরিবেশে একা রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে চলে এসেছে। নাফিসা আসলে এসেছিল তার এই সন্দেহ নিয়ে অভির সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু অভির কাছে আসার পর যখন জানতে পারলো তার মা তার খালার বাড়িতে আছে এবং ইয়ামিনও হোস্টেল থেকে বাড়ি এসেছে তখন সে ইচ্ছে করেই এ বাড়িতে এসেছে। আর এখন তো মনে হচ্ছে এসে খুব একটা ভুল করেনি সে।এখন ইয়ামিনকে বাগে পেলেই হয়!
এমন সাত পাঁচ ভেবে আরও দশ পনের মিনিট কেটে যাওয়ার পর সদর দরজা খুলে ইয়ামিন প্রবেশ করে। নাফিসাকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। নাফিসাও তাকে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়। সে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলে,
– ইয়ামিন ভাই, কেমন আছেন?
ইয়ামিন একটু হকচকিয়ে যায়।
– ইয়ে আপনি মানে তুমি… পিয়ার ফ্রেন্ড নাফিসা না?
– এইতো চিনতে পেরেছেন! কেমন আছেন আপনি?
– আমি ভালো আছি, কিন্তু তুমি এখানে?
– আমি আন্টির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, মানে আপনার খালার সঙ্গে। কিন্তু আপনি আমাকে এখানে দেখে এতটা ভয় পাচ্ছেন কেন বুঝলাম না!
– ও আচ্ছা!
ইয়ামিনের চেহারায় ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার ভাবভঙ্গি। তাই দেখে নাফিসা বেশ মজা পায় এবং তাকে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে দিয়ে জানতে চায়,
– কেন? আপনি কি অন্য কিছু ভেবেছিলেন?
চেহারায় ভীত ভাব ফুটে উঠলেও ইয়ামিন নিজেকে সামলে নেয়।
– না অন্য কি ভাববো বলো? তুমিতো পিয়ার বন্ধু, এখানে কিভাবে এলে তাই জিজ্ঞাসা করলাম আর কি।
– আপনার সঙ্গে আমার মাঝে সাঝে জাফর ভাইয়ের বদৌলতে দেখা হয়েছে বটে তবে কথা হয়নি বলে আপনি যে আমাকে মনে রেখেছেন সেটা কিন্তু আমি জানতাম না। আমার কিন্তু আপনার চেহারা খুব একটা মনে ছিল না। তাই সেদিন হসপিটালে দেখেও আপনাকে চিনতে পারিনি।আজ সকালেই জানতে পারলাম জাফর ভাইয়ের হোস্টেলের জুনিয়র রুমমেট ইয়ামিন আর আপনি একই লোক।
– ওহ্, তাই নাকি? আচ্ছা তুমি বসো, আমি ভেতরে যাই।
ইয়ামিন পালাতে চাইছে বুঝতে পেরে নাফিসা তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।
– বলছিলাম কি… বাড়ির ভেতরে একটু ঝামেলা চলছে। এদিকে আমি একা এসে ঝামেলায় পড়ে গেছি! আপনি যদি আমার সঙ্গে একটু এখানে বসতেন!
– ঠিক আছে বসবো, আগে ভেতর থেকে একটু ঘুরে আসি।
– সে তো আপনি যেতেই পারেন। কিন্তু তার আগে প্লিজ, আমাকে দশটা মিনিট দিন!
ইয়ামিনের কপালে চিকন ঘামের রেখা দেখে নাফিসা মনে মনে হাসে। শেষমেষ নাফিসার জয় হয়। ইয়ামিন তার সঙ্গে এসে সোফায় বসে।
– বুঝলেন ইয়ামিন ভাই, জাফর ভাইয়ের কাছে আপনার এত এত প্রশংসা শুনি। জাফর ভাই সব সময় আপনার কথা বলে।
– তাই? ভাই আসলে আমাদের দুজনকে খুব ভালোবাসে!
– তা আপনারা তো ভালোবাসার মতনই লোক। এত ভালো,এত ভদ্র!
নাফিসার কথায় ইয়ামিনকে একটু আশ্বস্ত দেখায়। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বলে,
– তা তুমি খালার সঙ্গে দেখা করতে এখানে চলে এসেছো?
– না মানে রুচিতা আপু সকালে আমাদের বাসায় এসেছেন। এসে অনেক কান্নাকাটি করে আমাকে অনুরোধ করলো তার হয়ে যেন আন্টির কাছে সরি বলে আন্টিকে বাড়ি নিয়ে আসি। তাই এসেছি আর কি!
– রুচিতা ভাবী তোমাদের বাসায়?
– শুধু আপনার ভাবী না পিয়াও আমাদের বসাতেই।
এ কথা শুনে ইয়ামিনের হাত থেকে পানের প্যাকেটটা মাটিতে পড়ে যায়। সে একটু নার্ভাস ভঙ্গিতে সেটা মাটি থেকে তুলে বলে,
– আমি পানটা না হয় খালাকে দিয়ে আসি।
এমন সময় অভিরূপ ঘরে ঢোকে, সেই সঙ্গে পরীও। তাদের দুজনের মধ্যে মনে হয় বেশ ভালো প্রকারের কথা কাটাকাটি হচ্ছে এবং এই অবস্থায় তারা দুজন সেখানে চলে এসেছে।
– দেখো পরী আপা, এখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার আলাপ করতে হবে না। সেটা আমি আর মা বুঝবো। আমি মাকে নিয়ে যেতে এসেছি, দয়া করে তাকে নিয়ে যেতে দাও। নয়তো আজ যদি আমি খালি হাতে বাড়ি ফিরি তাহলে পরবর্তীতে ঘটনা কিন্তু আরও জটিল হবে। তখন আমাকে কেউ দোষ দিতে পারবে না।
জবাবে পরী কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই ইয়ামিন গর্জে ওঠে,
– না না! তোমাদের দোষ দেবো কেন? খালার সব দুর্ভাগ্যের জন্য খালা নিজেই দায়ী! সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য ছেলের বউ তো ছেলের বউ, তার ছেলেরাও তার আপন নয়।
অভিরূপ ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে রাগত স্বরে বলে,
– মুখ সামলে কথা বলবি! বলেছিলাম মুখের ভাষা সংযত করবি নইলে বাড়ি এলে তোকে চ*ড় দিয়ে দাঁত ফে*লে দেবো। ভুলে গেছিস?
নাফিসা এবার হাত উঠিয়ে বলে,
– আপনারা একটু থামবেন প্লিজ! এই কথাগুলো আমরা একটু শান্তি মতও বলতে পারি। তবে আমার মনে হয় এখানে পুলিশ ডাকা ভালো।
– পুলিশ?
ইয়ামিন সাপ দেখার মত চমকে উঠে তিন পা পিছিয়ে যায়। অভিরূপ বলে,
– আপনি আবার এসব কি উল্টাপাল্টা বকা শুরু করলেন? পারিবারিক ব্যাপারে আপাতত পুলিশ ডাকবো না এমনটাই কথা হয়েছিল আমাদের।
– সেটা ঠিক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা শুধু আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারই নয়, আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পুলিশ না ডাকলে চলছে না।
– মানে?
অভিরূপ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাফিসার দিকে তাকায়। ঠিক তখন বারান্দা থেকে একজন বৃদ্ধের গলা শোনা যায় যে টেনে টেনে বলছে,” মদন, ক্ষুধা লাগছে খাইতে দে।” অভি চমকে বারান্দার দিকে তাকায়, তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নাফিসার দিকে তাকায়। নাফিসা হেসে বলে,
– আপনাদের ময়না পাখিটার বোধহয় ক্ষুধা পেয়েছে। বেচারা সেই তখন থেকে খাবার চেয়ে ডাকাডাকি করছে। আচ্ছা, আপনাদের বাড়িতে মদন কে? ইয়ামিন ভাই?
ইয়ামিনের দিকে অর্থবহ চোখে তাকায় নাফিসা আর ঠিক তখন পরীর হাতের মোবাইলটা বেজে ওঠে। রিংটোনটা খুব পরিচিত, একটু আগেও নাফিসা জাফরের কাছে পাঠানো ভয়েজ মেইলে শুনতে পেয়েছিল সেটা।
নাফিসা অভিরূপের দিকে তাকিয়ে তার মুখের হাসি বিস্তৃত করে।
– কি? বুঝতে পারছেন পুলিশ কেন ডাকবো বলছি? দুয়ে দুয়ে চার মিললো আপনার?
নাফিসার কথা শেষ হবার আগেই ইয়ামিন সদর দরজার দিকে দৌড় দেয় পালাবে বলে। তাই দেখে নাফিসা উচ্চকণ্ঠে ইয়ামিনকে বলে,
– কোন লাভ নেই, বাইরে মাকে বলে আমি পুলিশের ব্যবস্থা অনেক আগেই করে রেখেছি, অপেক্ষায় ছিলাম আপনাদের বলে পুলিশ ভেতর ডাকার। শ্বশুরবাড়িতে আজ আপনার যেতেই হবে! এ্যাট এ্যানি কস্ট।
চলবে…