অকিঞ্চন পর্ব-০১

0
508

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – ০১

– আপা দেখ, মুদির দোকান থেকে যে ভাইয়াটা সবসময় তোর দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই ভাইয়াটাই চালের বস্তা নিয়ে আসছে।

নিশী তার আপাকে ভীষণ আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে কথাটা বলল। তার কণ্ঠে কিংবা বলার ধরনেই বোঝা গেল, ব্যাপারটা তার কাছে ভীষণ রোমাঞ্চকর বলে বোধ হচ্ছে। তবে নিশীর কথায় প্রভাকে তেমন বিচলিত হতে দেখা গেল না। সে নিজের মতোই পেঁয়াজ কাটতে ব্যস্ত। মা অসুস্থ। ঘাড় ব্যথায় শুয়ে আছে। আজ প্রভা’ই রান্না করবে।
নিশীর কথা গায়ে মাখেনি — কথাটা ভুল। সে উপরে উপরে নির্বিকার প্রতিক্রিয়া দিলেও, ভেতরে ভেতরে কিছুটা অবাক হয়েছে বৈকি! তার চেয়েও বড় ব্যাপার নিশীর ওপরে ভীষণ পরিমাণ বিরক্ত হয়েছে প্রভা। গলা তো নয় যেন ফাঁটা বাঁশ! নিশ্চিত লোকটা শুনতে পেয়েছে। বস্তা রাখতে গেছে ভেতরের রুমে। রুমের দূরত্বই বা কতোটুকু! অপরিচিত একটা লোকের সাথে কী বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটাল মেয়েটা!

– যেখানে বস্তাটা রাখতে বলসিলেন, রেখে দিসি।

কথাটা কানে পৌঁছতেই প্রভা, নিশী দু’বোনই চোখ তুলে তাকাল সামনে থাকা মানুষটির দিকে। তাকাতেই চোখে বিঁধল চোখের দেখায় চেনা অথচ সম্পর্কের দিক থেকে অচেনা এক যুবকের মুখাবয়ব। যুবক শ্রেণীর মধ্যম ধাপে স্থান দেওয়া যেতে পারে সামনের মানুষটিকে। গঠনগত দিক থেকে যুবকটি একদম সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী নয়, আবার একেবারে হ্যাংলাও নয়। মধ্যম গড়নে অবস্থান। হাত-পা দেখে বোঝা যায় খেটে খাওয়া শরীর। গায়ের রঙ সাধারণ বাংলা ভাষায় ‘ময়লা-রং’। শক্তপোক্ত লোমশ হাতে কালো হাতের রক্তনালি গুলো ফুলে নিজেদের জানান দিচ্ছে। গায়ে জড়ানো একটা রঙ জ্বলে যাওয়া সাধারণ শার্ট। মুখে হালকা-পাতলা দাঁড়ি। মুখটাও তেমন সুশ্রী নয়। কেমন খটখটে মুখ! সৌন্দর্য তো নেই, সাথে মায়ার’ও বেশ অভাব।
প্রভা এক পলক দেখেই নিজের দৃষ্টি সরাল। নিজের কাজে ব্যস্ত হলো।
নিশী চোখের পলক ফেলে ফেলে দেখল সামনে থাকা মানুষটাকে। কৃষ্ণবর্ণের মুখাবয়বে ঘামের কণা বেশ ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে। পরনের শার্ট’টাও গরমে ভিজে উঠেছে। নিশীর ভীষণ খারাপ লাগল। গরীব শ্রেণির মানুষের প্রতি তার মায়া অন্যরকম। নিজের মায়া থেকে ভীষণ বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
– আংকেল পানি দেই? পানি খাবেন?

নিশীর প্রশ্নে সামনের মানুষটা উসখুস করে উঠল। নিশীর দিকে বিপন্ন দৃষ্টিতে চাইতেই হয়তোবা নিশী নিজের ভুল বুঝতে পারল। তড়িঘড়ি বলে উঠল,
– সরি, ভাইয়া। সরি। আসলে সবাইকে আংকেল বলে অভ্যস্ত আমি। একারণে আপনাকেও বলে ফেলেছি। পানি খাবেন? দিব?

সামনের মানুষটির কাছে বোধয় পানি পান করার চেয়েও এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়াটা বেশি জরুরী বলে মনে হলো। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে এইভাবে দাঁড়াতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা। একারণেই নিশীর প্রশ্ন, অনুরোধ, কথা সব ছাপিয়ে ত্রাসিত কণ্ঠে বলে উঠল,
– আচ্ছা, আমি যাই তাহলে।

বলেই কোনোকিছুর অপেক্ষা করল না। বিচলিত ভঙ্গিতে চলে গেল মুদির দোকানের ছেলেটা। সেদিকে ভীষণ আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিশী নামক কিশোরী। সাথে আলু কুঁচিকুঁচি করতে করতে কপালের মাঝে হালকা ভাঁজ দেখা গেল প্রভা নামক যুবতীর।
_____

রাত দশটা।
আজ একটু তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করা হলো। হাসানের শরীরটা তেমন ভালো না। তাই দোকানের পর্ব চুকিয়ে বাসায় চলে এলো। তাদের বাসাটা মেইন রোড থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে। তাদের গলির ডানপাপাশে একটি দালানকোঠা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাম পাশে টিনশেড এর কিছু ঘর। যেখানে রিকশাওয়ালা সহ দিনমজুর শ্রেনীর মানুষদের বসবাস। গলির সোজাসুজি শেষ মাথায় তাদের বাড়ি। টিনশেডের একতলা বাড়ি। সেখানে উঠতে হয় লোহার সিড়ি বেয়ে। হাসান উঠতে আরম্ভ করল। উঠতে উঠতে তার মনে হলো, সে নিজের ডুপ্লেক্স বাড়ির সিড়ি বেয়ে উঠছে। এইটা যে সে প্রথমবার ভাবল, ব্যাপারটা তেমন নয়। প্রায়’ই ভাবে। কল্পনা করে তার বাড়িটা কোনো টিনশেড নয়, চাকচিক্যময় একটা রাজপ্রাসাদ। মনে করাতে তো দোষের কিছু নেই।

ঘরে ঢুকেই খাওয়া-দাওয়ার পর্বের সমাপ্তি ঘটাল হাসান। এবার ঘুমুনোর পালা। ঘুমাবে। আহ! ভাবতেই হৃদয়ে অন্যরকম আলস্য-শান্তি অনুভব হয়। তবে এর আগে আরেকটি বিরক্তিকর কাজ তাকে করতে হবে। বাথরুম যেতে হবে। এই মূহুর্তে বাথরুম যাওয়াটাকে ভীষণ ভারী এবং অসহ্যকর কাজ বলে বোধ হলো।

হাসান ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল তার বৈমাত্রেয়-সহদোর ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে ব্যস্ত। তবে কাজ যে কেমন গুরুত্বপূর্ণ তা ভালো করেই জানা আছে হাসানের। হাসান ডাকল,
– কিরে তাওহীদ! ভাবীরে দেখা হয় নাই?

তাওহীদ পিছন ফিরল। সে চমকায়নি, আবার হঠাৎ করে হাসানের গলা আশাও করেনি। হাসান ভাই আরোও দেড়িতে বাড়ি ফেরে। সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
– এইসব কী বলেন ভাই! কীসের ভাবি? আমি চাঁদ দেখতেসিলাম।

হাসান মজা পেল কথাটায়। গায়ের গেঞ্জি খুলতে খুলতে বলল,
– হঁ। চাঁদ’ই তো। আমাগো তাওহীদের ব্যক্তিগত চাঁদ। দেখ, দেখ। ভালো কইরা দেখ। তুই চাঁদ দেখতে থাক, আমি বাথরুমের জ্বিনেগো লগে আলাপ কইরা আসি।

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল হাসান। তাওহীদ আবারো নিজের কাজে মন দিল। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করল সামনের তিনতলার ফ্ল্যাটের রমণীকে। সামনের ব্লিডিং এর তিন তলার মেয়েটা বর্তমানে বারান্দায় বসে আছে। দৃষ্টি তার বইয়ের দিকে। তাওহীদ প্রতিদিন মেয়েটিকে দেখে। ভীষণ যত্ন নিয়ে, তৃষ্ণা নিয়ে, চোখ ভর্তি খুশি নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তাও যেন দেখার সাধ মিটে না। বরং দিনকে দিন বেড়েই চলে। তাওহীদ আর হাসান একই ঘরে থাকে। তাদের ঘরের জানালা দিয়ে খুব সহজেই মেয়েটার বারান্দা, বারান্দায় থাকা মেয়েটার ঘরের জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরের কিছু অংশ দেখা যায়। তাওহীদ মাঝেমধ্যেই মেয়েটাকে দেখতে বসে যায়। সবসময় অবশ্য দেখার সুযোগ হয়না তার। মেয়েটা বারান্দায় এলেই যা একটু সুযোগ মিলে! তাইতো তাওহীদ প্রতিদিন দু’টো সময়ের অপেক্ষা করে। মেয়েটার কলেজ থেকে ফেরার এবং বারান্দায় এসে বসার। তাওহীদের ঘর থেকে বের হলেই তাদের লম্বা এক বারান্দা। যেই বারান্দা দিয়েই মূলত সবার ঘরে চলাচলসহ যাবতীয় কাজ করতে হয়। সে চাইলেই বারান্দায় চলে যেতে পারে। এতে করে আরোও ভালোভাবে দেখা যাবে মেয়েটিকে। কিন্তু উপায় নেই। সে যদি বারান্দায় চলে যায়, এতে করে মেয়েটি বিরক্ত হতে পারে। মেয়েদের ষষ্ঠ-ইন্দ্রীয় প্রবল। মেয়েটি নিশ্চয় খুব সহজেই ধরে ফেলবে তাওহীদের তাকিয়ে থাকা। এরপর তাকে অভদ্র ভাববে। কোনো ছেলে তার দিকে ছোঁচার মতো চেয়ে আছে – ব্যাপারটা নিশ্চয় তাকে স্বস্তি দেবে না। কী দরকার! সে তো বেশ দেখতে পাচ্ছে। শুধু সে নয়; মেয়েটা যদি তাকায়, মেয়েটাও অবশ্য দেখতে পাবে তাকে। তবে সেই সুযোগ তাওহীদ দেয়না। কায়দা করে লুকিয়ে পড়ে। তাওহীদ ভীষণ উদাস হয়ে মেয়েটির বারান্দা থেকে নিজের দৃষ্টি আকাশের পানে নিয়ে নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তাওহীদের মনে পড়ল আজ সকালের অস্বস্তিকর ঘটনা। মাথা থেকে ঘটনাটা সরছে না। মস্তিষ্কের কোথাও একটা কামড়ে ধরে আছে। যখনই মনে হয়, তখনই অস্বস্তিদায়ক-ব্যথা হয়। অভ্যাসমতো আজও সে দোকানে বসে ছিল। টুকটাক হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত ছিল। তখনই হঠাৎ করে গুরুগম্ভীর এক মধ্যবয়সী লোকের আওয়াজ পাওয়া গেল। ভরাট কণ্ঠে মিনিকেট চাউলের বস্তা আছে কিনা জানতে চাইছে সে। সে এগোবে তার আগেই দোকানের অন্যপাশ থেকে তার চাচা এগিয়ে গেল। লোকটি হাত দিয়ে চাউল পরখ করে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানাল। দাম মিটিয়ে বস্তা নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন লোক খুঁজছিল, তখন তার চাচা বলল,

– ভাই, রিকশা দিয়া নিয়া যান।
লোকটি প্রত্যুত্তরে বলল,

– না। বাসা সামনেই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দিয়ে আসতে হবে। তাই লোক খুঁজতেসি। লোক-টোক থাকলে দেন। বিশ-তিরিশ টাকা বাড়াই দিবনি।

কথাটা শোনা মাত্রই তার চাচা কিছু বাড়তি পয়সার আশায় তাকে ডেকে বললেন দিয়ে আসতে। তাওহীদ অজানা কারণবশত ভীষণ লজ্জা পেল। এতোদিনে দোকানে বসা ছাড়া এমন কোনো কাজ সে করেনি। তবুও তাওহীদ তার চাচার আদেশ পালন করল। তবে লোকটির নির্দেশ মোতাবেক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তিনতলা শুনে ঘাবড়ে গেল। পরমুহূর্তেই ভাবল অন্য ফ্ল্যাট হতে পারে। কিন্তু ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়’ – প্রবাদ বাক্যটির বাস্তবরূপ দেখিয়ে, চোখ আটকাল মনের দিক থেকে বহুল পরিচিত হলেও সেই মূহুর্তের জন্য ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মুখের দিকে। ভীষণ ব্রীড়া’ময় পরিস্থিতি কাটিয়ে কোনোমতে নিচে নামতেই পড়ল লোকটির সামনে। লোকটিকে সে চিনত না, চেনা থাকলে হয়তোবা চাচার আদেশ শুনে বস্তা নিয়ে আসত না। তাওহীদকে দেখে লোকটি ভীষণ অবলীলায় একপ্রকার বিনয়ী-দয়া ছুঁড়ে দিল,

– নেও। কষ্ট কইরা আসছো, পঞ্চাশ টাকাই রাখ। ভাংতি নাই।

তাওহীদ লোকটির দিকে চোখ তুলে ভীষণ শ্রদ্ধা নিয়ে চাইল। আড়ষ্টপূর্ণ তবে আন্তরিক কণ্ঠে বলল,
– লাগবে না চাচা। সাহায্য করে টাকা নিতে চাইতেসি না। এইখান থেকে এইখানে টাকা নিব কীসের জন্য? টাকা লাগবে না। একই এলাকার মানুষ আমরা। যে কোনো দরকারে আপনি আমারে ডাকবেন। আমি হাজির হয়ে যাব। এখন আমি আসি চাচা?

নিজের কথা শেষ করেই দ্রুতপদে স্থান ত্যাগ করল সে। তাওহীদ টাকা কেন নেয়নি তা সে নিজেও জানে না। সত্যিই কী সে প্রতিদান চায়নি নাকি তার অবচেতন মন লোকটির চোখে নিজেকে শিষ্ট প্রমাণ করতে চেয়ে নেয়নি – কে জানে!
___

প্রভা ভীষণ অসন্তুষ্ট মুখে রিকশায় চেপে বাড়ি ফিরছে। মুখভঙ্গির আকার যথেষ্ট শক্ত। প্রভার মুখের প্রতিক্রিয়াতেই সামনে থাকা যেকোনো আগুন্তুক অনায়াসেই ধরে ফেলবে তার ভেতরকার অপ্রসন্নতাকে। তার কঠোর মুখভঙ্গি দেখেই কথা বলতে দু’বার ভাববে।

বর্তমানে প্রভার অপ্রসন্নতাকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। তার মন খারাপ কিংবা রাগ যাই হোক তার মূলে রয়েছে — প্রবেশ পত্র হারিয়ে যাওয়া। সামনে তার স্নাতকের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা। আর সে কি না প্রবেশপত্র হারিয়ে বসে আছে! হোক ইনকোর্স। তবুও, এক্সাম তো। কবে হারিয়েছে, কোথায় হারিয়েছে তারও কোনো ইয়ত্তা নেই। সব শেষে যখন স্যারকে কথাটা বলল, তখন তিনি যা নয় তাই বলে রাগ ঝাড়ল ওর উপর। অবান্তর সব কথা জুড়ে বকা শুরু করল। কেন? ও কী ইচ্ছে করে হারিয়েছে? কাল তো শুধু বকা দিয়েই থেমেছিল, আর আজ একদম সাফ সাফ জানিয়ে দিল, প্রভা পরীক্ষায় বসতে পারবে না। তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। বিরক্ত, রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো প্রভার। তার রাগের দ্বিতীয় কারণ — সূর্যের তেজ। এমনিতেই মন-মেজাজ ঠিক নেই, তার উপর সূর্যের এমন তীক্ষ্ণ আলোয় প্রভার মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাওয়া যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে সূর্যকে টেনে এনে দুইটা চড় লাগাতে পারলে মনটা হয়তো শান্তি পেত। ভেবেই হাপ ছাড়ল প্রভা।

নিজের অবানঞ্ছিত ভাবনার মাঝেই প্রভা পৌঁছে গেল তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে। ভাড়া মিটিয়ে বির্মষ মুখে চলল নিজ বাসার গলির দিকে। চলতে চলতে কয়েক পা সামনে এগোতেই কানে এলো কারো বিচলিত স্বর। কেউ ভীষণ যত্ন, আড়ষ্টভাব নিয়ে তাকে ডাকছে,
– সুপ্রভা, শুনুন?

অজ্ঞাত ব্যক্তির প্রথম ডাকে যখন প্রভার কোনোরূপ সারা মিলল না, তখন ব্যক্তিটি আবারো দ্বিধা নিয়ে ডেকে উঠল,
– সুপ্রভা!

প্রভা সবিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল। সুপ্রভা বলে কী তাকে কেউ ডাকছে? হ্যাঁ তাকেই তো ডাকা হচ্ছে। তবে বুঝি কিছুক্ষণ আগের অবচেতন মনে শোনা ডাকটাও তার জন্যই ছিল? এই ভরদুপুরে, জনমানবহীন জায়গায় তাকে কে সুপ্রভা বলে ডাকছে? প্রভার জানামতে তাকে সুপ্রভা বলে ডাকার মত কেউ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মজুত নেই। যে ছিল, সে অনেক আগেই সৃষ্টিকর্তার কাছে ধরা দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মুখে অনেক বছর পর পর হ্যালির ধূমকেতুর মতো ‘সুপ্রভা’ নামটা শোনা গেলেও যায়…
ন্যানো-সেকেন্ডে সকল ভাবনা বিশ্লেষণের নিবৃত্তি ঘটিয়ে প্রভা ফিরে তাকাল। চোখের পড়ল মুদির দোকানের ছেলেটাকে। মূহুর্তেই ভীষণ রকমের বিতৃষ্ণা ফুটে উঠল প্রভার দৃষ্টিতে। এতোদিন পর্যন্ত শুধু কারণে-অকারণে তাকিয়ে থাকত। সেই তাকিয়ে থাকাই আজ নাম ধরে ডাকা পর্যন্ত চলে এলো নাকি! প্রভা একপ্রকার ধরেই নিল নিশ্চয় ছেলেটা কোনো প্রেম বিষয়ক ব্যাপারে তাকে ডেকেছে। নিশ্চয় এখন মুখস্থ করে আসা বাংলা মুভির সস্তা ডায়লগ উগরাবে। আজ হয়তো একেবারে চলেই এসেছে আট-ঘাঁট বেঁধে প্রেম নিবেদন করতে। বিরক্তি, রাগ, বিতৃষ্ণায় যখন প্রভার মুখ কুঁচকে যাওয়া শুরু হলো, ঠিক তখনি তাওহীদ প্রভার ধ্যান-ধারণার আশপাশ দিয়ে না গিয়ে একটি কাগজ বাড়িয়ে দিল। বিনয়ী কণ্ঠে বলল,

– কাগজটা হয়তোবা আপনার দরকারি।

প্রভা ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টি দিল। তার দরকারি কাগজ এই ছেলের কাছে কীভাবে থাকবে তাই সে ভেবে পেল না। মনে মনে সন্দেহ হলো, নিশ্চয় কাগজে খারাপ কথা লেখা। প্রভা হাত বাড়িয়ে কাগজ নিল। ভ্রু কুঞ্চিত করে কাগজ খুললে প্রভার কুঞ্চিত দৃষ্টি সোজা হলো। তার পরীক্ষার প্রবেশপত্র! যে কাগজটার জন্য কাল থেকে আজ সারা সকাল ঝামেলা পোহাতে হলো, সেই কাগজ কি-না এই ছেলের কাছে ছিল! প্রভা অবুঝ দৃষ্টিতে চাইল তাওহীদের পানে। তাওহীদ দৃষ্টির ভাষা বুঝে বলল,

– সেদিন রিকশা থেকে নামার সময় কাগজটা ফেলে দিসিলেন। তাড়াতাড়ি এসে কাগজ তুলে দেখি অনেক দূরে চলে গেসেন। আবার কাগজে ময়লা-পানিও লেগে গেসিল। ছিঁড়ে যায় নাকি তাই ভেবে বাসায় শুকাতে দিসিলাম। এরপর তো আজকে দেখা হলো।

তাওহীদের নীরব কণ্ঠের কথা শুনে প্রভার চক্ষু থেকে ধারাল ভাব কাটে। ধারাল ভাব কাটে কিন্তু কোমলতা প্রকাশিত হয়না। প্রভা মনে মনে নিজেকে শাসায় যে, মানুষটা তার উপকার করেছে। তার কোনো প্রয়োজন ছিল না প্রভা কোন কাগজ ফেলে গেল বা নিয়ে গেল এইসব নিরীক্ষণ করার; কিন্তু সে করেছে। শুধু করেনি, যত্ন করে রেখে দিয়েছে এরপর আবার তাকে ফেরতও দিচ্ছে অথচ সে কি-না তারই সামনে কঠিন মুখের আকারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রভা বলল,
– থ্যাং য়্যু আপনাকে।

প্রভা হতাশ হলো। সে চেয়েছিল কোমল কণ্ঠে বলতে। তবুও কণ্ঠটা বোধয় কঠিন শোনাল। কাগজের দিকে চাইতেই প্রভার কিছু মনে পড়ে যাওয়ায় কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়ে রূঢ় কণ্ঠেই শুধাল,

– আপনি কী কোনো ছোট খাম পেয়েছিলেন? আমার দু’টো পাসপোর্ট সাইজের ছবি ছিল সেখানে। ছবি দু’টো পাচ্ছিনা।

তাওহীদ তোতাপাখির মতো করে বলল,
– না, পাইনি। পেলে তো আপনাকে দিতাম।

প্রভা আশাহত হলো। বিভিন্ন চাকরির ফর্ম ফিলাপে কিংবা ভার্সিটিতে প্রায়শই ছবি লাগে। সবসময় ছবির জন্য একপ্রকার হয়রানিতে পড়তে হয়। একারণে প্রভা ছবি নিজের সাথে নিয়ে ঘোরে। ছবিগুলো হারিয়ে গেল। এরমানে আবার তাকে দু’ বছর আগের তোলা ছবি থেকে কয়েক কপি উঠাতে হবে। এই ছবি জিনিসটা নিতান্তই একটা বিরক্তিকর ব্যাপার বলে মনে হয় প্রভার কাছে। প্রভা তাওহীদের দিকে তাকাল। ছবি যেহেতু নেই তাহলে বলার মত কিছু পেল না। অবশ্য বলবেই বা কী! ছেলেটা কাগজ দিয়েছে, সে ধন্যবাদ জানিয়েছে। এইতো… আর কী? প্রভার মনে হলো আগের ধন্যবাদটা ভালো শুনায়নি। এতোটা রূঢ়ভাবে ধন্যবাদ হয়না, গালি হয়ে যায়। তাই সে যদি আবার তাওহীদকে ধন্যবাদ না দেয় তবে তার স্বস্তি মিলবে না। আগামী একমাস যাবত মন বলবে, সুন্দর কণ্ঠে ধন্যবাদটা দেওয়া উচিত ছিল। এই অনুভূতিটা আবার ভীষণ অসহ্যকর। তাই সে ভবিষ্যতের অসহ্যকর, অসহায় অনুভূতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আবারো বলল,

– আচ্ছা। না থাকলে তো কিছু করার নেই। তাছাড়া আপনি আমার উপকার করেছেন। একারণে আবারো আপনাকে থ্যাংক য়্যু।

বলেই প্রভা সময় নষ্ট করল না। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। তার পায়ের প্রতিটি ধাপের সাথে সমানুপাতিক হারে বেড়ে গেল দূরত্ব। এই দ্বিপ্রহরে কেবল একা পড়ে রইল তাওহীদ। উত্তপ্ত আগুন রঙা অরুণে একাই স্নান করতে লাগল সে। সূর্য স্নানে দাঁড়িয়ে প্রভার আকার নিশ্চিহ্ন হতে দেখে তাওহীদ শার্টের বুক পকেট থেকে ছোট একটা খাম বের করল। খামের ভেতর দুটো একই মুখ। সুপ্রভার মুখ। হঠাৎ করেই সুপ্রভার মুখচ্ছবি দেখে তাওহীদ নিজের বুকে বেজায় জোড়ে একটা ধাক্কা অনুভব করল। ইশ! ধাক্কাটা কী ভীষণ ভারী! তার চেয়েও ভীষণ ভারী অরুণ আলোয় রাঙা সুপ্রভার মুখ।
_______

চলবে।