অকিঞ্চন পর্ব-০৪

0
153

গল্পের নাম – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – চার (এক ঠোঙা যত্ন)
_____

আলস্যের সুবাসে ভরপুর সন্ধ্যা। চারদিকে কেমন ঝিমধরা ভাব। দিনের এই ভাগে অধিকাংশ বাসার সদস্যরা নিজেদের মত করে কাজে ব্যস্ত থাকে বলেই সম্ভবত সময়টাকে আরোও বেশি অনর্থক, অপ্রিয় বলে বোধ হয়। গতিহীন ঠেকে। মনে হয় যেন, সময় চলছেনা; থেমে আছে গোঁ ধরে। প্রভা ঘরে ঢুকে এমনই এক বিশ্রী সন্ধ্যার সম্মুখীন হলো। প্রভা চোখের পলক ফেলে আরোও অনুভব করল, তার ধারণা অনুযায়ী প্রতিটা সন্ধ্যাই বিশ্রী, তবে আজকের সন্ধ্যেটা অন্যদিনের তুলনায় অধিক বিশ্রী এবং গুমোট। সন্ধ্যে সম্পর্কে এমন কদার্য, হীন ধারণা করার পরেও এই সন্ধ্যাটাকেই প্রভা ভীষণ পছন্দ করে। ব্যাপারটা এমন, সে জানে সন্ধ্যে সুন্দর নয়, অথচ তার মন-প্রাণ অনুভব করে সন্ধ্যেই সুন্দর। সন্ধ্যেই বড্ড আপন।
প্রভা সন্ধ্যাবেলা পছন্দ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ কখনো খুঁজে পায়নি। তবে যে কারণে সে পছন্দ করে সে কারণটা নিছকই আশ্চর্যের। সন্ধ্যাবেলায় প্রভা চারদিক থেকে আশ্চর্য রকমের একটা গন্ধ পায়। এক অদ্ভুত ধরনের পর পর গন্ধ। যে গন্ধ সকল মানুষকে শুধু দূরের বলে পরিচয় করায়। সবার গায়ে ফেলে দেয় ‘পর’ নামক আস্তরণ। আবার মাঝে মাঝে গন্ধটাকে একলা থাকার গন্ধ বলেও অনুভব হয়। এই পর পর গন্ধ যখন প্রভার চারদিক জুড়ে বিরাজ করে তখন প্রভা এই পর পর গন্ধে খুঁজে নেয় নিজের বড্ড আপন আমিকে। চারদিকের এতো মানুষের মাঝে কেবল নিজেকেই নিজের কাছের বলে মনে হয়, আপন বলে মনে হয়। প্রভা তখন সযত্নে নিজের মাথায় নিজেই আদুরে হাত বুলোয়। এই সন্ধ্যেতেই প্রভা কেবল নিজেকে একটু ভালোবাসে, যত্ন করে, আদর করে। ইশ! কী অদ্ভুত! কী অহেতুক কার্যকলাপ!
প্রভা তার অপ্রিয় হয়েও প্রিয় সন্ধ্যার আপন-পরের অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত আলোচনার মাঝেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিল। সাথে নাকে বাড়ি খেল বদ্ধ রুমের গন্ধ। পুরো ঘর জুড়ে বইছে ভ্যাপসা গন্ধ। দুপুর বেলা দরজা-জানালা আটকানো হয়েছিল। এখনো খোলা হয়নি বিধায় ঘরের গুমোট ভাবটা ঘরেই আটকে আছে। দরজা-জানালা খোলা প্রয়োজন। প্রভা এগিয়ে গিয়ে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে, কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতে গিয়ে অনুভব করল তার হাতের মুষ্টিতে আটকে পড়ে থাকা বস্তুটিকে। প্রভা এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপরিতলে নিজের হাতের মুষ্টিকে মুক্ত করে দিল। মুষ্টিবদ্ধ আঙুল মুষ্টিমুক্ত হতেই টেবিলের উপরে দেখা গেল কাগজের একটি সাধারণ ঠোঙা; যার সর্বাংশ অধিক বল প্রয়োগ করে মুষ্টিবদ্ধ করার দরুন কুঁচকে গিয়ে করুণ অবস্থা। প্রভা নিশ্চল চোখে একবার বাদামের ঠোঙা দেখে, এরপর নিজের মেলে রাখা হাতের দিকে তাকাল। হাতটাকে ভেজা দেখাচ্ছে। প্রভা নিজের ঘামে অর্ধভেজা হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে নিল। ভাবল, এই সাধারণ একটা বাদামের প্যাকেটকে এত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরার কোনো কারণই তার ছিলনা।
_____

টেবিলের ওপর মাথা ফেলে বসে আছে প্রভা। আশে পাশে বই ছড়ানো। কাল একসাথে দুটো এক্সাম। অথচ সে এতোদিন যাবত বই ধরেও দেখেনি। পরীক্ষার ডেট শুনে বই কিনেছে গত সপ্তাহে। এখন তার পড়া উচিত, অথচ পড়তে পারছেনা। বইয়ের দিকে তাকালেই মাথাতে কেবল দুটো শব্দ’ই আসে। তা হলো – এসব কী? তখন ওবা/য়দুল কাদের এর মতো বলতে ইচ্ছে হয়, আরে এরা কারা! কোথথেকে এলো এরা! তবে প্রভা তা বলতে পারে না।

নিজের প্রতি একটু মায়া হওয়ায় মাথা উঠিয়ে বসতে চাইল প্রভা। তার পড়া দরকার। পড়ার আগে এক কাপ কড়া চা দরকার। তবে চা বানাতে গেলে তাকে বাহিরে যেতে হবে। বাহিরে নিচ তলার আন্টি বসা। তার সামনে দিয়ে যাওয়া মানেই এটাসেটা প্রশ্ন করবে আর প্রভাকে উত্তর দিতে হবে। মানুষ শব্দটিই এক প্রকারের আতংক প্রভার জন্য। সে মানুষের সাথে মিশতে পারে না, আবার কেউ তার সাথে অযথা কথা বললেও তার ভালো লাগে না। উলটো তার লক্ষ্যই থাকে মানুষ যেন তার সাথে কথা না বলে। যখন কেউ তার সাথে কথা না বলে, তখন অন্যরকম স্বস্তি-সুখে ভরে ওঠে তার চারপাশ। সে হয়তো ভীষণ রূঢ়। তবে কিছু করার নেই। নিজের কমফোর্টজোনের বাহিরে গিয়ে সে মানুষদের সাথে মিশতে পারে না; মিশতে চায় না। সে চেষ্টা কখনো করাও হয়না। কী হবে এক জীবনে এতো অবাঞ্ছিত মানুষের স্থান রেখে! প্রভা শ্বাস ফেলে দরজার দিকে তাকায়। রুমে বসেও সে তার মা এবং নিচ তলার মহিলার সকল কথোপকথনই শুনতে পাচ্ছে। বর্তমানে মহিলাটি তার বাচ্চাদের পেছনে ব্যয় করা কষ্ট নিয়ে বিলাপ করছেন। ভীষণ দুঃখী, আত্মত্যাগী কণ্ঠে বলে চলেছেন,

– কক্ষনো আমি আমার সন্তানগো হাতে মোবাইল দেই নাই, ভাবি। দিসি তাও ক্লাস টেনে এ প্লাস পাওয়ার পড়ে। বড় হইসে ফোন-টোন লাগেই। এই জন্যে দিসি। দিসি তাও চোখে চোখে রাখসি। ফোন চেক কইরা দেখসি যে কোনো ছেলের সাথে আবার কথা বলে কি না। বাসায় আসলে ব্যাগ দেখসি। আল্লাহর রহমতে আমার দুই মেয়ে সোনার মেয়ে। এখন পর্যন্ত কোনো ছেলেদের সাথে চলাফেরা নাই। এই সময়ে এমন মেয়ে আপনি আর কই দেখসেন বলেন? আমার মেয়ে রান্নাবান্না, ঘর গুছানো, পড়ালেখা, মানুষের সাথে কথা বলা সবদিক থিকা এক্কেবারে দশে দশ। এই যে আমার মেয়ে ইডেন এ চান্স পাইসে – এইটা কী কম বড় কথা! আমার মেয়ে ঘরের কাজ-বাজ কইরাও এতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে চান্স পাইসে এইটা মা হইয়া আমার জন্য কতো যে সুখের! সন্তানদের সফলতাই তো মা-বাবার সফলতা। ইডেনে যে চান্স হইসে তাও সেই সকালবেলা উইঠা পড়াশুনা করে তারপর রওনা হয়। যাইতেও সময় লাগে। ইডেন তো পুরান ঢাকায়। উম..প্রভার ভার্সিটি জানি কই? ও কোন সাবজেক্ট নিয়া পড়তাসে? কিছুই তো জানা হয় নাই।

প্রভা নিস্তেজ অনুভূতির সাথে ভদ্রমহিলার সকল কথা শুনতে পেল। তার মেয়ে ইডেনে চান্স পেয়েছে – এটা নতুন কোনো কথা নয়। দু’মাস আগেই জানা গেছে যে, চান্স হয়েছে। তার মেয়ের চান্স পাওয়া প্রভার জন্যে কোনোপ্রকার দুঃসংবাদ নয়। বরং সাধারণ এক মেয়ে হিসেবে সে অন্যের ভালোতে খুশিই হয়। সাধারণত সবাই হবে। তবে সেই মেয়ের মা অর্থাৎ এই ভদ্রমহিলার খুশি এতোটাই হয়তো বেশি যে সে দু’দিন পর পর যদি আসে, তবে শত আলাপের মধ্যেও এই আলাপ করতে ভুলেন না। ঠিক যেমন আজ করলেন। এরপরের আলাপের ধারাবাহিকতাও কিছুটা প্রভার জানা। তবুও সে উৎসুক হয়ে রয় বাকি আলাপচারিতা শোনার আশায়।

– প্রভা হলো সমাজবিজ্ঞান নিয়া পড়তেসে, ভাবি। বুঝেনই তো এস.এস.সি, এইচ.এস.সি তে এ প্লাস আসে নাই। আমার মেয়ের ব্রেন আবার অতোটা ভালো না। ছোটবেলায় ভালো ছিল। ক্লাস ওয়ান থেকে এইটে তো এক থেকে দশের মধ্যে রোল ছিল। স্কুলের সবাই ভালো জানতো। মেডাম’রা আদর করতো। বড় হওয়ার পরে যে ঢিলামি দিল, তাই দেখে শুনে সোজা সাবজেক্ট দিসি। এখন একটা নিয়া পড়তে থাকুক, বিয়া কইরা সংসার করবে… আর কী! মেয়েদের আবার এতো পড়া ভালো না। মেয়েদের সংসারেই মানায়।

প্রভার মা নিজ কণ্ঠে আলাদা এক শক্তি নিয়ে নিজের কথা শেষ করলেন। সে প্রমাণ করতে চাইলেন সে’ই সঠিক। মেয়েদের সংসারেই মানায়; পড়ালেখায় নয়। কে জানে যদি তার মেয়ে প্রভা ভালো কোনো বিষয় নিয়ে পড়তো, তাহলে তখনো তার মতবাদ একই থাকত কি-না! প্রভার মায়ের আত্মকেন্দ্রিক বাক্যের বিপরীতে ভদ্রমহিলাটি সগর্বে উত্তর দিল,
– এখনকার মেয়েদের সংসার, পড়াশোনা সবই ব্যালেন্স কইরা চলতে হয়। নয়তো টেকা যায়না। আর তাছাড়া পড়াশুনা খারাপ বিষয় না। নিজের প্রতি নিজের শক্তি থাকে। আমার মেয়ের ব্রেন আবার ছোট থেকেই ভালো আলহামদুলিল্লাহ, মাশা-আল্লাহ। ইকোনোমিকস নিয়ে পড়তেসে। ইকোনোমিক্স ভালোও! বিদেশেও যাওয়া যায় এই বিষয় নিয়া। এখন পড়তে থাকুক দেখি কতোদূর পারে!

প্রভা আলাপের সবটাই শুনলো। তার কানে তার মায়ের হতাশায় ডুবো কণ্ঠ, একপাক্ষিক জেদ, ভদ্রমহিলার গর্বিত কণ্ঠ কিছুই বাদ পড়লো না। প্রভা ভীষণ অবহেলায় তার মাথা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে ভাবতে শুরু করল। ছোটবেলা থেকে সাইন্স, জটিল জটিল সমস্যা কিছুতেই কোনোপ্রকার আগ্রহ তার ছিল না। বায়োলজির এতো এতো খুঁটিনাটি বিষয়, কেমিস্ট্রির বিক্রিয়া কিছুই তার শেখার আগ্রহটুকু হতো না। তার আগ্রহ ছিল আর্ট, বই পড়া, নাটক, উপস্থাপন, খেলাধুলাজনিত ব্যাপারে। তার আগ্রহ ছিল দেশ, সমাজ, ইতিহাসজনিত ব্যাপারে। তার ইচ্ছে করতো ইতিহাস, সভ্যতা, বাংলা জানতে, পড়তে। তার ইচ্ছে করতো উপন্যাস পড়তে, কবিতা লিখতে। তার ইচ্ছে হতো পড়ার মাধ্যমে জীবনটাকে একটু উপভোগ করতে। নিজের শখকে নিজের পেশাতে রূপান্তর করতে। কিন্তু তাকে দেওয়া হলো সাইন্স। এরপর অনাগ্রহ, অনিচ্ছায় হাজার চেষ্টার পরেও যখন সেখানে এ প্লাস এলো না তবুও নিষ্কৃতি মিলল না। আবারো ইন্টারে তাকে দেওয়া হলো সাইন্স। সাইন্স নিতেই হবে। হবে মানে হবে। সাইন্স না নিলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে কেমন করে? ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হলে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়না। ভবিষ্যৎ একদম সেটেল। এই পেশায় শুধু টাকা আর টাকা। বিশমিনিট রোগী দেখলেই এক/দুই হাজার টাকা। এর থেকে ভালো পেশা আর কী হতে পারে? কিন্তু সেখানে প্রভা ভীষণ সুন্দরভাবে ব্যর্থ হলো। মা-বাবার স্বপ্ন যখন ইন্টারেও পূরণ হলো না, যখন এ প্লাস এলো না, তখন তারা ক্ষোভের বশে আর প্রভাকে কোনো এডমিশন কোচিং’ই করালেন না। কী হবে করিয়ে? জেদের বশে বলে দিলেন যে, কোনো কোচিং এর টাকা তারা দিতে পারবেন না। দিলেনও না। প্রভা নিজ উদ্যোগে কিছু প্রস্তুতি নিয়ে দু’একটা কলেজে বি-ইউনিটে পরীক্ষা দিলেও বিশেষ কোনো লাভ হলোনা। পরে তার বাবা-মা কী ভেবেই যেন ভর্তি করিয়ে দিলেন ন্যাশনালে। মার্ক্স অনুযায়ী যা সাবজেক্ট এলো সেখান থেকে সমাজবিজ্ঞান নেওয়াকেই বেশি প্রাধান্য দিল প্রভা।
প্রভা ম্লান হাসে। সারাজীবন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে, তার সিদ্ধান্তের কোনো গুরুত্ব না দিয়ে যখন সাবজেক্ট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো – ব্যাপারটিকে নিছকই কোনো হাস্যকর ঘটনা বলে মনে হয় প্রভার কাছে। ঘটনাটি যখনই মনে পড়ে, প্রভা ভীষণ সুন্দর করে হাসে। মন ভরে হাসে। প্রভা মাথা এলানো অবস্থাতেই চোখ খুলে, ঘাড় বাঁকিয়ে দরজার দিকে তাকায়। মস্তিষ্কের এক পাশে বাজে তার মায়ের হতাশায় ভরপুর কণ্ঠ; যে কণ্ঠ দিয়ে ভদ্রমহিলার সামনে তার মা তাকে যথাসম্ভব ছোট করেছে, অপমান করেছে। আর অন্যদিকে বাজে, মহিলার গর্বিত কণ্ঠ। প্রভা ম্লান দৃষ্টি মেলে ভাবে, তাকে যদি ইন্টারেই আর্টস দেওয়া হতো তবে সেও নিশ্চয় ভালো করতো। সেও নিশ্চয় ইকোনোমিক্স এর মতো, ইংরেজির মতো, বাংলার মতো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মতো ভালো কোনো বিষয় পেতো! এই মূহুর্তে প্রভার মনে হলো, ভদ্রমহিলার এইসব কথা বলা, গল্প করা, গর্ব করা কোনো খারাপ কথা নয়। বরং ভালো কথা। সে তার মেয়ের মর্জি মতো তাকে ইন্টারে আর্টস বিভাগে দিয়েছে, তার মেয়েকে নিজ ইচ্ছায় বাঁচার একটি সুযোগ দিয়েছে। এখন যখন তার মেয়ে সেখানে সফল হয়েছে, তাহলে একটু গল্প তো করাই যায়। প্রভা ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেলল। এই ভদ্রমহিলার প্রতি এতোদিন যাবত যা একটু বিতৃষ্ণা এসেছিল, তা হঠাৎ করেই মুছে গেল। তার জন্য বুকের সবখানি সম্মানে পরিপূর্ণ হলো। মনে হলো, যে মা সুযোগ দিয়েছে, সে মা একটু গল্প করতেই পারে; এতে হয়তো দোষের কিছু নেই।

বুক ভর্তি অজানা আক্ষেপ নিয়ে সোজা হয়ে বসতেই প্রভার চোখ পড়ল সাধারণ এক ঠোঙার দিকে। বিকেলের তাওহীদ আলমের দেওয়া সেই ঠোঙা। চারদিকে এতো তীব্র হার-জিত, অহংকার-পতনের অসহ্যকর গন্ধে ওই সাধারণ একটি ঠোঙাকেই ভীষণ বিশেষ কিছু মনে হলো। এতো এতো অযত্নের ভীড়ে এই সামান্য যত্নটুকুই প্রভার সামনে পাহাড়সমান হয়ে দাঁড়াল। মনে হলো যেন, টেবিলের ওপর এক ঠোঙা বাদাম নয়, এক ঠোঙা যত্ন রাখা। যেই যত্ন কেবল আর কেবল প্রভার। কেউ একজন প্রভার কথা ভেবে,
তাকে বাছ-বিচার না করে, তার থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করে তাকে যত্ন উপহার দিয়েছে ভেবেই প্রভার বুকের ভেতরকার শিলায় ফাটল ধরে এলো। প্রভা হাত বাড়িয়ে ঠোঙা খুলে বাদামের দিকে তাকাল। বাদাম তার কোনোকালেই পছন্দের খাবার নয়। চানাচুরের বাদাম তো নয়ই, সাধারণ বাদামও নয়। তবুও, কে জানে কোন কারণে প্রভা ভীষণ শখ করে, ভীষণ ভালোবেসে দুটো বাদাম মুখে দিল। ওর হৃদয় থেকে মনে হলো, বাদামগুলো খেলে হয়তো ওর মন ভালো হয়ে যাবে। এই বিতৃষ্ণাময় মূহুর্ত থেকে রক্ষা পাবে। বাদামগুলো পুতিয়ে গেছে। তবে খেতে ভালো লাগছে। তার জন্যে কেউ যত্ন উপহার দিয়েছে এই মূখ্য বিষয়। কে উপহার দিয়েছে – তা হয়তো নয়।
_____

– জানোস তাওহীদ, আজকা মাঠে এক পোলারে দেখলাম বইসা বইসা বাদাম ছুলতাসে। আবার অনেকক্ষণ পরে দেখি যে এক মাইয়ার লগে কথাও কয়। পিছন থিকা না এক্কেবারে তোর মতো লাগতেসিল। কিন্তু আমি একবারো তোরে মনে করি নাই। কারণ আমি তো জানি আমাগো তাওহীদ মাইয়া মানুষ থিকা একশো হাত দূরত্ব রাইখা চলে। ওই পোলাডারে তুই মনে না কইরা কামডা ভালো করসিনা?

হাসানের এমন কথায় তাওহীদ হাতের হিসাব রেখে পূর্ণচোখে চাইল। হাসান ভীষণরকমের গুরুগম্ভীর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। হাসানের এমন মুখভঙ্গিতে তাওহীদের মনে হলো, তার সামনে থাকা গুরুগম্ভীর মুখের নকশার বাঁকে বাঁকে কেউ যেন রসিকতার রঙ তুলিতে মেখে জায়গায় জায়গায় লেপ্টে দিয়েছে। হাসানের দিকে চেয়ে তাওহীদ এক বুক হতাশার শ্বাস ছাড়ে। হাসান যে তাকে দেখেছে এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছে, তা আর তাকে সুস্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন পড়বে না। অন্যদিকে তাওহীদের দিক থেকে কোনোপ্রকার কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে হাসানের ভেতরকার উৎসুক পোঁকার ঝাঁক কিলবিল করতে করতে তাওহীদকে ফের তাড়া দেয়,

– কিরে! কিছু কস না ক্যা?

– আমি আর কী বলুমু, ভাই? আপনি তো সব বললেনই। বিকালে এক ছেলেরে দেখসেন, আমার মতো লাগসে কিন্তু আপনের আমার উপর থাকা অগাধ বিশ্বাস এর জন্য আপনে আমারে মনে করেন নাই। এইটা তো আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের কথা। আপনে আমার বিশ্বাস করসেন এইজন্যে আপনারে ধন্যবাদ, হাসান ভাই।

নিজের করা অসরল প্রশ্নের উত্তরে একইভাবে অসরল উত্তর পেয়ে আক্রোশে পূর্ণ হলো হাসান। এইবার আর এদিক-ওদিক বক্ররেখায় না চলে সরলরেখায় প্রশ্ন ছুঁড়ল। শুকনো, গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,
– ওই মাইয়া ওইখানে গেল কেমনে? কী করতাসিলি দুইজনে?

– ওনার নাম, সুপ্র….প্রভা।

– ওইলো একটা। এখন ক তোর লগে কী কথা বলতেসিল? পইটা গেসে নাকি? প্রেম করতাসিলি দুইজনে? পটলো কেমনে? কাহিনী তো আগে কস নাই। নাকি আমার থিকা লুকাইতে চাইতেসোস? আমি তোর ভাই লাগি। আমার থিকা লুকাবি কীসের জন্যে? এইটা কেমন কথা, তাওহীদ! উলটা তোর উচিত আছিল আমার কাছে আইসা নাচতে নাচতে গল্প করা। বেকুবের বেকুব!

হাসান একের পর এক বাক্য ছুঁড়ে; কখনো উজ্জ্বল চোখে প্রশ্নে করে, কখনো নিভু চোখে সন্দেহ ছুঁড়ে কখনোবা তাওহীদের কাজে হতাশায় ডুবে গিয়ে নিজের কথার সমাপ্তি ঘটিয়ে শান্ত হলো। হাসানের এমন উত্তেজনায় তাওহীদ নিশ্চল দৃষ্টি মেলে চেয়ে নির্মলভাবে হেসে ফেলে। হাসান ভাই অস্থির প্রকৃতির মানুষ। স্থিরতা তার রক্তে নেই। একারণেই বোধহয় তাদের একসাথে দেখে প্রেমকাব্য লিখে ফেলেছে। প্রথম দিকে হাসান ভাইয়ের কাজকর্মে তাওহীদের ভীষণ রাগ হতো, সহ্য করতে না পেরে বিতৃষ্ণায় শরীর ভাড় হতো। মাঝেমধ্যে আবার বিরক্তিতে শরীর রি রি করতো। তবে এখন কেবল হাসি পায় আর ভীষণ মায়া হয়। আগে হাসান ভাইয়ের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাওহীদ অবগত ছিল না। যখন হলো, তখন কেবল তার ব্যক্তিত্বে মনে হয়, কী সুন্দর, কী স্বচ্ছ! হাসান ভাইয়ের অসন্তুষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে তাওহীদ তার সকল ভাবনা পাশে ফেলে বলল,

– আমারে প্রেম করতে না, হুমকি দিতে ডাকসিল, হাসান ভাই।

তাওহীদের সহাস্যপূর্ণ কণ্ঠে হাসান জড়ানো দৃষ্টিতে চাইল। তাওহীদ সেই দৃষ্টির উত্তরে বলল,
– আমি যে তার দিকে তাকাই সেইটা সে জানে। আবার বারান্দায় তাকাই সেইটাও লক্ষ্য করসে। তাই আমারে ডাইকা নিয়া বলসে যাতে এমন আর না করি।

হাসান তার অস্থিতিশীল প্রকৃতির সাথে ভীষণ রকমের রক্তগরম একজন মানুষ। একারণেই তাওহীদের সামান্য কথায় ক্ষেপে গিয়ে তেড়ে উঠল,
– আল্লাহ তোরে বানাইসে। বানানোর সময়ে আল্লাহর মনে হইসে যে সে তার এই বান্দারে দুইডা চোখ দিব। সেই হিসাবে আল্লাহ তোরে ভালোবাইসা দুইডা ভালো পাওয়াফুল চোখ দিসে। এখন সেই চোখটা তোর। তবে চোখের মালিক আল্লাহ। তবে দুনিয়াতে চোখের সাময়িক মালিক তুই। এখন তুই তোর চোখ দিয়া কারে দেখবি না দেখবি সেইডা কী তোর প্রভাতে ঠিক করব? তুই একবার ক্যানো, একশোবার তাকাবি।

কিছুক্ষণের গর্জনেই হাসান বেশ হাঁপিয়ে উঠল। তাওহীদ সরল মুখে তার প্রভাকে নিজ স্থানে সঠিক প্রমাণ করতে বলল,
– আপনি হুদাইকামে রাগ করতেসেন, ভাই। একজন বেডামানুষ একটা মাইয়ার দিকে অযথা তাকাই থাকে এইটা কী ভালো বিষয় – বলেন? আমার তাকাই থাকাটা তো উচিত না; যতোই মন চাক। আমারই তো একজন আরেকজনের দিকে অযথা তাকাই থাকলে অস্বস্তি হবে। সেইখানে উনি একটা মেয়ে মানুষ। ব্যাপারটা বুজতেসেন না!

তাওহীদের বলার এই পর্যায়ে হাসানের মুখ থেকে রাগের আবরণ সরে গিয়ে মুখ গুরুগম্ভীর আকার ধারণ করল। বিজ্ঞ কণ্ঠে বলল,
– কথাডা ভুল বলোস নাই। আসলেই তো, ওয় তো…

তাওহীদ নিস্তেজ মুখে শুধরে দিল,
– উনার নাম প্রভা।

তাওহীদের শুধরে দেওয়াতে হাসান ভীষণ অবলীলায় তার ভুল ঠিক করে, আগের মতোই গম্ভীর, বিজ্ঞ স্বরে এতোক্ষণ যা প্রলাপ বকছিল তার একদম বিপরীতে চলে যায়। তাওহীদ যেন কোনো শিশু! সেই শিশুকে হাসান বুঝ দিতে বলে,
– ওয় একটা হইলোই। প্রভা। প্রভা একটা মাইয়া মানুষ তো। এই কারণে মনে হয় ব্যাপারটায় ও বেশি কষ্ট পাইসে। তুই কিছু মনে করিস না।

বলেই হাসান চুপ করে কোনো এক ভাবনার ভুবন থেকে থেকে ঘুরে এলো। এরপর আবারো তাওহীদের দিকে তাকিয়ে, ভীষণ নরম কণ্ঠে পরামর্শ দিতে লাগল,
– তাওহীদ, আসলেই তোর এতোদিন কামডা করা ঠিক হয়নাই। মাইয়া মানুষ তো। মাইয়াগো দশ ইন্দ্রিয় থাকে। কে তাকায়, কে প্রেমে পড়ে সব বুঝে ওরা। শোন ভাই, আর তাকাইস না। তাকাইলে তোরে খারাপ কইবো। এর থেকে তুই ভালো একটা চাকরি খুঁজ বা ব্যাবসা কইরা একটা পজিশনে আয়। আমি নিজে তোর জন্যে প্রস্তাব নিয়া যামু। আমি প্রস্তাব নিয়া গেলে হইবো না?

তাওহীদ আশ্চর্য হয়ে হাসানের সরল কথা শুনে। একবার বলতে ইচ্ছে করে, ‘বিয়ে-টিয়ে নিয়ে এইসব কী শুরু করসেন, হাসান ভাই? আপনি কী ধরেই নিসেন যে আমাদের বিয়ে হবে?’ কিন্তু তাওহীদ তার কিছুই বলে না। উলটো হাসানের করা প্রশ্নে মাথা কাঁত করে জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– খুব হবে।

তাওহীদের শিশুসুলভ মান্যতা দেখে হাসান মুখ ভরে হাসে। চৌকিতে আরাম করে শুয়ে পড়ে জিগ্যেস করে,
– এমনিতে তোরা কী কইলি? মাইয়াডা কী বেশি বকসে তোরে?

বকার কথা শুনে হেসে ফেলে তাওহীদ। বলে,
– তেমন কিছুই না। খালি বলসে আমারে একটু সংযত হইয়া চলতে।

তাওহীদের উত্তরে হাসান ভীষণ রকমের উচ্ছ্বাস নিয়ে অভিজ্ঞ কণ্ঠে বলে,
– আরে, প্রেমের শুরুতে মাইয়ারা এমন একটু-আধটু ভাব নেয়’ই। এখন বলতেসে সংযত হইয়া চলতে, দুইদিন পরে বলবে অসংযত হইয়া চলতে। আর তাছাড়া তুই যাই কস না কেন, তোরে এইভাবে বলাডা ঠিক হয় নাই। মাইয়ারা না বুঝে কে তার দিকে কেমন কইরা তাকাইলো, তাইলে তোর তাকানোডা বুঝল না কীসের জন্যে? তুই তো আর রাস্তার পোলাগো মতো তাকাস নাই।

প্রথমে উচ্ছ্বাস নিয়ে শুরু করলেও শেষের দিকে হতাশায় ডুবে গেল হাসানের কণ্ঠ। হাসানের এমন প্রশ্নে তাওহীদ বলার মতো কিছু পেল না। সেই মূহুর্তেই হাসান আবার ভীষণ রকমের গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– তাওহীদ, একটা কথা কই। কিছু মনে নিস না। তুই একটা বেকুব, তুই পছন্দও করছোস এক বেকুবরে। আল্লা ঠিকই কইসে। যে যেমন, তার জীবনসঙ্গী তেমনই হইবো। এখন খালি দোয়া করি তগো বাচ্চাকাচ্চা যেন বেকুব না হয়।

নিজের মতো কথা শেষ করে বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস নেয় হাসান। সেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে দুই হাত দিয়ে মোনাজাতের মতো মুখ মুছে আওড়ায়, আমিন।

হাসানের এমন অতিরঞ্জিত চিন্তায় হঠাৎ করেই মনটা রঙিন হয়ে ওঠে তাওহীদের। এক মূহুর্তে মনে হয়, সুপ্রভা নামক রমণীকে পাওয়া বোধহয় তেমন কঠিন কিছু হবে না। একবার চোখে ভাসে, তাদের রঙিন ছোট্ট ছাউনির সংসার। তাওহীদ হাসে। ভীষণ যত্ন নিয়ে তার খটখটে, মসীবর্ণ বুকের অন্তরে রঙিন স্বপ্নের বীজ বপণ করে। বুকভরা নতুন রঙের খুশি নিয়ে উঠে গিয়ে যখন কৃত্রিম আলোর পথ বন্ধ করে দেয়, তখন রাস্তার পাশের সোডিয়ামের ঝাপসা ঝাপসা আলোয় আলোকিত হয় ঘরের এক-তৃতীয়াংশ। তাওহীদ নীরব হেঁটে এগোয় জানালার ধারে। সুপ্রভার বারান্দা খালি। বারান্দার দরজা, বারান্দা দিয়ে দেখা যাওয়া ঘরের জানালা সবই বন্ধ। তাওহীদ যখন সুপ্রভার ভাবনায় বিভোর, ঠিক সেই মূহুর্তে মস্তিষ্কে, কানে বেজে উঠল সুপ্রভার করা কর্কশ প্রশ্ন,
– আপনি সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কেন? আমাকে দেখেন কেন?

মস্তিষ্কের ভেতরের সদ্য শোনা কর্কশ প্রশ্ন তাওহীদ এর কানে অভিমানী প্রেমিকার কণ্ঠ হয়ে বাজে। তাওহীদ হাসে। ভীষণ সুন্দর করে হেসে বলে,
– প্রভা! আপনি তো আর জানেন না, আপনারে ছাড়া এই ভুবনে আমার আর কিছু দেখার নাই বইলাই শুধু আপনারে দেখি। যদি জানতেম এই প্রশ্ন তাইলে করতেন না। আপনিতো জানেন না। আপনি দেখি কিছুই জানেন না।

চলবে_
______
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান