গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – সাত
_____
লোহার সিঁড়িতে বসে এক সুগন্ধিময় বিকেল উপভোগ করছে তাওহীদ। চারদিকের নরম আলো পৃথিবীকে কী ভীষণ সুন্দর করেই না জড়িয়ে আছে! দেখতে আরাম লাগছে। বাংলায় সম্ভবত ফাল্গুন মাস চলে। এই ফাগুনের হাওয়াতেই তো এক স্মৃতি স্মৃতি সুবাস ভাসে যা অন্য ঋতুতে মেলা বেশ ভাড়। স্মৃতির সুবাসে মত্ত হয়ে তাওহীদ ডুব দিল তার রঙধনুর মতো সাধারণ-সুন্দর অতীতে। এক বছর, দু’বছর না; বেশ অনেক বছর পেছনে গিয়ে তাওহীদ চলে গেল নিজের শৈশবের অধ্যায়ে। যেখানে তাওহীদ একটা হাফ প্যান্ট আর ভীষণ সাধারণ, সুতির এক শার্ট পড়ে স্কুলে রওনা হতো, বন্ধুদের সাথে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরত। হাসি-ঠাট্টা কখনো গিয়ে ঠেকত মারামারিতে। কখনোবা মাঠে খেলাধুলা করতে গিয়ে মাঠেই মাগরিবের আজান শুনে স্তব্ধ হতো সবাই। কী সাধারণ, কী সহজলভ্য জীবন ছিল তার। অথচ এমন আশ্চর্য মধুর দিনগুলো কতো অবহেলাতেই না কেটে গেল! তাওহীদ নিজের হাতে থাকা আড়াই হাজার টাকায় নিজের দৃষ্টি আটকে স্থির রইল। আজ সে তার জীবনের প্রথম রোজগার করেছে। আড়াই হাজার টাকা। শুনতে কম, তবে তাওহীদের জন্য এই টাকার মূল্য অপ্রতুল। সে ঢাকায় এসেছে থেকে গত পাঁচমাস যাবত দোকানে বসছে। শুরুর দুই’মাস তাকে কোনোপ্রকার বেতন না দেওয়ার হেতুস্বরূপ জানানো হয়েছে, প্রথম দু’মাস তার কাজের ধরন দেখে তাকে বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ, প্রথম দু’মাস ছিল তার দোকানে বসার হাতেখড়ি; এখানে কোনোপ্রকার কোনো টাকা সে পাবে না। পরের দু’মাসের কারণ হিসেবে অজুহাত দেওয়া হয়েছে, ব্যবসা পূর্বের তুলনায় খারাপ চলছে; বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। বেতন, টাকা নিয়ে বড়সড় কোনো আক্ষেপ অবশ্য তাওহীদের মাঝে লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। সে খুশি, সে যা পেয়েছে, যতোটুকু অর্জন করেছে তাতেই খুশি। তাওহীদ স্থিরতা নিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখটা থেকে থেকে চোখে ভেসে উঠছে। মন বলছে, রঙিন একটা শাড়ি কিনে চট করে রঙপুর চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সব কী এতোই সহজ!
তাওহীদ হাত থেকে নিজের দৃষ্টি আকাশপানে নিয়ে নিজের জীবন সমন্ধে ভাবতে বসল। তার জীবনে তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। গড়পড়তায় মানুষ যেমন জীবন নিয়ে জন্মায়, সেও তেমনি খুব সাধারণ একটি জীবন নিয়ে জন্মেছে। তাওহীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার মান চলনসই। আয়-রোজগার করে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো। তারা দু’ভাই এক বোন। তাওহীদের বড় ভাই গ্রামে কাপড়ের ব্যবসা করেন। ব্যবসার মান মধ্যম পর্যায়ে। কখনো বেশ ভালো চলে, কখনোবা চলেইনা। তাওহীদের ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে গত বছর; ঢাকায় আসার পরে তেমন খোঁজ-খবর নেওয়া হয়ে উঠেনি আর। বড় ভাই আর ছোট বোনের মধ্যে তাওহীদ। তাওহীদের স্বপ্ন ছিল সে পড়াশোনা করবে। অনেক পড়াশোনা করে বেশ বড় এক পর্যায়ে যাবে। তার স্বপ্নকে তেমন ভিত্তিহীনও বলা চলে না; সে ছাত্র হিসেবে ভালো। এস.এস.সি তে এ প্লাস সহ এইচ.এস.সি তে রেজাল্ট ফোর পয়েন্ট এর ঘরে। মানুষ নানান শখে নানান স্বপ্ন বুনে। তাওহীদের শখ, স্বপ্ন দুটোই ছিল পড়াশোনা কেন্দ্রিক। তাওহীদ চেয়েছিল একটু পড়তে, চেয়েছিল শহরে এসে নিজের পড়াশোনা সম্পন্ন করতে। তবে ভাগ্য বোধকরি অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। একারণেই তাওহীদ যখন অর্নাসের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে, তখন তার ভাবি তার বড় ভাইকে কিংবা বাবাকে খরচ চালানোর সকল দুয়ারে তালা বসিয়ে দেয়। তাওহীদের ভাই যেমন-তেমন, বাবাটা একটু মাথা-খারাপ ধরনের। সে এইসব পড়ালেখা, বড় বড় ডিগ্রী বোঝে না। তার মাথায় যখন ঢুকে গেল তাওহীদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, তখন সে বেশ কঠোরভাবেই তাওহীদকে সকলপ্রকার পয়সা-পাতি দেওয়ার ইস্তফা ঘোষণা করলেন। তাওহীদকে গুরুতর ভাবে জানানো হলো, সে পুরুষ হয়ে জন্মেছে আর যথেষ্ট বয়সও পার করে এসছে। এখন আর বাপ-ভাই এর ঘাড়ে বসে খাওয়ার দিন তার নেই।
তাওহীদ ছোটবেলা থেকেই শান্ত, সরল ধরনের ছেলে। যে যা বলে তাই বেশ খুশিমনে মেনে নেওয়ার সুন্দর গুণ নিয়ে জন্মেছে। তাই বুঝি এবারেও সকলের কথা মেনে নিয়ে নিজ গ্রামেই কাজ করার মাধ্যম খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভাগ্যের পরিহাসে সবকিছুতেই যখন তাওহীদ ব্যর্থ তখন গ্রামে থেকেই আড়াই বছর নিজ ক্ষেতে কৃষিকাজ করে। মাঝে বেশ কয়েকবার অন্য দেশে যাওয়ার জন্যেও তাকে উস্কে দেওয়া হয়; তবে তাওহীদ সেদিকে পা বাড়ায়নি। গ্রামেই নিজের মতো কাজ করতে চেয়েছে। তবে কাজ করেও সে যেন তার বাবার, ভাবীর জন্য বিশেষ বিরক্তিকর কেউ হয়ে উঠছিল। তাই তার বাবার দূরসম্পর্কের ভাই যখন তাকে ঢাকায় আসার প্রস্তাব দিল, তখন সে বেশ খুশিমনেই ঢাকায় পাড়ি জমাল। হয়তো একটু শান্তির আশায়, একটু সম্মানের আশায় কিংবা হয়তো একটু বেঁচে থাকার আশায়। এই সবকিছুর মাঝে তার মা থেকেও যেন কোথাও’ই সে নেই। তাওহীদ তার মায়ের কথা ভাবতে বসলে ভীষণ অসহায়, ক্লান্তি বোধ করে। ওর দুনিয়া সংকীর্ণ হয়ে আসে। সে কখনো কিছুতে তার মাকে দোষারোপ করতে পারে না, করতে চায় না। তার মায়ের কোমলপ্রাণের অসহায়ত্ব সম্পর্কে তার অজানা কিছুই নেই। তাদের পরিবারের ভীষণ উপেক্ষিত এক প্রাণ হলেন তাওহীদের মা; যার কোনো মত দেবার নেই, কোনো কথা বলবার নেই, কোনো কিছু পাবার নেই। হ্যাঁ, পাবার তালিকায় যা আছে তা হলো কেবল নিপীড়িত ভালোবাসা। তাওহীদের মাঝে মাঝেই বোধ হয়, তার মা আর জীবিত নেই। মারা গেছেন অনেক আগেই। কেবল প্রাণ আছে বলে সংসারের কাজে ফাঁকি দিতে পারছেন না। নয়তো একজন মানুষ এতো দৃঢ়ভাবে অনুভূতিহীন কেমন করে হয়! তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের হাতের দিকে চাইল। মায়ের সাথে কথা হয়না আঠারো দিন যাবত। মায়ের ফোন নেই। আব্বার ফোন থেকেই কল করতো সপ্তাহে দু’বার করে; তবে আব্বার ফোনটাও নাকি এখন আর কাজ করে না। গতবার ফোন করেছিল পাশের বাড়ির চাচির ফোন থেকে। এরপর আর কোনো খবর এসে পৌঁছুলো না।
তাওহীদ গলির শেষ মাথায় তাকাল ভীষণ অবহেলায় নিয়ে। হঠাৎ মনে হলো, সে খারাপ নেই। তার জীবন ততোটাও দুঃখের, কঠিন কোনো জীবন নয়। তার জীবন নিয়ে তার কোনোকালেই কোনো আক্ষেপ, হতাশা ছিল না; আজও নেই। এই দুনিয়াতে আরোও কতো মানুষ কতো তীব্র সীমাহীন যন্ত্রণায় দিন পার করছে, সেখানে তো সে বেশ আছে। হ্যাঁ, শখ-স্বপ্ন তার হয়তো ছিল। তবে পূরণ না হলে আর কী করার! এক জনম হয়তো সব স্বপ্ন পূরণের জন্যে যথেষ্ট না। থাকুক না কিছু অপূর্ণতা! কে জানে জীবনে এতো অপূর্ণতা থাকে বলেই হয়তো জীবন এতো মধুর, এতো সুন্দর হয়!
_____
সুপ্রভা নিজের ব্যাগ কাঁধে তুলে দেখতে পেল তার মা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। সুপ্রভা হাত-ঘড়িটা পরতে পরতে জানতে চাইল,
– কিছু বলবা?
– এই নে একশো টাকা। আসার সময় একটা ড্যানিশ নিয়ে আসিস মনে করে। দুধ শেষ। সন্ধ্যায় চা না খেলে ভালো লাগে না।
সুপ্রভা দ্বিধায় পড়ে বলল,
– আমি আনব?
– আরেহ! তোর বাবাকেই বলতাম। কিন্তু এইটুকুর জন্যেও যদি তার অপেক্ষায় থাকি কেমন লাগবে তার কাছে! এইটুকু তো কিনতেই পারিস। কিনলে কী হাত খুলে পড়বে নাকি। প্রয়োজন না হলে তো বলতাম না রে। এতো মুখচোরা হলে হয়!
সুপ্রভা কথা না বাড়িয়ে টাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অযথা বেশি বলা মানেই বিপদ। রেগে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করবে, সেই চিৎকার গিয়ে থামবে ওর পড়াশোনায়, ব্যক্তিত্বে। কী দরকার! অযথা প্রশ্নবিদ্ধ হতে আর ইচ্ছে হয় না। এমনিতেও একটা ড্যানিশ কিনলে, তাকে তো নিশ্চয় কেউ খেয়ে ফেলবে না।
সোনালী আলো বিলীন হয়ে সন্ধ্যা এসেছে পৃথিবীর বুকে। চারদিকের দোকান-পাট রাতের উজ্জ্বল তারার মতো মিটমিটিয়ে জ্বলছে। সুপ্রভা ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা অজ্ঞাতমনেই গিয়ে উঠল তাওহীদের দোকানে। সুপ্রভার লুকোনো ইচ্ছেটা পূরণ হলো না; আজ দোকানে মধ্যবয়সী দোকানি দাঁড়িয়ে। সম্ভবত তাওহীদেরই কোনো আত্মীয়। সুপ্রভা দোকানের মানুষ কমার আশায় দাঁড়িয়ে রইল। তার পাশে দু’জন ছোট ছেলে। সামনে একজন মহিলা; যে ডাল, সাবান-শ্যাম্পুর পলিথিন হাতে নিচে নেমে গেল। সামনে আরোও দু’ তিনজন মানুষ। প্রভা হতাশ হলো নিজের বোকামিতে। বিকেলে নিয়ে গেলে এতো ভীড়ের মাঝে পড়তে হতো না। সন্ধ্যা মানেই ভীড়। তাওহীদের চাচা সালাম সাহেব পেছনের মানুষদের দাঁড়ানো দেখে মৃদু জোড় গলায় জিগ্যেস করলেন,
– বাচ্চারা কি নিতে আসছো?
প্রভার পাশের দু’জন জানাল,
– চারটা টু-ইন-ওয়ান আইস্ক্রিম নিব।
সালাম সাহেব জবাব দিলেন,
– এইগুলা ওইপাশে। ওইপাশে যাও। এইপাশে সব মাসকাবারির জিনিস-পাতি। আপনে কী নিবেন?
সুপ্রভা জড়ানো গলায় উত্তর দিল,
– ড্যানিশ হ..লাগবে একটা।
– কষ্ট কইরা একটু ওইপাশে যাইয়া চান।
সুপ্রভা ওপাশে গিয়ে দেখল, দোকানে ঢুকে যে জন্য নিরাশ হয়েছিল, সে কারণটাই তার সামনে দাঁড়ানো। তাওহীদের দৃষ্টি সুপ্রভার দিকে পড়তেই তাওহীদের মসীবর্ণের মুখটা আলোকিত হলো। বাচ্চাদের আইস্ক্রিম দিয়ে সুপ্রভাকে হাসিমুখে প্রশ্ন করল,
– আমাকে বকতে আসছেন নাকি কিছু কেনার জন্যে আসছেন?
সুপ্রভা বলল,
– একটা ড্যানিশ দিন।
তাওহীদ কথা বাড়াল না। চারপাশে মানুষজন আছে। এখন কথা বলাটা দৃষ্টিকটু। তাওহীদ এগিয়ে গিয়ে ড্যানিশের কৌটা হাতে ফিরে এলো। ফিরে এসে অযথাই বলল,
– এই দোকানে আসার জন্যে ধন্যবাদ।
সুপ্রভা চোখ তুলে তাকিয়ে নামিয়ে নিল। সাবলীল কণ্ঠে জিগ্যেস করল,
– দাম একশো দশ টাকা না?
তাওহীদ বেশ সুন্দর করে মিথ্যা বলল,
– নাহ। একশো টাকা।
প্রভা বাড়তি কথা বলতে পারে না। এমন অবস্থাতে তো একেবারেই না। সে তার একশো টাকা এগিয়ে দিয়ে কৌটা নিজের ব্যাগে তুলে বেশ অস্থির ভঙ্গিতে বেরিয়ে পড়ল।
তাওহীদ স্থির দাঁড়িয়ে দেখল তার সুপ্রভার অস্থিরতা। কাঠের তক্তায় রাখা টাকা তুলে নিজের বুক পকেটে রেখে, প্যান্টের পকেট থেকে দু’টো পঞ্চাশ টাকা নিয়ে রাখল দোকানের টাকার বাক্সটায়। তাওহীদ শার্টের পকেটের ওপরে হাত রেখে ভাবল, এই টাকা’টা সে কখনোই খরচ করবে না। রেখে দিবে। রেখে দিবে ভীষণ যত্ন করে, ভীষণ আদর করে; তার সুপ্রভার দেওয়া প্রথম উপহার বলে কথা!
চলবে
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান