অকিঞ্চন পর্ব-০৯

0
86

গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – নয়
_____

মলিন, ধুলোপড়া এক বিকেলে মাহমুদা প্রভার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। প্রভা তখন তার ল্যাপটপে কাজে ব্যস্ত। কেউ এসেছে বুঝতে পেরে প্রভা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের মাকে দেখে; এরপর আলগোছেই স্ক্রিন বদলে সোজা হয়ে বসে। মাহমুদা এগিয়ে এসে বিছানায় বসে শুধোলেন,
– কম্পিউটার ক্লাস কেমন যায়? আজকে নেই ক্লাস?

মাহমুদা জানেন আজ প্রভার ক্লাস নেই। তবুও জানতে চাইলেন আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে। ধাপ-ধুপ করে নিশ্চয় কোনো বিষয়ে কথা বলা যায় না। প্রভা উত্তর দিল,
– না নেই।

মাহমুদা অযথাই জিগ্যেস করলেন,
– কী করছিলি?

– কিছু না। ওই ক্লাসে যা শেখায় তাই প্র্যাকটিস করছিলাম।

– রুম থেকে তো বেরই হোস না। বিকেল হলে একটু আমার রুমে গিয়ে গল্পও তো করতে পারিস। কতো দেখি, কতো শুনি মা-মেয়েরা বন্ধুর মতো হয়। বন্ধুর মতো গল্প করে। আর তোরা কেমন যে হইলি!

প্রভা চোখে তুলে নামিয়ে নিল। মায়ের এমন কথার বিপরীতে তার কিছু বলার নেই। বলতে চায়’ও না। অবশ্য বলবেই বা কী! দূরত্ব একবার তৈরি হলে তা কখনো পূরণ হয় না। হলেও সেখানে জীবনের অনেকটা সময় লেগে যায়। তার আর তার মায়ের দূরত্বটা তো আজকের তৈরি নয়। এতো বছর ব্যাপি একটু একটু করে, ভীষণ যত্নে, ভীষণ অবহেলার তৈরি এই দূরত্ব। কিছু ভুল তার মায়ের ছিল, কিছু ভুল হয়তো তার ছিল। জীবনের তেইশটা বছর যখন দূরত্বেই কেটে গেল, এখন আর দূরত্ব ঘুছিয়ে দেওয়ার কোনো অর্থ প্রভা পায় না। সেই তর্কে না গিয়ে নিজের মতো জানতে চাইল,
– কিছু বলতা এমনিতে?

– হ্যাঁ, বলতাম তো এমনিতে। কিন্তু তুই কী ব্যস্ত? ব্যস্ত হইলে আর বলব না। ফ্রী টাইমে একটু রুমে যাইস, তখন আলাপ করবনি এই বিষয়ে।

প্রভা বলল,
– না বলো, সমস্যা নাই। ব্যস্ত না।

– তোর বিয়ে নিয়ে বলতাম।

প্রভা চুপ করে চেয়ে রইল। মাহমুদা বললেন,
– শোন রে মা, আমি আর কী বলব! আমার বয়স হইতেসে। তোরও বয়স হইতেসে। সামনের বছর চব্বিশে পড়বি। আমরা যতোই শিক্ষিত হই না কেন বিয়ে তো একদিন করতেই হবে। আর তোর বাবা আর আমি অনেকদিন যাবতই তো তোর বিয়ের কথা ভাবতেসিলাম। এখন তোর বাবায় একজন ছেলে দেখসে। এমনিতে ভালোই। ভালো চাকরি করে। সবদিক থেকেই যোগ্য। উঁচা-লাম্বা-ফর্সা। এখন তুই কী বলিস! কথা কী আগাবে, মানে তোরও একটা পছন্দ আছে তাই বলি…

মাহমুদার কথায় প্রভা চমকাল না। আজকাল এমন কথা বাসায় প্রায়ই চলে। উলটো মাহমুদা যে প্রভার অনুমতিটুকু নিতে এসেছে – এতেই যেন প্রভা বেশ চমকাল। সাথে মায়ের কথা শুনতে শুনতে অপ্রতিরোধ্য বিস্ময় নিয়ে একটি দৃশ্য কল্পনা করল। তার মা বলল, ছেলেটা উঁচা-লাম্বা, প্রভার মনে পড়ল, তাওহীদ চোখে পড়ার মতো লম্বা নয়; গড়পড়তায় বাঙালি ছেলেরা যেমন হয়, তেমন। তার মা বলল, ছেলেটা ফর্সা, প্রভার সামনে ভেসে উঠল তাওহীদের কৃষ্ণবর্ণের মলিন চেহারা। তার মা বলল, ভালো বেতনের চাকরি করে, প্রভার সামনে ভেসে উঠল, মুদির দোকানে দাঁড়ানো তাওহীদের হাসিমুখ। নেই, মায়ের বলা ছেলের সঙ্গে তাওহীদের কোনো মিল নেই। বরং সবদিকেই তাওহীদ বিপরীত। সবদিক থেকেই যেন অযোগ্য। অযোগ্য! হ্যাঁ, অযোগ্য। সবার জন্য অযোগ্যই। তবে প্রভার জন্য অযোগ্য হয়েও তাওহীদ’ই যেন সবচেয়ে যোগ্য। প্রভা মাহমুদার দিকে তাকিয়ে ভাবল একবার বলে যে, মা, ওই ছেলেটার আমার মন খারাপ বোঝার যোগ্যতা আছে? আমি রেগে গেলে হাসিমুখে আমাকে বোঝানোর যোগ্যতা আছে? কিন্তু বলা হলো না। প্রভা হাপ ছাড়ল। মাহমুদা প্রভার মৌনতায় নিজে থেকেই আবারো বললেন,
– ছেলেটা কিন্তু ভালোই, প্রভা। বয়সও কম আছে।

প্রভা কথা কাটানোর কোনো উপায় না পেয়ে বুদ্ধি করে বলল,
– কোনো ছবি আছে, মা?

মাহমুদার মুখ উজ্জ্বল হলো। মেয়ে একেবারে না করছে না। ছবি চাওয়া — ইতিবাচক ইঙ্গিতই প্রকাশ করে। তবে ছবি তো নেই বর্তমানে। মাহমুদা উজ্জ্বল মুখেই বললেন,
– না রে, ছবি তোর বাবার ফোনে দেখেছি আমি। এমনিতে তো নেই। তোর বাবা আসলে আমি দেখাবনি তোকে।

প্রভা ভীষণ অনাগ্রহে মাথা নাড়ে। নিজের কাজে সফল হয়ে মাহমুদা হাসিমুখে বলল,
– চা বানাচ্ছি, ড্রইংরুমে আয়। একসাথে খাবনি। অন্যদিন তো বাসায়ই থাকিস না। আয়….

মাহমুদা চলে গেলেন। প্রভা বিরক্তি, হতাশার সংমিশ্রণে তাকিয়ে রইল
স্ক্রিনের পানে। বিতৃষ্ণাময় বিকেলটা যেন আরোও বিতৃষ্ণার হয়ে উঠল। বিরক্তি সাথে হতাশা মিলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে ভীষণ সাবধানে বেরিয়ে পড়ে একটি নাম — তাও..হী…দ।
_____

পেরিয়েছে তিন সপ্তাহ। বসন্তের শেষে চৈত্রের আগমনীর সময়। বসন্তের এই সমাপ্তি লগ্নে অধীর হয়ে জানালায় বসে প্রভা। থেকে থেকে অস্থিরতায় কেঁপে উঠছে ভেতরযন্ত্রটা। অস্থিরতার নাম যে তাওহীদ — তা প্রভা জানে, মানে এবং বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করতে দোষ নেই। এটা তেমন বড়সড় অস্থিরতা নয়, ছোটখাটো অস্থিরতা। এই অস্থিরতাকে প্রম-বিষয়ক কিছু ভাবা নিতান্তই শিশুসুলভ কাজকারবার হবে। প্রভা যেমন জানে, সে তাওহীদের কারণে অস্থির। প্রভা তেমন এটাও জানে, এই অস্থিরতা অনর্থক, শিশুসুলভ। এর প্রকৃত কোনো অর্থ নেই। তবে অস্থিরতা তো আছে, ব্যাকুলতা তো আছে। প্রভার ব্যাকুলতার প্রধান কারণ – এই তিন তিনটে সপ্তাহ যে পেরুলো, এর মাঝে একদিনো তাওহীদের সাথে কথা হলো না। চোখের দেখা যাও হলো, কিন্তু কথা হলো না। প্রভা মাঝে দু’ দিন শাপলা স্বরণীর মাঠে গিয়ে বসে রইল। আশা কেবল তাওহীদের সাথে কথা বলা। কিন্তু তাওহীদ এলো না। দেখা হলো না। কথা হলো না। তবুও ভার্সিটির প্রেশারে দু’সপ্তাহ কোথা দিয়ে চলে গেল তা প্রভা জানে না। বিপত্তি বাজাল এই সপ্তাহটাই। এই এক সপ্তাহ যাবত মনটা বাড়াবাড়ি রকমের জ্বালাতন শুরু করেছে। প্রভা জানালা থেকে উঠে ফোন তুলল। সে এখন ভয়ংকর একটি কাজ করতে চলেছে। ভয়ংকর কাজটি হলো — তাওহীদকে ফোন করা। হ্যাঁ, তাওহীদকেই ফোন করবে। প্রভা গত সপ্তাহেই জেনেছে তাওহীদ তাদের বাসায় পানি তুলে দেয়। এছাড়া যাবতীয় টুকটাক কাজে যে তার বাবা তাওহীদকে দিয়ে করায় তাও আর অজানা নেই। করুক, সমস্যা নেই। তাওহীদ কেমন, কী করে – এসব কখনোই প্রভার চিন্তার কারণ হয়নি। তাই এই কথা জানার পরেও প্রভা তেমন বিচলিত হচ্ছে না। উপরন্তু, যখন জানা গেল তাওহীদ সকল কাজ বিনামূল্যে করে তখন প্রভা যেন অবাকের আরেক ধাপ উঁচুতে পৌঁছে গেল। বিস্মিত মনে কেবল একটা প্রশ্নই এলো যে, একটা মানুষ এতোটা সহজ, এতোটা সরল কেমন করে হতে পারে! সেই ঘটনাকেই কেন্দ্র করে প্রভা তার বাবার থেকে তাওহীদের নাম্বার টুকে নেয়। বাবাকে আশ্বস্ত করে যে, যেকোনো কাজে ডাকতে পারবে তাই নেওয়া।

প্রভা নিজের সাহসের মাত্রা অতিক্রম করে তাওহীদের নাম্বারে ফোন লাগায়। কম্পিত বুক নিয়ে ফোন ধরে রাখে একটু গলা শোনার অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষায়। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এই তীব্র আশাকে নিরাশ করতে চাইলেন না। তাই আচানক পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো,
– হ্যালো! আসসালামু আলাইকুম। কে বলতেসেন?

প্রভা দু-এক পল নিশ্চুপ রয়ে উত্তর দিল,
– আমি।

– আমি ক….সুপ্রভা!

তাওহীদের বিস্ময় যেন তার কণ্ঠেই প্রকাশিত হলো। কয়েক মূহুর্ত সে কিছু বলতে পারল না। এরপর বলল,
– কেমন আছেন, সুপ্রভা?

– আছি… ভালো।
প্রভা ভীষণ লজ্জায় নিজের চোখ নামিয়ে আছে। তার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, তাওহীদ যেন তার সামনেই দাঁড়ানো। প্রভার জড়তা কণ্ঠ ছাপিয়ে শরীরেও প্রকাশ পেল। হাতের মৃদু কম্পন, কণ্ঠের আড়ষ্টভাব সব মিলিয়ে প্রভার কাছে নিজেকে ভীষণ অজানা, বিরক্তিকর কেউ মনে হলো।

নিজের বিস্ময়ভাবকে কাটাতে একটু কষ্ট করতে হলো তাওহীদকে। মনে প্রশ্ন এলো, তার নাম্বার সুপ্রভা পেল কেমন করে? ভাবে জিগ্যেস করবে। পরমুহূর্তেই মনে হলো, নাহ থাক! এখন নয়। জিগ্যেস করে শুধু শুধু প্রভাকে রাগিয়ে তোলার কিংবা লজ্জায় ফেলার অর্থ হয় না। নিজের মনের প্রশ্ন মনেই রেখে তাওহীদ শুধাল,
– কোনো বিশেষ কারণে ফোন করেছিলেন, সুপ্রভা? কোনো সমস্যা?

এতোদিন যাবত তাওহীদের কণ্ঠ না শোনার দুঃখ তো ছিলই, তার ওপরে কণ্ঠে এমন আদরভাব! মুহূর্তেই সুপ্রভার চোখ ভরে উঠল। দিন, দুনিয়া, ব্যক্তিত্ব ভুলে আচানক বলে বসল,
– আমার বন্ধু হবেন, তাওহীদ?

এতোক্ষণের কম্পিত হৃদপিণ্ড এবার যেন আরোও কঠিনরূপ ধারণ করল। নিজেকে শান্ত করা প্রয়োজন। তাওহীদ নিজেকে শান্ত করতে বেশ ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে বিছানায় বসল। এরপর বেশ শীতল গলায় বলল,
– আপনি একথা বলছেন, সুপ্রভা?

প্রভা এতোক্ষণে বুঝতে পারল নিজের ভুল। শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে আগের রূপে ফিরে গিয়ে বলল,
– না মানে…আমার মাত্র একটাই বন্ধু। আর তেমন কোনো বন্ধু নেই। আর আপনিও মানুষ হিসেবে তেমন একটা খারাপ নন। চলার মতো। তাই বলছিলাম, আমার বন্ধু হবেন?

তাওহীদ মৃদু হেসে বলল,
– আপনি উত্তরটা জানেন, সুপ্রভা।

প্রভা চোখ বন্ধ করে বুক ভরে শ্বাস নিল। বুকের কোথাও যেন শীতলতায় আচ্ছন্ন হলো। ওপাশ থেকে তাওহীদ বলল,
– কী করছিলেন আপনি?

– কিছু না। তাওহীদ, ফোন রাখি?

প্রভার সাবলীল কণ্ঠের পিছনের অসহায়ত্ব, লজ্জা বুঝতে তাওহীদের মোটেও অসুবিধা হলো না। ভরাট কণ্ঠে বলল,
– সুপ্রভা? ধন্যবাদ।

তাওহীদের ধন্যবাদে সুপ্রভা মৃদু হেসে বলল,
– কাল কী এই নতুন বন্ধুর সাথে একবার দেখা করতে পারবেন, মিস্টার তাওহীদ আলম?

তাওহীদের হাসির শব্দ সুপ্রভা শুনতে পেল। তাওহীদ বলল,
– আদেশ করুন, সুপ্রভা।

প্রভা কিছু না বলে ফোন রেখে দিল। এবার নিজের করা কাজে নিজেই বিমূঢ় হয়ে রইল। কাজটা ভুল হলো কী? নাহ, ভুল হয়নি। নিজের মনের কথা শুনতে, মানতে ভুল হবে কেন। আর হলেও…হোক না দু’একটা ভুল।

সুপ্রভা বিছানায় মাথা হেলিয়ে তাওহীদের ব্যাপারে ভাবতে শুরু করল। প্রথমেই মাথায় এলো, লোকটা ভীষণ সুন্দর করে সুপ্রভা ডাকে। কী যত্ন, কী আদর, কী স্নেহ মেশানো ডাক! এইভাবে সুপ্রভা বলে ডাকার মতো তার কেউ নেই। প্রভার এই নাম রেখেছিলেন তার দাদা। অবশ্য তার দাদাও খুব সুন্দর করে তাকে সুপ্রভা বলে ডাকতেন। সে মারা যাওয়ার এতো এতো বছর পর ডাকল তাওহীদ। প্রভা উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। প্রভার মাঝেমধ্যে মনে হয়, সে বোধকরি অপেক্ষা উপন্যাসের সেই ছোট্ট সুপ্রভাই। ছোট সুপ্রভা আর সে সুপ্রভার মধ্যে একটি মিল আছে অবশ্য। সেই ছোট্ট সুপ্রভার মনও ছিল অভিমানে পরিপূর্ণ। তার মনও অভিমানে পরিপূর্ণ। কিন্তু অভিমানটা যে কার উপর তা বোধহয় আর জানা হবেনা….
_____

– তাওহীদ! তুই কী আমারে একটা নিজেস্ব চাঁদ খুঁইজা দিতে পারোস, ভাই?

প্রভার ভাবনায় বিভোর থাকা তাওহীদ হাসানের এমন কথা শুনে কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। বলল,
– মানে কী, ভাই?

– ইংরেজি ভাষা কই নাই। কইসি যে, আমারে একটা আমার চাঁদ খুঁইজা দে?

তাওহীদ সংকোচ নিয়ে বলল,
– আপনার চাঁদ আমি পামু কেমনে?

হাসানকে এবার চিন্তিত দেখাল। চিন্তিত হয়ে বলল,
– তর কথাও ঠিক। আমার চাঁদ তুই পাবি কেমনে! কিন্তু আমার একটা চাঁদ লাগবোই। এই যে তুই কী সুন্দর প্রভারে দেখার লোভে দোকানে গিয়া বইসা থাকোস। প্রভারেও দেখস আবার দোকানও সামলাস। কিন্তু আমার তো এমন ব্যক্তিগত চাঁদ নাই। আমি দোকানে বইসা হুদাই মশার কামড় খাই। আমার তো একটুও মজা লাগে না। তাই ভাবসিলাম, একটা চাঁদ-পরী থাকলে মনে হয় আমারো দোকানে বসতে ভালোই লাগতো।

হাসানের দুঃখ শুনে তাওহীদ সহাস্যে বলল,
– একটা পরী খুঁইজা নিলেই পারেন।

– যা অবস্থা দেখতাসি, খুঁজাই লাগব। আইজকা তো দোকানে ঘুমাইশা পড়সিলাম। পড়ে এক বাচ্চায় আইসা কানের সামনে চিল্লানি দিসে। পড়ে উইঠা জিনিস দিসি। একটা বউ থাকলে কী এমন হইতো! হইতো না। বউ এর অভাবেই কবে জানি মইরা যাই।

হাসানের কথা কোনদিক থেকে কোনদিকে গেল তাওহীদ তার কোনো কিনারা পেল না। কিনারা খোঁজার বৃথা চেষ্টাও তাওহীদ করল না। কেবল হাসিমুখে চেয়ে রইল হাসানের দিকে। হাসানকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না যে, সে মজা করছে। বরং তার চেহারা-সুরতের ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে যেন, আসলেই তার বিরাট দুঃখ, আসলেই সে বড্ড অসহায়।

তাওহীদ হাসানকে সান্ত্বনা দিতে চাইল। বলল,
– মন খারাপ কইরেন না, ভাই। চাচীআম্মায় তো মেয়ে দেখতেসেই। দেখবেন কোনো হুর-পরীই আল্লাহ আপনের ভাগ্যে রাখসে।

হাসান ধমকে উঠল,
– বিয়ার কথা তুলবি না, তাওহীদ। বিয়া একটা লস প্রজেক্ট। বিয়া করা না কুয়ায় ঝাঁপ মারা। বিয়া মাইনষ্যে করে! বিয়া হইলো আস্ত একটা ঝামেলার নাম। সারাদিন বউ এর প্যানপ্যানানি কে শুনব? হাপ! আমি বিয়াটিয়াতে নাই।

তাওহীদ হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল। হাসানের সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া তার কাজ নয়। আদ্যোপান্ত এক মাথা খারাপ লোক। তাওহীদের ভাবনার মাঝেই হাসান বলল,
– তাওহীদ, একটা গান গা তো। গান শুনতে ইচ্ছা করতাসে। যদি কস পারোস না, এই এক লাথথিতে বাউন্ডারির বাইরে পাঠায় দিমু। গান গা। শুরু কর…

হাসানের এমন ধমকে তাওহীদ শব্দ করে হেসে ফেলল। নাহ, হাসান ভাইয়ের মাথা খারাপ হলেও মানুষ হিসেবে ততোটাও খারাপ না। উলটো তাওহীদ মনে করে হাসান ভাই একজন চমৎকার গোছের মানুষ।

গান ধরতে যেতেই আচানক মনে এলো তার সুপ্রভার কথা। সুপ্রভার নিজে থেকে বন্ধু হতে চাওয়ার বিষয়টা ছিল অকল্পনীয়। তাওহীদের সকল ভাবনাকে ছাপিয়ে যেন সুপ্রভা কাজটা করেছে। হঠাৎ করে তাওহীদের মনে হলো, মহান আল্লাহ তার আর সুপ্রভার সম্পর্ক এই বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ রাখবেন। এর বাইরে তার কখনো সুপ্রভাকে পাওয়া হবে না। তার কখনো নিরালায় বসে সুপ্রভার সাথে দু’টো কথা বলা হবে না। তার কখনো সুপ্রভার অভিমানের কারণ হওয়া হবে না। তাওহীদের মনে হলো, তাদের যাত্রাটা ভীষণ ছোট। তাদের যাত্রাটা বোধহয় এতোটুকুরই; কেবলই-মাত্র বন্ধুত্বের।

তাওহীদ গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে,
আশা ছিল মনে মনে
প্রেম করিব তোমার সনে
তোমায় নিয়া ঘর বাঁন্ধিব
গহীন বালুর চরে গো…
গহীন বালুর চরে

তাওহীদের আশা কখনো পূরণ হবার নয়। তার আর সুপ্রভার কখনো ঘর হবার নয়। তাওহীদ জানে এটাই তাদের নিয়তি। তবুও নিয়তিকে কখনো কখনো মানতে ইচ্ছে হয়না। বড় দুঃখ হয়। অনেক দুঃখ হয়। ভাবতেই তাওহীদের চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে গেল দু’ফোঁটা উত্তপ্তজল।

চলবে-
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন ইরান