গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – তেরো
_____
নিজের থেকে কিছুদূর ব্যবধানে দাঁড়ানো নারীটিকে দেখে তাওহীদ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। অস্ফুটস্বরে আওড়াল,
– সুপ্রভা! আপনি!
প্রভা কোমল হাসল। সে শতভাগ নিশ্চিত ছিল তাওহীদ এমনই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে চমকে উঠবে। তার ধারণা মিলে গেছে। প্রভা ভেবে স্বস্তি পেল যে, প্রভাকে কেবলমাত্র তাওহীদ নয়, প্রভা নিজেও তাওহীদকে পড়তে জানে। খুব বেশি না হলেও কিছুটা জানে। প্রভা চারপাশ নিরীক্ষণ করা অবস্থাতে এগিয়ে এলো। বলল,
– বাসায় কেউ নেই?
প্রভার প্রশ্নে তাওহীদ উত্তর দেওয়ার মূহুর্তেই বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। বলল,
– সবাই বাইরে গেছে, সুপ্রভা।
প্রভা পূর্ণচোখে চেয়ে বলল,
– আপনি গেলেন না যে?
– এমনি। সবাই মার্কেটে গেছে। আমি বাসায়। আজ দোকানও খুলিনাই।
প্রভা গিয়ে খাটে বসল। তাওহীদ দূর থেকেই প্রশ্ন করল,
– আপনি এখানে কেন বললেন না যে?
বারবার এমন প্রশ্নে প্রভা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
– কেন? খুশি হন নি বুঝি? বিরক্ত করে ফেললাম এসে?
– তেমন কিছুই না। অবাক হয়েছি বিধায় প্রশ্নটা করলাম।
প্রভা মুখি হাসি রেখে বলল,
– ইসমাতের কাছে এসেছিলাম। আপনি একবার বলসিলেন ইসমাত খুব সুন্দর হাতের কাজ জানে। তাই এসছিলাম।
তাওহীদ সরল কণ্ঠে বলল,
– ইসমাত তো নেই, সুপ্রভা। আপনার আসাটা বৃথা চলে গেল! আপনাকে যে পরে আবার আসতে হবে।
প্রভা কণ্ঠে কিছুটা হাসি মিশিয়ে বলল,
– আপনি সরাসরি বলুন যে আপনি চাচ্ছেন আমি চলে যাই।
তাওহীদ অসহায়, করুণ চোখে চাইল। হ্যাঁ সে চাইছে। সে তো কতোকিছুই চায়, সব কী সম্ভব হয় আর না সব আশা পূরণ হয়? সে তো চায় একটা জনম সুপ্রভাকে সঙ্গে করে কাটিয়ে দিতে। সে তো চায় একটা জনম সুপ্রভাকে দেখতে দেখতে কাটিয়ে দিতে। মাঝে একটু গালে, নাকে হাত বুলোবে। একটা শিশু যেমন তার প্রিয় পুতুলকে খুটিয়ে খুটিয়ে যত্ন করে, সেও তেমন যত্ন করবে। যত্নে বুকের অতল গহ্বরে বসিয়ে রাখবে। কিন্তু, সব আশা কী আর পূরণ হয়! তাওহীদ মর্মান্তিক কণ্ঠে বলল,
– একটু বুঝুন, সুপ্রভা। মানুষজন খারাপ বলবে। বাসায় কেউ নাই। এখন বাহির থেকে কেউ যদি আপনারে দেখে তাইলে কথা ছড়াইতে সময় লাগব না।
তাওহীদের কথা প্রভাকে তেমন বিচলিত করতে পারল না। প্রভার মুখের হাসি পূর্বের তুলনায় বিস্তৃত হলো। তাওহীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
– আপনার মনটা কী আজকে বেশি ভালো নাকি?
প্রভা সুন্দর হেসে মাথা উপর-নিচ করল। এরপর সুবিস্তীর্ণ হাসির সঙ্গে ব্যাকুল হয়ে বলল,
– আমাকে এতো বুঝেন কীভাবে আপনি!
প্রভার এমন কথায় তাওহীদও কিছুটা হেসে বলল,
– আপনার মুখের আদলেই প্রকাশ পায়তেসে। যে কেউ বুঝতে পারব। আপনি কী আরেকটু বসবেন?
প্রভা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বলল,
– কী আশ্চর্য! আপনি দেখি রীতিমতো আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। যান গিয়ে আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসুন। অতিথি হই আমি।
প্রভার বলা কথায় তাওহীদ আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে, বের হওয়ার মূহুর্তেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো। আচমকা এমন হওয়াতে প্রভা, তাওহীদ দু’জনেই চমকে উঠল। তারা ভেতরের ঘরে বসা। সামনের আরেক রুমের পরে গিয়ে বারান্দা। নিবিড় আঁধারে কয়েক মূহুর্ত কেটে গেল ভীষণ রকমের ভয়ানক নিস্তব্ধতায়। সম্ভবত ঘরে কোনো জানালা নেই; থাকলে বাহিরের আলোতে ঘরের আঁধার কিছুটা হলেও মিটতো। কিছুটা সময় কাটার পরে খুট করে আওয়াজ তুলে ঝনঝন শব্দে গড়িয়ে পড়ল টিনের গ্লাস। প্রভা চমকে শব্দের উৎস খোঁজার বৃথা চেষ্টা করল। সাথে বেশ অবাক হলো এমন গাঢ় অন্ধকার দেখে। প্রভা কিছু বলতে উদ্যত হবে, আচানক মনে এলো তাওহীদের কথা। তাওহীদ আঁধার সহ্য করতে পারে না। সে আঁধার ভীষণভাবে এড়িয়ে চলে। প্রভা উঠে দাঁড়াল। সে একথা জেনেছিল ফোনালাপে। যখন প্রভা মিশমিশে কালো অন্ধকার জায়গাকে তার প্রিয় জায়গা বলেছিল সে মূহুর্তে জানা গেছিল তাওহীদ বিপরীতভাবে অন্ধকার সহ্যই করতে পারে না। সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, জমে যায়। প্রভা উঠে গন্তব্যহীন হেঁটে এগিয়ে গেল। আবছা মূর্তির দিকে এগিয়ে গিয়ে দু হাতে কবজি আঁকড়ে ধরল। খানিকটা সময় কেটে যাবার পরে প্রভা কবজি ছেড়ে হাতের মুঠো চেপে ধরল। আড়ষ্ট, ব্যাকুল হয়ে বলল,
– তাওহীদ, আমি আছি।
তাওহীদ নড়েচড়ে গেল। বোধহয় কী করবে, কী করা উচিত তা বুঝে এলো না। প্রভা আরেক হাত এগিয়ে তাওহীদের হাতটি দু’হাতে মুঠোবন্দি করে আবারো বলল,
– তাওহীদ, ভয় পাবেন না। দেখুন, আমি আছি তো।
প্রভা বেশ মন্থর গতিতে শীতল গলায় কথা বলছে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত, অস্বস্তিকর পরিবেশে সে নিজেও কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। তবে তার সকল ভাবনা জুড়ে কেবলমাত্র তাওহীদ। প্রভা কিছু বলতে উদ্যত হবে মূহুর্তেই সারাঘর আলোকিত হয়ে গেল। আচম্বিত আলো ফিরে আসায় প্রভা চোখ কিছুটা বন্ধ করে নিজেকে আশ্বস্ত করল। তাওহীদকে কিছু বলার পূর্বেই তাওহীদ বেশ বিনয়ীভাবে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।
প্রভা তাওহীদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে খানিকটা থমকে গেল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ঘাবড়ানো মলিন মুখ। প্রভার মনে উদ্বিগ্নতার সাথে মায়ার ঢল নেমে মিশে গেল। কিছুটা সামনে এগিয়ে বলল,
– ইটস ওকে, তাওহীদ! ভয় পাওয়া, কোনো কিছুতে ভীতি থাকা লজ্জার নয়। আমরা মানুষ। ভয়, দুর্বলতা আমাদের সবারই আছে কম-বেশি। এতো অস্বস্তি করবেন না। ভয় থাকলে লজ্জা নয়, ভয়কে কাটিয়ে ওঠার সাহস জোগাতে হবে।
প্রভা দু’কদম এগিয়ে বেদনার্ত কণ্ঠে বলল,
– আমি আছি, তাওহীদ।
প্রভার ভরসা মাখা কণ্ঠ, চক্ষুর ভাসা ভাসা অশ্রু আর দেখতে ইচ্ছে হলো না। তাওহীদ চোখ সরিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– আপনি বসুন, আমি আসছি।
তাওহীদ প্রভাকে কাটিয়ে চলে যাবে এমন মূহুর্তে প্রভা আবারো তাওহীদের কবজি আঁকড়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে তাওহীদ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রভার দিকে তাকাল। এমন শক্তভাবে হাত ছাড়িয়ে নেওয়া, তাওহীদের চোখের দৃঢ়তা — সব মিলিয়ে প্রভা কিছুটা অপমানিত হলো। আত্মাভিমানে সংঘাত হানল। প্রভা কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার পূর্বেই তাওহীদ দৃঢ়তা, আক্ষেপ, দুঃখের এক আশ্চর্য মিশেলে বলল,
– এমন কিছু করবেন না সুপ্রভা যাতে করে পরে গিয়ে আপনার আক্ষেপ হয়। নিজের কাজে ঘেন্না হয়।
প্রভা অবাক হয়ে শুধালো,
– ঘৃণা হবে কেন?
তাওহীদ ভুবন সমান দুঃখ নিয়ে বলল,
– আপনি একজন ছেলের হাত ধরতেসেন বারে বারে ব্যাপারটা শোভনীয় কোনো কথা নয়, সুপ্রভা। আজ আপনি নিজে থেকে হাত ধরতেসেন। অথচ পরে গিয়ে কোনো এক ধূসর বিকেলে আজকে করা আচরণের কথা ভেবে আপনার মন ভাড় হইতেই পারে। নিজের ওপর দুঃখ হতেই পারে যে কেন আপনি আমার হাত ধরসিলেন। আমি তো আপনার কেউ হই না সুপ্রভা। আমি আপনার দুঃখের কারণ হইতে চাই না। আপনি আমার কথা ভাইবা আক্ষেপ করবেন — ব্যাপারটা আমার জন্যে অনেক কঠিন হবে, আমার দুঃখ হবে।
তাওহীদের এমনসব কথায় স্থির প্রভা আচমকা বলল,
– আপনি আমাকে ভালোবাসেন না, তাওহীদ?
তাওহীদ প্রভার কণ্ঠের এমন অবিশ্বাস্য ভাব, চক্ষু ভর্তি টলটলে পানি, ব্যাকুল চাহনি কিছুই সহ্য করতে পারল না। বুকের ভেতর হিমালয় পুষে হেসে ফেলে বলল,
– আপনারে ভালোবাসব কেন, সুপ্রভা?
প্রভা স্থবির চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলার পূর্বেই তাওহীদ বলল,
– আপনারে কী কখনো আমি বলসিলাম যে আমি আপনারে ভালোবাসি?
আর সম্ভব হলো না তাওহীদের চোখে চোখ রাখা। প্রভা নিজের চোখ নামিয়ে নিল। তাওহীদ সহাস্যে বলল,
– আপনারে বলসিলাম আমার আপনারে দেখলে ভালো লাগে। আমি খুশি হই। এর বেশি কিছু তো কখনো কিছু বলি নাই। বলসিলাম?
প্রভা মুচকি হেসে বলল,
– আপনি দেখি আমার কথা সিরিয়াসভাবে নিচ্ছেন। মজা করছিলাম আমি।
তাওহীদ নিশ্চুপে চেয়ে রইল তার সুপ্রভার দিকে। প্রভা মুখ তুলে বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
– আর এমনিতেও আপনি বন্ধু হিসেবেই পারফেক্ট। জীবনসঙ্গী হিসেবে নয়।
তাওহীদও সায় জানাল। হেসে ফেলে বলল,
– এটা কিন্তু একদম ঠিক বলসেন। আচ্ছা আপনি বসেন। আমি একটু আসি।
তাওহীদ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কথার ভঙ্গিতেই প্রভা বুঝতে পারল তাকে অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত করতে চলেছে তাওহীদ। সেদিকে মন দেওয়ার ইচ্ছে হলো না। কিছুক্ষণ আগের উল্কার বেগে ঘটে যাওয়া ঘটনাতে বিমূঢ় হলো প্রভা। কোথায় দিয়ে কী হয়ে গেল এসব! হতবুদ্ধিভাব কাটিয়ে প্রভা অবজ্ঞার হাসি হেসে ঘর থেকে বেরুবে, এমন সময় চোখ আটকাল টেবিলের দিকে। ইচ্ছে হলো একটু এগিয়ে দেখতে। এগুতেই চোখে পড়ল টেবিলের ওপর রাখা দু’টো ছবির ওপর। প্রভা হাতে তুলে দেখল – ছবিগুলো তার হারিয়ে যাওয়া সেই ছবি। ভ্রু কুঁচকে গেল। তবে তাওহীদ মিথ্যে বলেছিল সেদিন! ছবিগুলো তবে সেই পেয়েছিল! টেবিলের ওপরেই রাখা একশো টাকাও হাতে তুলে নিল প্রভা। টাকার ওপর কিছু লেখা। প্রভা লেখাটা পড়তে শুরু করে – ‘সুপ্রভার দেওয়া প্রথম উপহার’। প্রভার দেওয়া? প্রভা কবে….ওহ! সেই যে তাওহীদের থেকে ড্যানিশ নিয়েছিল সেই টাকা! প্রভা ভ্রু কুঁচকে রইল কিছু সময়। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা, তাওহীদের দৃঢ়তা, নিজের প্রতি অভিমান সবকিছু একত্র করে প্রভা দু’হাতে জিনিসগুলো মুচড়ে ধরল। এরপর ছুঁড়ে ফেলে এক দুনিয়া অভিমান নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে।
_____
– কী বলোস কী, তাওহীদ! প্রভা আইছিল?
– হ্যাঁ, আসছিল। দেখসেনই তো।
হ্যাঁ, হাসান দেখেছে। প্রভা যখন সিঁড়ি বেয়ে নেমে তার বাড়ির গেটে ঢুকে পড়ল – সম্পূর্ণ দৃশ্য হাসান দেখেছে। হাসান খাটে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মাথার নিচে দু’হাত রেখে মুখভর্তি উত্তেজনা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
– প্রভা কিন্তু তর থিকা রোম্যান্টিক মাইয়া। কী সুন্দর বাসা পর্যন্ত চইলা আসছে।
তাওহীর কপট হেসে বলল,
– আপনে বেশি ভাবতেসেন, ভাই।
হাসান উঠে বসে গদগদ হয়ে বলল,
– আমি বেশি না বরঞ্চ কম ভাবতাসি। মাইয়া কিন্তু বেশ চালু আছে….. কীরে! তোরে এমন বেজার বেজার লাগতেসে ক্যা? তোর তো খুশি হওয়ার কথা।
তাওহীদ হাসি গলায় মেখে বলল,
– খুশিই তো আমি। আপনি চোখে বেশি দ্যাখেন, ভাই।
হাসানের ভ্রুক্ষেপ হলো। আচমকা উঠে বসে তাওহীদের পিঠে হাত রেখে শুধালো,
– কোনো সমস্যা হইসে ভাই? আমারে বলতে পারোস।
তাওহীদ তার বালকের ন্যায় মুখ নেড়ে, শিশুসুলভ চোখে তাকিয়ে বলল,
– কী হবে ভাই?
হাসান নড়ল না। তাওহীদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– কী হইসে, তাওহীদ?
তাওহীর তার টলটলে দিঘীর মতো চোখ তুলে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– সুপ্রভা আজকে আমারে জিগ্যেস করসিল যে আমি তারে ভালোবাসি কি-না। আমি…
হাসান উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে বলল,
– কী কস তুই! আরে বরকির ঘরের বরকি এইটা তো খুশির খবর। কই আমারে মিষ্টি খাওয়াবি, তোর বিয়ার দিন-তারিখ শুনাবি আর তুই এনে মুরগির মতো ঝিমাইতাছোস!
তাওহীদ হাসানের খুশিতে কোনোপ্রকার রা না করে কেবল শীতল গলায় বলল,
– আমি তারে বলসি আমি তারে ভালোবাসি না। কখনো বাসি নাই। মানা কইরা দিসি।
তাওহীদের কথায় হাসান ভ্রু কুঁচকে থেকে ধমকে উঠল,
– হ! তুমি কইলা আর আমি বিশ্বাস গেলাম। আমি তো ঘাসে মুখ দিয়া চলি।
তাওহীদ হাসানের দিকে চেয়ে বলল,
– আমি সত্যি বলতেসি, ভাই। আমি সুপ্রভার কাছে স্বীকার করি নাই।
হাসান অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠে বলল,
– এমন করলি কীসের জন্য তুই?
তাওহীদ ম্লান কণ্ঠে বলল,
– আপনি তো জানেন ভাই যে উনার পরিবার কেমন। কতো উচ্চবিত্ত সেখানে আমি মধ্যবিত্ত তো দূর নিম্নবিত্তের কাতারেও পড়ি না। তাছাড়া পরিবারের কথা একপাশে রাখলেও সমাজ বইলা একটা কথা আছে। বাচ্চাগো মতো আবদার করলে তো চলে না। প্রভার জীবন এমনেতেই অন্যরকম। আর কঠিন করতে চাই নাই।
হাসান ক্ষেপে উঠে বলল,
– আহারে! কতো বাঁচান বাঁচাইলা প্রভারে। উলটা আরোও মারলা। যেখানে মাইয়াটাও তোমারে পছন্দ করে সেইখানে এইসব তামাশা বাদে কিছুই না। ভালোবাইসাও স্বীকার করলি না কীসের জন্য তুই?
হাসান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাওহীদ সাবলীল কণ্ঠে বলল,
– সুপ্রভা হয়তো আসলেই আমারে অনুভব করে। আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আজকে তো না কইরা দিসি। উনার আত্মসম্মানবোধ প্রবল। এরপর থেকে উনি নিজেরে গুটাই নিবে। আমিও নিব। উনার সাথে আর বেশি দেখা-সাক্ষাৎ করা যাবেনা, হাসান ভাই। উনি আমার বন্ধু হইসেন, আমার সঙ্গে হাইসা-খেইলা দুইটা কথা বলসেন — এইটুকু প্রাপ্তি নিয়াই আমি এক জনম কাটাই দিতে পারব।
হাসানের রাগীমুখ মলিন হলো নিমেষেই। তাওহীদ সেদিকে চেয়ে বলল,
– ভালোবাসা স্বীকার করা মানেই পৃথিবীতে আরেকটা ব্যর্থতার গল্প হওয়া। এক জীবনে এতো ভাড় নেওয়া যায় না, হাসান ভাই।
হাসান মৃত কণ্ঠে শুধাল,
– তুই তাইলে প্রভারে হারায় ফেললি?
তাওহীদ মুখভর্তি করে হেসে ফেলে বলল,
– আমি সুপ্রভারে কখনো পাইলামই না। হারাইলাম আর কেমনে! ভাই, ঘুমায় পড়েন। রাত হইসে।
হাসান খানিকসময় স্থির হয়ে বসে রইল। বলার মতো কোনো শব্দ হাজার খুঁজেও পেল না। শব্দ খোঁজার জন্য আঁধারে বেশ খানিকসময় হাতড়ে বেরিয়েও যখন কিছু জোগাড় হলো না, হাসান তখন নিশ্চুপে শুয়ে পড়ল। শীতল কণ্ঠে বলল,
– শুইয়া পড়, ভাই।
তাওহীদ ঢোক গিলল। গলা ব্যথা করছে। উঠে গিয়ে কৃত্রিম আলোর পথ বন্ধ করতেই জানালা গলিয়ে সড়কের আলো এসে ভিড় করল ঘরজুড়ে। তাওহীদ এসে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। ভালোবাসে না; তাওহীদ ভালোবাসে না শুনে হাসান ভাইয়ের, তার সুপ্রভার, দুনিয়াজোড়া মানুষের কতো হতাশা, কতো আক্ষেপ, কতো অভিযোগ! অথচ তারা তো কেউ জানে না যে, আমরা যাদের ভালোবাসি না তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। চোখটা জ্বলছে। ইদানীং চোখের জ্বলুনি বেশ বেড়েছে। অল্পকথাতে, অল্প ঘটনাতেই চোখ জ্বলে ওঠে। জ্বলা জ্বলা চোখে বারংবার ভেসে উঠছে সুপ্রভার অবিশ্বাস্য, থমকে যাওয়া, জ্বলজ্বলে চোখের দৃষ্টি। তাওহীদ আবারো ঢোক গিলে। গলা ব্যথাটাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাওহীদ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা চালাল। নাহ…কোনোমতেই সফল হচ্ছে না। বেশ খানিকসময় ধরে অনর্থক চেষ্টা করার পরেও বিশেষ লাভ মিলল না। পাশ ফিরে চোখ খুলতেই আবারো ভেসে উঠল তার সুপ্রভার মলিন মুখ। তাওহীদ তার নিজ মনেই বলতে শুরু করে,
– কী নির্বিবাদে আমি আপনারে বইলা দিলাম আমি আপনারে ভালোবাসি না, সুপ্রভা। অথচ আপনারে ভালো না বাইসা সবচেয়ে বেশি আপনারেই ভালোবাসলাম। আল্লাহ জানে যদি কইতাম ভালোবাসি তাইলে আরোও কত বাসতাম!
বলতে বলতেই বন্ধ চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে গেল উষ্ণ দু’ফোঁটা অশ্রু।
চলবে-
_____
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – চৌদ্দ
_____
বড় মেয়ে প্রভাকে নিয়ে ইদানীং বেশ চিন্তায় পড়েছেন মাহমুদা। প্রভার কথা ভাবতে বসলেই থেকে থেকে বুকটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে আসে। অদ্ভূত শুন্যতায় গ্রাস করে নেয় চারিপাশ। আবার আচমকা বুকটা ভারী হয়ে আসে তীব্র হাহাকারে। মনে হয়, জীবনে কিছু একটা নেই। জীবনে কিছু একটা সঠিকভাবে বোধহয় করা হলো না। কোথাও না কোথাও একটা যেন খামতি রয়ে গেল। কিন্তু এই শুন্যতা, হাহাকার, তীব্র আর্তনাদ যে হয় — তার কোনো যথাযথ কারণ কখনো মেলে না। থেকে থেকে জীবনটা শুন্য মনে হয় আবার মূহুর্তেই সব পূর্বের মতো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। তাহমিদা চায়ে চুমুক বসিয়ে বলল,
– আজকে মিষ্টি একটু বেশি হয়েছে।
মাহমুদা বললেন,
– হুম। চিনি বেশি পড়ে গেছে।
তাহমিদা ভ্রুক্ষেপ করে শুধাল,
– তোমাকে এমন লাগতেসে কেন? এতো উদাস হয়ে কী চিন্তা করতেসো তুমি?
মাহমুদা ছোট বোনের দিকে তাকালেন। নিজের ভেতরকার সংশয়, অস্থিরতা থেকে বললেন,
– প্রভাটা কেমন জানি হয়ে গেল, তাই না রে? কারোর সাথে তেমন মিশে না। কথা বলে না। নিজের মতো থাকে। মেয়েদের সাথে মায়েদের বন্ধুর মতো সম্পর্ক থাকে। আর ও তো আমার সাথে ভালো করে কথাই বলে না।
তাহমিদা মাহমুদার কথায় কিছু বললেন না। বলতে ইচ্ছে হলো না। মাহমুদা বেগম নিজেই বললেন,
– কাল ওর ঘরে গেলাম। কতোক্ষণ বসে রইলাম। কথা বলতে চাইলাম। কথাই বলল না। উলটা ওর মুখের অস্বস্তিতে, সংশয়ে লজ্জা পেয়ে আমিই চলে আসলাম। মায়ের সাথে এগুলা কেমন ব্যবহার? আমার অনেক কষ্ট লাগসে ওর ব্যবহার। আমি যে মা এইটা মনেহয় ও মনেই করেনা। কী কপাল নিয়ে যে আসছিলাম!
তাহমিদা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,
– সবসময় কপালের দোষ দেও কেন? কিছু জিনিস কপালের দোষে না, বরং নিজের দোষে হয়।
মাহমুদা তাহমিদার কথাকে গুরুত্ব দিয়েছেন কি না বোঝা গেল না। স্থবির হয়ে বসে রইলেন তিনি। তাহমিদা বলল,
– অতিরিক্ত কিছুই ভালো না, আপা। বাচ্চাগুলারে কেমনে পালসো তা তো নিজের চোখেই দেখসি।
মাহমুদা নিজের জায়গা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলেন,
– বাচ্চাদের শাসনে না রাখলে হয় না।
তাহমিদা এবার ভীষণ রকম বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে নিলেন। বলল,
– হ্যাঁ, মাশা-আল্লাহ শাসন করে খুব ভালো করে গড়ে তুলসো তুমি। ফলাফল তো নিজের চোখের সামনেই। শাসন তো করো নাই দুইজনের মাঝখানে দেওয়াল দাঁড় করাইসো। ছোটবেলা থেকে সামান্য কিছুতেও জঘন্যভাবে শাস্তি দিছো। একবার পুকুরে গোসল করলো বলে তুমি সারা দুপুর ওরে জামাকাপড় ছাড়া রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলা। একটা সাত-আট বছরের বাচ্চার মস্তিষ্কে এইটা যে কেমন বিরূপ প্রভাব ফেলে তা তো নিশ্চয় জানো।
মাহমুদা তাহমিদার কথায় যে বিরক্ত হচ্ছেন তা তার চেহারাতেই প্রকাশিত হলো। তাহমিদা হতাশার সঙ্গে বিদ্রুপ মিশিয়ে বললেন,
– ছোট বেলা থেকেই একটা ট্রমার মধ্যে বড় হইসে প্রভা। জীবনটাকে তো জীবনের মতো না, উলটা রোবটের মতো কাটাইসে।
মাহমুদা নিজের বিপরীতে এসব জ্ঞানী কথাবার্তা আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,
– হইসে, যাহ, ওঠ। কাপগুলা নিয়া যা।
তাহমিদা দু’চোখ ভর্তি করুণা নিয়ে চেয়ে রইলেন তার বড় বোনের প্রতি। মাহমুদা ঠেস মেরে বললেন,
– আমি তো আমার বাচ্চাগো মানুষ করতে পারি নাই। তুই করিস।
তাহমিদাও দমার পাত্রী নন। বলল,
– হ্যাঁ, করবোই তো। আল্লাহ চাইলে ওদের মানুষের মতো মানুষ করব। মানুষ করা মানে ক্লাসে ১,২ হওয়া আর ডাক্তার বানানো না। আমার ছেলে ক্লাস ফোরে গতবার ইংলিশ এ ফেল করসে। ওর কাছ থেকে আমি বুঝতে চেষ্টা করসি ওর দুর্বলতা। পরে ওরে প্রতিদিন সহজ করে করে পড়াইসি। আলহামদুলিল্লাহ এইবার ইংলিশে ৬০ মার্ক্স তুলসে যেটা আহামরি না হইলেও আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ এই ওয়ান-টু এর রেজাল্টে ও বিশ্ব জয় করবে না। আসল পড়া সামনে। এই সময়টা নাহয় একটা সুন্দর শৈশব তৈরি করতে মন দিক।
তাহমিদা থামলেন। নিশ্বাস গুলো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। সে স্বভাবতই কম কথা বলে। তবে উত্তেজিত হলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। তার আপার প্রতি তার অভিযোগ অনেকদিনকার। শুরুতে সে, তার মা কতো করে বুঝাতো এমন আচরণ না করতে। কিন্তু মাহমুদা তো মাহমুদাই। তাহমিদার হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা থমকে উঠল। প্রভা যখন নানিবাড়ি যেত তখনই মাহমুদা এতো শাসন করতেন, না জানি অন্য সময়ে মেয়েটার সাথে কী হতো! তাহমিদা নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইলেন। উত্তেজনায় পা কাঁপছে। এখান থেকে সড়ে যাওয়া উচিত। কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে এসে তাকেই অপমান করা — শোভনীয় কোনো কথা নয়। এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বলে ফেলেছেন তিনি। তাহমিদা দু’কাপ মগ নিয়ে উঠে যেতে যেতে ঠিক করলেন, কাল সকালেই চলে যাবেন তিনি। ভীষণ লজ্জা লাগছে।
_____
সিঁড়ি বেয়ে মন্থর পায়ে নেমে এলো তাওহীদ। আভাময় বিকেলে মৃদু তাপ মিলে বেশ অন্যরকম একটা মুহূর্ত তৈরি হয়েছে চারপাশে। অবসাদে শরীর ভেঙে আসতে চাইছে। আজ খানিকটা ধকল গেছে শরীরের ওপরে। সকালবেলা যেতে হয়েছে রাজারবাগের কাছে একটি জায়গায়। উদ্দেশ্য ছিল চাকরি বিষয়ক কথা বলা। চাকরিটা অবশ্য জোগাড় করেছে হাসান ভাই। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই সে দীপ্তিময় চেহারায় এগিয়ে এসে তড়িঘড়ি করে বলল,
– তাওহীদ, তোর জন্যে চাকরির খোঁজ করতাসি। এই নে ঠিকানা। এই কাগজে লেখা আছে দেখ । সক্কাল সক্কাল চইলা যা। এইখানে কম্পিউটারে লোক নিব। তুই না কম্পিউটার চালানি শিখসিলি কলেজে থাকতে? তুই যা। যাইয়া বিস্তারিত কথা বল। বেতন বলসে আলোচনা সাপেক্ষে। তুই বুক ফুলাইয়া কথা বইলা আসবি, ঠিকাছে? যাতে তর সাহস দেইখাই তোরে নিয়া নেয়।
তাওহীদ বলল,
– আমি কম্পিউটারের টাইপিং শিখসিলাম। খুঁটিনাটি তো জানি না।
হাসান ধমকে উঠল,
– খুঁটিনাটি দিয়া কাজ নাই। যা জানোস তাতেই চলব। যাহ। আজকে দোকানে আমি বসুমুনি সারাদিন। আর এই যে এই নতুন প্যান্ট-শার্ট পইরা যাইস। বের কইরা রাখসি।
তাওহীদ খাটের ওপরে থাকা প্যান্ট-শার্ট দেখে ম্লান হাসল। হাসান ভাইয়ের এমন উৎসাহ দেখে নিজেকে বিশেষ স্নেহভাজন কেউ বলে বোধ হলো। মানুষটা বোধহয় তাকে একটু বেশিই স্নেহ করে। তাওহীদ কিছু বলার পূর্বেই হাসান তাওহীদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
– চিন্তা করিস না, ভাই। এই জাহানের একমাত্র মালিক ওপরওয়ালা। তুই দোয়া কর যেন চাকরিটা হয়। তোর চাকরি হইলে আমি নিজে যামু প্রভার বাপের কাছে। বুক ফুলাইয়া কমু, আমার ভাই কম কীসে, কন মিয়া! চেহারা সুরত নায়কের মতো, হাসিতে মুক্তার মতো মায়া ঝরে। চাকরিও ভালো, তাইলে আপনার কী সমস্যা, কন?
শেষের কথাগুলো ধমকের ভঙ্গিতে বলায় তাওহীদ হেসে ফেলল। সামনের মানুষটিকে অত্যধিক সরলতায় বুক ভরে উঠল। হয়তো হাসান ভাই অত্যধিক পরিমাণে সরল আর নয়তো অত্যধিক চতুর। চতুরতার সাথে তাওহীদকে উপহাস করল। তবে হাসান ভাই এমন নয় তা তাওহীদ জানে। তাওহীদ এও জানে কোনোভাবে যদি চাকরিটা সে পেয়েও যায়, তবুও সে তার সুপ্রভার যোগ্য হতে পারে না। এখন এটা কে বুঝাবে হাসান ভাইকে?
সেখানে গিয়ে দেখা করে, প্রয়োজনীয় আলাপ করে কিছুক্ষণ হলো এসেছে তাওহীদ। এখন বেরিয়েছে দোকানের উদ্দেশ্যে। চাকরি কনফার্ম হয়েছে কি না তা জানানোর হয়নি। লোকটি বলেছে, ফোন করে জানাবে। তাওহীদের ধারণা, চাকরিটা হবে না। সে কোনো প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর দিতে পারে নি। সেভাবে ঘটা করে ইন্টারভিউ না নেওয়া হলেও তাকে নানান প্রশ্ন করা হয়েছিল, সে উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট এসকল কিছু সম্পর্কেই তার ধারণা শুন্যের কোঠায়। এখানে তাকে উত্তীর্ণ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এরচেয়ে ভালো সে গিয়ে দোকানে বসুক। হাসান ভাই যে ভাতৃস্নেহ থেকে তার জন্যে এতোটুকু করেছেন — এই তাওহীদের জন্য বিশেষ পাওয়া। মানুষটা নিশ্চিত চাচা-চাচির বকা খেয়ে সকাল থেকে দোকানে বসে আছে। এমনিতে সে বেশিক্ষণ দোকানে বেশিক্ষণ বসতে পারেন না। তার শরীর নাকি অসাড় অসাড় লাগে। হাত-পা ঝিঁঝিঁ করে। তাওহীদ মৃদু হাসল। এখন একবার প্রভার সাথে কথা হলে মন্দ হতো না। তার সুপ্রভা তাকে ফোন কিংবা কোনো ম্যাসেজ করে না আড়াই দিন হয়ে গেল। তার স্মার্ট ফোন নেই। বাটন ফোনেই সে বুকভর্তি রোমাঞ্চকর অনুভূতির নিয়ে সুপ্রভার এসএমএস পড়ে। আচ্ছা, তার সুপ্রভা কী তার প্রতি অভিমান করে আছে? সুপ্রভা যে তাওহীদকে সামান্য পছন্দ করে তা নিয়ে তাওহীদের কোনো সন্দেহ নেই। তবে, অনুভূতি! তার তাওহীদের প্রতি অনুভূতিও কী তাওহীদের মতোই প্রবল? আচ্ছা, সুপ্রভার মনেও কী তাওহীদ আছে ঠিক যেমন করে তাওহীদের মনে সুপ্রভা আছে একদম দৃঢ় পর্বতের মতো অটল হয়ে! না, মনে হয় নেই। বুকে ভেতর সংশয়, আড়ষ্টতার, দ্বিধার প্যাঁচানো জাল নিয়ে চপল পায়ে এগিয়ে চলল তাওহীদ।
_____
পৃথিবীর কোনো মানুষই একা জীবন যাপিত করতে পারে না। মানুষ সামাজিক জীব। তার জন্মই আরেকটি মানুষের সঙ্গে মেশার জন্যে, কথার বলার জন্যে। তবে প্রয়োজন কেবল ‘স্বস্তির’। স্বস্তির ওপরে কিছু হয় না। যেখানে স্বস্তি নেই, সেখানে বোধহয় কিছুই নেই। এই যে প্রভা। পুরো দুনিয়া জানে সে কারোর সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কেবলমাত্র সে জানে তার অন্যতম স্বস্তি হলো আফরিন; যাকে বাছ-বিছারহীন ভাবে, নির্বিবাদে সকল কিছু বলে ফেলা যায়। প্রভার মন খারাপ হলে সে ঘণ্টাবেঁধে মন খারাপের বিলাপ যপে, মন ভালো হলে সারাদিন, সারারাত জুড়ে উচ্ছ্বাস,খুশির মেলা বসায়। সবটাই করে তবে সবার অজান্তে। আজ প্রভার মনটা বেশ ফুরফুরে। গত দু’দিন যেমন মরি মরি অবস্থার ছিল, আজ ততোটাই উচ্ছ্বসিত। গত দু’দিন তাওহীদ প্রভাকে কোনোপ্রকার কোনো কল, ম্যাসেজ করে নি। সেই ঘটনার পরে তাওহীদের এমন আচরণ যেন প্রভাকে আরোও ভেঙে দিয়েছিল। নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ, ভীষণ অপ্রয়োজনীয় কেউ মনে হচ্ছিল। সাথে সেদিনের অপমানের মৃদু আভাতে প্রভার দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তবে আজ বিকেলে তাওহীদ নিজে থেকেই ম্যাসেজ করেছে। লিখেছে, ‘ সুপ্রভা! আপনি কী আমার ওপর রেগে আছেন? দু’দিনে যে একটা ম্যাসেজও করলেন না?’
বাক্য দু’টিতে কী ছিল জানা নেই। তবে বাক্য দু’টি পড়তেই প্রভার ভেতরকার অভিমানগুলো, জেদগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাকে গুরুত্ব দেওয়ায় একপ্রকার অহং কাজ করেছে। তাই সে ম্যাসেজের কোনোপ্রকার কোনো উত্তর না দিয়ে আফরিনের সঙ্গে আমোদ মিশিয়ে বাক্যালাপে ব্যস্ত হয়েছে। মাঝে মেয়েটার সাথে বেশ কিছুদিন কথা হয় নি। তবে বন্ধুত্বে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে কথা হতে হবে — এমন নীতিতে প্রভা বিশ্বাসী নয়।
এতোক্ষণের আলাপের মাঝে হঠাৎ আফরিন অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আফরিন ওপাশ থেকে লিখেছে,
– প্রভা! তুই হুমায়ূন আহমেদ এর ‘উড়ালপঙ্খী’ পড়ছোস? ভাই এটা পড়ে তো আমি হাসতে হাসতে শেষ। এটা চমৎকার একটা বই। প্রভা, তুই এইটা পড়বি। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। পড়ে আমাকে অনুভূতি জানাবি। আমি শিওর তোর এই বই সবচেয়ে প্রিয় বই হয়ে যাবে। যেমন হাসির তেমন কষ্টের।
মৃদু হাসি সমেত প্রভা পুরো ম্যাসেজটা পড়ল। পড়ার সাথে সাথে কানে ছন্দের সুর তুলে বাজল আফরিনের হাসিপূর্ণ কণ্ঠের কথা। প্রভা ‘উড়ালপঙ্খী’ বইটি পড়েছে। কলেজে থাকাকালীন’ই হুমায়ূন আহমেদ এর মোটামুটি সকল বই তার পড়া হয়ে গেছে। তবুও প্রভা লিখল,
– না পড়িনি। তবে তুই যখন বললি পড়বনি।
ওপাশ থেকে আফরিন আবারো বলল,
– পড়িস, দেখবি তোর অনেক ভাল্লাগবে।
প্রভা লিখল,
– আচ্ছা।
ওপাশ থেকে ম্যাসেজের ওপর ম্যাসেজ আসতেই চলেছে। প্রভাকে পড়তে বলেও থেমে নেই আফরিন। নিজ গরজে, নিজ উৎসাহে সে এখন প্রভাকে কাহিনী বৃত্তান্ত শোনাতে ব্যস্ত। প্রভাও বিরক্ত হচ্ছে না। মুখে হাসি নিয়ে দেখে চলেছে আফরিনের খুশি। গত দু’দিন মেয়েটার কাছে তাওহীদকে নিয়ে অনেক আবেগের কথা বলেছে প্রভা, অনেক জ্বালিয়েছে। আজ যখন তার মন-মেজাজ সুস্থ আছে, আজ নাহয় একটু আফরিনের পাগলামো দেখা যাক। প্রভা মৃদু হাসি সমেত তাকিয়ে রইল স্ক্রিনে। নিজের এমন কিশোরীদের মতো আবেগে নিজেই আশ্চর্য হলো। তাওহীদ তাকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে মাত্র। তাতেই তার মাঝে আলাদা এক শক্তি, দম্ভ এসে ভীড় করেছে। কিশোরীদের মতো অভিমান করতে ইচ্ছে হচ্ছে। জিতে যাওয়ার উত্তাল খুশিতে পূর্ণ হচ্ছে বুক। সামান্য একটা ম্যাসেজে তার এতো খুশি কেন লাগছে, আশ্চর্য ব্যাপার!
চলবে –
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান