গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – ষোলো (প্রথম অংশ)
_____
গত দিনের ঘটনার পর আর কথা হয় নি সুপ্রভার সাথে। সুপ্রভা কল, ম্যাসেজ করে নি। তাওহীদেরও ইচ্ছে হয় নি কিছু করতে বা বলতে। মানুষের বিচিত্র মন। যতোই তাওহীদ উপরে উপরে বিকারহীন হয়ে ঘুরে বেড়াক না কেন, তারও মন খারাপ হয়। তার বুকটাও অভিমানে ধুঁক ধুঁক করে। তাওহীদ নিজের হিসেব খাতাটায় চোখ বুলিয়ে আজকের দিনের হিসাব করতে ব্যস্ত হয়। অথচ মন পড়ে থাকে তার সুপ্রভা নামক নিঠুর মানবীর দিকে। তাওহীদ বুকের জমাট বাঁধা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আজ সকালে যখন সুপ্রভা ভার্সিটি থেকে ফিরল, যাওয়ার পথে বারে বারে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। তাওহীদকে খুঁজছিল? কে জানে কাকে খুঁজছিল! তাওহীদ সামনের হিসেবের খাতাটা অবহেলায় বন্ধ করে দু’হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে। দু’হাতে মুখ ঢেকে আকম্পিত বুক থেকে আবারো শ্বাস আছড়ে ফেলে। শ্বাস ফেলার পরমুহূর্তেই তাওহীদের ভীষণ ইচ্ছে হয়, শ্বাসের মতো যদি বুকের ভেতরকার সব স্মৃতি আছড়ে ফেলা যেত — তবে বোধধয় বেশ হতো। জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। সে এদিকে এক মেয়ের অনুভূতিতে মুখ থুবড়ে আছে, ওদিকে গ্রামে তার বিষণ্ণ, ম্লান মুখী মা তার বাপের সংসার আঁকড়ে আছে। সপ্তাহ পেরিয়ে গেল মায়ের কণ্ঠ শোনা হয় না। কী হয় একটু ফোনটা ঠিক করে কথা বললে। তাওহীদের বুকটা যেন আরোও ভারী হলো। বুকের মাঝখানে কিছু কামড়ে ধরতেই তাওহীদ উঠে দাঁড়াল। এই মূহুর্তে কী এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না? দূরে কোথাও নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায় না? হারিয়ে যাওয়া বুঝি এতোটাই কঠিন? তার তো আর এখানে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যেদিকে চোখ যায় কেবল ম্লানতা। এই যে চাচা-চাচি! তারাও তো তাওহীদকে বিশেষ একটা পছন্দ করে না। সে তো অবুঝ কোনো বালক নয়। হতে পারে সে সবকিছু সহজ চোখে দেখে তবে এরমানে তো এই নয় সে বোকা। মূহুর্তের মধ্যেই তাওহীদ ভীষণ কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে ঠিক করে ফেলল, সে এখানে, এই বাসায় আর থাকবে না। এভাবে জীবন চলে না, উলটো আরোও গন্তব্যেহীন নৌকার মতো অথৈ সাগরে ভেসে বেড়ায়। সে চলে যাবে দূরে কোথাও। দুনিয়াতে কোনো না কোনো কাজ নিশ্চয় মিলবে। না, তাওহীদ মরবে না। সে বেঁচে থাকবে। সে বাঁচবে তবে একটু সম্মান নিয়ে বাঁচবে যেখানে কেউ তার দিকে তুচ্ছতা ভরে চাইবে না। ভালো না বাসুক, তুচ্ছ করবে না। এমনিতেও তার কখনো সুপ্রভাকে পাওয়া হবে না। তবে কীসের তরে এতোসব কিছু? কীসের তরে এতো মায়া? তাওহীদ শীতকালের নির্জীব পাতার ঝরে পড়ার মতো আলগোছে শুয়ে পড়ল বিছানায়। অস্থিরতায় টনটন করছে বুক। ছেলেবেলায় সামান্য মন খারাপেই তাওহীদ মায়ের বুকে পড়ে হু হু করে কেঁদে ফেলত। তার কান্নাতে তার মা দু’হাতে তার মুখ মুছে নরম আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলতো – এতো ছোটো বিষয়ে কানতে আছে? তুমি পুরুষ মানুষ হইয়া যদি এমনে কাঁনদো, মাইনষ্যে না হাসবো রে, বাবা। কান্দে না, আমার সোনা মানিক। আমার চাঁদের মতো পুলা তুমি।
তাওহীদের চেহারা তেমন সৌষ্ঠব নয়। প্রায় মানুষই এটা সেটা বলত। ছোটো বেলাতেই তাওহীদ বেশ ভালোমতো বুঝেছিল সে খুব সুন্দর নয়, কেবল চলনসই চেহারা নিয়ে জন্মেছে; যে চেহারা কখনো কখনো চলে আবার কখনো চলে না। নানান কথা শুনে তাওহীদের মন খারাপ হতো, দু’চোখ ভরে উঠতো। তবে সামান্য কথায় কাঁদলে তো চলে না। লোকে হাসবে। তার বড় ভাই’ই হাসতো। প্রায়শই বলেই বসতো – আমাগো তাওহীদ মাইয়াগো মতো কথায় কথায় মুখ ছুটো কইরা ফেলে।
তাওহীদ শক্ত ঢোক গিলল। গলাটা ব্যথা হচ্ছে। দুনিয়ার প্রতি তীব্রভাবে সব অভিযোগ জেগে উঠছে। দুনিয়া’টা শুধু ছোট কথাকে দেখে। কথার নিচের ভারটাকে না। দুনিয়া শুধু তাওহীদের ছোটো, শুকনো মুখ দেখে। কিন্তু, সেই ছোট কথাতেই যে তাওহীদের মন হাজার টুকরো হয়, সেটা দেখে না। তাওহীদ পাশ ফিরে শুয়ে, জানালা পেরিয়ে চাঁদের দিকে তাকায়। শিশুসুলভ অভিমানে, দুনিয়ার সকল মন খারাপে ভেঙে আসে তার ঠোঁট। ছোটবেলায় সে ভাবতো, সে বড় কোনো মই নিয়ে উপরে উঠে গেলেই চাঁদ ধরতে পারবে। ইচ্ছে হতো কাঠ কেটে বিশাল কোনো মই বানাতে। ইচ্ছে হতো আকাশের বুক থেকে চাঁদকে ছিঁড়ে নিয়ে আসতে। চাঁদকে ছিঁড়ে আনলে নিশ্চয় আকাশটা ফাঁকা দেখাতো? তাওহীদ নিজের ভাবনায় হেসে ফেলে। সে বরাবরই অসম্ভব জিনিসের প্রতি ঝুঁকে। এই যেমন, সুপ্রভা। বিশাল বড় মই দিয়ে যেমন সে চাঁদ পাবে না, তেমন এক বুক ভর্তি অনুভূতি দিয়েও সে সুপ্রভাকে পাবে না। মুহূর্তে মুহূর্তে চারিপাশ কিংবা সুপ্রভা নিজেই তাওহীদকে বুঝিয়ে দেয়, সুপ্রভা তাওহীদের নয়। কখনো হবে না। তাওহীদ বুঝদার হয়েও অবুঝ শিশুর মতো অভিমান আঁকড়ে পড়ে রইল বিছানায়। ওই যে, বলেছি না মানুষের মন মাত্রই বিচিত্র। একারণেই তো তাওহীদের মন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। সবকিছুতে তিক্ততা ভর করছে। মনটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে। ভাঙা মনের এক টুকরো বলছে, মায়ের কাছে ছুটে যেতে। আরেক টুকরো বলছে, হাতের দু’আজলায় ভালোবেসে সুপ্রভার মুখখানা ধরতে। মুহূর্তে অন্য আরেক টুকরো চাইছে, সুপ্রভার থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে। যে তাওহীদকে একটুও মনে করে না, তাওহীদ কেন তাকে মনে করবে। আর তাওহীদ কে’ইবা মনে করার!
_____
বিষণ্ণ শান্ত মনে বসে আছে প্রভা। গতদিনের ঘটনার ছায়া এখনো তার উপর থেকে কাটেনি। সে বরাবরের মতোই প্রয়োজনের তুলনায় অত্যধিক বলেছে। অপ্রয়োজনীয়ভাবে তাওহীদের ওপর রাগ ঝেড়েছে। তাওহীদ তো তার জায়গায় ঠিক। সেখানে হাতাহাতি, মারামারি করলে ব্যাপারটা আরোও ঘেটে যেত। অথচ বোকা সে কথাটা বুঝতে এতোটা দেড়ি করে বসল। সে তো পারে একটু ধৈর্যশীল হতে, সে তো পারে একটু সবকিছু অনুধাবন করে চলতে। কিন্তু না…তার সকলই কাজই কেবল আর কেবল দুঃখ ডেকে আনে। প্রভা ফোন তুলে আফরিনের কনভারসেশনে ঢুকল। না, কোনো উত্তর নেই। আফরিন এখনো অনলাইনে আসে নি। প্রভা বিষণ্ণ মনটা আরোও বেশি ব্যথিত হলো। মনে হচ্ছিল আফরিনকে বললেই সকল সমস্যার সমাধান মিলবে। আফরিন তাকে একটু সুন্দর করে বোঝাবে। তুরি মেরে সকল সমস্যা স্বচ্ছ জলের মতো তার সামনে তুলে ধরবে। কিন্তু মেয়েটা অনলাইনেই এলো না। প্রভা ছোটমুখে বসে থেকে চট করে উঠে দাঁড়াল। এইবার সে তার সমস্যার সমাধান একাই করবে। দেখা যাক তার সমাধান কাজে দেয় কি-না।
আফরিন অপ্রসন্ন মুখে ফোনের নোটিফিকেশন থেকে প্রভার কনভারসেশন টা সরিয়ে দিল। সরিয়ে দিয়ে মন দিল ফেসবুক স্ক্রলিং এ। সবসময় এই ‘সাপোর্ট’ শব্দটা খাটে না। একটা মানুষ কিছু হলেই তাকে ম্যাসেজ করে, হুট করে কল দিয়ে বসে। আফরিন নিজেও একজন মানুষ। তারও মন ভালো-খারাপ হয়। তারও মনের স্বচ্ছলতার প্রয়োজন আছে। নিজের দুঃখ পেরিয়ে অন্যের ঢাল সবসময় হওয়া যায় না, মন টানে না। আফরিন ফেসবুক থেকে বেরিয়ে ফোনটা ছুঁড়ে দিল। জোড়ে শ্বাস ফেলে ভাবল, প্রভা ভীষণ দারুণ একজন মেয়ে। তবে বন্ধু নয়। আফরিন মাঝেমধ্যেই ভাবে সে হয়তো কেউ নয় প্রভার জীবনে। তার কোনোই গুরুত্ব নেই প্রভার কাছে। প্রভা কেবল তাকে ব্যবহার করে একটি জড়বস্তুর মতো; যাকে সবসময় নিজের দুঃখের শামিল করা যায়। নিজের দুঃখ বলে হালকা হওয়া যায়, সমাধান নেওয়া যায়। এমনিতে কোনো প্রভাব নাই। আফরিন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল অজানাভাবে। প্রভা শুধু তাকে দুঃখে নয়, একইভাবে বরং তার চেয়ে বেশি নিজের খুশিতে শামিল করে। অথচ তবুও আফরিনের মন ভরে না। তাদের বন্ধুত্বের একটিমাত্র আফসোস সে কখনো প্রভার মুখে নিজের মর্যাদা সম্পর্কে শুনল না, জানল না। আফরিনের তো মন বলে, প্রভা কখনো তাকে বন্ধু হিসেবেই মানে নি। মানবে কেমন করে সে তো নিম্নবিত্ত পরিবারের। নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ কী আর মানুষ হয়!
_____
অসময়ে ঘুম দিয়ে মাথাটা ভারি হয়ে আছে। ঝিম ঝিম অবস্থাতে খাটতে থেকে নামতে যেতেই শুনতে পেল ফোনের শব্দ। ফোন তুলে কানে দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সুপ্রভার রিনরিনে কণ্ঠ,
– তাওহীদ?
তাওহীদ এক হাতে মাথা চেপে নিশ্চল কণ্ঠে বলল,
– বলেন।
কণ্ঠে কী কিছু ছিল? অন্যসব বারের তুলনায় কেমন রূঢ় শোনাল। তবুও প্রভা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
– রেগে আছেন?
তাওহীদ কপালে ভাঁজ ফেলে উত্তর দিল,
– রাগব কেন?
প্রভাও মৃদু মায়া কণ্ঠে বলল,
– তবে সুপ্রভা বলে ডাকলেন না কেন?
তাওহীদ স্পষ্ট করে উত্তর না দিয়ে হেয়ালি করে বলল,
– অসময়ে ফোন দিলেন যে হঠাৎ? কিছু বলতেন?
প্রভা বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
– একবার গেটের সামনে আসতে পারবেন, তাওহীদ?
– গেটের সামনে? হঠাৎ কেন? চাচা ডাকছে?
– কেউ ডাকেনি, তাওহীদ। আমি ডাকছি। আপনি কী আসবেন? প্লিজ আসুন।
তাওহীদ নীরব। কোনো উত্তর দেয় না। প্রভা মৃদু কণ্ঠে বলল,
– আমি জানি আপনি আসবেন। আমি ৫ মিনিট পরে নামছি। এখন ৭ টা ৫০ বাজে। ৮ টায় নামব।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে প্রভা আবারো বলল,
– তাওহীদ, সামনের বড় গেট টায় দাঁড়িয়েন না। ভেতরে আইসেন। বড় গেটে সিসিটিভি আছে। ওইটা বাদে আর কোথাও নেই। তাই ভেতরে আইসেন। ৫ মিনিট পরে নামছি নিচে।
তাওহীদ গেটের ভেতর সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা অন্যদিনের তুলনায় গম্ভীর। হাত উঠিয়ে কপালে রাখতেই গেট থেকে একজন বেরিয়ে গেল। তাওহীদ সেদিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। ছোট ছোট পায়ে পায়চারি করতে করতে বেশ খানিকক্ষণ বাদে জুতোর শব্দ মিলল। জুতোর শক্ত তলার সঙ্গে টায়েলস এর সংঘর্ষে টাপটাপ শব্দে এগিয়ে এলো প্রভা। প্রভার দিকে চাইতেই কিছু হৃদস্পন্দন মূর্ছা গেল তাওহীদের। তৃষ্ণিত চক্ষু মেলে চেয়ে দেখল প্রভার মুখের গড়ন। মনে হলো না জানি কতো বছর পেরিয়ে গেছে এই মুখটা না দেখার। না জানি কতো শতাব্দী পেরিয়ে গেছে ওই সহজ, সুন্দর চোখটি না দেখার। তাওহীদ এগিয়ে গেল। দৃষ্টি ফিরিয়েও আকুল চক্ষে আবারো চাইল। বরাবরের দেখা বিন্যস্ত, সুশৃঙ্খল সুপ্রভার চেয়ে এই অবিন্যস্ত সুপ্রভাকে বড় সুন্দর দেখাল। কী সুন্দর এলোমেলো ঘোমটা জড়ানো, আলুলায়িত চুলের গোছা, তৈলাক্ত মুখ। বুকের মাঝে হটাৎ টনটন করে উঠতেই তাওহীদ ঢোক গিলে বলল,
– বলুন, কী বলবেন?
প্রভা পূর্ণচোখে চেয়ে স্বভাবের বিপরীতে গেল। সহাস্যে বলল,
– আপনি না বলেছিলেন আসবেন না?
তাওহীদকে জড়তা স্পর্শ করল না। ভরাট কণ্ঠে বলল,
– আপনার বিশ্বাস ছিল আমি আসব। আমি এসে বিশ্বাস টার মান রেখেছি মাত্র।
প্রভা ঠোঁটের হাসি চোখেও পৌঁছাল। বলল,
– আপনাকে রাগতে দেখে ভালো লাগছে।
তাওহীদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
– আমি রাগ করি নাই, সুপ্রভা। রাগ করব কীসের জন্য?
– আমার জন্য। নিন।
তাওহীদ তাকাল প্রভার হাতের ওয়ান টাইম বক্সের দিকে। প্রভা বলল,
– আমি নিজে বানিয়েছি মোগলাই আর সবজির বড়া। এটার সঙ্গে সস খুঁজতেই একটু দেড়ি হয়ে গেছে। নিন।
তাওহীদ উদাস কণ্ঠে বলল,
– এর দরকার ছিল না কোনো।
– আছে কি নেই আমি বুঝব। আপনি নিয়ে যান। আর আপনাকে দেড়ি করাব না। আপনি এখন যান।
তাওহীদ কথা বাড়ায়নি আর। বাক্স হাতে পিছু ফিরে দু’কদম দিতেই প্রভা আবারো ডেকে উঠল। এগিয়ে গিয়ে সামনে দাঁড়াল। তাওহীদ প্রশ্ন চোখে চাইতেই প্রভা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
– ঐ টলটলে চোখে আমার জন্য স্নেহ মানায়, আদর মানায়। অভিমান নয়। অভিমান মানায় তবে আমি মানতে পারি না।
প্রভা হাত তুলে আঙুল দিয়ে তার হাতে থাকা আটা লাগিয়ে দিল তাওহীদের গালে। তাওহীদের গভীর দু’চোখে চেয়ে বলল,
– খুব না সুপ্রভাকে চেনেন? এই চেনা হলো? আপনি বুঝি জানেন না আমি কেমন। বন্ধু আমরা তাওহীদ। ঝগড়া করব, মারামারি করব, মিটিয়েও নিব। তাই বলে কথা বন্ধ করবেন? অভিমান করেছেন তাই বলে সামনেই আসবেন না? কী লাভ হলো দোকানের আড়ালে লুকিয়ে থেকে। আমি তো ঠিকই দেখেছিলাম আপনাকে।
আচম্বিত প্রভার এমন আচরণে তাওহীদ কিছু বলতে পারে না। তার সময় তো সেই কখনই থমকে গেছে। প্রভা মাথা নিচু করে বলল,
– সবসময় আপনি আমাকে স্পেশাল ফিল করান। আজ আমি নিজে আপনার জন্য রান্না করে আপনাকে স্পেশাল ফিল করাতে চাইছি। স্পেশাল ফিল করলেন কি না বাসায় গিয়ে জানাবেন, কেমন?
তাওহীদের চোখের সেই সরলতা ফিরে পেয়ে প্রভা মৃদু হাসল। ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
– অনেক সময় নিলাম, আর নিচ্ছি না। আপনি যান, আমিও যাই।
প্রভা দ্রুত পায়ে এক দৌড়ে ঢুকে গেল গেটের ভেতরে। তাওহীদ ঘাড় বাঁকিয়ে মূর্তির মতো চেয়ে রইল সেদিকে। চেয়ে রইল ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত শোনা যায় প্রভার পায়ের আওয়াজ।
_____
প্রভা শঙ্কিত হয়ে বসে আছে মাহমুদার শিয়রে। চোখ-মুখে ফুটে আছে তীব্র শঙ্কার, ভয়াবহতার ছাপ। ঘরে পৌঁছে সে, নিশী আর মাহমুদা মিলে প্রভার বানানো নাস্তা খেয়ে তিনজনে সাধারণ আলাপ করছিল। টুকটুক করা আলাপের মাঝেই মাহমুদা চলে গেলেন তার গুরুত্বপূর্ণ একটি কলে। প্রভা, নিশী তখনো খেতে ব্যস্ত। বেশ অনেক্ষণ বাদে নিশীর সঙ্গে একটি মুভি দেখা অবস্থাতেই উঠে গেল প্রভা। রান্নাঘরে গিয়ে ব্যবহৃত হাঁড়িপাতিল পরিষ্কার করা অবস্থাতেই ভেসে এলো নিশীর চিৎকার। প্রভা ছুটে গিয়েই দেখতে পেল মায়ের অবস্থা। মাহমুদা তখন আধো কণ্ঠে বিলাপ করছিল — প্রভা, নিশী কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগতেসে। শরীরে শক্তি পাইতেসি না। চারিপাশ ঘুরতেসে।
বিলাপের মাঝেই জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছিলেন তিনি। প্রভা দ্রুতভাবে এসি অন করে মায়ের পাশে বসে। নিশীকে বলল বাবাকে ফোন করতে। নিশী ছুটে চলে গেল। প্রভা মাথায় তেল দিয়ে, মায়ের দাঁতের পাটি দু’হাতে লেগে যাওয়া থেকে আলগা করে। সাথে মালিশ করতে থাকে মায়ের হাত-পা। প্রভা নিজের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে মালিশ করছে মাহমুদার হাত। মুহূর্তেই অস্থির ভঙ্গিতে হাত ছেড়ে এগিয়ে গেল পায়ের কাছে। বুক ভর্তি জমাট-ভয় নিয়ে মালিশ করতে শুরু করে পা। পা মালিশ করা অবস্থাতেই রুদ্ধশ্বাসে ডেকে উঠল নিশীকে,
– নিশী! বাবা ফোন ধরে না?
অন্যরুম থেকে নিশীর গলা পাওয়া গেল। নিশীর ভেতরকার ভয় তার কণ্ঠে প্রকট হলো,
– ফোন তো সেই কখন থেকেই করতেসি। ধরতেসে না, কী করব আপাআ? পাশের বাসাতে যাব আন্টির কাছে?
প্রভা গলা বাড়িয়ে বলে,
– লাগবে না, তুই এখানে আয়।
প্রভার বলার সঙ্গে সঙ্গে নিশী ঘরে মাহমুদার পাশে গিয়ে বসে। প্রভা বিষাদে ভরা ম্লান মুখে বলে,
– তুই আম্মুর মাথায় তেল দিয়ে দে। বাকিটা দেখতিসি।
প্রভা উঠে যেতে গিয়েও ফিরে তাকায়। নিশীর দিকে চেয়ে বিচলিত কণ্ঠে সাবধান করে,
– নিশী, খেয়াল রাখিস আম্মুর দাতের সাথে দাত যেন লেগে না যায়। আমি চিনির পানি আনতেসি।
নিশী অবিদিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছটফটে কন্ঠে বলে ওঠে,
– চিনির পানি! চিনির পানি কেন? চিনির পানি খেয়ে কী হবে এখন?
প্রভা খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলে,
– আম্মুর ডায়বেটিস কমে গেছে। একারণে এমন দুর্বল হয়ে পড়ছে। ডায়বেটিস কমলে মিষ্টি খাইতে হয়।
প্রভা চপল পায়ে বেড়িতে যেতেই মাহমুদার মাথায় ম্যাসেজ দিতে দিতে নিশী গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়। নিশী এতকাল যাবত জেনে এসেছে ডায়বেটিস বাড়ানো উচিত নয়; বেড়ে গেলে শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। নানান অসুখ বাসা বাঁধে। আর আজ কি না তার আপা বলছে ডায়বেটিস কমে যাওয়ায় তার মা অসুস্থ হয়েছে! কী আশ্চর্য ব্যাপার! এরমানে তো এটাই দাঁড়ায় যে — এই রোগ বাড়ানোও যাবে না, কমানোও যাবে না। এরমানে, মৃত্যু পর্যন্ত এই রোগ বয়ে বেড়াতে হবে? নিশীর মস্তিষ্ক শুন্য অনুভব হতেই সে তার মায়ের দিকে তাকায়। মায়ের হাত-পা কাঁপসে। নিশী তার মায়ের হাত শক্ত করে ধরতেই সে লক্ষ্য করে তার চোখ ভরে উঠছে।
দু’চামচ চিনি-পানি মুখে দিতেই ঠোঁটের পাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা পানি। প্রভা ব্যস্ত হয় না। ধীরস্থির হয়ে ধৈর্য নিয়ে পান করাতে থাকে। মাহমুদা সম্পূর্ণরূপে অচেতন হয়নি; কলসির তলার পানির মতো তার মাঝেও তলায় কিছুটা চেতনা রয়ে গেছে। মায়ের নিভু নিভু চোখ দেখে নিশী মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে জানতে চায়,
– এখন কেমন লাগছে, মা?
মাহমুদা উত্তর দিবেন, সেই মুহূর্তে সশব্দে বেজে ওঠে ফোন। নিশী চপল পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফোন নিয়ে ফিরে আসে প্রভার কাছে। রিসিভ করে প্রভাকে দিতেই প্রভা কানে নিয়ে বলে,
– হ্যালো, বাবা?
– হ্যাঁ, বলো প্রভা। এতো ফোন দিলে যে! চার্জ ছিল না। ফোন অন করতেই দেখলাম। সব ঠিক আছে না?
প্রভা নিজেকে স্থির করে বলে,
– বাবা, মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে। আমি আমার রুমে ছিলাম। হঠাৎ নিশী ডেকে বলল, মা নাকি কেমন যেন করছে। এসেই দেখি অস্থির হয়ে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে আছে।
ওপাশ থেকে মিনহাজ অপ্রত্যাশিত কণ্ঠে ব্যস্তভাবে বলে,
– সেকি! হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ কী?
– জানি না। বিকালেও একবার বলছিল শরীর নাকি দুর্বল। জিগ্যেস করাতে তেমন কিছুই বলল না। এরপর একদম পড়ে গেছে রাতে। শরীর ঘাম দিয়ে কাঁপছিল। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল। পরে হাত-পা মালিশ করায়, মাথায় তেল দেওয়াতে এখন একটু চোখ খুলতে পারছে। মনে হয় সুগার ফল হইসিল।
– মিষ্টি জাতীয় খাবার দিসো? না থাকলে চিনির পানি খাওয়াও একটু। এখন কেমন আছে? সুস্থ?
প্রভা চিন্তা চোখে মাকে দেখে বলে,
– না, তবে চোখটা খোলা রাখতে পারছে। চিনি পানি খাইয়েছি, আগের থেকে হয়তো আরোও কিছুটা ভালো লাগবে এখন।
মিনহাজ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
– হ্যাঁ, একটু ভালো লাগলে খাবার খাইয়ে ঔষধ টা খাইয়ে দাও। গতদিন গুলাতে ঔষধ খায় নাই। ঔষ….ও! ঔষধ তো মনে হয় নাই’ও। আমাকে নিতে বলসিল খেয়ালই নাই। প্রভা তাইলে তুমি বাহিরে গিয়ে নিয়ে আসো। ঔষধ ২ টার নাম জেনে যেয়ো।
প্রভা চোখ তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
– ১০ টা ৫০ বাজে, বাবা।
মিনহাজ বোধহয় প্রভার ইঙ্গিতে বিরক্ত হলেন। অধৈর্যে পূর্ণ হয়ে কিছুটা কঠিনভাবে বলে,
– বাচ্চাদের মতো কথা বোলো না। ঢাকা শহরে এটা কিছুই না। তাছাড়া বাহিরে চলাফেরা করতে হয় সাহস জোগাইতে। এখন মা অসুস্থ, এখন তো তোমারই যাওয়া উচিত। না কি সুদূর কুষ্টিয়া থেকে আমি আসব?
প্রভা নিচুচোখে বলে,
– আমি যাচ্ছি, রাখলাম।
প্রভা চোখে-মুখে নিচে যাওয়ার তীব্র অনিহার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে আছে দায়িত্বের ছায়া। প্রভা ওড়না পেঁচিয়ে পাশ টেবিল থেকে ঔষধের বাক্স হাতে তুলে নিয়ে মাহমুদায় কাছে বসে। বেছে বেছে এক প্যাকেট বের করতেই, মাহমুদা দুর্বল হাতে আরেকটি প্যাকেট এগিয়ে দেয়। প্রভা চোখ তুলে বলে,
– এই দু’টো তেই চলবে?
মাহমুদা দুর্বল কণ্ঠে বলে,
– হ্যাঁ। একাই যাবি?
প্রভা নিশীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– হ্যাঁ, একাই যাই। নিশী তোমার কাছে থাকুক। গেলাম আমি।
প্রভা এগিয়ে চলল তার বুকের ভেতরকার খুঁট খুঁট করতে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং অজ্ঞাত কোনো কারণের অনিশ্চয়তা নিয়ে।
চলবে –
_____
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – ষোলো (পরবর্তী অংশ)
_____
বাইরে নিশাচরের অদ্ভূতুরে ফুসফুসে আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলেছে প্রভা। বুকের মধ্যিখানে চলমান ঢিপঢিপ অস্থিরতা। রাত এগারোটা ঢাকা শহরের জন্য তেমন বিশেষ রাত না হলেও, এমন সময়ে সে বাহিরে বেরোতে অভ্যস্ত নয়। গেট পেরিয়ে থেমে যায় প্রভা। ঘাড় ফিরিয়ে একবার আকুল চোখে চায় তাওহীদদের দু’তলা টিনশেডে। মন বলে, তাওহীদ কেন দাঁড়িয়ে নেই বারান্দাটায়? তাওহীদ কেন সবসময়ের জন্যে তার সঙ্গ দিতে এলো না? তাওহীদকে ডাকবে? ইশ! ভুল হলো। সাথে ফোন আনা হয় নি। ওপরে থাকা অবস্থাতেই যদি তাওহীদকে একটিবার কল করতো, তবে বোধহয় তাওহীদকে সঙ্গে নিয়েই যাওয়া যেত। নিজের বোকামিতে আর ভেতরকার অস্থিতিশীল অবস্থার সংমিশ্রণে প্রভার মনটা ছোট হয়ে গেল। এখন ডাকার উপায় নেই। প্রভা আশ্বস্ত হতে চাইল, সে বৃথাই অস্থির হচ্ছে। প্রভা হাঁটতে আরম্ভ করে। গলির শেষ মাথাতে যেতেই অপ্রাকৃতিক ভয়টা আরোও বেড়ে গেল। এতোক্ষণের অস্থিরতা’কে নয়, বরং কিছুক্ষণ আগে নিজেকে দেওয়া সান্ত্বনাকে বৃথা বলে মনে হলো। চারিপাশের গন্ধে কী যেন ভেসে আসছে। বুকের হৃদপিণ্ডকে অদ্ভূত কিছু একটা খুঁচিয়ে চলেছে। তবুও প্রভা থেমে নেই। তার ভেতরকার অনিশ্চিত অস্বস্তি কে দায়িত্ব শব্দটার তলায় পিষে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলল ফার্মেসীর দিকে। গলির শেষের মাথায় চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা থমকে যায় প্রভা। তার সামনে এক রাস্তা, হাতের দু’পাশে দুটো রাস্তা চলে গেছে। ডান পাশের সরু রাস্তা দিয়ে তাকে যেতে হবে তবে বাম পাশের সরু রাস্তা নামক গলির মাথায় আসর জমিয়েছে কিছু উশৃঙ্খল ছেলেপুলের দল। সম্ভবত ক্যারাম খেলছে। প্রভার নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারে তাদের মধ্যকার কয়েকজন ইতোমধ্যে তাকে পরখ করতে শুরু করে দিয়েছে। আর এদের মধ্যকার কিছুজনের সম্পর্কেই যে নিশী তাকে বলেছিল তা আর বোঝার বাকি থাকে না প্রভার। বুকের মধ্যিখানে হঠাৎ হঠাৎ উতলে ওঠা অস্থিরতা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, এখানকার কয়েকজনই প্রায়শই গলির মাথায় দাঁড়িয়ে তাকে, নিশীকেসহ উঠতি বয়েসী, যুবতি মেয়েদের উত্যক্ত করে। নিশী বলেছিল বাবাকে। তবে বাবা কী কিছু বলে নি তাদের? প্রভা হঠাৎই আশ্চর্য হয়ে অনুধাবন করল তার পিছন থেকেই কয়েক জোড়া পায়ের খসখসে আওয়াজ স্পষ্টভাবে বাড়ি খাচ্ছে। প্রভা বিস্ময়ে, হঠাৎ ভয়ে জমে গিয়ে ভাবে আশেপাশে তো তেমন মানুষ ছিল না, পাশের কাঠের কারখানাও তো সেই সন্ধ্যেতেই বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে তো কেবল সরু, নিস্তব্ধ গলি আর বিল্ডিং। এই গলি পেরুলে তবেই সে মেইনরোডে উঠবে। ফার্মেসীর দোকানের সন্ধান পাবে। তবে পায়ের আওয়াজ! সামনে এগুনোর সাহস হলো না। সে জায়গা আরোও বেশি জনশুন্য। প্রভা ঘাড় ফিরিয়ে পিছন ফিরতেই চোখে পড়ল সর্বদা গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন ছেলেকে। প্রভার ভয় আরোও দ্বিগুণ হলো এই ভেবে যে, সে তার বাসা থেকে, বাসার গলি থেকে যথেষ্ট দূরে। এখানে দাঁড়িয়ে না তো সে তার বাসায় ফিরতে পারবে আর না পিছু ঘুরে ছুট লাগাতে পারবে। প্রভা নিজের মধ্যে সাহস জোগাতে গিয়ে খুব একটা সফল হলো না। অনিশ্চিত ভয়, আতঙ্কে জমে গেল তার পুরো দেহ, পুরো মন।
_____
ফ্লোরে বসে উদাম গায়ে টেবিল ফ্যান পরিষ্কার করায় ব্যস্ত তাওহীদ। গলায় ঝুলছে লাল রঙের সাধারণ একটি গামছা। যেখানে কিছুক্ষণ পরপরই কপালের ঘাম মুছছে সে। চাচি বলেছিল ফ্যানটিকে একটু পরিষ্কার করে দিতে। অনেকদিন ধরে ব্যবহার করা হয় না। চাচির অত্যধিক গরম জনিত সমস্যা আছে। গরমকালে তার উপরের একটিতে হয় না। উপরে চলে একটি। পাশে চলে একটি। ফ্যানের তিন পাখা পরিষ্কার করে স্ক্রু লাগাতে ব্যস্ত হলো তাওহীদ। ওমনি ঘরে প্রবেশ করল হাসান। ভরাট পেটে তাওহীদের সরল মুখের উজ্জ্বল হাসি দেখতে দেখতে রসিকতা করে বলল,
– তা ভাই, আজকে সারা রাইত’ই কী তোমার এমনে কইরা হাসার সম্ভাবনা আছে?
তাওহীদ হাতের কাজ রেখে হাসানের দিকে চেয়ে নিজের হাসিকে বিস্তৃত করল। তাওহীদের এমন মুখ ভর্তি হাসি থেকে বুকের মাঝখানে সজোরে একটি ধাক্কা লাগল হাসানের। মাথা নিচু করে মুহূর্তেই অজানায় দৃষ্টি নিয়ে ভাবনায় মশগুল হয় হাসান। সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে বলে,
– আল্লাহ, কোনোভাবে কী এই পোলাডার লগে ওই প্রভা মাইয়াডার লাইন কইরা দেওয়া যায় না? আল্লাহ তুমি দেখো পোলাডার মুখের উজ্জ্বলতা। আল্লাহ, তুমি কেমনে কইরা এই উজ্জ্বল মুখরে আঁধার বানাইবা? একটু কী মায়া হইব না? দেওনা আল্লাহ ওরে। খালি তো একটা মানুষই। আল্লাহ তুমি চাইলে এই দুনিয়াতে কতো মানুষ আসবোও! কিন্তু একটা প্রভার অভাবে যে আমার তাওহীদটা মইরা যাইব, আল্লাহ। একটু নাহয় হইল অমিলের মধ্যে মিল। সবাইরে একইরকম হইতে হইব এমন কী কথা আছে?
তাওহীদ উজ্জ্বল মুখে বলল,
– কই হারাইলেন, হাসান ভাই?
হাসান চট করে নিজের ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। নিজের চিন্তাটুকু বিন্দুমাত্র প্রকাশ না করে হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বলল,
– রাতে খাইলি না কীসের জন্যে?
সাধারণ একটি কথা, তবুও তাওহীদ মুখ ভরে হেসে বলল,
– ইচ্ছে হইলোনা, ভাই।
হাসান এগিয়ে গিয়ে তাওহীদের পাশে বসে শুধাল,
– তা প্রভার দেওয়া খাবার খাইছোস বইলা কী ইহজনমে আর ভাত-টাত মুখে দিবি না? এই জনমটা কী তোর উপবাসে কাটাই দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে না কি?
তাওহীদ মাথা নিচু করে ফ্যানের শেষ স্ক্রু টা লাগাতে লাগাতে বলল,
– কী যে কন, ভাই! আমি তো এমনিতেই খাই নাই। পেট টা ভরা ভরা।
হাসান তাওহীদের মাথায় হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
– পেট কী খাবারে ভরা নাকি মহব্বতে ভরা?
তাওহীদ সহাস্যে উত্তর দিল,
– খাবারের মোহাব্বাতে ভরা।
হাসান ভ্রু কুঁচকে তাওহীদের মুখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিরীক্ষণ করে। এরপর পূর্বের ন্যায় সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
– তাওহীদ আমার মনে হইতাসে খাবারে কিছু আছিল। খাওয়ার পর থিকাই তুই খালি হাসতাছোস। আমি, ইসমাত ও তো খাইলাম। কই আমরা তো হাসতাছি না।
তাওহীদ ফ্যান নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভাবল, হাসানের কথা মিথ্যে নয়। সত্য অর্থেই তার মনটা বেজায় ভালো। আর এজন্যেই মুখে হাসি লেপ্টেই আছে। বিকেলে ঠিক যেমন রুদ্ধকর অবস্থা ছিল, এখন ঠিক তেমনি ফুরফুরে অবস্থা বিরাজ করছে। মনজুড়ে শান্তি শান্তি হাওয়া বইছে। চারপাশের সকল কিছুই হঠাৎ করে স্নিগ্ধ লাগছে। প্রভার দেওয়া খাবারটা যখন সে খেল, প্রতি মুহূর্তে নিজেকে খুব বিশেষ বলে মনে হলো। বুকটা অথৈ খুশিতে থৈ থৈ করে উঠল। তাওহীদের ভালোবাসার মানুষ তাওহীদের মান ভাঙানোর জন্যে, বিশেষ অনুভব করানোর জন্যে কিছু বানিয়েছে — তাওহীদ সেখানে খুশি না হয়ে পারে! এরপর থেকেই কৈশোরের কোনো নব্য প্রেমিকের মতো তাওহীদ হেসে চলেছে। আপনখুশিতে এটা সেটা করে চলেছে। এই যে রাত্রিবেলায় হঠাৎ করে ফ্যান পরিষ্কার করতে বসা’ই তার উড়ো খুশির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাওহীদ ফ্যান নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ফ্লোরে বসা হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– ভাই, আপনে ঘুমের চোক্ষে বেশি ভাবতেসেন। ঘুমে আপনের চোখ লাল হয়ে গেসে। আমারে নিয়া গবেষণা বাদ দিয়া ঘুমাই পড়েন, ভাই।
হাসান কিছু বলবে, তার আগেই রুমে প্রবেশ করতে দেখা গেল ইসমাত কে। মিষ্টি, সরল, গোলগাল মুখে সংকোচে ভরা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিছু বলবে বলবে ভাব, তবে কোথায় থেকে শুরু করবে, মেয়েটা বোধ করি বুঝে উঠতে পারছে না। হাসান কপালে ভাঁজ ফেলে শুধাল,
– তুই এনে?
ইসমাত ধিমে পা এগিয়ে এনে বলল,
– আসলাম, এমনেই।
হাসান খাটে যেতে যেতে বলল,
– এমনেই আইছোস, এখন এমনেই যা গা। ঘুম আসতাছে। ঘুম দিমু।
– ভাই, একটু সিমেন্ট আইনা দিবা আমারে?
কথাটার দ্বারা হঠাৎ’ই ইসমাত একটি অসংলগ্ন আবদার করে বসল।
হাসান কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। এই রাত-বিরেতে কী তার বোন তার কাছে সিমেন্ট চাইল? সে হয়তো ঘুমের ঘোরে ভুল শুনেছে। হাসান শায়িত অবস্থাতেই ঘাড় সামান্য উঁচু করে রূঢ় কণ্ঠে বলল,
– মিন মিন কী করতাছোস? ভালো কইরা ক’ কী চাস?
ইসমাত দু’ পা এগিয়ে এসে হাতের আঙুলে ওড়না মুচড়ো-মুচড়ি করতে করতে সংকোচে ভরা স্বরে বলল,
– সিমেন্ট লাগব এক ব্যাগ।
মুহূর্তে হাসানের ঘুম ঘুম চোখ জোড়া বিরক্তিতে ক্রুদ্ধ হলো। শান্ত শীতল কণ্ঠে বলল,
– রাজ মিস্ত্রির কাম ধরছোস?
ইসমাতের আকুতিভরা চেহারা আরোও করুণ দেখাল। তাওহীদ এতোক্ষণ যাবত নীরবতা পালন করলেও, এবার নীরবতার আসন ছেড়ে বলল,
– ইসমাত, বুঝাইয়া কও ভাইরে। সিমেন্ট কী জন্যে লাগবো তোমার?
– জিনিস বানামু।
তাওহীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কেমন জিনিস?
ইসমাত ব্যথিত মুখে চেয়ে রইল। সে কীভাবে বুঝাবে এখন! কোথায় থেকে শুরু করবে! সে সিমেন্ট দিয়ে নানান নকশার হস্তশিল্পের কাজ করতে চায়। ফুলের টব বানাতে চায়, প্লেট বানাতে চায়, কচু পাতা দিয়ে নকশা করতে চায়। অনেকদিন ধরে ভাবছিল করবে, তবে প্রয়োজনীয় সামগ্রীসমূহর অভাবে করে হওয়া ওঠেনি। ইসমাত নিচুস্বরে বলল,
– ইউটুবে যে ফাইভ মিনিট ক্রাফটস দেখায় না? ওইগুলা বানাব আমি।
হাসান অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
– আমার হাতের চড় খাওয়ার আগে যা, রাইত এগারোটা বাজে তুমি আসছো ফাইভ মিনিট ক্রাফট নিয়া?
ইসমাত অস্থির হয়ে মেঝেতে পা দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে,
– এমন করোস কেন, ভাই? আইনা দে।
হাসান উঠে বসল। মুখ কুঁচকে বলল,
– সবকিছুর একটা সময় আছে না, ইসমাত? রাইত্রেবেলা কী শুরু করলি?
তাওহীদও এবার সান্ত্বনা দিতে চাইল,
– হ্যাঁ, হাসান ভাই ঠিক বলতেসে। কাল আনলে হবে না?
কাঁদোকাঁদো হয়ে ইসমাত নাকোচ করল,
– নাহ, হবে না। দিনের বেলায় সিমেন্ট আনতে দেয় না। আমি চাইসিলাম। বকা দিসে।
তাওহীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
– কে বকা দিসে?
– ওই মিস্ত্রিরা। সামনের গলিতে নতুন বাসার কাজ হইতেছে না? ওইখানে সিমেন্ট চাইছিলাম, দেয় নাই। বলে কি না, এতো টাকার সিমেন্ট দিবে না। না দিসে না দিতো, আমারে ধমক দিলো কী জন্যে? এইজন্যে আমি চাই ওইখান থেকে এক বস্তা সিমেন্ট চুরি করতে। বলদা মিস্ত্রিরা ওইগুলা বাইরে রাইখাই চলে যায়; আমি সকালে নামাজ পড়ে হাঁটতে গিয়ে দেখসি। আইনা দেন না, ভাই।
ইসমাত এইবার তাওহীদের পিছু পড়ল। তাওহীদ একবার হাসান একবার ইসমাতের দিকে চেয়ে বলল,
– আজকেই লাগব, ইসমাত?
হাসান খ্যাঁক করে উঠল,
– এই তাওহীদ! রাখ তো ছাতার মাথার কথা। রাত এগারোটায় নাকি যাইব সিমেন্ট চুরি করতে!
ইসমাত তৃষ্ণায় বুক ফাঁটা পথিকের ন্যায় আকুতি ভরে বলল,
– দেন না, ভাই।
তাওহীদ বলল,
– কাল দিলে চলব না?
ইসমাতের অস্থিরতা বেড়ে গেল। হড়বড় করে বলল,
– না, তাওহীদ ভাই। আজকেই লাগব। আমার এখনই করতে মন চাইতেসে। আমার সবসময় সবকিছু ভালো লাগেনা। যখন ভালো লাগে তখন করি। অন্যসময় হাজার জিনিসপত্র পইড়া থাকলেও আমার আগ্রহ আসে না। আইনা দেন, ভাই।
তাওহীদের মন আজ ভালো। ভালো ছিল না, প্রভার এমন মর্মস্পর্শী প্রচেষ্টায় মন ভালো হতে বাধ্য হয়েছে। তৃপ্ত মনে দুনিয়ার ভীষণ তুচ্ছ কাজেও আনন্দ খুঁজে নেওয়া যায়। তাওহীদের বেলাতেও বোধহয় তাই ঘটল। গামছায় কপাল মুছে বলল,
– যাইতেসি, ইসমাত। হাতটা ধুয়েই যাইতেসি।
তাওহীদ হাত ধুয়ে অগোছালো আলনা থেকে একটি চাদর তুলে নেয়। তা দেখে ইসমাত বলে,
– এই গরমে চাদর দিয়ে কী হবে, ভাই?
তাওহীদ বদ্ধ গরমের প্রতি তীব্র অভিযোগ থেকে বলল,
– এই গরমে আর শার্ট-গেঞ্জি পরতে মন চাইতেসে না। চাদর গায়ে জড়াই যাই। এইখানেই তো। আমাদের গলির পরের যে লম্বালম্বি গলি গেছে তার ডানদিকের গলির বাসাটা না?
ইসমাত সম্মতি জানাল,
– হ্যাঁ, ভাই।
ঘুম ঘুম চোখে হাসান বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
– সত্যিই তুই যাইতেছোস?
তাওহীদ ফিরে তাকিয়ে সহাস্যে বলল,
– যাই, ভাই। সমস্যার কী? এক বস্তা সিমেন্ট’ই তো। তাছাড়া আমাগো ইসমাত রে ধমক দিলো, আমরা কিছু করব না?
হাসান আচমকা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
– করুমনা কে কইসে! কালকে যাইয়াই সবকয়ডা মিস্ত্রির গাল ফাটামু।
তাওহীদ হেসে ফেলে বলল,
– ওইটা কালকের হিসাব। আজকে ওরে সিমেন্ট আইনা দেই।
বলেই ইসমাতকে স্নেহসুলভ হাসি উপহায় দিয়ে বেরিয়ে গেল তাওহীদ।
_____
প্রভা জড়ীভূত হয়ে দেখছে তার সামনে দাঁড়ানো তিনজন উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির মানুষদের। এতোক্ষণে বুকের ভেতরে হতে থাকা ধুঁক ধুঁক ভয় কে সত্যি করতে তিনজনের মাঝ এগিয়ে এলো একজন বলবান যুবক। দু’চোখ ভর্তি ক্রুরতা, অথচ হাসিমাখা মুখে বলল,
– আসসালামু আলাইকুম, আপু।
এমন বিকৃত, অস্বাভাবিক চোখের দৃষ্টির সঙ্গে সালামটা ঠিক গেল না। প্রভা হাঁসফাঁস করে উঠল। শ্বাস নিয়েও বোধ হলো আরোও একটু শ্বাস নেওয়া প্রয়োজন। আসন্ন বিপদের আভাসে কেঁপে উঠল হৃদয়। মহান সৃষ্টিকর্তার অকল্পনীয় রহমতে এমন কোনো পরিস্থিতিতে সে আগে পড়ে নি। কেমন করে মোকাবেলা করে জানা নেই। মুহূর্তেই আবার নিজের চিন্তায় নিজেই অসন্তুষ্ট হলো প্রভা। কোনো মেয়ের জীবনেই নিশ্চয় বলে কয়ে বিপদ আসে না। নিশ্চয় বলে না, শোনো মেয়ে, আমি বিপদ। আজকে আমি তোমার কাছে এসেছি। আমাকে গ্রহণ করো। প্রভা নিজের জমাট বাঁধা বুক থেকে আরেকটু শ্বাস নিয়ে চারদিকে নিজেকে বাঁচানোর একটুখানি আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত হলো। ছেলেগুলো নিজে থেকে চলে গেলে তো ভালোই, না হলে নিজের জন্যে শেষ রক্ষার চেষ্টাটুকু তো করতে হবে।
ছেলেটি হাসিমাখা মুখে বলল,
– তা আপু, আমরা নাকি আপনারে খুব বিরক্ত করি?
সামনের জনের কথায় পেছনে থাকা দু’জনের মাঝে একজন সশব্দে হেঁসে বলল,
– না, না রাজীব ভাই। আপনি ব্যাপারটা বুঝতেসেন না। আপু শুধু নিজের জন্য বলে নাই। আপু সবার কথাই বলসে। আমরা নাকি এলাকার যুবতি মেয়েদের টিজ করি। উনার বাপ তো আমাদের তাই বইলা গেল কাঁধ চাপড়াইয়া। আমাদের জন্য নাকি মেয়েরা নিজের সুবিধা মতো চলতে পারে না।
সামনে থাকা রাজীব পেছনের ছেলেটার কথায় অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে শুধাল,
– শুধু কী কাঁধ চাপড়াইসে, আমিন? আর কিছু করে নাই আপুর বাবা? আমার তো মনে আসতেছে না ঠিক।
এবার অন্য ছেলেটি হিংস্র মুখে এগিয়ে এসে অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে দিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল,
– করে নাই মানে! কতো বড় বুক হইলে এলাকার নেতার গায়ে হাত দেয়! দেয় তো দেয় আবার কলার ধইরা শাসায়!
রাজীব এগিয়ে আসা ছেলেটি কাঁধে হাত রেখে কপটতা নিয়ে বলল,
– আহা, মামুন! আপুর বাবা তো ভুল কিছু করে নাই। আমারে কাঁধ চাপড়িয়ে বুঝানোর পরে আমি ত্যাদড়ামি কইরা বলসিলাম, আমি আপনার মেয়েদের কীভাবে বিরক্ত করি আংকেল? ওড়না ধরে টান মারসি নাকি জড়িয়ে ধরে চুমু খাইসি? কথাটা আংকেল এর ভালো লাগে নাই। ব্যাস, একটু রাগ করসে। তাই বলে আমরা তো রাগতে পারি না। ছোট হিসেবে আমাদের উচিত ছিল আংকেল এর কথা শোনা। আংকেল বলসে এলাকা ছেড়ে দিতে। আমি যতোই সহ-সভাপতি হই না কেন, ক্লাবের নেতা হই না কেন, আমি ছেড়ে দিব। কোনো সমস্যা নাই আমার।
মামুন হিংস্র, অধৈর্য, জানোয়ারের মতো ফোঁসফোঁস করে উঠল,
– মাগীরে আগে একটা শিক্ষা দিয়া নে।
রাজীব ধমকে উঠল,
– মামুন, মুখ খারাপ করিস না। আপু বল। আমরা উনাকে সম্মানের সঙ্গে অসম্মানিত করব। আশা করি, আপুও আমাদের সাহায্য করবে।
কথাগুলো এতো দ্রুত চলে যাচ্ছে যে প্রভা নিজের অনুভূতি, বোধশক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। শুধু মনে হচ্ছে, কানটা সেই তখন থেকেই ঝাঁ ঝাঁ করছে। এতোসব ঘটনা তো তার জানা ছিল না। সে শুধুমাত্র নিশীকে বলেছিল বাবার কাছে সব খুলে বলার জন্যে। আর বললেও এখানে তো তার বা তার বাবার কোনো দোষ নেই। প্রভা এদিক-ওদিক ফিরেও যখন ধুলো জাতীয়, লাঠি জাতীয় কিছু পেল না প্রভার দুনিয়াটা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে এলো। বড্ড ভুল হলো! সবদিক থেকেই বড্ড ভুল হলো। না সঙ্গে নিয়ে এলো তাওহীদকে, আর না পরে এলো হিজাব। রাত হওয়ায় ওড়না টা কেবল মাথায় পেঁচিয়ে এসেছে। সঙ্গে আলপিন জাতীয় কোনো বস্তুও নেই। প্রভা হটকারিতায় করে বসল নতুন আরেকটি ভুল। দিক-বিদিক চিন্তা না করে দৌড়ে ঢুকে গেল বাম দিকের গলিতে।
শেষ রক্ষা হলোনা। রাজীব দানবীয় পায়ে এগিয়ে এসে চুল টেনে ধরে, বিশ্রী গালি দিল প্রভাকে,
– শালী! পালাবা তুমি?
মামুন, আমিনও এগিয়ে এলো। তাদের চোখ-মুখেও ক্রোধের-উন্মাদনা। আমিন বলল,
– কই নিয়া যাবি, এরে?
রাজীব প্রভার চুলের মুঠি আরেকটু শক্ত করে টেনে বলল,
– কই আবার? ওই যে দুই বিল্ডিং এর চিপায় নিয়ে আদর করব, আপুরে। আপুও মনেহয় আমাদের আদর চাইতেসে। তাই না, আপু? তাই তো নিজে থেকেই এইদিকে দৌড় মারলেন?
এক হাতে প্রভার চুলের মুঠি ও অন্য হাতে প্রভার চোয়াল শক্ত করে ধরা। এমন হিংস্রস্পর্শে প্রভার চোখ গলিয়ে নীরবে ধারা বইছে। নীরব কণ্ঠে ক্রোধ মিশিয়ে বলল,
– আমাকে যেতে দিন।
প্রভার কথায় রাজীবের চোখ আরোও বেশি জ্বলে উঠল। শক্ত চোয়ালে, ক্রুর চোখে প্রভার শরীর থেকে ওড়না টেনে নিল। মুখে, ঠোঁটে, গলায় হাতের কদর্য স্পর্শে প্রভার শরীরের একেকটি অঙ্গ জমাট বেঁধে গেল। উদ্ভ্রান্তের মতো চোখ নিয়ে খাবলে ধরলো রাজীবের মুখ। উদ্দেশ্য যদি মুক্তি মেলে। সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচাল,
– কেউ আছেননন? আছেন কেউউউ? এই কুত্তার বাচ্চাদের থেকে আমাকে রক্ষা করুউন। আমাকে সাহায্য করুন।
রাজীবের মুখে হামলা, চিৎকার এর মাঝেই রাজীব প্রভার কাঁধে ঘাড়ে হাত রেখে তাকে আছড়ে ফেলল সামনে দেয়ালে। এগিয়ে গিয়ে আওয়াজ তুলে বসিয়ে দিল এক থাপ্পড়। এক হাতে মুখ চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
– আমার হাত থেকে বাঁচবি? এতো সহজ সবকিছু? এই হাত কোনো আনাড়ি হাত না। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হাত। কতো মেয়েরে আদর করসি এই হাতে। কতোজনরে গলায় যাতা মারসি এই হাতে। ওই! এইটার মুখ চাইপা নিয়া আয়। কুত্তার লগে তুলনা করসে না, একটু কুত্তারমতো আচরণ কইরা দেখাই যে কেমন লাগে।
কথার সাথে সাথে শরীরে নানান জায়গার স্পর্শে প্রভা নিস্তেজ হয়ে জমে গেল। রাজীবের কথার মাঝেই পেছনে একজন গিয়ে তার মুখ সর্বশক্তিতে চেপে ধরে অন্যজন তার পা তুলে…না ভুল হলো। তার জানুভাগে বিকৃত স্পর্শ সমেত এগিয়ে চলল। প্রভা ছটফটিয়ে উঠে নিজের হাত ছাড়াতে চাইছে। চোখের উত্তপ্ত, উষ্ণ চোখের পানি কান পেরিয়ে চলে যাবার মুহূর্তে হঠাৎ করে কানে বেজে উঠল তাওহীদের কণ্ঠ — সুপ্রভা, আপনি অনেক দামী।
প্রভা চক্ষু চিপে বন্ধ করে শরীরের সর্বশক্তিতে দিয়ে ছুঁটতে গিয়ে ধনুকের ন্যায় বেঁকিয়ে উঠল। তবে পরিস্থিতি তার সহায় হলো না। মাঝে থেকে শুনা গেল আরোও দু’টো অশ্রাব্য গালি। শ্বাস ছেড়ে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মাঝেই বুকের ভেতর জমাটবাঁধা শ্বাসে মৃত্যু হবে প্রভার। মৃত্যু হবে? হোক না…. দেরি কেন! প্রভাও বাঁচুক এমন নরক যন্ত্রণা থেকে।
প্রভা ঝাপসা চোখে দেখল একটা বদ্ধ চিপায় আনা হলো তাকে। সামনেই রাজীবের মুখ জুড়ে ফুটে আছে বিশ্রী, দুনিয়ার সবচাইতে নোংরা হাসি।
মামুন চেপে রাখা মুখ এবং ধরে রাখা হাতে রাজীবকে বলল,
– কী? কাম শুরু কর। এই শালীরে তিনজনে আয়েষ মিটিয়া আগে খাইয়া তারপর গলির মাথায় ফালায় রাইখা যামু। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর সবাই দেখব রাস্তায় ওর ছেঁড়া শরীর। তাড়াতাড়ি কর।
মামুনের কণ্ঠে ঝড়ে পড়ছে পৈশাচিক উত্তেজনা। হিংস্র, জ্বলে ওঠা মামুনকে আরোও উত্তেজিত পরামর্শ দিল রাজীব। বলল,
– ওড়না ফালায় রাইখা আসছি না, নিয়া আসতাছি। ওড়না দিয়া মুখ বাইন্ধা তিন জনে এক সাথে শুরু করি।
প্রভা দু’পাশে মাথা নাড়াতে নাড়াতে ছটফটিয়ে উঠল। তা দেখে আমিন বলল,
– ওই দেখ, শালি না করতাছে। ও মনে হয় চাইতেছে, একে একে শুরু করি।
আমিনের কথায় তিন মানুষ নামক জন্তু হেসে উঠল দুনিয়া কাঁপিয়ে। তাদের হাসির হিংস্রতায় আকাশ, বাতাস নিস্তেজ হয়ে পড়ল। দূরে সরে গেল এই দুনিয়ায় বিদ্যমান সকল পবিত্রতা, মানবতা, ভালোবাসা। আর সহ্য হলো না। আর না। ফ্লোরের সাথে মাথা জোরে ঠুকতে শুরু করল প্রভা। প্রভার এমন আচরণে মামুন ধমকে উঠল প্রভাকে। অন্যদিকে আমিন পা ধরে রেখে বলল,
– পা কী ধইরা রাখার দরকার আছে?
মামুন না বোধক মাথা নাড়াতেই আমিন ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে এলো। প্রভার শরীরে লালুষ্য ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিজের চোখের মাধ্যমেই সে একবার ধর্ষণ করে নিল প্রভাকে। প্রভা ঝাপসা চোখে তা দেখে অদূরে চেয়ে রইল। শরীরের সঙ্গে আর যাচ্ছে না। এমনটাতো হওয়ার কথা ছিল না। দুঃস্বপ্নের মতো এইসব কী ঘটছে তার সঙ্গে? দুঃস্বপ্নের তো শেষ হয়। তবে এই দুঃস্বপ্নের শেষ কোথায়? কেন প্রভা জেগে উঠছে না ঘুম ছেড়ে? তাদের মধ্যকার একজন গেছে ওড়না আনতে। এই তো…এরপরেই প্রভা হারিয়ে ফেলবে সবকিছু। চিরকাল বেঁচে থাকবে একটা নোংরা মানুষ হিসেবে। যার দিকে কেউ চাইবে সহানুভূতি নিয়ে, কেউ চাইবে চক্ষুকোল ভর্তি তাচ্ছিল্যতা নিয়ে। আচ্ছা, ওরা কী ওকে বাঁচিয়ে রাখবে? নাকি নিজেদের তৃপ্তি মিটিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলবে? মেরে ফেললে ভালো হয়। অপবিত্র আত্মা নিয়ে বাঁচা যায় না। ওরা তো শুধু ওর শরীরে হাত দেয় নি। দিয়েছে আত্মায়। এই যে পুরো শরীরকে নিজের কাছে আবজর্না মনে হচ্ছে, পুরো শরীরে হাতের স্পর্শ বোধ হচ্ছে এই নিয়ে কী আর বাঁচা যায়? এর চেয়ে নাহয় নীরবে ঝরে পড়ুক ফুটে ওঠার আগেই। এতো এতো নোংরা, কামনায় পূর্ণ চোখের মাঝে তাওহীদের টলটলে সরল দুটো চোখ বড্ড মনে পড়ছে। মানুষটার আচার-ব্যবহারে, কথায়, অঙ্গভঙ্গিতে প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দিত প্রভা কতোটা সম্মানিত একজন। প্রভার বড্ড মন চাইলো এক ছুটে তাওহীদের বুকে মাথা রাখতে। তবে কী ওর কুলষতা একটু মিটবে? আচ্ছা, ওকে যদি বাঁচিয়ে রাখা হয় তবে তাওহীদের চোখে ও চোখ মেলাবে কেমন করে? প্রভার জন্য তখনো কী তাওহীদের মনে সম্মান বেঁচে থাকবে? নাকি সবার মতোই তাওহীদও ওকে ঠেলে দেবে অতল আঁধারে? প্রভা আরোও কিছু ভাবার আগেই এগিয়ে এলো রাজীব। দু’চোখে শিকার করার তৃষ্ণা নিয়ে ওড়না এগিয়ে এনে বলল,
– হাত সরা, মুখটা বাঁইধা আয়েশ কইরা কাম সাড়ি।
মামুন হাত সরানোর ক্ষণকাল মুহূর্তেই প্রভা তার শেষ চেষ্টাটুকু করল। আবছা এক আশা। যদি কেউ বাঁচাতে আসে! গগনবিদারী চিৎকারে আরোও একটু করুণ, আরোও নিস্তব্ধ শোনালো চারিপাশ। দূরের অল্প একটু আকাশ, বাতাস সবকিছু যেন মাথা নত করে নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করল। মুহূর্তেই পুরুষালী শক্তিতে পেটের মাঝে সজোরে এক লাথি বসাল রাজীব। ক্ষিপ্র গতিতে হিসহিসিয়ে বলল,
– গলার জোর কমে না? এখনো দেখি বড্ড বেশি জোর।
পেটে মাঝে আঘাতের তীব্রতার চারদিকে আঁধার দেখল প্রভা। চিৎকার করেছিল শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। চিৎকার টা দেওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, খসখসে গলা বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে। সেই মুহূর্তে এমন আঘাত আর সহ্য হলো না। তার মুখ বাঁধা শেষে হাতও বেঁধে ফেলা হলো। এক টানে জামার গলা থেকে আরোও বিস্তৃতভাবে ছিঁড়ে ফেলল রাজীব। পাশের দু’জনের একজনের হাত জানুভাগে। অপরজন হাত প্রভার মুখে ঘুরছে। প্রভা আরোও নৃশংস, করুণ, অপার্থিব যন্ত্রণা অনুভবের আগেই আচম্বিত শুনতে পেল গগনবিদারী এক চিৎকার। মুহূর্তে তার শরীর থেকে ক্রমেই সরে গেল একেক জোরা হাত। এক জোড়া গেল, দ্বিতীয় জোড়া গেল, তৃতীয় জোড়াও সরে গেল। শরীরে আর কোনো হাতের স্পর্শ না পাওয়াতে এক মুহূর্তে একটু প্রাণে পানি এলো প্রভার। তক্ষুনি শুনতে পেল আরেক চিৎকার। প্রভা দেখল তার মাথার কাছে যে বসে ছিল প্রভাকে ডিঙিয়ে সেও চলে গেল। প্রভা বোধজ্ঞানহীন মস্তিষ্কে কেবল দেখতে পেল একজন মানুষের ক্ষিপ্রগতির প্রহার। দেখতে পেল একজন নিজের মনের শখ মিটিয়ে কী নিদারুণ হিংস্রতায় মারছে তার সামনের দু’জনকে। প্রভা যে তিনজন পশুর থেকে বেঁচে গেল — তা নিয়ে ওর মাঝে তেমন বোধখুশি দেখা গেল না। পেটের চিনচিনে ব্যথা, মাথাভর্তি আতঙ্ক নিয়ে বাঁধা হাতেই ধীরে ধীরে উঠে বসল প্রভা।
নিশ্চল চোখে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখল সামনের মানুষটার অস্থিরতা। দু’জনকে মনের সবটুকু দিয়ে আঘাত করে চলেছে মানুষটা। ইতোমধ্যে মাথায় হাত রেখে রক্তাক্ত অবস্থায় নিচে পড়ে আছে একজন। প্রভা আশ্চর্য বিস্ময়ে দেখছে তার নরম, সরল প্রাণের তাওহীদকে। হাতে ধরা একটি শাবল জাতীয় বস্তু দিয়ে নির্বিকারে তার ভেতরকার পপরাক্রমশালী তেজ দেখিয়ে চলেছে। প্রভা হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে, শুন্য মস্তিষ্কে দেখল মাথা ধরে পড়ে থাকা ছেলেটি রক্তাক্ত মাথায় দৌড়ে চলে গেল জায়গা ছেড়ে। তাওহীদ টলটলে লালাভ চোখে রাজীবের পেটে সজোরে কয়েকটা লাথথি বসিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো আঘাত করতে লাগল। ইতোমধ্যে প্রভা দেখল সেই দু’জনের রক্তাক্ত মুখশ্রী। শাবলের একেকটা আঘাতে কী নিদারুণ করুণ কণ্ঠসর বেড়িয়ে আসছে তাদের গলা ছেড়ে। অথচ প্রভা তেমন বিচলিত হলো না। মনে হলো যেন আকাশ-বাতাসও উপভোগ করছে সেই করুণস্বর। প্রভার বোধ হলো তার জমাটবাঁধা শ্বাস যেন ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছে। এতোক্ষণের ক্লান্তিতে শুকিয়ে যাওয়া চোখ আবারো ভরে উঠছে। সামান্য বোধজ্ঞান ফিরে পেতেই প্রভা নিজের দিকে তাকাল। নিজের শরীরের বাহ্যিক দৃশ্যে প্রভার মুখ লজ্জায়, ঘৃণায় শুকিয়ে গেল। তার পরিহিত জামার গলা ধরে ছেঁড়ার কারণে বুকের লজ্জাস্থানের অংশ দৃশ্যমান। প্রভা নিজের হাঁটু এগিয়ে পুরো শরীর মুড়িয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল। এ কীরকম জীবন তার! একি করুণ পরিস্থিতি!
আচম্বিত পেছন থেকে আঘাতে পিচিয়ে গেল তাওহীদ। পিছিয়েও তেমন একটা অসুবিধা হলো না। সিংহের পিছিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া নয়, বরং পূর্বের তুলনায় দশগুণ হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়া। তাওহীদ’ও হিংস্র গতিতে এগিয়ে শাবলের শেষ আঘাত করল পেছনে থাকা ছেলেটির পায়ে। ছেলেটি রক্তাক্ত শার্টের হঠাৎ আঘাতে পায়ের মাংস ঝুলে পড়ে হুমড়ি খেয়ে থুবড়ে পড়ল।। তবে জানের ভয় বোধহয় জন্তুরও থাকে। হুমড়ি খেয়ে পড়েও উঠে গিয়ে জান হাতে পালাল সে। বাকি দু’জন সুযোগ বুঝে আগেই নিজেদের জান বাঁচাতে পালিয়েছে।
জায়গা ফাঁকা পেয়েও তাওহীদ শান্ত হয় না। আছড়ে পড়া শ্বাস ফেলত না ফেলতেই বুক ভারি হয় দীর্ঘশ্বাসে। আশেপাশে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে ঘুরে কাউকে না দেখে যেন তাওহীদের হিংস্রতা মেটানোর তৃষ্ণা আরো বৃদ্ধি হলো। গগনবিদারী চিৎকারে মুখ ঢেকে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থাতে হিংস্র জানোয়ারের মতো হিসহিস আওয়াজ শোনা গেল তার মুখ থেকে। এরপর….এরপর মুখ থেকে ধীরগতিতে হাত সরিয়ে লালাভ, টলটলে চোখে চাইল দূরে বসা মুড়িয়ে থাকা প্রভার দিকে। তাওহীদ এসেছিল নব্য তৈরি দালানের সামনে থেকে ইসমাতের অনুরোধ অনুযায়ী সিমেন্ট নিতে। সিমেন্টের বস্তা তোলা অবস্থাতেই তার হৃদপিণ্ড কেমন যেন বদ্ধ পাখির মতো ছটফট করছিল। মনে হচ্ছিল, কোথাও কিছু ঠিক নেই। নিজের ভাবনার মাঝেই পিছনে কারোর অস্তিত্ব বুঝে তাকাতেই দেখেছিল একজন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। যে কি না এগিয়ে এসে একটা ওড়না তুলে এগিয়ে যাচ্ছিল। তাওহীদ ওড়নার দিকে ক্ষণকাল তাকাতেই মস্তিষ্ক চিড়িক দিয়ে উঠল। ওড়নাটা তার চেনা। কিন্তু ওড়নাটা….মুহূর্তেই শোনা গেল কারোর অসহায়ত্বের, নির্ভরহীন, করুণ গলার চিৎকার। যে চিৎকার ছলকে উঠেছিল তাওহীদের শরীরের রক্ত। কিছু না ভেবে এগিয়ে যেতে চোখ পড়ল তার সুপ্রভার পেটে দেওয়া লাথিটা। তাওহীদ ভুলে গেল নিজেকে, ভুলে গেল এই পৃথিবীকে। আহত বাঘের ন্যায় চোখ বুলিয়ে এক দৌড়ে নিয়ে এসেছিল সদ্য তৈরি হওয়ার বিল্ডিং এর সামনে থাকা শাবলটিকে। এরপরই দেখিয়ে দিল তার প্রভাকে, তার সুপ্রভার গায়ে হাতে দেওয়ার পরিণাম। দেখিয়ে দিল নিজের হিংস্রতা। দেখিয়ে দিল তার সুপ্রভার পবিত্রতা।
তাওহীদের গায়ে জামা ছিল না। অনেক আগেই গায়ে জড়ানো চাদর তার হিংস্রতায় ঝরে পড়েছে। তাওহীদ প্রভার দিকে কিছু কদম গিয়েও, স্থবির পায়ে বিপরীত দিকে গেল। সামান্য ক্ষণ চোখ বুলিয়ে তুলে নিল নিজের চাদর। নিস্তেজ পায়ে হেঁটে এসে ভীষণ যত্নে সে মুড়িয়ে দিল তার প্রভাকে। পেছনে গিয়ে নীরবে ছাড়িয়ে দিল প্রভার হাত। মুহূর্তেই তাওহীদের শক্ত চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে গেল এক ফোঁটা উত্তপ্ত অশ্রু। গলাটা ব্যথা করছে। তবুও নিজেকে বৃথা আশ্বস্ত করে বলল,
– বাড়ি চলেন।
তাওহীদের কণ্ঠে প্রভা নিজের গায়ের চাদর নিয়ে আরোও একটু মুড়ে গেল। প্রভার থরথর করে কাঁপা শরীরটিকে ভীষণ যত্নে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হলো তাওহীদের। তবে সে তা না করে আবারো বলল,
– উঠুন, প্রভা। কেউ নেই। আমি সবাইরে সরিয়ে দিসি।
প্রভার সাথে হওয়া ঘৃণ্য ঘটনার ছায়া তখনো প্রভার দু’চোখ জুড়ে দৃশ্যমান। তাওহীদ ধীরগতিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। প্রভা উঠে দাঁড়াল সময় নিয়ে। পেটের মাঝে তীক্ষ্ণ ব্যথায় মুড়ে গেল সে। এরপর মুখ উঠিয়ে তাকাল তাওহীদের দিকে। তাওহীদ তার দৃঢ়, অনড় চোয়ালে, জ্বলজ্বলে চোখ দেখল প্রভার মুখে ফুটে থাকা লজ্জাকে, দেখল একটি নারীর অসহায়ত্বকে, দেখল সমাজের কিছু কাপুরুষের নিজের পুরুষত্বের অপব্যবহারকে। তবুও তো সমাজ নারীকেই দোষে। কখনো কোনো পুরুষের দোষ হয় না। তারা এমনভারে পার পেয়ে যায় যেন ধর্ষণ করা তাদের জন্মগত অধিকার।
তাওহীদ হাত এগিয়ে ধরল প্রভার হাত। এরপর প্রভাকে নিয়ে বসাল একটি স্থানে। উঠে গিয়ে যৎসামান্য দূর থেকে নিয়ে এলো প্রভার জুতোজোড়া। সযত্নে পরিয়ে দিল সে জুতো। এরপর প্রভাকে, পরিস্থিতিকে, সেখানে থাকা সকল প্রাণী-উদ্ভিদ জড়বস্তুকে বিস্মিত করে চুমু খেল প্রভার দু’পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে তাওহীদের গাল বেয়ে গড়িয়ে গেল আরোও দু’ফোঁটা অশ্রুজল। সময়ে নিয়ে চুম্বন করে লালাভ, জল ভরা চোখ নিয়ে প্রভার চোখে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বলল,
– আর যেন কক্ষনো নিজেরে ঘেন্না করতে না দেখি। আপনার কিছু হয় নাই, সুপ্রভা। আমি হতে দেই নাই। একটু হয়তো দেড়ি করসি। তাও আল্লাহ আমারে সব শেষ হওয়ার আগেই পাঠাই দিসে আপনার জন্যে। আপনি এখনো ঠিক ততোটাই পরিষ্কার, ততোটাই পবিত্র ঠিক যতোটা আগে ছিলেন। আপনার কিচ্ছু হয় নাই, সুপ্রভা। আপনি এখনো সেই স্বচ্ছ, কোমল একজন নারী যে সুন্দর। যে সকালের মতো সুন্দর। যে নিজের পবিত্র আলো দিয়ে সবাইরে আলোকিত করে। তাইতো আপনি সুপ্রভা। আমার সুপ্রভা। আমার সকাল। আমার সুন্দর, পবিত্র সকাল।
আকম্পিত কণ্ঠে, থরথরে কাঁপা ঠোঁট নিয়ে নিজের কথা শেষ করে প্রভা পায়ে নিজের মাথা ঠেকাল তাওহীদ। শান্ত হচ্ছে না। কোনোমতেই হৃদপিণ্ড শান্ত হচ্ছে না। রক্তের বেগ কমছে না। রক্তের মাঝে টগবগিয়ে কী যেন ফুটেই চলেছে। প্রভা হাত এগিয়ে তাওহীদের মাথায় রেখে বলল,
– আপনার কপাল থেকে রক্ত পড়ছে, তাওহীদ।
প্রভার কথায় তাওহীদ স্তম্ভিত ফিরে পেয়ে নিশ্চুপে উঠে দাঁড়াল। ঘাত-প্রতিঘাতের সময় হয়তো লেগেছিল কোনোভাবে। সে দিকে চিন্তা না নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– বাসায় যান, সুপ্রভা। রাস্তা ফাঁকা আছে। মুখ ঢাইকা চইলা যান।
প্রভা উঠে দাঁড়িয়ে করুণ কণ্ঠে অনুনয় করল,
– তাওহীদ আপনি…
তার আগেই আরোও বেশি গম্ভীর কণ্ঠে এক প্রকার আদেশ করল তাওহীদ,
– আপনারে যাইতে বলসি সুপ্রভা।
তাওহীদের এমন স্বরে থমকে গেল প্রভা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলল কয়েক কদম। ভয়, আতঙ্কের আবহ এখনো মুছে যায়নি। ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাওহীদের দিকে তাকাল প্রভা। তাওহীদ তখনো ঠায় দাঁড়ানো। প্রভা সামনে ফিরে আরেক কদম এগুনোর পূর্বেই তাওহীদ ডাকল,
– সুপ্রভা!
প্রভা থেমে যেতেই, তাওহীদ এগিয়ে গিয়ে প্রভার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
– আপনার জীবনে আমি নামক বন্ধুর যদি কোনো মূল্য থাকে, তবে আজকের ঘটনা কক্ষনো কাউরে জানাবেন না, সুপ্রভা। কাউরেই না। কেউ আমার সুপ্রভার দিকে আঙুল উঠাইবো, তারে খারাপ বলব এইটা আমি বাঁচাকালীন শুনতে চাই না।
প্রভার চক্ষু বেয়ে চলা অশ্রুপাত সমেত সে মাথা নাড়িয়ে তাওহীদের কথাটা গ্রহণ করল। দু’ কদম হাঁটতেই আবারো শুনল তাওহীদের কোমল স্বর,
– আপনি ভয় না পাইয়া যান, সুপ্রভা। সামনে কেউ নাই। আমি আপনার পিছু পিছু আসতাছি। আল্লাহ আমার জানে জান রাখতে আমি আপনার ক্ষতি হইতে দিমু না। আপনি নিশ্চিন্তে যান। খালি চাদরটা দিয়ে এমনভাবে যান যেন কিছুই হয় নাই। কেউ যেন বাঁকা চোখে আপনার দিকে না তাকায়।
____
পরের সময়টা গেল একটি ঘোরের মাঝে। বাসায় পৌঁছেই তাওহীদের অনুরোধ অনুসারে প্রভা নিজের আতঙ্ক কোনোরকমে ছাপিয়ে, ঘরে ঢুকে পোশাক পরিবর্তন করে নেয়। এরইপরে নিশীর মাধ্যমে জানতে পারে, ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় ঔষধ ছাড়াই প্রভার মা পূর্বের তুলনায় কিছুটা সুস্থবোধ করায় আর ঔষধের অপেক্ষা করেন নি। রাতের খাওয়া সেড়ে শুয়ে পড়েছেন অসুস্থ শরীরে। এরপরে নিশীকেও মায়ের পাশে শুতে বলে একলা ঘরে নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ রাত কাটাল প্রভা। আর অনুভব করতে লাগল তার আত্মায়, শরীরের ভেতরে, মনে আঘাত করা একেকটি কুলষিত স্পর্শকে। তবে কুলষিত, নোংরা স্পর্শে যখনি হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে, তখনি নিজের পায়ে তাওহীদের করা চুম্বনে, পায়ের ওপরে পড়া তাওহীদের চোখের পানিতে প্রভার আসলেই মনে হয়, সে পবিত্র। কিছুই হয়নি। কেউ কিছু করতে পারে নি। অশান্ত প্রাণে বয়ে যায় তাওহীদের মতো সরল, শান্ত একটি বাতাস।
এদিকে নির্ঘুমেই কেটে যায় প্রভা ও তাওহীদের রাত। জানালায় দাঁড়িয়ে তখনো পাথর চোখে অজানায় তাকিয়ে রয় তাওহীদ। অজানা ঘোরে ডুবিয়ে রাখে নিজেকে।
কেটে যায় নীরব-হিংস্র একটি রাত। জানালার কাছে ঘোরে দাঁড়িয়ে থাকা তাওহীদের ঘোরকে আরোও একটু বাড়িয়ে দিতে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দশ/বারোজনের পুলিশ সমেত থামে একটি গাড়ি। সেখান থাকা পুলিশেরা সকলের সামনে দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে গাড়িতে তোলে তাওহীদকে। গাড়ির মাঝে স্তব্ধ, নীরব চোখে বসে এলাকার সকলের থমকে যাওয়া বিস্মিত চোখ দেখে নেয় তাওহীদ। গাড়ি চলতে শুরু করে। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে রয় বস্তির মানুষেরা, পুলিশের চোটপাটে বেরিয়ে আসা মানুষেরা। দাঁড়িয়ে রয় তাওহীদের চাচা-চাচি, ইসমাত। কেবল গাড়ির দিকে ছুটতে থাকে একলা হাসান।
চলবে~
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান