গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – সতেরো (প্রথম অংশ)
_____
সংক্ষিপ্ত এক ঘুমের পরে ধ্বংসাবশেষ মন নিয়ে এক অবহেলিত দিনের শুরু হয় প্রভার। চোখ খুলতে ঘুমের পরে সাধারণত যে ফুরফুরে, প্রাণবন্ততা কাজ করে তা প্রভার ক্ষেত্রে হওয়া আজ কল্পনার সমান। মাথাটা তীক্ষ্ণ ভোঁতা যন্ত্রণায় ম্যাজম্যাজ করছে। শরীর জুড়ে নিরবিচ্ছিন্ন ক্লান্তি। ঘুমটাও খুব একটা সুবিধার হয়নি। সমস্ত রাত অস্পষ্ট ভয় আর দুঃস্বপ্নের জালে জড়িয়ে আহত হয়েছে। তন্দ্রাঘোর থেকে বারে বারে ছিটকে পড়ে অনিশ্চয়তায় গাঁট হয়ে এসেছে। অযাচিত আশঙ্কায় প্রাণ ছটফটিয়ে উঠেছে। এই বুঝি কেউ এসে পড়ে! এই বুঝি কেউ তার দেহে কুলোষিত স্পর্শে হাত বুলোয়! অতল আঁধারে চেয়ে বারংবার ভ্রম হয়েছে কয়েক জোড়া নাপাক চোখের; যে চোখের ভ্রমে মুহূর্তেই সে ধর্ষণ হয়েছে শত সহস্রবার। বুকের হিমবাহের ঠাণ্ডা বাতাসে তার শরীর হাত-পাও ঠাণ্ডা, নিশ্চল হয়ে এসেছে। চারিপাশের এমন নির্দয়তায় চোখ মেলে রাখার সাহসটুকুও হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রভা। শেষে কেবল অসীম শক্তিতে চোখ মুদে ঘুমের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সফল হয়েছে কি না কেবল প্রভাই জানে।
সব ছাপিয়ে মানসিকভাবে পঙ্গু প্রভা যখন শরীরের দায়ে পেটের অসহ্য তীব্র যন্ত্রণায় ডাইনিং-এ উপস্থিত হলো, সেই মূহুর্তে সম্মুখীন হলো তার বাবা, মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্যের ফাঁকা শাসনের। মাহমুদা জাগ্রত অবস্থাতে প্রভাকে ফিরতে দেখেন নি। দেড়িতে ফেরার দড়ি টেনে আগে-পিছে না শুনে বেশ ভালোই বক্তৃতা দিলেন। প্রভা মৃত চোখে বুঝতে চাইল তার বাবা-মায়ের জ্ঞানের মাত্রা। তবে, সে তার বাবা-মায়ের কাজে একদমই আশ্চর্য হলো না। এমনই তো হয়ে আসছে। এরচেয়ে তার বাবা-মা যদি তাকে ভালো কোনো প্রশ্ন করতো, চিন্তা প্রকাশ করতো তবেই বোধহয় সে আশ্চর্য হতো। সন্দিহান যেহেতু হচ্ছে, সেহেতু সকল কিছু স্বাভাবিক। সবার বাবা-মাকে পাওয়া হয়ে ওঠেনা। প্রভারও হয়ে ওঠেনি, এতে কী আসে যায়! তবুও প্রভা কী একবার আগ বাড়িয়ে বলবে তার বাবা-মাকে? জানাবে কাল রাতের নির্মম ঘটনার কথা? তবে কী তার পিতা-মাতার একটু করুণা হবে তাদের প্রতি? জীবনের এই পর্যায়ে এসে বাবা-মায়ের করুণা পাওয়ার সাধটুকুও আর হলো না। মিনহাজ সাহেব সম্ভবত সকালের ফ্লাইটেই ঢাকায় ফিরে এসেছেন। এখন কয়টা বাজে তা প্রভার খেয়াল নেই। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ভীষণ উদাস চিন্তায় শুনেছে বাবা-মায়ের বলা প্রতিটি নিয়ন্ত্রণমূলক বাণী। বাঁচার দায়ে প্রভা টেবিলে বসল। গায়ে চাদরের মতো জড়িয়ে রাখা ওড়না। মুখের মলিনতা, সামান্য আঁচড় কারোর নজরে এলো না। এলে মাতৃ হৃদয় কিছু বুঝলেও হয়তো বুঝতে পারতো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রভা নিশ্চুপে যখন সামান্য খাবার মুখে তুলল, নিঠুর দুনিয়ার অপ্রত্যাশিত ঠাট্টাতে সে খাবার গিলতে পারার ক্ষমতাটুকুও তার আর হলো না। স্পষ্ট শুনল মিনহাজ সাহেবের বিতৃষ্ণিত অনুভূতি,
– এখনকার দিনে মানুষ আর মানুষ নেই। কে যে আসল মানুষ আর কে পশু তা চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই। তাওহীদ….যে ছেলেটা কিছুদিন আমাদের বাসায় পানি, বাজার দেওয়া নেওয়া করল, সেই ছেলেটাকে নাকি আজকে সকালে পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেসে।
কিছুক্ষণ পূর্বের রাগারাগির আভা মিলিয়ে, মাহমুদা বেগম খাবার চিবুতে চিবুতে অবিশ্বাস্য বিস্ময় নিয়ে গমগমে গলায় বলল,
– সে কি কথা! এলাকায় পুলিশ আসছে? আর তুমি এখন বলছো? আচ্ছা…আচ্ছা…সকালে তবে এই নিয়ে এতো চেঁচামেচি হলো? আমি চিৎকার-চেঁচামেচি শুনেছি। তবে ভেবেছি যে সবসময়ের মতো বস্তির মানুষেরা বোধহয় ঝগড়া করছে। কান দেই নি। তার উপর রাতে ভালো লাগাতে ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম বলে উঠেছিও কিছুটা দেড়িতে। কখন এসেছে পুলিশ? তুমি দেখে আসছো? তোমার আসার সময় আসছে?
মিনহাজ নির্বিকার ভাবে বলল,
– আরে না! আসলাম তো নয়টার টার দিকে। পুলিশ ভোরে আসছে। সাতটা কি সাড়ে সাত টার দিকে। মানুষ তো এখনো গলিতে গিজ গিজ করতেসে।
মাহমুদা উৎসুক হয়ে বলল,
– ছেলেটা করসেটা কী? চুরি?
– খুন। খুনের মামলায় গেসে। কোন নেতা-কর্মীদের সদস্যদের নাকি খুন করসে!
অপ্রতিরোধ্য আতঙ্ক সমেত মাহমুদা চিল্লিয়ে উঠলেন,
– ওরে বাপরে! এতোদূর! সরাসরি নেতাদের খুন?
– কী জানি! দেখে তো ভালোই মনে হইসিল। আল্লাহ সহায় হইসে যে বাসায় সেভাবে আনাগোনা হয়নি। বিয়ে উপযুক্ত দুই মেয়ে থাকে বাসায়। কখন কী ঘটায় না ঘটায়। এরপর থেকে আর বাহিরের কাউকে এলাও করব না। এই ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা হলো। যাকে তাকে বিশ্বাস করা আসলেও ঠিক না। এতোদিন ভদ্রতার মুখোশ পড়ে ছিল। উলটো এই ছেলেরেই বলসিলাম প্রভা-নিশীর সমস্যা-টমস্যা দেখে রাখতে।
– ছেলেরে সহজ-সরলই মনে হইসে। না না…সহজ-সরল মনে হওয়াটা আমাদের বোকামি ছিল। টাকা না নিয়ে পানি উঠিয়ে দেওয়া, বাজার এনে দেওয়া এইগুলা ছিল সব ওই ছেলের ধূর্ততার লক্ষণ। এখন বুঝলাম ওই ছেলের ধান্দাবাজির কাহিনী। এইভাবেই হয়তো বিশ্বাস অর্জন করে পিঠ-পিছে ছুরি চালায়।
– হুম। আবার হতে পারে রাজনৈতিক বিষয়। ক্ষমতার লোভে-টোভেও কিছু করে ফেলতে পারে।
– হ্যাঁ, এইটার সম্ভাবনাও আছে। এখনকার ছেলে মানেই ক্ষমতার লোভ। ক্ষমতার লোভে ছোঁকছোঁক করতে….
আর কোনো কথা কানে গেল না প্রভার। কপালে ভাঁজ ফেলে, দ্বিধার জালে আটকা দৃষ্টিতে বুঝতে চেষ্টা করল মাহমুদ-মিনহাজের কথা। তাদের কথা অনুযায়ী গেলে তার তাওহীদকে নিয়েই তার বাবা-মা কথা বলছে। এর অর্থ তো…প্রভা খানিকক্ষণ প্লেটের দিকে অনিমেষ চেয়ে থেকে আশ-পাশের পরিবেশ বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল। তবে কিছুই বোধগম্য হলো না। মনে হলো সে আরোও একটু আটকা পড়ে গেল। না সুতার জালে নয়, গুণার তৈরি জালে। হঠাৎ শরীর ছাপিয়ে হৃদয়ে হওয়া টনটনে ব্যথায় উঠে পড়ল প্রভা। প্রভার এভাবে উঠে পড়াতে তার মা গমগমে কণ্ঠে উঠলেন,
– যাচ্ছিস কোথায়? একটা রুটিও তো খেলি না। দুইবার মাত্র ছিঁড়ে খাবার ফেলে যাচ্ছিস কী জন্যে? খাবার আছে বলেই নষ্ট করবে?
প্রভা বিশেষ কিছু না ভেবে জড়বস্তুর মতো ফরফর করে বলল,
– গ্যাস হয়েছে মা। বমি পাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ বাদে এসে খেয়ে নিব।
_____
মাথার ওপর গম্ভীর এক আকাশের সঙ্গে এগিয়ে চলছে প্রভা। বুকের ভেতরে স্তবকে স্তবকে জমাটবদ্ধ অনিশ্চয়তা। চারিপাশের লোকসমাগম, মানুষজন কিছুই তার নজরে গুরুত্ব পেল না। পুরো জগত থেকে সে বিছিন্ন হয়ে চলল নিজের মতো। আজ এই জগত-সংসারের সকল কিছুই প্রভার জন্য ম্লান, অর্থহীন। কোনো কিছুর, কারোর কোনো জায়গা নেই প্রভার ভেতর মহলে। তার দৃষ্টিতে কেবল অযুতদিকের ধূ ধূ মরুভূমির শুন্যতা। কোথাও কারোর দেখা নেই। কোথাও কেউ নেই। কেবল আছে সে; যে বুকের ছাতি ফাঁটা তৃষ্ণা নিজের বুকে লালন করে এগিয়ে চলেছে। তাওহীদকে একবার দেখবে বলে, একটিবার ছোঁবে বলে।
প্রভা থানার সামনে দাঁড়িয়েও একবার মিথ্যা আকাঙ্ক্ষায় কুণ্ঠিত হলো। সে বোধহয় শুধু শুধুই এখানে এলো। যে তাওহীদকে ধরে নেওয়া হয়েছে, সে হয়তোবা তার তাওহীদ নয়। তার তাওহীদ আলম নয়। তাদের গলিতেই আরোও একজন তাওহীদ ছিল — হতেই তো পারে। খুব কী অসম্ভব! প্রভা নিজের মিথ্যা স্বপ্ন থেকে এগিয়ে গেল। মিথ্যা তাওহীদকেই না-হয় একবার স্বচক্ষে দেখে নেওয়া যাবে।
প্রভাকে থানার ভেতর পৌঁছেও অপেক্ষা করতে হলো আধা-ঘন্টার মতো। নিয়মানুযায়ী, অনুমতি পেতে থানার ওসির নিকট দরখাস্ত পত্র জমা দিতে হয়েছে। এখন প্রভা বসে আছে ‘সাক্ষাৎ কক্ষ’ নামক একটি সাধারণ রুমে। যেখানে দু’টো চেয়ার, একটি টেবিল ব্যতীত কিছুই চোখে পড়ছে না। প্রভা উন্মুখ চোখে দরজার দিয়ে চেয়ে রয়। বুকে প্রচ্ছন্ন প্রতীক্ষা; তাওহীদ নামক ব্যক্তিটি আসবে। প্রভা দু’চোখ ভরে দেখবে এই তাওহীদ তার তাওহীদ নয়। এরপর ভারমুক্ত মনে ঘরে ফিরে যাবে। তার তাওহীদকে, তাওহীদ আলমকে খুঁজবে। সকালে ফোন করেছিল, ফোন বন্ধ ছিল। প্রভা ঠিক করল, ফোন তোলা মাত্রই সে সকল পরিস্থিতি ছাপিয়ে ধমকে উঠবে। কড়া কতোগুলি কথা শুনিয়ে দেবে। প্রভার অলীক ভাবনার মাঝেই শব্দ পাওয়া গেল। প্রভা তাকিয়ে দেখল দু’জন জেলার একজন মানুষকে রক্ষাকবচের মতো আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা এমন, মাঝের জনকে বিপদ স্পর্শ করার আগে তাদের করতে হবে। প্রভা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষণকাল নীরব থেকে বুঝতে চেষ্টা করল, এই মুহূর্তে সে কী করবে। তার দৃষ্টি মেঝেতে। সে দু’জন রক্ষীদের দেখেছে, তবে মাঝের জনকে দেখার সাহস করে উঠতে পারে নি। তাই তাদের জুতোর দিকে দৃষ্টি রাখাকেই সঠিক বলে মনে হয়েছে। প্রভার বুকের ভেতরকার একপাক্ষিক যুদ্ধে হয়রান হয়ে নিজের ধৈর্য্য হারাল। মুহূর্তেই চোখ তুলে তাকাল মাঝে থাকা অতি মূল্যবান মানুষটির দিকে। মানুষটি ম্লান মুখের শান্ত দৃষ্টিতে আটকেই পার হলো কয়েক মুহূর্ত। প্রভার চেতনা ফিরতেই তার বোধ হলো, সে হেরে গেছে। সে ভীষণভাবে হেরে গেছে। এতোক্ষণের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা দিবাস্বপ্ন হয়ে তাকে উপহাস করছে। প্রভার মুখ থেকে অস্ফুটে আওয়াজে বের হলো,
– তা…তাওহীদ!
তাওহীদ বোধহয় শুনলো প্রভার ডাক।পলক পড়ল নিভৃতে। ততোক্ষণে রক্ষী দু’জনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সম্মুখে। প্রভা অবর্ণণীয় বিস্ময়ে এগিয়ে চলল তাওহীদের দিকে। তাওহীদ তখনো মধ্য দুপুরের নীরব দিঘীর মতো শান্ত, নিশ্চল, নির্বাক। যেন তার কাউকে কিছু বলবার নেই। কিছু করবার নেই। কেবল সকল কিছু দেখে চলাই তার কাজ।
বুকের ভেতরকার নিগুঢ় অস্থিরতা নিয়ে হাত বাড়ালো প্রভা। কম্পিত হাতে তাওহীদের গাল, বাহু স্পর্শ করতেই প্রভার দুনিয়া ভীষণ আওয়াজ তুলে আছড়ে পড়ল। হৃদপিণ্ড কে যেন খামছে ধরল। প্রভা বাহু ছেড়ে তাওহীদের চোখে চোখ ফেলতেই তার শেষ ভরসাটুকুও সে হারাল। এই তো তাওহীদের স্বচ্ছ এক জোড়া চোখ। এই তো তাওহীদ। এই তো তাওহীদের পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, অতল মায়ার দৃষ্টি। এই তো তার সেই তাওহীদ। এই পৃথিবীর সূর্য-তারা যেমন সত্য, তাওহীদের দিঘীর মতো টলটলে চোখের দৃষ্টিও তো তেমনি সত্য। বুকের জমাট বাঁধা দুঃখে প্রভা মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগল। চক্ষু ভরে চারপাশ বড় ঝাপসা দেখাচ্ছে। প্রভা তাওহীদের দিকে ফের চেয়ে বলল,
– সত্যিই তাহলে আমার তাওহীদকে ধরে এনেছে পুলিশেরা? আপনি…আপনি…
প্রভা থরথর করে কম্পমান হাত তাওহীদের মুখে বাড়িয়ে বলল,
– আপনি আমার তাওহীদ?
বলার সঙ্গে সঙ্গেই চক্ষুকোলে জায়গা করতে ব্যর্থ অশ্রুফোঁটা টপ টপ করে ঝরে পড়ল। নিজেকে দেওয়া সকল প্রবোধ, সকল মিথ্যে আশ্বাস মুহূর্তেই চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে ধূলিসাৎ হলো।
প্রভার এমন অস্বাভাবিক, অসহনীয় অস্থিরতায় তাওহীদ হাত বাড়িয়ে প্রভাকে স্থির করতে চাইল। তারা খুব স্বাভাবিক এক পরিস্থিতিতে আছে — এমন ভঙ্গিতে তাওহীদ ভ্রুক্ষেপ করে স্থির স্বরে শুধাল,
– আপনাকে এমন লাগতেসে কেন, সুপ্রভা? সকালে খাওয়া-দাওয়া করেন নাই? ঔষধ খাইসেন আপনি? গা টাও তো বেশ গরম। জ্বর আসছে আপনার?
আর সহ্য হচ্ছে হলো না এমন আদর আদর কথার পিছে ছাপানো তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা, দুঃসহ অভিযোগ। প্রভা অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের যন্ত্রণা বিসর্জন করতে চাইল। রুদ্ধশ্বাসে চুল খামছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল। বুকের ভেতরকার হৃদয়টা কিছুতেই স্থির করা গেল না। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রভা অবোধ বালিকার মতো বলল কিছু অর্থহীন কথা,
– তাওহীদ! আমি কী এখানে থাকতে পারব, তাওহীদ? আমাকে কী আপনার সঙ্গে থাকতে দেবে ওরা?
তাওহীদ প্রভার সমানে এসে মাথায় আদুরে স্নেহে হাত বুলিয়ে বলল,
– আগে কান্না মুছেন, সুপ্রভা। এভাবে কাঁদে না। এমন করে কাঁদতে আছে?
বলেই নিজ হাতেই কান্না মুছিয়ে দেয় তাওহীদ। দু’হাত বন্দি হাতজোড়া যখন আবারো মাথায় তুলে হাত বুলোতে চাইল, ওমনি হাতজুড়ো প্রভা আঁকড়ে ধরল। বন্দি হাতজোড়ার দিকে হতবাক চেয়ে থেকে হাতজোড়া কণ্ঠদেশে এনে থুতনি ঠেকিয়ে ধরল। খানিক মুহূর্ত পরে তাওহীদের দিকে সর্বহারা চোখে চেয়ে কেবল ডাকল,
– তাওহীদ?
একটি শব্দে, একটি ডাকে বলা হয়ে গেল না বলা কতো কথা। তাওহীদ সে সকল কথা বুঝলেও দৃঢ়, নিশ্চুপ রইল। নিজের দু’হাত ফিরিয়ে নিল ভীষণ যত্নে। চোখে পদ্মের মতো ভাসা পানি নিয়ে বলল,
– বাসায় যান, সুপ্রভা। দেখা তো হলো।
প্রভা মাথা নাড়ল। শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
– আমি এখানে থাকি না তাওহীদ। একটু থাকি? আপনার সঙ্গে? ওদের বলেন না আপনি, ওরা যেন একটু থাকতে দেয় আপনার সঙ্গে। দেখা হওয়ার পর থেকে তো আপনিই আমার সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, আমাকে বাঁচিয়েছেন। এবারো একটু সহায় হোন, তাওহীদ? আমাকে একটু সাহায্য করেন। আমাকে থাকতে দিতে বলেন। আপনার সঙ্গে থাকব আমি। আপনার সঙ্গে থাকতে দিন। একটু থাকি….
শক্ত শক্ত কয়েকটা দুঃখ গিলে ফেলায় কণ্ঠনালিতে বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে তাওহীদের। তার উপর প্রভার এমন দুর্বোধ্য অস্থিরতা! তাওহীদ আগের চেয়েও নরম হয়ে বলল,
– এমন করে না, সুপ্রভা। বাসান যান। গিয়ে একটু আরাম করেন। কাল আপনার ওপর কম ধকল যায় নাই।
বলতে বলতেই তাওহীদের নরম মুখ দৃঢ় হতে চাইল। গতদিনের ওই কালো রাতটুকুর কথা যতবার স্মরণে আসে, ওই পশুগুলোকে শেষ না করতে পারার ব্যর্থতার জেদে তাওহীদের ততবার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। সে ওদের মেরেছে, তবুও তাতে হৃদয় শান্ত হতে চায় না, তার আফসোসও হয় না। বরং বারংবার ক্ষিপ্রতায় শেষ থাবাটুকু দিতে ইচ্ছে হয় তাদের জীবনীশক্তিতে। তাওহীদ সে কালো রাতের কথা তার সুপ্রভাকে স্মরণ করাতে চায় না। তাই তো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলতে চাইছে; যাতে করে সুপ্রভা চলে যায়। বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। প্রভার ওপরে করা নৃশংস পাশবিক কাজের চাক্ষুস সাক্ষী সে। প্রভার পেটে লাথির দৃশ্যটুকু স্মরণ হতেই ফের রক্ত ছলকে উঠল। বিদুৎ এর বেগে অসীম শক্তি এসে জড়ো হলো তার শরীরে। সারা শরীর তীব্র বেগে কাঁপতে চাইল। তবুও বেশ কষ্টে নিজেকে দমন করতে হলো। সামনেই তার সুপ্রভা। মেয়েটা যতোই দৃঢ়তা নিয়ে ঘুরুক, ফিরুক। তাওহীদ জানে তার সকালের কোমলতা। তাওহীদ আবারো আদুরে হয়ে বলল,
– আমি ঠিক আছি, সুপ্রভা।
প্রভা ব্যাকুল হয়ে চাইল। অথচ একবার বোঝার চেষ্টা করল না এমন দৃষ্টির ভার নেওয়ার ক্ষমতা সামনের মানুষটার আছে কি নেই। প্রভার আতুর চোখে চেয়ে তাওহীদ বলল,
– আপনি এই মুহুর্তে এখান থেকে না গেলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করব, সুপ্রভা। আপনি…
– আমি বাসায় স্বস্তি পাই না তাওহীদ। কেউ আমাকে বোঝে না তো। আমি যাব কেন সেখানে? আপনি চান আমি ভালো থাকি তবে এখানে কেন থাকতে দিচ্ছেন না তাওহীদ? আমি…আমি আপনার কাছে ভালো থাকব। এখানে থাকি? একটু স্থির হয়ে নিই আপনার কাছে থেকে। জেলে আমার কোনো অসুবিধে….
– প্রভাআআ!
তাওহীদের ধমকে খানিক কেঁপে থেমে যেত হয় প্রভার। অবিশ্বাস্য চোখে বুঝতে চেষ্টা করে সামনের মানুষটাকে। প্রভা? সে প্রভা কবে হলো? তক্ষুনি কানে এলো এক রক্ষীর নির্বিকার কণ্ঠস্বর,
– পনেরো পেরিয়ে বাইশ মিনিট হলো। তিন মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করুন।
তার পরপরই তাওহীদ বেশ দৃঢ় স্বরে বলল,
– নিজেকে সামলাই বাসায় যান, সুপ্রভা। আমি ঠিক আছি। ঠিক থাকব। সমস্যা নাই। আপনি চিন্তা করবেন না। দেখবেন আজ বাদে কালই ছাইড়া দিছে। বড়লোকদের বড়লোকি কারবার। মারছি না? তাই তাদের সম্মানে আঘাত লাগসে। জলদিই চইলা আসুমু আমি।
প্রভা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। প্রভা বলে ধমকে এখন সুপ্রভা ডাক শুনতে চায় না সে। জন্মের পর থেকেই বুঝে এসেছে সে সবার বিরক্তির কারণ। এখন যদি তার প্রতি তাওহীদও বিরক্ত বোধ করে, তবে কী দরকার এখানে থাকার। চলে যাওয়াই শ্রেয়।
প্রভার এমন করে মুখ ফিরিয়ে যাওয়ায় ব্যথিত হলেও কিছু বলতে পারে না তাওহীদ। বেরোনোর আগে প্রভা একবার ফিরে চায় তাওহীদের দিকে। চোখে চোখ পড়ে যায়। প্রভার চোখের প্রগাঢ়, অন্তহীন অভিমানে তাওহীদের হৃদয় আহত হয়। তবুও তার মুখ ফুটে না। কেবল ভীষণ কষ্টে বলে ওঠে,
– আমি ফিরা আসব, সকাল। খুব শিগগিরই ফিরা আপনার সঙ্গে গল্প করব। আপনার হাতের শিঙ্গারা খাব। আপনে নিশ্চিন্তে থাইকেন। সুস্থ থাইকেন।
তাওহীদের এমন নরম কথাকে প্রভা গুরুত্ব দেয় কি-না কে জানে! বুকের ভেতর ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহ নিয়ে এগিয়ে চলে প্রভা। দু’চোখ ভরে বইয়ে চলে নিঠুর দুনিয়ার প্রতি সীমাহীন অভিযোগ।
চলবে-
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – সতেরো (শেষ অংশ)
_____
বিপর্যস্ত প্রভা হৃদয়ের বিধ্বংসী বিদ্রোহে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বড়ই অচেতনে এসে পৌঁছুলো আফরিনের বাড়ির আঙিনায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সামান্যটুকু সংশয় তার মধ্যে দেখা গেল না যে, এই অবেলায় যে অন্যের বাড়িতে এলো, তারা তো হঠাৎ প্রভার আগমনে অপ্রস্তুতও হতে পারে। প্রভা বিনা জড়তায় আফরিনকে ফোন করে কেবল বলল,
– আফরিন! আমি তোর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে একটু গেট খুলে নিয়ে যা তো।
কণ্ঠে ছিল না কোনো দ্বিধা, না কোনো সংকোচতা। যেন আফরিনের বাড়িতে এইভাবে চলে আসা নিত্যনৈমিত্তিক কোনো ঘটনা। আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে প্রভা এমন কিছুও জিগ্যেস করল না যে, আমি কী তোর বাড়িতে আসতে পারি বা তুই কী আমার আমি এলে বিরক্ত বোধ করবি? হতবুদ্ধিকর আফরিন যখন প্রভাকে নিয়ে ওপরে গেল, তখনো আফরিনের চোখ-মুখ থেকে বিস্মিত ভাব পরিপূর্ণ ভাবে সরে যায়নি। তবে প্রভা বেশ সাবলীল ভঙ্গিতেই হেঁটে আফরিনের ঘরে গেল। ঘরে বসে আছে মিনিট পনেরো হয়। আফরিন এখনো ঘরে আসে নি। সম্ভবত তার পরিবারকে তার হঠাৎ আগমনের ব্যাপারে অবগত করছে। অতিথি এসেছে, স্বাভাবিকভাবেই সামান্য আয়োজন হলেও করা হবে। প্রভা মৃত চোখে কিছুক্ষণ এলেবেলে সব চিন্তা করল। এরপর হঠাৎই তার মেঘলা আকাশে পা টিপে টিপে জড়ো হলো কালো মেঘেদের দল। টুপ টাপ করে গড়াল অশ্রু ফোঁটা। রুদ্ধশ্বাসে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল কপাল। সে এখানে কেন এসেছে, এতোক্ষণ যাবত মস্তিষ্কে ধরা না পড়লেও এখন বেশ ভালোমতো ধরা পড়ল। সে এখানে এসেছে মূলত একটু স্বস্তির আশায়। একটু বাঁচবার আশায়। সে শতভাগ নিশ্চিত, এই মুহুর্তে নিজের বাসায় গেলে নিশ্চিতভাবে দম আটকে মারা যাবে। ওই রাস্তা, ওই গলি, ওই ঘর — সবকিছু তাকে ধ্বংস করে দেবে। বাঁচবার একটা উপায় অবশ্য ছিল। তাওহীদ ছিল। তবে সেও তো….প্রভা হাত উঁচিয়ে নিজের বুকে সামান্য চাপড় দিতে শুরু করে। বুকের ভেতর তার রক্তাক্ত দগদগে ঘা। সেই ঘা চুইয়ে অবিরামভাবে চলছে রক্তের বিসর্জন। কী অসহ্য তীব্র যন্ত্রণা তার! কী হৃদয় ঝলসানো হাহাকার! প্রভা তো সইতে পারছে না। তবুও কেন এমন আঘাতই পাচ্ছে সে?
প্রভা আফরিনের ঘরে অচেতনের মতো পড়ে আছে অনেকক্ষণ হয়। মাঝে একবার আফরিন এসেছিল। প্রভার দিকে অনিমেষ চেয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছে পরিস্থিতি। প্রভার এমন অবিন্যস্তভাব দেখে যদিওবা বুঝেছে ‘কোনো চুনোপুঁটি নয়, বিরাট কাহিনী’ তবুও কিছু জানতে চাওয়ার সাহস জোগাতে পারে নি। প্রভার এমন হালচালহীন অবস্থায় উদ্বেগ, অস্বস্তির সঙ্গে তরতর করে বেড়েছে মায়া। ম্লান মুখের লালাভ আবহে, লালচে নাকে, স্থির দু’চোখ থেকে উপচে পড়া তীব্র অভিমান, অভিযোগে মায়া না হয়ে পারা যায় না। এরপর আফরিনের ভাবনার উর্ধ্বে গিয়েই প্রভার সাথে তার হয়েছে বেশ কিছু স্বাভাবিক কথোপকথন। কথোপকথনের রূপ –
প্রভা নির্বিকার কণ্ঠে : আফরিন! আমি কী এসে তোকে বিরাট কোনো বিপদে ফেলে দিলাম? আমি তো তোর বন্ধু। আমি তো যখন-তখন আসতেই পারি। পারি না?
আফরিন খানিক জড়তা নিয়ে : অবশ্যই পারিস, প্রভা। এইভাবে বলার কী আছে? আর আমি সবসময় চেয়েছি তুই যাতে আমাদের বাড়ি আসিস। তুই তো আসলেও সেভাবে আসিসই না। আজ এসে ভালো করেছিস।
প্রভা আফরিনের দিকে চেয়ে ভাসা অশ্রু নিয়ে বলে : এই মুহূর্তে তুই ছাড়া কারোর কথা মাথায় আসে নি আফরিন।
আফরিন প্রভার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে : আমি সবসময় আছি তোর জন্যে। কিন্তু সমস্যা কী খুব বেশি? মানে বলা যায় না আমাকে?
প্রভা শিশু বালিকার মতো বলে : এখন বলতে ইচ্ছে করছে না। আমার না খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে অস্বচ্ছ কোনো স্বপ্ন দেখছি। যেই স্বপ্নের শুরু কাল রাতে হয়েছে। তবে স্বপ্নটা না ভাঙছে না আফরিন। দেখেই চলেছি। দেখেই চলেছি। আফরিন! তুই কী নামাজের জন্যে হিজাব পড়েছিস? আফরিন! আল্লাহকে একটু বল তো আমার স্বপ্নটা যেন ভেঙে দেয়। তুই মোনাজাতে আমার স্বপ্ন ভাঙার জন্যে একটু দোয়া করিস তো। আমি তো তেমন নামাজ-কালার পড়ি না। আল্লাহ বোধহয় আমার ওপর নারাজ। তুই একটু বলিস, কেমন?
প্রভার এমন অস্বাভাবিক আচরণে আফরিন কিছু বলতে পারে নি। কেবল মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিয়েছে। অবশ্য প্রভা আশাতে তার তেমন কোনো সমস্যা নেই কেবল একটি ছাড়া। তার পরিবারে বাবা-মায়ের মধ্যে বেশ ঝামেলা চলছে। পারিবারিক জমি সংক্রান্ত ঝামেলা। এই ঝামেলাটা আপাতত স্থগিত আছে। তবে কতোক্ষণ থাকবে বলা যায় না। ঝামেলার ফুলকি জ্বলে উঠামাত্রই তার মায়ের চেঁচামেচি, অকথ্যা ভাষার গালাগালিও শুরু হবে। গ্রাম্যজীবনের সেসব গালি শুনলে আফরিনের বড় লজ্জা হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি তার মা প্রভার সামনেই গালাগাল শুরু করে, তবে আফরিনকে বেশ লজ্জায় পড়তে হবে। আফরিন প্রভার দিকে তাকিয়ে কেবল বলতে পেরেছে : প্রভা তুই বিশ্রাম নে। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।
প্রভা কিছু বলে নি। না যে করবে তাও করতে ইচ্ছে হয়নি। কেবল ঠায় শুয়ে নিজের মন, মস্তিষ্ক স্থির করার দ্বন্দ্বে মরেছে। চোখের গড়িয়ে পড়া পানিও আর মুছতে ইচ্ছে হয়নি। চোখের পাড় জ্বালা করছে। আর বার কয়েক মুছলেই বোধহয় চামড়া উঠে হাতে চলে আসবে।
প্রভা উঠে বসল আচানক। ঘড়ির দিকে চোখ গেলে দেখল তিনটে বিশ। তখনি ঘরে এলো আফরিন। আফরিন এগিয়ে এসে বলল,
– হাত-মুখ ধুয়ে আয়, প্রভা। এইভাবে মায়ের সামনে গেলে মা হাজারটা প্রশ্ন করবে। আর আমি বুঝতে পারছি তোর মানসিক অবস্থা ঠিক নেই। প্রশ্নের সম্মুখে পড়ে তোর মোটেও ভালো লাগবে না। তুই হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আয়। তাহলে শরীর অসুস্থ দিয়ে চালিয়ে দিতে পারব। চল?
আফরিনের দিকে চেয়ে হঠাৎ প্রভা মেনে নিল, সে কোনো স্বপ্নে নেই। আছে মর্মভেদী বাস্তব জীবনে। এই জীবনে হুহু করে কাঁদলে কোনো লাভের লাভ হবে না। তার মাথার ওপর এখন একশো মনের ভার। তাওহীদকে মুক্ত করার ভার। আর সে কি-না এখানে বসে গঙ্গা বিসর্জন দিচ্ছে। নিজের প্রতি নিজের ভয়ানক ক্ষোভে প্রভার অন্তরআত্না জ্বলে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– এখন চলে যাব, আফরিন। কিছু খাব না।
বলা বাহুল্য, প্রভার এমন উপস্থিতিতে এতোক্ষণ কিছুটা উশখুশ করলেও এখন প্রভার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মনটা ছোটো হলো আফরিনের। নিভু কণ্ঠে বলল,
– খেয়ে যা, বন্ধু।
প্রভা মলিন হাসে। আফরিনের মুখের ‘বন্ধু’ ডাকটা বেশ গভীর। আবেগী করে তোলে প্রভাকে। তবুও বলল,
– আজ ইচ্ছে করছে না, বন্ধু। আজ যাই?
প্রভা মাথা হেট করে এগিয়ে চলল। ঘরের পথে পড়ল আফরিনের মা। স্নেহসুলভ হেসে বললেন,
– আসো মা, সোফার রুমে আসো। আন্টির ঘরে তো ডাইনিং নাই। সোফায় বইসাই দুপুরের খাবারটা খাইয়া নেও।
প্রভা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলতে চাইলেও খানিকটা অস্বাভাবিক শোনাল,
– আজ না আন্টি।
– আজ না মানে?
– আজকে আমার জরুরি কাজ পড়ে গেসে। আমি তো আপনার হাতের খাবার খেতেই আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ জরুরি কাজ পড়ে গেল। এই মুহূর্তেই আমাকে বাসায় যেতে হবে। আমি খুব তাড়াতাড়ি আবার আসব আন্টি। আপনি চিন্তা করবেন না।
– অসুস্থ তুমি?
– না ঠিকাছি।
– একলা যাইতে পারবা?
– জ্বী, পারব। গেলাম আন্টি। আমি স্যরি এইভাবে আপনাদের হয়রানি করতে চাইনি। আমি আসি।
প্রভা এগিয়ে চলতেও বাঁধা পেল। সামনে দাঁড়ানো আফরিনের ছোট ভাই। ছেলেটা বেশ আদুরে। প্রভা যখনই আসে তখনই প্রভার আশেপাশে একটা মিষ্টি শোরগোল তৈরি করে ফেলে। তবে আজ তেমনটা হয়নি। বোধহয় আফরিন আজ ছেলেটাকে যেতে দেয়নি। নিজের বিশৃঙ্খল জীবনকে একপাশে সরিয়ে রাখলে সামনে দাঁড়ানো শিশুটির প্রতি বড় মায়া হলো প্রভার। অগাধ মায়ায় বলয়ে প্রভা শিশুটিকে এড়িয়ে যেতে পারল না। কিছুটা অগোছালো ভঙ্গিতে ব্যাগ হাতড়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা চালাল। হাতে পড়ল দু’শো টাকার নোট। সেই নোট এগিয়ে ধরল ছেলেটির সামনে। ছেলেটি ছিটকে দূরে গিয়ে বলল,
– না না আপু, লাগবে না।
প্রভা কপট রাগে বলল,
– লাগবে না মানে, অবশ্যই লাগবে। নাও, ধরো।
ছেলেটি এগুলো না। পিছন থেকে আফরিন, আফরিনের মা বারণ করছে। সেই বারণ-বাণী অগ্রাহ্য করে প্রভা এগিয়ে গিয়ে ছেলেটির হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিল। অধিকার নিয়ে বলল,
– আর কক্ষনো আমি কিছু দিলে না বলবা না। আমি অপরিচিত কেউ নই। আমি তোমার আরেক বড় বোন। আজ তোমার জন্যে চকলেট আনতে পারি নি। এটা দিয়ে কিছু খেয়ো। কেমন?
প্রভার দৃঢ়তায় ছেলেটি মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলল,
– আচ্ছা, খাব সকাল আপু।
প্রভা এক মুহূর্তের জন্য থমকে চাইল। পরেই মনে এলো, ছেলেটা তো তাকে সকালই বলে ডাকে। ক্লাসে না কি একবার ওর টিচার ওকে বলেছে যে, সকাল এর প্রভা শব্দের অর্থ একই। সেই থেকে সে সকাল আপু, সকাল আপু বলে প্রভাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে চলে। ভাবে, এই পৃথিবী কী অদ্ভূত! একটা মুহূর্ত তাকে তাওহীদকে ভুলে থাকতে দেয় না, ক্ষণে ক্ষণে মনে করিয়ে দেয়, প্রভা, তোমার জীবনে কিন্তু তাওহীদ নামক একজন ব্যক্তি আছে। যে তোমাকে জগতের সব ভালোবাসার মালা গেঁথে সুপ্রভা বলে ডাকে, যে তোমাকে সকাল বলে ডাকে। যে সর্বদা প্রস্তুত তোমার মন ভালো করতে। যে তোমার….নাহ! আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা তার কথা। ভাবকেই বুকের ঘা টা দপদপ করে ওঠে।
_____
হাজতের এক ঘরে তুচ্ছ কোনো আসবাবের ন্যায় রেখে দেওয়া হয়েছে তাওহীদকে। এতোক্ষণ যাবত গুটিকয়েক পুলিশের আনাগোনা হলেও এযাবৎ আর কাউকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না হাজতের বাইরের সরু পথে। চারটে হাজত সেলের মাঝে বরাবর বসা বাল্বের টিমটিমে দুর্বল আলোয় পরিবেশটা হয়ে ওঠেছে স্বাভাবিকের তুলনায় অধিক দুর্বোধ্য, অতৃপ্ত। ক্ষীণ বিমূর্ত আলোর প্রভাবে পুরো ঘটনাটিকে মনে হচ্ছে অস্বচ্ছ এক স্বপ্ন। চারদিক জুড়ে জাগরণ-ঘুমের সম্মিলনে উৎপন্ন কোনো বিদঘুটে স্বপ্নের আবহ। দুর্বল আলোর প্রভাবে কিছুটা মধ্য রাত্রির ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে চারিপাশে। হাজতের শীতল, টনটনে ঠাণ্ডা দেওয়ালে পিঠ হেলিয়ে ম্রিয়মান দৃষ্টিতে শুন্যে চেয়ে আছে তাওহীদ। তারই কিছুটা দূরে ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে ঘুমোচ্ছে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি। ব্যক্তিটিকে সম্ভবত আনা হয়েছে তাওহীদের আগেই। কথা হয়নি তাওহীদের সাথে। তাওহীদেরও জানতে ইচ্ছে হয় নি ওই ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি। এরমাঝে হাসান ভাই এসে ঘুরে গেছেন একবার। মুখ জুড়ে ছিল অসহায়ত্বের মাখামাখি। মানুষটার মর্মস্পর্শী ব্যাকুল কান্না মনে করে তাওহীদের চোখে ভেসে উঠল অজস্র মায়া। হাসান তার আপন ভাই নয়, তবুও তার প্রতি হাসানের কতো দরদ, কত স্নেহ! আচ্ছা, এই মানুষটার এমন ভালোবাসার ঋণ তাওহীদ মেটাবে কেমন করে? এসেই বুক ভাঙা কষ্টে কেমন অস্থির হয়ে বলছিল,
– তাওহীদ, তর ভাই না আমি! তোর বড়ভাই তো আমি। তুই চিন্তা করিস না, ভাই। আমি তরে ছাড়াই নিয়া যামু। তুই দেখবি খুব তাড়াতাড়িই তরে আমি ছাড়াই নিয়া যামু। একটু কষ্ট কইরা একটাদিন থাক। আমি দেখতাসি কী করা যায়। পুলিশগো কইসি আমি যে তুই খুন করোস নাই। আমাগো তাওহীদ খুন করে নাই। ওরা বিশ্বাসই গেল না। আমার ভাইরে আমি চিনুম না?
তাওহীদ হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল,
– খুন আমি করসি, ভাই।
তাওহীদের এমন সহজ স্বীকারোক্তি শুনে দপ করে জ্বলে ওঠে হাসানের মস্তিষ্ক। ধমক দিয়ে বলে,
– এই চাপটে দাত ফালাই দিমু। সবকিছুরে তোর খেলনা মনে হয়? সরল হইছোস তাই এমনি হইছোস যে মিথ্যা মামলাতেও হ্যাঁ কইবি? জানোয়ার!
হাসানের ধমকে তাওহীদ কপট হেসে বলেছে,
– আপনে না আমারে ছাড়াই নিয়া যাইবেন, ভাই? ছাড়ানোর পরে একদিন বইসা আপনার সঙ্গে এই নিয়া আলাপ করবনি। এখন আপনে ব্যবস্থা কইরা দেখেন যে আমারে ছাড়ানো যায় কি-না। না গেলেও আমার বিশেষ অসুবিধা নাই।
তাওহীদের এমন কথায় জ্বলে ওঠে মস্তিষ্কে কতোক্ষণ তাকে ঝেড়ে চলে গেছে হাসান। মাঝে অবশ্য তাওহীদ বেশ নরম গলায় বলেছে ,
– ভাই, আমি যে জেলে আসছি আমার গ্রামে এই খবর দিয়েন না। আমার বাপ-মায়রে জানাইয়েন না। আল্লাহ চাইলে তো ছাড়া পামুই কিন্তু ওরা শুনলে ওগো মনটা ভাইঙা যাইব।
হাসানের কথা, নিজের পরিবারের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তাওহীদ। তখনি মাথায় পেঁজা তুলোর মতো ভীড় জমায় প্রভার চিন্তা। তাওহীদ নত মস্তিষ্কে মনে করল তার সুপ্রভার একেকটা আর্তনাদ। তার সুপ্রভার আর্তনাদে তার হৃদয় যে কতোবার নিহত হয়েছে, তা কী মেয়েটা কখনো জানবে? কী অসহনীয় দুঃখ নিয়ে কাঁদল মেয়েটা! তার জন্যেই তো কাঁদল। তবুও এমন মিষ্টি সুখের মাঝে এ কেমন যন্ত্রণা? এ কেমন হারানোর ব্যথা! আচম্বিত তাওহীদ শ্রবণেন্দ্রিয়ে ঝংকার তুলে বেজে উঠল সুপ্রভার কণ্ঠ,
-আপনি সত্যিই আমার তাওহীদ?
আমার তাওহীদ! সুপ্রভার তাওহীদ? তাওহীদের বড় ইচ্ছে হলো একবার সুপ্রভার সঙ্গে দেখা করে। করে কেবল জিগ্যেস করে,
– আমি কী সত্যিই আপনার সুপ্রভা?
হাহ….কে জানে সে কার! মেয়েটার ছন্নছাড়া কাজকর্ম মনে করে মলিন হাসে তাওহীদ। আজ কী অগোছালো আচরণ টাই না করল মেয়েটা! প্রথমে ব্যাকুল চোখের কান্না, আমার তাওহীদ, আমার তাওহীদ বলা সুরলহরী, অভিমানী চোখের চাউনি। চাউনি….এই চাউনির মাধ্যমে নিজের অগোছালো আচরণের চূড়ান্তে পৌঁছেছে মেয়েটা। কত অনায়াসেই চোখ ফিরিয়ে দিয়ে গেল একটা চাউনি। অথচ একটিবার ভাবল না অমন চাউনির গভীরতা মাপার শক্তি এই তাওহীদের আছে কি-না। অমন চাউনির ভার নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে কি-না। একটিবার ভাবল না, ওমন চাউনি এই নিঃস্ব তাওহীদ রাখে কোনখানে। এই জেলে রাখবে? এই অসামাজিক, প্রাণহীন, অবরুদ্ধ জায়গায় রাখবে? একটি জায়গা কী দিয়ে যাওয়া যেত না? জায়গা নাই বা দিক অন্তত একটা সমাধানই নাহয় করে যেত!
মনস্তাত্ত্বিক হিসেব-নিকেশ এর মাঝেই দুর্বল আলোটুকুও বিছিন্ন হতে গণনা থেকে বিতারিত হতে হলো তাওহীদের। চোখ তুলে বোঝার চেষ্টা চালাল। মুহূর্ত কয়েক পার হবার পরেও যখন আলো এলো না, তাওহীদ উঠে দাঁড়িয়ে সামনের রক্ষীকে বলল,
– কারেন্ট চলে গেল, ভাই?
রাতের শিফটের ডিউটি থাকায় কর্মরত রক্ষীর প্রায় ঘুম ধরে গেছিল। তবে তাওহীদের কণ্ঠে সে ঘুম থেকে ছিটকে পড়ায় কর্কশ কণ্ঠে বিদ্রুপ করল,
– চইলা যাবে কেন? আমি নিয়া গেসি। কোনো সমস্যা?
তাওহীদ উত্তর দেয় না। এমন বিরক্তির পরে কথা বাড়ানো যায় না। তাওহীদ নিশ্চুপে বসে রয় এক কোণায়। ঘরের ওপরদিককার ছোট্ট জানালা পেরিয়ে আলো আসার পথ খোঁজে, পথ মেলে না।
বিদ্যুৎ যাওয়ার পার হলো বেশ কিছু মুহূর্ত। বেশ কিছু মুহূর্ত আদতেই পার হলো না কেবল তাওহীদের ভাবনা কে জানে! এমন অতল, নিগুঢ় আঁধারে ইতোমধ্যে তাওহীদের শরীর ছেড়ে ঘাম ছেড়ে দিয়েছে। নিজের ভেতরকার অস্বাভাবিক কম্পনে তাওহীদ শরীর ছেড়ে দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে রাখল দেয়ালে। মাথা, হাত-পায়ের মৃদু ঝিঁঝিঁ অনুভবে কিছুটা অসাড় অসাড় লাগছে। দুর্বোধ্য আঁধারে এক টুকরো স্বস্তি খুঁজতে চোখ বোজে তাওহীদ। বন্ধ চোখে আচানক মায়ের হাসিমুখ ভেসে আসতেই প্রাণটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে! হৃদয় ঠিকরে বেরিয়ে পড়তে চায় প্রকট ভূমিকম্প। চোখে ভাসে মায়ের কোমল মুখের গড়ন। চোখে ভাসে হাসিমুখে নকশা করা এগিয়ে দেওয়া মোমবাতির দৃশ্য। তাওহীদ আরোও অস্থির হয়। নিজের শরীরের অনিয়মিত কম্পনে, শ্বাস-প্রশ্বাসে নিজেই বেজায় বিরক্ত হয়। এতো দুর্বল কেন সে! এতো নরম কেন সে! হাঁসফাঁস করে এগিয়ে যায় আবারো রক্ষীর অভিমুখে। অস্থিরতা গিলে বলে,
– কা..কারেন্ট কী আর আজকে আসবে না, ভাই?
আবারো একই ঘটনায় ঘুমের ব্যাঘাত। মাথা ঘুরিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয় রক্ষী,
– চুপ, শালার পুত! কারেন্ট না আসলে না আসছে। হাজতের ভিতরে বইসা তুমি আরাম-আয়েশ খুঁজো?
অসীম আঁধারে লোকটার চাউনি সেভাবে বোধগম্য হলো না, তবুও কণ্ঠের তুচ্ছতা, ঘৃণা পরিমাপ করে তাওহীদের মনটা ছোট হয়ে গেল। অবুঝ বালকের মতো গিয়ে বসল কোনার দেওয়াল ঘিরে। মাথার অদ্ভূত যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে। বমি বমি ভাবে পেট গুলিয়ে আসছে। তাওহীদ মুখের মাধ্যমে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা চালায়। খানিক দূর হতে ভেসে আসে সেই রক্ষীর অশ্রাব্য সব কথা। কথার মধ্যকার ঘৃণা পরিমাপ করে তাওহীদ মনে করে নিজের মায়ের কথা। মনে করে আলোতে ঘুম না আসা সত্ত্বেও নরম আলো জ্বালিয়ে রাখা হাসানের কথা। মনে করে তার সুপ্রভার কথা। যে কি-না তার দুর্বলতার কখনো সামান্যটুকু হাসেনি, উপহাস করেনি। উলটো অগাধ মমতা, অপার ভালোবাসায় বলেছিল,
– আমি আছি, তাওহীদ।
মুহূর্তেই সকল জমাট বাঁধা দুঃখে চোখ ভরে আসে তাওহীদের। চক্ষু ভর্তি জলে অতল আঁধার আরোও বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। দানবীয় শক্তিতে তেড়ে আসে তার দিকে। চোখের জল ছেড়ে দিতে হয় তাকে। আর রুদ্ধ কণ্ঠে কেবল বলে,
– নেই সুপ্রভা। আপনি নেই। আপনি কোথাও নেই। আমি পাচ্ছি না আপনাকে। কোথাও পাচ্ছিনা। আপনি কোথাও নেই….
চলবে~
_____
#অকিঞ্চন
#শারমিন_ইরান