গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – বিশ (প্রথম অংশ)
_____
অলস দুপুরের কালে ছটফটে পাখির মতো দরজা গলিয়ে উঁকি দিতে দেখা গেল নিশীকে। মুখজুড়ে তার ভাসমান মেঘের নির্মলতা। ছেলেমানুষী পূর্ণ চোখে চেয়ে দরজা গলিয়ে ভেতরে এলো। শব্দ পেয়ে প্রাণহীন আসমান থেকে চোখ ফেরাল প্রভা। নিশী হাসিমুখে বেশ লম্বা সুরে ডেকে উঠল,
– আপাআআআ! দেখ আমি কিনে নিয়ে এলাম।
প্রভা তাকাল। ভীষণ অনাদৃত দৃষ্টিতে দেখল নিশীর হাতের বস্তুটি। গোলাপ। একটি গোলাপি রঙের গোলাপ। বলতে হয়, লাল পাড়ের সাদা শাড়ির ন্যায় গোলাপী পাড়ের সাদা গোলাপ। রঙটা চোখের লাগার মতো নয়, মায়া মায়া নরম ভাব দেওয়ার মতো রঙ। ফুলেও বুঝি মায়া থাকে? কে জানে! প্রভা জানে না। প্রভার কিছু না বলাতে নিশীই নিজের বুকে বাক-বাকুম করা আগ্রহ টুকু প্রকাশ করে বলল,
– তোর খুশি লাগছে না? আমার কিন্তু ভীষণ খুশি লাগছে। আমার এতো শখের গাছে শেষপর্যন্ত ফুল ফুটেছে। তোকে আমি বলছিলাম না আমিও দেখব এই গাছে ফুল না ফুটে কেমন করে পারে! এতোদিন কলি দেখেও এতোটা আনন্দ হয় নি যতোটা আজ এই ফুল দেখে হচ্ছে। আ…হা…..
প্রভা দুর্বল কণ্ঠে বলল,
– এখান থেকে যা। ভালো লাগছে না।
নিশী নিজের উল্লাস কমিয়ে কিছুটা নীরব হয়ে প্রভার দিকে চাইল। এরপর হাসি মুখে বলল,
– আপা, আমার বায়নার পরে গাছ টা যে তুই এনে দিলি মনে নেই? তুই এনে দিয়েছিলি বলেই ফুলটা নিয়ে সবার প্রথমে তোর কাছে এলাম। দেখাতে যে ফুলটা কতো দারুণ সুন্দর! ফুলটা দেখেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে।
খানিক বাদেই নিশী এগিয়ে এসে প্রভার হাতে ফুলটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
– এইটা তুই রাখ। তুই আমাকে গাছ দিয়েছিলি। আমি তোকে ফুলটা দিলাম। তোর বোধহয় মন খারাপ; ফুলটার দিকে তাকিয়ে থাক, দেখবি মন এক্কেবারে চনমনে হয়ে উঠবে। আমার যে কী আনন্দ লাগছে! গত দেড় ঘণ্টা যাবত আমি ফুল নিয়ে ফটোশুট করেছি। আমার গাছের প্রথম ফুল। হি হি।
বলেই নিশী চলে গেল দূরন্ত হাওয়ার রূপে বয়ে। এতো শীঘ্রই যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু নিশী বেশ বুঝেছে প্রভার মন ভালো নেই; কারোর খারাপ মনে সে কথা বলতে পারে না। মানুষের মন খারাপে তাকে অযথা ত্যক্ত করার অভ্যেস নিশীর নেই। বাকি দিক বাদ রেখে, এদিকে সে বেশ ম্যাচিওর।উন্নত বোধজ্ঞান সম্পন্ন। তবে ওপর ব্যক্তির মন ভালো থাকলে, সেখানেই অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে দেড়-দু’ঘণ্টা। প্রভা মাঝেমধ্যে ভেবে পায় না তার বোন হয়ে নিশী এমন চমৎকার একজন মেয়ে হলো কেমন করে? কী অকপটে কথা বলে, নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে, মানুষের মন ভালো করার চেষ্টা করে! প্রভা কী কখনো এমন ছিল? ভাবতেই চোখের সামনে পর্দার মতো ভেসে ওঠে নিজের একলা চলার, একলা থাকার সকল গল্প। ছেলেবেলা থেকে তার পাশে অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু কোনো বন্ধু ছিল না। এই ‘বন্ধুত্বের’ অভাবেই হয়তো সময়ের সঙ্গে রঙহীন হয়ে গেছে তার সকল কিছু। মা-বাবা তো আর বন্ধু হলো না, সবশেষে বন্ধুত্বের হাহাকারে মৃতপ্রায় প্রভা আশ্রয় হিসেবে উপহার পেল আফরিন নামক মানুষকে। আফরিনকে একটু ঠাঁই করে হৃদয় চাইল নিশ্চয়তা। যে নিশ্চয়তাকে কেন্দ্র করে একটু বেঁচে থাকা যায়। একটু বাঁচার ইচ্ছে পাওয়া যায়। দমবন্ধ থেকে নিস্তার মেলা যায়। বিচার-বিবেচনাহীন প্রাণখুলে কথা বলা যায়। আফরিনের প্রতি এমন গভীর মমতার কোনো কারণ প্রভা পায় না। হতে পারে সে ব্যতীত তার কথা কখনো কেউ মনোযোগী হয়ে শোনে নি, তাকে কেউ গুরুত্ব দেয় নি এজন্যেই এতো ভালোবাসা। মানুষ স্বার্থপর প্রাণী; মানুষ মানুষকে ভালোইবাসে নিজে ভালো থাকার জন্য, অন্যের জন্য নয়। প্রভা এদিকে বড্ড সার্থপর। সাথে অনেকটা বোকা। বোকা মানুষেরা বন্ধু খোঁজে। এদিকে আবার নিশী বুদ্ধিমতী মেয়ে। একারণেই বোধহয় বন্ধুত্বের পিছে সময় ব্যয় না করে নিজেকেই বন্ধু করে নিয়েছে। প্রভা কেন পারে নি? প্রভারও তো উচিত ছিল। তবে কিছু সময় হলেও তো জীবনটা বেশি উপভোগ করা যেত। কী আশ্চর্য! প্রভার মাঝে এমন বোধ উদয় আগে কেন হয় নি?
_____
থানা অর্থই অসংখ্য মানুষের অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন জটিলতার তাড়নার গল্প। এই যে থানা জুড়ে এস.আই, এ.এস.আই দের ডেস্ক। অগণিত মানুষ। মুখে প্রিয়জনের দুঃসহ চিন্তা। কারো মুখে চনমনে ভাব। কতোই না গল্প, কতোই না হাহাকার সেসব অনুভূতিতে। সকল কিছু একচোখে নিরীক্ষণ করে আবেদন মঞ্জুর হতেই প্রভা ছুটল নিজ গন্তব্যে। তার চলনে সহজ ভাব। যেন থানায় আসা নিত্যদিনের ঘটনা। যেন এই থানা, হাজত তার বহুল পরিচিত কোনো আবাস।
কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছতেই হাজতের বদ্ধ সুবাস নাকি বাড়ি খেল। প্রভার অজান্তেই কোথাও যেন কিছুর সংযোগ হলো। মন বলল, সে একদম সঠিক জায়গায় আছে। তার কয়েক হাত ব্যবধানেই তাওহীদ বসা। আজও প্রভা হাজতেই দেখা করার অনুমতি পেয়েছে। অনৈতিক অর্থের বিনিময়ে যেদিন দেখা করার সুযোগ মেলে, সেদিন হাজতেই সাধারণত আনা হয়। প্রভা তাওহীদের রুগ্ন মুখের পানে তাকিয়ে কী বলবে ভেবে পেল না। কেবল দু’চোখ ভরে দেখে এতোদিনের পিপাসা মেটাতে চাইল। প্রভার ইচ্ছে হলো, তাওহীদকে টুপ করে বুকের ভেতর লুকিয়ে নিতে। যেন আর কখনো তার তৃষ্ণাই না পায়। যেন এই চেহারার পিপাসায় আর সে কাতর না হয়। যেন সে, তার বুক পূর্ণ হয়ে থাকে অশেষ তৃপ্তিতে। একমাস হয়েছে বুঝি না দেখার? না, এতোদিন নয়। পনেরো/বিশ দিন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রভা কথা বলতে গিয়ে দেখল, তার কণ্ঠ গলিয়ে কথা বেরুচ্ছে না। আড়ষ্টতায় তাওহীদের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেরাল প্রভা। খানিকক্ষণ সময় নিয়ে অসংলগ্ন কথা উঠিয়ে ব্যাগ হাতড়ে বলল,
– তাওহীদ! আজ আমি আপনার জন্য টর্চ নিয়ে এসেছি। এই দেখুন।
তাওহীদ বসা ছেড়ে উঠে গেল না। বসে থেকেই অতল গভীর দৃষ্টি নিয়ে তাকাল প্রভার চোখে। দু’চোখ ভরে দেখল তার সুপ্রভার অগোছালো ভাব। বসে থাকাতে মাথা উঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে। ঘাড়ে জমাটবদ্ধ দুঃসহ ব্যথা। উঠে দাঁড়ালেই মাথাটা ঝিমিয়ে ওঠে। দুনিয়া দুলে পড়ে যেতে হয়। তাই উঠে পড়ে প্রভাকে দুশ্চিন্তায় ফেলার ইচ্ছে হলো না। জাদুশক্তির মতো অদেখা কোনো শক্তির বলে প্রাণখোলা সরল হাসি হেসে ফেলল তাওহীদ। সহাস্যে বলল,
– সেই কবে বইলা গেলেন আমার জন্য লাইট নিয়ে আসবেন। আর ফিরে আসলেন এতো দিন বাদে। এইটা কিছু হইলো সুপ্রভা? আমার ভয় লাগে না বুঝি? এতো দেড়ি কেউ করে!
দু’/আড়াই মাস পেরিয়ে এসে এতোদিন বাদে তাওহীদের মুখে পূর্বের মতো মিষ্ট কথা শুনে কিছুটা ভড়কে গেল প্রভা। বুকের ভেতরে মৃদু একটা ধাক্কা খেল তাওহীদের এমন হাসিমুখে।
তাওহীদ ফের বলল,
– কিছু বললেন না যে! হারাই গেসিলেন লাইট কিনতে গিয়া?
বলেই মাথা দুলিয়ে হাসতে আরম্ভ করল তাওহীদ। তার কথাতে পরিবেশটা হয়ে উঠল অধিক সহজ, অধিক প্রাণবন্ত। প্রভা এক পা এগিয়ে লোহার বাঁধায় ঠেকিয়ে ধরল নাক, কপাল, গাল। বাঁধা না থাকলে বোধহয় একছুটে তাওহীদের সামনে গিয়ে বসে পড়া যেত। গারদের শিকে সঙ্গে মিশে গিয়ে ভাঁজ পড়া কপালে প্রভা শুধাল,
– আজ বুঝি আপনার মন খুব ভালো?
তাওহীদ মাথা দুলিয়ে বলল,
– জ্বী, ভালো।
– কেন ভালো?
– মন খারাপ কইরা থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেসি, সুপ্রভা। তাই আর মন খারাপ করতে মনে চায় না। একটু না হয় মন ভালো কইরাই থাকি।
প্রভা দু’চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে চাইল তাওহীদের চোখের ভাষা। অধীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছু জানার আশায়।
তাওহীদ হাসিমুখে শুধাল,
– কেন, সুপ্রভা? আমার মন ভালো থাকলে আপনার ভালো লাগে না?
তাওহীদের কণ্ঠটা কী গভীর শোনাল? শোনাল, বোধহয়। তাওহীদের এমন গভীর, কাতর কণ্ঠ প্রভা সহজে নিতে পারে না। বুকে ব্যথা হয়। এখনো সম্ভবত হলো। বুক ব্যথায় না কী কে জানে, তার দু’চোখ ভরে উঠল টলটলে জলে। কান্না গলায় আটকে প্রভা শুধাল,
– আপনি খুব অসুস্থ তাওহীদ। তাই না?
তাওহীদ প্রভার চোখে চোখ রেখেই ঢোক গিলল। চোখের দৃষ্টি ফেলে ফেলে প্রভার বাক্যটির সত্যতায় বিমূঢ় হলো। সে কৃষ্ণ বর্ণের মানুষ। খটমটে মুখ তার। তার অসুখ বোঝার উপায় তো তেমন নেই। গৌরবর্ণের হলে একটা কথা ছিল। সেসব মানুষের অসুস্থতায় আলাদা একটা ছায়া পড়ে মুখে। মুখ-চোখ রক্তিম হয়। চেহারা বর্ণহীন হয়। তার এসব হওয়ার সম্ভাবনা নেই। না, হতে পারে। হতেই পারে তার জ্বরের প্রভাবে তার কালো মুখ আরোও বেশি কালচে হয়ে উঠেছে। অসম্ভব কী?
তাওহীদ শিক ধরে দুর্বল দেহে উঠে দাঁড়াল। অনুভূতিতে টুইটুম্বুর চোখে চেয়ে রইল প্রভার দিকে। খুব বলতে ইচ্ছে হলো, সুপ্রভা! আমার সত্যিই খুব অসুখ। আমি রাতে ঘুমাইতে পারি না সুপ্রভা। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে খালি ফাঁসি দেখি। দেখি কারা জানি আমারে ধাওয়া করতেসে। আবার জাইগা থাকলেও খারাপ খারাপ আওয়াজ শুনি। হাজতের ভিতরে মানুষ থাকে না অথচ আমি ছায়া দেখি। দেখি যে ছায়া আমার উপরে ধেইয়া আসে। আমারে মারতে চায়। আমার ঘুম হয় না সুপ্রভা। আমি শান্তি পাই না। আমার…আমার কী জানি হইয়া গেল গা। আমার এইখানে আর ভালো লাগে না। থাকতে মনে চায় না। আপনি দেখবেন এইখানে থাকতে থাকতেই আমি অসুখে মইরা যাবগা। আমার এইখানে আর মন টেকে না। সবকিছু অস্পষ্ট স্বপ্ন লাগে। আপনি কিছু একটা করেন, সুপ্রভা। কিছু একটা করেন।
মুখে এর একাংশ বলা হলো না। কেবল বলল,
– আমার অসুখ হইলেই কি আর না হইলেই কী বলেন!
– কী বলেন এইসব? অসুখ হলে এইখান থেকেই ডাক্তার দেখাবে আপনাকে।
সঙ্গে সঙ্গে তাওহীদ বলল,
– নাহ, মজা করতেসিলাম। অসুখ নাই আমার। সকাল থেকে মাথাটা একটু ব্যথা। সাইরা যাবেগা এমনেই। লাইট দেখি….
কিছুটা দূরে দাঁড়ানো কনস্টেবল এগিয়ে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
– কিছু দেওয়া বা রাখা যাবে না। লাইট ও দিয়ে দেন।
তাওহীদ লোকটির দিকে তাকিয়ে লাইটটি বাড়িয়ে ধরল প্রভার দিকে। প্রভা হতাশ ক্লান্তিতে হাতে তুলে নিল সে লাইট। মুখ ঘুরিয়ে বলল,
– মোমবাতি, লাইটার যদি দেই?
এভাবে অনুমতি নেওয়াতে লোকটিকে কিছুটা প্রফুল্ল দেখাল। সম্ভবত নিজেকে খুব বিশেষ উচ্চতর কোনো আসনে বসিয়ে নিয়েছেন। কাট কাট কণ্ঠে বলল,
– একবার কথা কানে যায় না? কোনো কিছুই রাখা যাবে না।
বলেই চলে গেলেন তিনি। প্রভা তাকাল তাওহীদের দিকে। কথা ঘুরাতে অন্য প্রসঙ্গ খুঁজল। তাওহীদের চেহারা, দৃষ্টি-ই নতুন প্রসঙ্গ এনে দিল। বলল,
– চেহারার কী হাল করেছেন আপনি? চোখ দু’টো ভেতরে চলে গেছে। এতো চিন্তা করেন কেন? আমি তো বলেছি এখান থেকে আমি আপনাকে নিয়ে যাব।
– কী হাল হইসে চেহারার?
– মুখটা শুকিয়ে গেসে আপনার। হাড়গোড় তো সব মনেহয় বেড়িয়ে আসবে।
তাওহীদ মাথা নামিয়ে হেসে বলল,
– আমার চেহারা ভালো ছিল কবে যে আজকে খারাপ হবো? আমার চেহারা তো শুরু থেকেই মন্দ একটা চেহারা।
তাওহীদের মুখে এমন কথা শুনে বুকের কোথাও চাপ খেল। যে চেহারাতে প্রভার সকল স্বপ্ন লুকোনো, সেই চেহারা নিয়ে এমন মন্তব্য শুনে সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
– এইসব কী বলেন আপনি!
তাওহীদ জবাব দিল না। প্রভার বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল একভাবে। অন্যদিকে বিস্মিত প্রভা তাওহীদের মন্তব্যে এতো দিনকার সব আবেগ উগড়ে দিয়ে বলল,
– তাওহীদ , আপনি জানেন আপনি কতোটা সুদর্শন! আপনার কপাল, গাল, আপনার চুল, চোখ – সবকিছু কতোটা তীব্রভাবে আমাকে আকর্ষণ করে! আপনি জানেন আপনার চোখে তাকানো মানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা? ওই গভীর চোখে তাকালেই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। কতো শতো বার আপনার চোখে নিজেকে হারালাম, অথচ ফিরে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার হলো না।
একনাগাড়ে সকল কথা বলেই চোখ নামিয়ে নিল প্রভা। অনেকদিনকার মনের কথা বলে ফেলেও এখন বেশ লজ্জা হচ্ছে। তাওহীদের চোখে চোখ রাখার সামান্যটুকু সাহস হচ্ছে না। আজ তাওহীদের সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ কথা বলবে বলে ভেবে রাখা প্রভার এই মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছে এক ছুটে পালিয়ে যেতে।
তাওহীদ ভরাট আদর কণ্ঠে বলল,
– আপনি না থাকলে আমার এই সুন্দরের কথা জানাই হইতো না। মরণ পর্যন্ত মনে হইতো আমি খুব মন্দ দেখতে একটা মানুষ।
প্রভা চোখ তুলে বলল,
– আর এখন কী মনে হচ্ছে?
তাওহীদ মৃদু হেসে বলল,
– আমি খুব সুন্দর একজন মানুষ।
তাওহীদের চোখে চেয়ে প্রভার বলতে ইচ্ছে হলো, আপনি অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী, তাওহীদ। কিন্তু বলা হলো না।
আচম্বিত অনেকদিন ধরে মনে আসা প্রশ্ন খেয়াল হতেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে চিন্তিত চোখে তাওহীদ জানতে চাইল,
– সুপ্রভা, ওরা কী আপনেরে এখনো বিরক্ত করে?
প্রভা বুঝতে পেরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– নাহ। করে না।
তাওহীদ আরোও একটু ব্যাকুল হয়ে শুধাল,
– ওরা কী এলাকায় আপনের নামে খারাপ কোনো কথা ছড়াই দিসে?
– নাহ। ছড়ায়নি।
তাওহীদকে তবুও কিছুটা উদ্বিগ্ন দেখাল। সে বোধহয় প্রভার কথা বিশ্বাস করে নি। তাই প্রভা নিজে থেকেই বলল,
– আমার নামে বদনামি ছড়ানোর কোনো প্রমাণ তো তাদের কাছে নাই। আর আমার নামে কিছু বলতে গেলে তাদের কথাও উঠে আসবে। তারা নেতা মানুষ। নিজেদের ইমেজ নষ্ট করবে কোন দুঃখে! তাই আড়ালে থেকে সব রাগ আপনার উপরেই ঢালছে।
বলেই থেমে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে উপেক্ষিত হাসি হাসল প্রভা,
– অবশ্য খুব বেশি কষ্ট তাদের করতে হচ্ছে না। কটা ঘুষ দিয়েই সব কাজ করিয়ে নিচ্ছে। নেতাদের মুখের উপরে কথা বলবে কার সাহস!
এই পর্যায়ে তাওহীদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
– একবার বের হইয়া নেই। সব কয়টারে জ্যান্ত কবর দিব।
বলার ধরনে হেসে ফেলল প্রভা। সহাস্যেই বলল,
– আপনি যে সহজ মানুষ! আপনারে দ্বারা জ্যান্ত কবর দেওয়া হবে না।
নিজ অহমে এমন তীক্ষ্ণ মন্তব্য সহ্য করা যায় না। তাওহীদ কিছুটা অভিমানী গলায় গম্ভীর হয়ে বলল,
– সুপ্রভা! আপনি মনে হয় ওইদিনের আমার করা মাইরপিট ভুইলা যাইতেসেন।
আবারো হেসে ফেলল প্রভা। সময় ভুলে, কাল ভুলে, স্থান ভুলে একসঙ্গে হাসতে লাগল দু’জনে। আজ কতোদিন বাদে এমন সহজভাবে কথা বলা হলো, মনে পড়ছে না। কেবল মনে হচ্ছে, সামনের এই পুরুষটার কাছে প্রভা চাইলেও আর দৃঢ় হতে পারে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তার তুলতুলে সত্তা ঠিকই বেরিয়ে আসে। তবে স্থানটা ভিন্ন হলেও পারতো। তারা হাজতে না থেকে, শাপলা স্বরণীর মাঠে বসলেও পারতো। সামনে এক দিঘী রেখে না হয় সে দৃষ্টি রাখত তার নিজস্ব দিঘী-মানবে। কিন্তু…..প্রভার উজ্জ্বল মুখ সামান্য নিভে গেল। নিভু মুখেই হাত ঢুকাল নিজের ব্যাগে। হাতের মুঠোতে কাঙ্ক্ষিত জিনিস নিয়ে লুকিয়ে নিল ভীষণ যত্নে। ঠিক সেই মুহূর্তে কনস্টেবল তাড়া দিয়ে বলল,
– সময় শেষের পথে।
কথাটা শুনেও গ্রাহ্য করতে ইচ্ছে হলো না। না শোনার মতো করেই তাওহীদকে প্রভা বলল ,
– হাতটা একটু বাড়াবেন?
তাওহীদ বিপরীতে প্রশ্ন চোখে চাইল। প্রভা বলল,
– একটু ধরব বেশি না।
তাওহীদ যন্ত্রের মতো বাড়িয়ে দিল নিজের হাত। প্রভা দু’হাতে তাওহীদের হাত ধরতেই চোখ ছাপিয়ে পড়ে গেল দু’ফোঁটা অশ্রুজল। হাতটা মাথায় ঠেকিয়ে রাখল বেশ অনেকক্ষণ। মাঝে লুকনো সেই বস্তুটিরও আদান-প্রদান ঘটে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন প্রভা মাথা তুলল না, তাওহীদ অপর হাত নিয়ে রাখল প্রভার মাথায়। প্রভা মাথা উঠিয়ে কিছুটা রাগী, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– আপনি আমাকে একটা জিনিস দেবেন, তাওহীদ?
তাওহীদ ম্লান হেসে বলল,
– আমার সাধ্য সম্পর্কে আপনার ধারণা পরিষ্কার। সাধ্যের মধ্যে চাইলে আমি অবশ্যই দিব।
গলায় কান্না আটকে বলল,
– আমাকে… আমাকে ‘আপনাকে’ দিবেন?
তাওহীদ বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইল প্রভার দিকে। কতো পল পেরিয়ে গেল তাও কথা বেরুলো না কারোর মুখ থেকে। তারও বেশ খানিকক্ষণ পরে তাওহীদ নীরব থেকে বলল,
– উপায় জানা নাই আমার।
প্রভা দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
– আমার জানা আছে। আগে আপনাকে এইখান থেকে বের করি এরপরে বাকিটাও দেখে নিব। শুধু আপনাকে আমার পাশে থাকতে হবে। থাকবেন না পাশে?
তাওহীদ কোনো উত্তর দিতে পারে না। প্রভা নিজে থেকেই বলে,
– থাকতেই হবে। কথা দিয়েছেন কিন্তু আমায়। তাও আমাকে ছুঁয়ে।
– আর সময় দেওয়া যাবে না। চলে আসেন।
প্রভা সেদিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয় তাওহীদের। চোখের অশ্রু মুছে দৃঢ় চোখে তাকায় তাওহীদের দিকে। ঘুরে চলে যেতে নিলেই তাওহীদের মন ভেঙে যায়। আজও চলে যাবে? আর একটু থাকা যায় না? প্রভার এক কদম দূরে সরে তো তাওহীদ দেখে শ’ কদমের দূরত্ব। গায়ের জ্বর যেন প্রকট হয়ে তেড়ে আসে। মনে হয়, সুপ্রভা চলে গেলেই তাওহীদ মারা যাবে। মারা যাবে ভীষণ জ্বরে। ডেকে ওঠে তাওহীদ,
– সুপ্রভা!
প্রভার থম ধরা দৃষ্টিতে তাওহীদ বলে,
– আরেকটু থাকা যায় না?
তাওহীদের একটি কথাতে প্রভার জন্য সকল নিয়ম তুচ্ছ হয়ে পড়ল। পুতুলের মতো এগিয়ে এসে গ্রিল ধরে বলল,
– খুব যায়।
তাওহীদ সরল গলায় বলল,
– আপনার কাছ যদি আমি একটা আবদার করি, আপনি রাখবেন সুপ্রভা?
প্রভা মাথা নাড়ল। তাওহীদ হাত বাড়িয়ে এই প্রথমবারের মতো প্রভার গালে হাত রেখে বলল,
– আপনি আপনার রাগ আমি ছাড়া আর কাউরে দেখাবেন না, সুপ্রভা। মনে থাকবে?
প্রভা মাথা নাড়িয়ে সুন্দর হেসে বলল,
– খুব থাকবে।
তাওহীদ হাত সরিয়ে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বলল,
– এখন তাইলে চইলা যান।
প্রভাও ঘুরে চলে যেতে নিলে তাওহীদ ফের ডেকে বলে,
– ভালো থাকবেন, সুপ্রভা।
সুপ্রভার দৃষ্টিতেও হয়তো একই কথা ভেসে ওঠে। কিন্তু বলা হয় না। প্রভা চলে যায়। যেতে পথে ফিরে ফিরে তাকায়। প্রভার আকার নিরাকার হতেই তাওহীদের শক্তি ফুরিয়ে আসে। হতে পারে, প্রভাই ছিল তার ঔষধ। ঔষধ ও নেই, শক্তিও নেই। তাওহীদ দুর্বল পায়ে তার বন্ধু দেয়ালের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। আর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাতে থাকা ফুলের দিকে। তাওহীদ আশ্চর্য হয়ে শোনে সেই ফুলের অদৃশ্য কণ্ঠের একটি কথা — ‘ভালোবাসি’।
চলবে-
_____
গল্প – অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – বিশ (২য় অংশ)
_____
তাওহীদের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর থেকেই প্রভার মন বিশেষ ভালো নেই। তাওহীদের চেহারায় প্রকাশ্য অসুস্থতা অথচ মানুষটা বলে কি না অসুস্থ না। প্রভা সোনালি রঙা রোদের দিকে চেয়ে রইল একাধারে। সকল চিন্তা ছেড়ে ফোন লাগাল রাশেদ রহমানের নাম্বারে। কিছু মুহূর্ত পরে কল ধরতেই রাশেদ রহমান লম্বা সালাম দিলেন। প্রভা সালামের উত্তর দিয়ে জিগ্যেস করল,
– আপনার কাজ কতোদূর?
রাশেদ রহমান আমোদ গলায় বললেন,
– কাজ হইলো অন দ্যি ওয়ে। পৌঁছায়তেসে কাজ। খুব শিগগিরই হইয়া যাবে বইলাই আমার বিশ্বাস।
– আরোও একটু তাড়াতাড়ি করা যায় না?
রাশেদ রহমান আরোও একটু আমোদিত কণ্ঠে বললেন,
– মা! জন্ম তাইলে অন্য দেশে নিতেন। এই দেশে যেহেতু নিসেন এই দেশের নিয়মেই তো কাম আগাইবো, তাই না? তাও আবার কেসের যা হাল, জামিন সাময়িক ভাবেও হইবো কি-না বুঝতে পারতেসি না।
– অযথা অবান্তর কথা বলবেন না। জামিন হওয়ার শিওরিটি যদি এক পার্সেন্ট ও থাকে, তবে সেই এক পার্সেন্টকে সম্বল করেই আপনি চেষ্টা করবেন। করতে হবে।
– জ্বি, আমি তা তো করতেসিই। করাই তো আমার প্রোফেশন।
– জ্বি, রাখছি।
– মিস, প্রভা। আমার পেমেন্টটা কিছু আগে করে দিতে হবে। বুঝেন-ই তো কোর্ট, ফাইলিং, ডকুমেন্টস কতো দিকে ব্যয় করতে হইতেসে।
প্রভা অধিক বাক্য ব্যয়ে না গিয়ে শুধাল,
– কবে দিব?
– পরশু পাঠাই দিয়েন।
– জ্বি, দিব। রাখছি তবে।
_____
প্রভাকে বের হতে দেখেই মাহমুদা এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন,
– কোথায় যাচ্ছিস?
প্রভা ঘুরে মায়ের দিকে তাকাল। সে এই মুহূর্তে যাবে রাশেদুর রহমানের নিকট। এই মুহূর্তে তার বিশেষ তেমন কাজ নেই। তাই মনে হলো সে যেহেতু টাকা চেয়েছে তাহলে নাহয় দিয়ে ফেলা যাক। হতেও পারে, টাকার জন্য তিনি কাজে মনোযোগ-ই দিলেন না। তাওহীদ সম্পর্কীয় ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি প্রভা নিতে ইচ্ছুক নয়। প্রভা বলল,
– একটু বাইরে যাব।
– বাইরে কোথায়?
– এখানেই।
– যাওয়া চলবে না।
– কেন?
মাহমুদা এগিয়ে এসে প্রভার হাত ধরলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
– না মানে না। বাইরে যাবি বললেই হলো? একটু পরে তোর বাবা আসবে। এসেই জিগ্যেস করবে তোর কথা। তখন আমি কী বলব? বাপ তো পাইছিস একটা। না শুনে না বুঝেই চোটপাট লাগাবে। চুপচাপ ঘরে যাহ।
প্রভা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল। পারল না। না চাইতেও কণ্ঠে জেদ প্রকাশিত হলো,
– তোমরা সবকিছুতে এমন কেন করো? আমাকে মানুষ মনে হয় না?
মাহমুদা বেজায় বিরক্ত হলেন,
– চুপচাপ ঘরে যাবি তুই? নিত্যদিন এইসব চেঁচামেচি আর সহ্য হয় না। ঘরে যাহ।
প্রভা চোখে চোখ রেখে বলল,
– যাব না।
মাহমুদা আশ্চর্য হয়ে ধমকে উঠলেন,
– যাবি না কেন?
– আমার ইচ্ছা।
-তর্ক করো তুমি! তর্ক করা শিখসো? এতো তর্ক কার জন্য?
প্রভা কিছুটা চেঁচিয়েই বলল,
– যার জন্যই হোক। কী করবা তুমি?
মাহমুদা কিছুটা আছড়েই ফেললেন প্রভার হাত। জেদের চূড়ান্তে পৌঁছে বললেন,
– কী করব তা তোর বাপ আসলেই দেখিস। তোর জন্যে প্রতিদিন ঝামেলা সহ্য করব না। কোন জন্মের পাপে যে পেটে তুই হইসিলি খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না।
বলেই হিসহিসিয়ে চলে গেলেন মাহমুদা। ঠায় দাঁড়ানো প্রভা দেখতে লাগল তার সামনেই তার মা কেমন করে সদর দরজায় তালা লাগিয়ে তাকে হারিয়ে দিলেন। অদূরে অন্য ঘরের দরজায় ভীত মুখে নিশী দাঁড়ানো। মেয়েটা কী কাঁপছে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভা ভাবল, আর কতো সহ্য করবে সে?
_____
প্রভা টাকাগুলো গুছাতে গুছাতে আফরিনকে শুধাল,
– আসার পরে মা ঝামেলা করেছে?
আফরিন চটপট মাথা নেড়ে বলল,
– কই না তো! কেন?
প্রভা টাকাগুলো আরেকবার গুণে নিল। গোণা শেষে বলল,
– ফোনে বললাম না, দু’দিন যাবত আমাকে কোথাও বেড়োতে দিচ্ছে না। দু’দিন আগে অযথা চেঁচামেচি করল। যাই হোক, বাদ দেহ। নে….টাকাগুলো দিয়ে দিস ঠিকানা অনুযায়ী।
আফরিন টাকা না ধরেই বলল,
– টাকাটা তুই-ই দিতে পারিস, প্রভা।
প্রভা আফরিনের চোখে তাকিয়ে বলল,
– আফরিন, আমি পারলে তোকে দিতাম না। আর আমাকে মনে হয় না খুব সহজে বেরতে দিবে। অযথাই বেশ বিরক্ত করছে আমায়। আর তাদের সাথেও বাচ্চামি রাগ দেখাতে মনে চায় না। কারণ তারা চেঁচামেচি করে ক্লান্ত হয় না, হই আমি। অতিষ্ঠ হয়ে উঠি। নিজেকে পাগল পাগল বোধ হয়। তাই তুই নিয়ে যা, বন্ধু। আমি চাই না টাকার জন্যে তাওহীদের কেস আটকে থাকুক। হতেও পারে সে টাকার জন্য হতাশ হয়ে কাজ এগুচ্ছে না। তুই নিয়ে যাহ। তুই আর আমি কী আলাদা হলাম না কি? আমি দেওয়া যা, তুই দেওয়াও তা। টাকা দেওয়া নিয়ে কথা। আমি তোকে উনার চেম্বার এর ডিটেইলস পাঠিয়ে দিব। লাগলে তার থেকে নিয়ে বাসার লোকেশনও পাঠিয়ে দিব। ঠিকাছে?
আফরিন জবাব দিল না। প্রভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তুই কী কোনোভাবে ভয় পাচ্ছিস?
– এতো টাকা! ভয় লাগবে না?
– হুর পাগল! ভয়ের কী আছে? আমি বিশ্বাস করি তোকে। নে….
আফরিন টাকাগুলো নিজের হাতে নিয়ে ব্যাগে ভরল। প্রভার চোখে গভীর দৃষ্টি তাঁক করে বলল,
– এই যে তুই এতো যন্ত্রণা পাচ্ছিস, এতো এতো সময় ব্যয় করে তাওহীদকে জামিন করাতে চাইছিস, এই যে এতো টাকা এতোকিছু করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করছিস! যদি হেরে যাস? ধর, তাওহীদ বের হলো। কিন্তু তোকে আর কোনো মূল্য দিল না, তখন? আবার ধর আংকেল-আন্টিই তোর বিয়ে অন্য কোথাও দিল তখন? তুই যার জন্য এতোসব কিছু করছিস, শেষে গিয়ে যদি সে তোর না-ই হয়, তখন?
প্রভা আফরিনের কথার গভীরতা উপলব্ধি করে থেমে গেল। থম ধরে চেয়ে রইল বেশ খানিক সময়। এরপর আচমকাই যেন কিছু হয় নি এমন ভাবে উঠে গেল টেবিলের কাছে। সাবলীল গলায় কেবল বলল,
– আমার হয়ে না থাক, এই দুনিয়াতে তো থাকবে।
_____
গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ গাছ, উদার আসমান পেরিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে গাড়ি। গাড়ির জানালাতে মুখ ঠেকিয়ে বসে আছে প্রভা। গন্তব্য তাদের ফুপির বাড়ি। হঠাৎ কোন উপলক্ষে তাদের যাওয়া তা প্রভা জানে না। সকাল সকালই বাবা এসে একপ্রকাশ হুকুম ছেড়ে গেলেন। সবাই যাবে মানে যাবেই। প্রভা না বললে, বারণ করলেও সেসবে কান দেওয়া হলো না। কেবল বলা হলো, রাতেই ফিরে আসবে। প্রভাও আর বাড়াবাড়ি করে নি। বিরুদ্ধে যায় নি। সে তার ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে যেতে পারে কেবল দু’জনের কাছেই। আর তারা— আফরিন এবং তাওহীদ। তারা ছাড়া সকলের সামনে না চাইতেও কেমন যেন গুটিয়ে যায়। গাঁট হয়ে আসে শরীর, মন।
প্রভা অদূর দূরের অস্বচ্ছ ছবির মতো দৃশ্য দেখে তাকিয়ে রইল। ফুপির বাড়ির এদিকটার সৌন্দর্য বেশ মনোমুগ্ধকর। ভয়ংকর আকর্ষণীয়। ছেলেবেলাতে ড্রইং সাবজেক্টে যেমন দৃশ্য আঁকা হতো, দূরের দৃশ্যটাও কিছুটা সেরকম। যেন কোনো ছবি বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রকৃতিতে গেলে মন ভালো হয়। প্রভারও বোধহয় হলো। নির্মল, সুগন্ধি বাতাসে বুকের দুশ্চিন্তা উড়ে গিয়ে বুকটা কিছুটা হলেও হালকা বোধ হলো। আজ টাকা জমা দেওয়ার কথা। নিশ্চয় এতোক্ষণে আফরিন বেরিয়ে পড়েছে। টাকা যেহেতু রাশেদ রহমান পেয়ে যাচ্ছে, সেহেতু কেসে হেলা-ফেলা করবে এমন দুশ্চিন্তার আর কারণ নেই। নিশ্চিন্ত মনে কেবল দোয়া করা যায়। না চাইতেও ঠোঁট’টা সামান্য বেঁকিয়ে প্রভার মুখে হাসি ফুটল। নীল আসমানের ভাসমান মেঘের সৌন্দর্যে গলে গিয়ে মন বলল, এবার বোধ করি তার জীবনের সকল সমস্যার অবসান হওয়ার সময় এসেছে। বুকের কোথাও তীব্রভাবে সুখ সুখ ব্যথা হলো। জীবনের তরঙ্গে সুর মিলে গিয়ে প্রভার মনে এলো নানান রঙিন ভাবনা। ঠিক করে ফেলল, তাওহীদের জামিন হতেই সে আর তাওহীদ পালিয়ে যাবে কোনো দূর অজানায়। বানাবে খড়ের একটা ছোট্ট ঘর। জীবন-সংসারের জটিলতা ছাপিয়ে তাদের হবে রূপকথার সংসার। একটা রঙিন সংসার। তাওহীদ চাইলে অবশ্য তার মাকেও নিতে পারে। মানুষটা মাকে অকল্পনীয়ভাবে ভালোবাসে। সেভাবে মা প্রসঙ্গে কথা না বললেও যতোটুকু বলেছে, তা থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই তাদের রূপকথার সংসারে সে থাকা খুব অসুবিধের কিছু নয়। আচ্ছা, তাদের সংসারের অনেকবছর পরে গিয়ে বুঝি সন্তান হবে? নরম, তুলতুলে, ছোট্ট শরীর আসবে? তার সন্তান হবে? তার আর তাওহীদের? প্রভা খুব করে ভেবে নিল, সে ভীষণ ভীষণ ভালো একজন মা হবে। বন্ধু-মা হবে। খুব চমৎকার একজন মা হয়ে পুরো পৃথিবীকে দেখিয়ে দেবে, দেখো পৃথিবী! সন্তান অর্থ প্রতিযোগিতার বস্তু না। সন্তান অর্থ একটি ভিন্ন, জীবন্ত প্রাণ। যার কি-না আলাদা সত্তা আছে, শখ আছে, জীবন-দর্শন আছে। যার নিজের মতো করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তখন নিশ্চয় তার সন্তান সবাইকে বলবে, আমার মা বেস্ট মা।
– আপু তুই এমন সুন্দর করে হাসছিস কী দেখে?
প্রভা ভীষণ চমকে নিশীর দিকে তাকাল। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফেরাল বাইরে। বোধ ফিরে পেতেই খুব লজ্জা হলো। এসব কী ভাবনা তার! তার ভাবনা তো রীতিমতো মাত্রা ছাড়িয়ে হুরহুর করে বেড়ে চলেছে। কী আশ্চর্য! নিজের ভাবনায় রাগ দেখাতে গিয়েও ইচ্ছে হলো না। থাকুক না রঙিন কিছু স্বপ্ন। কে জানে, সৃষ্টিকর্তা চাইলে তো পূরণ ও হতে পারে। তাই না?
_____
গুরুজন চেহারার জেলারকে নিজের হাজতের সামনে দেখে তাকিয়ে রইল তাওহীদ। বলল,
– কিছু বলবেন?
লোকটি কিছু বলতে পারল না। কিছুটা আশ্চর্যের হলেও সত্য, এই মুহূর্তে তার ডিউটি শেষ, বাসায় ফিরবে। অথচ এমন একটা সময়ে তার কেন একটিবার তাওহীদকে দেখে যেতে ইচ্ছে হলো তা আর বুঝে ওঠা হলো না। তাই তো ঘুরে এসে একবার দাঁড়িয়ে রইলেন হাজতের সামনে। আজ হাজতের বাইরে জেলার নেই। সবসময় অবশ্য থাকে না। লোকটি একাধারে চেয়ে থেকে বললেন,
– তোমার শরীর বোধহয় বেশি খারাপ। শরীর খারাপ হইলে এখানে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা আছে। বলো না কীসের জন্য? উঠে আসো। উঠে আসোতো গায়ে হাত দিয়ে দেখি জ্বর বেশি কি না।
তাওহীদ একভাবে তাকিয়ে থেকে মলিন হাসল। মিথ্যা বলল,
– জ্বর নাই।
লোকটি ভ্রু কুঁচকে বলল,
– জ্বর না থাকলে খাইতেসো না কীসের জন্য?
তাওহীদ খাবারের দিকে চেয়ে বলল,
– মুখের স্বাদ কেমন কইরা জানি কইমা যাইতেসে দিন দিন। তাই খাইতে একটু অসুবিধা হয়।
এরপর বেশ কিছুক্ষণ লোকটি, তাওহীদ কিছুই বলল না। নীরব হয়ে গেল স্থান। নীরবতা ভেঙে তাওহীদ বলল,
– স্যার, একটা কথা বলবেন?
– বলো?
– ফাঁসি দেওয়ার সময় তো মুখ বাঁইধা নেয় কালো কাপড় দিয়া। এখন আমি যদি বলি অন্ধকারে আমার ভয় করে তাহলেও কী বাঁধব? স্যার, আপনি কী একটু ব্যবস্থা করতে পারেন যাতে আমার মুখটা কালো কাপড়ে না বাঁধে সেজন্য?
বিস্মিত, তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে তাওহীদের কথা বুঝতে চেষ্টা করলেন লোকটি। বেশ খানিকক্ষণ বাদে কিছুটা ধমকেই বললেন,
– এইসব কী কথা বলতেসো তুমি! আর তোমার ফাঁসি তো দূর তুমি যে দোষী তাই তো নিশ্চিত হয় নাই। তাইলে ফাঁসি আসে কীভাবে?
তাওহীদ জবাব দিল না। বলতে পারল না, তার এই হাজতে খুব ভয় করে। যেদিকে সে তাকায়, সেদিকেই মনে হয় কেউ চেয়ে থাকে তার পানে। হাসে খিকখিক করে। অনেকসময় তো ফিসফিস করে কথাও বলে। সবই শুনে তাওহীদ, সবই বোঝে। কিন্তু অন্যরা বোঝে না, বুঝতে চায় না। তাওহীদ একভাবে চেয়ে রইল নিচের দিকে। লোকটির কী মায়া হলো? সে বলল,
– তুমি কী এইগুলা নিয়া বেশি চিন্তায় আছো? চিন্তা কইরো না। আল্লাহরে ডাকো। এমন দুশ্চিন্তা করলে চলব নাকি? তোমার অবস্থা দেখি খুব খারাপ।
তাওহীদ দ্বিতীয়বার আর মাথা তুলে তাকাল না। নীরবে টুকটুক করে খেতে লাগল বিস্বাদের খাবার। নাহ, এখন বোধহয় তৃপ্তি পাওয়া যাচ্ছে…
~চলবে
_____
গল্প- অকিঞ্চন
গল্পকার – শারমিন ইরান
পর্ব সংখ্যা – বিশ (তৃতীয় অংশ)
_____
তাওহীদের কানে অবিরাম সুর তুলে বেজে চলেছে প্রভার বলা বিস্ময়কর কথারাশি। বিস্ময়কর নয়, রীতিমতো অবিশ্বাস্য কথা। অথচ কী নিঃসংশয় ভঙ্গি ছিল প্রভার কণ্ঠে। সে কী প্রেম, সে কী মাধুর্য! কতো অবলীলায় বলে ফেলল,
– আপনি জানেন আপনি কতোটা সুদর্শন! আপনার কপাল, গাল, আপনার চুল, চোখ – সবকিছু কতোটা তীব্রভাবে আমাকে আকর্ষণ করে! আপনি জানেন আপনার চোখে তাকানো মানেই নিজেকে হারিয়ে ফেলা? ওই গভীর চোখে তাকালেই নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হয়। কতো শতো বার আপনার চোখে নিজেকে হারালাম, অথচ ফিরে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার হলো না।
কথাগুলো বলে যাওয়ার আজ প্রায় তিন দিন হয়ে এলো। অথচ আজও কথাগুলো সুরের লহরী তুলে নৃত্য করে চলে। থেকে থেকে মনে পড়ে। এই বদ্ধ কারাগারে বসে, জীবন-মরণের অনিশ্চয়তার মাঝে ঝুলে হঠাৎ বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়। প্রেমময় মিষ্টি-ব্যথায় কাতর হয় হৃদয়। নিজের এমন সৌন্দর্যের বর্ণনায় নিজের অজানাতেই এক ফালি আত্মবিশ্বাস বুক ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়তে চায়। বিশ্বাস করতে ভীষণ ইচ্ছে হয়, হ্যাঁ সুন্দর। তাওহীদ অবশ্যই সুন্দর। ছেলেবেলা থেকে নিজের নানান ত্রুটি শুনে আসা তাওহীদ অবশ্যই অবশ্যই সুন্দর। বুক পূর্ণ ছেলেমানুষী তৃপ্তি নিয়ে তাওহীদের ভীষণ ইচ্ছে হয় একটিবার নিজের সৌন্দর্য নিজ চোখে উপভোগ করার। এর আগে মানুষ কেবল তার ত্রুটিই চিহ্নিত করেছে। সে কালো, সে চোখে পড়ার মতো উঁচা-লম্বা নয়, তার দৈহিক গড়ন ভালো নয় – আরোও কতো ত্রুটি! সকলের কথাতে বহু নীরবে, অযত্নে নিভে গেছে তার আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রেম। আর আজ এই পর্যায়ে এসে কি-না শোনে সে সুর্দশন!
ইশ, ভুল হলো! খাবারের পর পরই যদি কাসার থালায় মুখটা দেখে নিতো তবে ভালো হতো। এখন অবশ্য সে খাবার খায়-ই না বলতে হয়। খেতে চায়, তবে তীব্র বিস্বাদে খাবার গেলা হয় না। শুরুতে এমন সংকটে পড়তে হয় নি। ইদানীং যেন বেশি-ই হচ্ছে। কিছুই খেতে মনে চায় না। হৃদয়-প্রাণ-মস্তিষ্কে ঘোরে কেবল একটিমাত্র বাক্য- কবে বেরুবে সে? এই চার দেয়ালের প্রতি তীব্র অভিমানে ছোট মন নিয়ে বসে থাকে সে। মন খারাপ হয় পুরো দুনিয়ার প্রতি। যাই হোক, উপায় যখন নেই, তখন আগামী দিনের অপেক্ষা করাই শ্রেয়। কাল সকাল বেলাতেই দু’চোখ ভরে একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে নিজের সুদৃশ্য মুখ। তাওহীদ মলিন হাসল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইল একভাবে। আজ অনেকদিন পরে মনটা অযথাই বেশ ভালো। চনমনে, ফুরফুরে। ঘাড়-ব্যথা, মাথা ব্যথা অনেকটাই কম। শরীরের দুর্বলতাও তেমন নেই। জ্বর তার ওপর চড়াও হতে না পেরে শেষমেশ পালিয়েই গেল। জ্বর গেছে তবে তার বংশবিস্তার রেখে নিতে ভুলে গেছে। এখন ঘুমটা যদি ঠিকঠাক হতো, তবেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যেত। তাওহীদ ঘাড় ফিরিয়ে এদিক-ওদিক অহেতুক চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করল। গত দিন থেকে হাজতে সে একা। তার পাশের লোকটিকে কাল কোথায় যে নিয়ে গেল, আর ফিরিয়ে নিয়ে এলো না। চারিপাশ তাকিতুকি করে তাওহীদের নিভে যাওয়া ভয়টা একটু একটু করে জ্বলে উঠতে চাইল। বুকের ভেতর ধিক ধিক করতে লাগল অস্থিরতা। সে যতোই থাক শান্ত থাকতে চায় তবুও মন বলে কোথাও যেন কিছু একটা ঠিক নেই। কোথাও যেন সে তার জীবনের তাল হারিয়ে চলেছে। তাওহীদ নড়েচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। সজোরে কয়েকবার শ্বাস ফেলে ভেবে নিল, সে এখন, এইমূহুর্তে ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমোবে মানে ঘুমোবে। এখানে আর কোনো কথা নেই। কোনো অস্থিরতা, ভয়ও নেই। সে আসতে দেবে না। তাওহীদ নীরবে শিশু বালকের মতো শুয়ে পড়ল। তার শুয়ে পড়ার ভঙ্গি, তার চালচলন সবকিছুতে সরলতা যেন ঝরে ঝরে পড়ে। আর সেই সরলতায় আসমান ঢেলে আদর করে যায় এই সৃষ্টিকুলের সকল কিছু। এই যে বালিশে মাতা পেতে গালের তলায় দু’হাত মুঠো করে শুয়ে পড়ল, এও তো এক মায়ার ভঙ্গি। মনে হয় কোনো ছেলেবেলার রূপকথার পরী যদি উদয় হতো, চট করে তাওহীদের পাশে বসে যদি কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিত, তবে বোধহয় এই মায়ার দৃশ্য কিছুটা পূর্ণতা পেত। তাওহীদ শুয়ে পড়ে মস্তিষ্কের সঙ্গে এক প্রকার যুদ্ধ করেই ঘোষণা দিল দৃঢ়, গভীর নিদ্রার।
রাতের মধ্যভাগ। সময় কতো বলা যাচ্ছে না। নিশাচরের তীক্ষ্ণ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চার দেওয়াল জুড়ে। তাওহীদ যে বাস্তবে নেই, স্বপ্নে মগ্ন — এ বোধ তার ঠিকই হচ্ছে তবুও তীব্র ভয়ে তার শরীর শক্ত হয়ে আসছে। ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। কিন্তু জেগে ওঠার শক্তি মিলছে না। কী অদ্ভূত অনুভূতি! নিদ্রা-জাগরণের মধ্যস্থান। তাওহীদের মাথা কেউ সর্বোচ্চ শক্তিতে পাথর দিয়ে আঘাত করছে। এরপর থেমে গিয়ে লোকটা এগিয়ে এসে তাওহীদের মাথা নিয়ে সেই পাথরে বারে বারে আঘাত করে থেতলে দিচ্ছে। তাওহীদ কতো চিৎকার করছে কিন্তু কারোর একটু করুণা হচ্ছে না। এরপর সকল কিছু অদৃশ্য হয়ে হঠাৎ দেখতে পেল নিজের ছিন্নভিন্ন মাথার অংশ বুকে জড়িয়ে সে দৌড়ে চলেছে। দৌড়ে চলেছে বুকে উতলে পড়া মৃত্যুভয়, তীব্র শঙ্কা নিয়ে।দৌড়ে চলেছে অজানা পথে। হয়তো অজানা সুখের পথে। কিংবা বেঁচে থাকার পথে। দৌড়োতে দৌড়োতে তাওহীদের বোধ হলো সে পৌঁছে গেছে। ওই তো রঙিন রাজ্য। ফুল, পাতায় ঘেরা ছনের ঘর। নানান রঙের প্রজাপতি। রিনরিনে পাখির ডাক। তাওহীদ ওই রঙিন দেশে পৌঁছোনোর লোভে আরোও একটু জোরে দৌড়োতে চাইল। হলো না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে। স্বপ্ন সে মারা যাচ্ছে। কিন্ত কোনো ব্যথা, যন্ত্রণা ভোগ করার পূর্বেই তাওহীদ চমকে উঠে গেল। কয়েক মূহুর্ত থেমে থেমে ঠাওর করতে চাইল নিজ অবস্থান। সারা মুখ তার ঘামে ভেজা। তীব্র গতিতে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। বুকের এই ওঠা-নামায় বুকের মাঝে তীব্র ব্যথা বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। কী আশ্চর্য! স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পরেও এতো অস্থির কেন হচ্ছে সে! একটু স্বস্তি কেন মিলছে না তার! তাওহীদের বড্ড তৃষ্ণা পেল। পানি…পানি কোথায়? তাওহীদ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল তার গায়ে সামান্যটুকু শক্তি অবশিষ্ট নেই। সমস্ত দুনিয়া তার মাথার ওপর দুলে দুলে উপহাস করছে। তাওহীদ চোখ ডলে পরিষ্কার দৃষ্টিতে দেখতে চাইল। হচ্ছে না। কিচ্ছু হচ্ছে না। ওই ছোট জানালা টা হাতের বাম থেকে ডান দিকে কেমন করে গেল? ওই লোহার শক্ত শিকগুলো ওমন করে দুলছে কেন? তাওহীদের চোখ ছাপিয়ে বড় বড় অশ্রুকণা ঝরে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে জেলের দরজায় গিয়ে কাউকে ডাকতে চাইল। কিন্তু দরজটার স্থানও স্পষ্ট বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। সামনে, না পাশে? তাওহীদ কী ভ্রমে আটকে গেল? তাওহীদ শেষ পর্যন্ত ধেয়ে আসা প্রকট ভয় নিয়েও দরজার দিকে পৌঁছে গেল। কিন্তু মনে হচ্ছে বাইরে কেউ নেই, কিছু নেই। কেমন ধূ ধূ আঁধার! তবে কী তার এই হাজতঘর আলাদা হয়ে গেল? সে কী জনমানবের পৃথিবী থেকে বহু দূরে চলে এলো? তাওহীদের হঠাৎ মনে হলো, তাকে সবাই একলা ফেলে চলে গেছে। তাকে এই হাজত ঘরে কবর দিয়ে চলে গেছে। তাওহীদ আচম্বিত চিৎকার করে উঠল। চিৎকার এর পরমূহুর্তেই চারিপাশটা আরোও বেশি অজানা, নিস্তব্ধ ঠেকল। তাওহীদ দিকবিদিকশুন্য হয়ে কেবল অশ্রু ঝরাতে লাগল। ঠিক সেই মূহুর্তে কারোর পায়ের খসখসে আওয়াজে হৃদয়ে আরোও চাপ অনুভত হলো। এইমাত্র…হ্যাঁ এইমাত্র কী চলে গেল এখান দিয়ে? তাওহীদ স্পষ্ট শুনেছে সে পদধ্বনি। গিয়েছে, অবশ্যই গিয়েছে। ভীষণ অস্থিরতায় কাতর তাওহীদের জন্য সামান্য ইঁদুরের চলার গতির ধ্বনিও ভয়ানল ঠেকল। নির্বোধ তাওহীদ ভয়ে গুটিয়ে চোখ ফিরিয়ে চাইল সেই ছোট্ট জানালাতে। আবছা চোখে দেখতে পেল দু’জোড়া চোখ। যারা কি-না হাত বাড়িয়ে ছুঁড়ে দিল তিন তিনটে রশি। হ্যাঁ, ওইতো সেখানে স্পষ্ট ফাঁসির প্যাচ। তাওহীদের বুকে তীব্র আশঙ্কায় রক্তচাপ বেড়ে গেল। শ্বাসের অভাবে ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মানুষের শব্দ কী শোনা যাচ্ছে? কে জানে! সে এই মুহূর্তে আর নড়তে পারছে না। তার মুখটা কী ধীরে ধীরে বেঁকিয়ে যাচ্ছে? এ কেমন দুঃসহ অনুভূতি তার! একেই কী বলে মৃত্যু যন্ত্রণা? তাওহীদের দু’চোখের পানিতে সব ঝাপসা হয়ে গেল। অপার্থিব যন্ত্রণার শেষ মূহুর্তে মনে পড়ল মায়ের মুখ। মা নিশ্চিত তার জন্য অপেক্ষা করবে। অবশ্যই অপেক্ষা করবে। তেলাপিয়া মাছ ভেঁজে, শাক রেঁধে, এক প্লেট ভাত সাজিয়ে অবশ্যই অপেক্ষা করবে। মায়ের সামনে বসে ভাত খাওয়া হলো না। মায়ের মমতা ঘেরা মুখটা দেখা হলো না। একটিবার বুকে জড়ানো হলো না। সুপ্রভাকে শেষবারের মতো তৃপ্ত চোখে দেখা হলো না। একটু কথা বলা হলো না। মেয়েটাকে, মেয়েটাকে ‘তাওহীদ’ উপহার দেওয়া হলো না। একটা ঘর দেওয়া হলো না। কতো ‘না’। কেবল না, না আর না। কতো ঋণ তাওহীদের ছিল। কতো কাজ তাওহীদের ছিল। কিছুই করা হলো না। অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মাঝে থেকে কেবল শেষ একটা আফসোস হলো। সে এই ভুবনে তেমন বিশেষ কেউ ছিল না। বিশেষ কোনো কাজও সে করেনি। সে হারিয়ে যাওয়া মানে চিরজীবনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া। ফিরে আসার সকল পথ বন্ধ। এই ধ্রুব সত্যকে বুকে ধারণ করে তাওহীদের রক্তাক্ত হৃদয়ে কেবল শেষ প্রশ্ন এলো, আচ্ছা, তাকে কী সকলে ভুলে যাবে? কেউ মনে রাখবে না?
নাহ, রাখবে না। নিজেকে মনে না রাখার কষ্টটাই তাওহীদের নিকট প্রকট হয়ে দাঁড়াল। সেই শক্ত কষ্ট বুকে চেপে পড়ে রইল তাওহীদ নামক তুচ্ছ মানব।
_____
লাশ নামানো হলো প্রভার পায়ের কাছে। প্রভা তা স্থির চোখে দেখল। সামনে থাকা পুলিশ তাকে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিগ্যেস করল,
– আপনি ওনার কী হন?
স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। অথচ প্রশ্নটা শুনতেই মাথার মধ্যে কী যেন একটা চিড়িক দিয়ে উঠল। শুন্য মস্তিষ্কে খেলে গেল একটি অদ্ভূত দৃশ্য!
দৃশ্যটা কিছুটা এরুপ-
বাকের ভাইয়ের ডেডবডি গ্ৰহণ করার জন্য রোগা, লম্বা, শ্যামলা মতো যে মেয়েটি ভোর রাত থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো! তাকে জেলার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ডেডবডি নিতে এসেছেন? আপনি মৃতের কে হোন?
মেয়েটি শান্ত গলায় বলল, ‘কেউ না! আমি ওর কেউ না।’
প্রভা চোখ পিটপিট করে পলক ফেলল। হঠাৎ করেই মনে হলো, সে হুমায়ুন আহমেদ এর সুপ্রভা নয়। সে মুনা। আর তার জন্য যে জীবন দিয়েছে সে কোনো তাওহীদ-ফাওহিদ নয়; সে বাকের ভাই। কিন্তু তাওহীদের তো বাকের ভাই হওয়ার কথা ছিল না। তার তো মুনা হওয়ার কথা ছিল না। তার তো সুপ্রভা হওয়ার কথা ছিল। যে কি-না ছেলেবেলাতেই ভুবনের প্রতি এক বুক অভিমান পুষে হারিয়ে গেছিল। প্রভারও তো হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ছিল না? প্রভা ভীষণ শান্ত চোখে সাদা চাদরে আবৃত লাশটির দিকে চাইল। উত্তরের হাওয়া বইছে। শীতকাল চলে এসেছে বোধয়। উত্তরের বাতাসে মুখের চাদর সরবে সরবে ভাব। প্রভা কথা বলতে নিলেও কণ্ঠ দিয়ে কথা বেরুলো না। ঠোঁটে আর্দ্রতার অভাব। ঠোঁট ভিজিয়ে নিল সে। নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলল,
– কেউ না। আমি ওর কেউ না।
সে এতোটাই ধীর, নিস্তেজ কণ্ঠে বলল যে সামনের পুলিশটি তার দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে ছিল বলেই শুনতে পেল। নয়তো সম্ভবত শুনতে পেত না। তার থেকেই কিছুটা পেছনে একজন দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় তার কাছে প্রভার কথা তো দূর, কণ্ঠও পৌঁছোয়নি।
প্রভা অনুভব করল তার বুকে ভীষণ ঝড় বইছে। সেই ঝড়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। কিছুই তার নিজস্ব জায়গায় স্থির নেই। কোনো বিষাক্ত তীর যেন তার অভিমুখে ধেয়ে আসছে। হ্যাঁ এইতো! ছুঁচাল, বিষাক্ত তীর গেঁথে গেল তার হৃৎপিণ্ডে। তীক্ষ্ণ, যন্ত্রণাময় অনুভূতিতে বুকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়ে গেল। বুকে কী তীব্র ঝড়! অথচ কতো শান্ত মুখেই না সে উত্তর দিয়ে দিল, সে কেউ না। সে তাওহীদের কেউ না। প্রভা বুঝতে পারল, তার জীবনের এতো এতো ব্যর্থতার মাঝে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা এইটাই যে, সে তার তাওহীদের কেউ না।
– ও! তাহলে অন্যকারোর জন্য অপেক্ষা করছেন? পুলিশ লোকটি ফের শুধাল।
প্রভা উত্তর দিল না। নিজেকে নিজের কাছেই জড়বস্তু বলে মনে হলো।
– মাইনষ্যে ফাঁসিতে মরে আর এ ডরেই মরল! মরা যে কার কেমনে আছে তা উপরওয়ালা ছাড়া কেউ জানে না।
প্রভা হঠাৎ আসা বাক্যগুলো ভীষণ মনোযোগী হয়ে শুনল। এরপর ভীষণ অবহেলায় পাশ ফিরে চেয়ে দেখল রাশেদুর রহমান উকিলকে। লোকটার চেহারায় সামান্যটুকু দুঃখবোধ নেই। প্রভা জড়বস্তুর ন্যায় সেই চেহারার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল।
রাশেদুর রহমান নিজে থেকেই বলল,
– ট্যাকা না দিয়াও ভালোই করসেন, মিস প্রভা। আল্লাহ আপনারে সাহায্য করসে বলা যায়। ট্যাকা দিলেও তো আপনের লোক বাঁচত না। বাইর হওয়ার আগে ভয়েই মরত। আপনে তারেও পাইতেন না, ট্যাকাও ফেরত দিতাম না। তার থিকা এইটাই ভালো হইলো না?
লোকটার এমন রসিকতায় প্রভা জেদের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল। শীতল রক্ত ছলকে উঠল মূহুর্তেই। দাঁতে দাঁত পিষে সামনের মানুষটিকে কেবল প্রশ্ন ছুঁড়ল,
– আমি আপনাকে টাকা দেই নি মিস্টার রাশেদ?
পিতৃ সমতুল্য রাশেদুর সাহেব এর সঙ্গে এর পূর্বে যথাযথ ভদ্রতা প্রভা পালন করেছে। তবে আজ আর হলো না। কিছুটা অভদ্রতা দেখানো হয়েই গেল।
প্রভার এমন দৃঢ় প্রশ্নে উকিল সাহেবের এবার ভ্রু কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল বেশ কয়েক। সে অযথাই কিছু চিবুচ্ছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
– আপন মানুষ মরাতে আপনের হুঁশ গেছে গা। আপনে আমারে কখন ট্যাকা দিলেন? দুই দিন ধইরা তো আমি অফিসেই আসি নাই। আপনারে কইনাই যে ট্যাকা বাসায় গিয়া দিয়া আসতে? তাও তো আসার নাম-গন্ধ নিলেন না। আমি আরোও আপনের জন্যে অপেক্ষা কইরা বউ-বাচ্চা নিয়া ঘুরতে গেলাম না। ভাবলাম আপনে ট্যাকা আনলেই আমি একবার জেলে আইসা তাওহীদ সাহেবরে সাহস দিয়া যামু।
প্রভা অধৈর্য্যের চূড়ান্তে পৌঁছে কিছুটা চেঁচিয়েই বলল,
– আমার বন্ধু আফরিন আপনাকে টাকা দেয় নি? গত দু’দিন আগে আপনার কাছে টাকা নিয়ে যায় নি? অস্বীকার করতে পারবেন আপনি? আমি নিজে গুণে পঞ্চান্ন হাজার টাকা দিয়েছি আমার বন্ধুকে। আমি নিজে এই হাতে তুলে দিয়েছি। সে আপনাকে টাকা দিয়েছে আজ দু’দিন হয়। অস্বীকার করতে পারবেন আপনি?
রাশেদুর সাহেব ভ্রু কুঁচকে গোলক ধাঁধাঁয় আটকে পড়ার দ্বিধা নিয়ে বললেন,
– কী আশ্চর্য! মাথা কী সত্যই বিঘড়াই গেসে? টাকা দিলে আমি মিথ্যা বলুমু কীসের জন্য? আর আপনার কোন বান্ধবী টাকা দিসে? কে দিসে? আমি কোনো টাকা পাই নাই। আপনে আমারে সেই যে ফোন দিয়া আমার বাসায় এড্রেস নিলেন সেই যে আপনার সাথে কথা। এরপর তো আমি চেম্বারেই বসলাম না। আর আপনি আরোও এড্রেস নিসেন দেইখা আমি বাসাতেই দুইদিন আপনের অপেক্ষা করলাম। না আপনে আসলেন আর না আপনের নামে বা আসামির নামে কেউ আসল। এখন আবার আবল-তাবল বলতেসেন যে টাকা দিসেন! টাকা দিলে আমি মানা করব কীসের জন্য? পাগল মনে হয় আমারে?
প্রভা থম ধরে চেয়ে রইল। সামনের মানুষটার কথাগুলো এলোমেলো ঘুরতে লাগল তাকে ঘিরে। কোথাও যেন তাল হারিয়ে গেছে। প্রভা মিলাতে পারছে না। কথাগুলোর যে মালা তৈরি করবে – হচ্ছেই না। প্রভা নিজের ব্যর্থতায় যে সামনের মানুষটিকে কিছু বলবে, তাও বলার সাহস করল না। এমন গম্ভীর, দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের বিপরীতে কথা বলা যায় না। তবুও, প্রভা শেষ চেষ্টা করে বলল,
– টাকা আপনি সত্যিই পান নি?
এবার রাশেদুর রহমানের মুখ তীব্র বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। অতিষ্ঠ হয়ে বলল,
– এইখানে আইসাও ভেজালে পইড়া গেলাম দেখতাসি। আমার কী তবে মানবতা থেকে আসাটাও ভুল হইলো? না আপনি আমারে একটা কথা বলেন। আপনার আমার কী রসিকতার সম্পর্ক? আমি মশকরা করতেসি আপনার সাথে? আপনার কোন বন্ধু কবে আসলো আমার কাছে? আসেন, আমার সঙ্গে আমার বাড়ি আসেন। আমার বাড়িতে আমার বউ, পোলারেই জিগ্যেস কইরেন এই দুইদিনে আমি বেরোইসি কি-না আর কোনো কেউ আসছেই কি না টাকা নিয়া। আসেন?
হিমালয়ের হিম শীতল বাতাসের মতো কনকনে ঠাণ্ডায় পুরো বুক ছেঁয়ে গেলে সূঁচালো শীতলতায়। ঠাণ্ডার সঙ্গে সঙ্গে আগত আশঙ্কায় জমে যেতে চাইল বুকের ভেতরটা। মাথার ভেতরে তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে ভীষণ শব্দে উড়ে গেল বোলতাটা। তার মস্তিষ্কের ইঙ্গিত সে কোনোভাবেই মানতে চাইল না। না, না তার অচেতন মন যেদিকে ইঙ্গিত করছে তা কখনো হওয়ার নয়। হতে পারেই না।
প্রভার বুকে ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে এতোক্ষণে। তবুও কাঁদতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু উকিল সাহেবের কথায় কেন জানি ওলট-পালট হয়ে থাকা ভিতরটা ধীরে ধীরে ভাঙতে লাগল। ভাঙতে ভাঙতে একদম গুড়োগুড়ো হয়ে গেল। সেই গুড়োগুলো বুক থেকে বেয়ে বেয়ে চোখে চলে এলো। চোখ জ্বালা করতে লাগল। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। প্রভা অদূরে সাদা কাপড়ে মোড়ানো তাওহীদের দিকে তাকাল। মুখ দেখা যাচ্ছে। আহা! কী মায়ার মুখ! কী মায়ার মানুষটা! প্রভা দেখল হাসান ভাইকে। হাসান ভাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তাওহীদের সামনে। কান্না দেখতে ভালো লাগছে না। তাওহীদের মুখটাই দেখা যাক আবারো। নিষ্প্রাণ, শুষ্ক, শুকনো মুখ। কেমন ফ্যাকাসে চেহারা! অথচ প্রভার মনে হলো পৃথিবীর সব মায়া এই মুখটাতে। এতো মায়ায় ভরা, সুশ্রী একটি মুখ এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে ভাবতেই এই দুনিয়ার প্রতি ভীষণ করুণা হলো। কী বোকা দুনিয়া! কতো মূল্যবান একটি মানুষকে এই দুনিয়া হারিয়ে ফেলছে তা কী বুঝছে পারছে? না, পারছে না। দুনিয়া তার নিজের মতোই আছে। কোনোপ্রকার হেলদোল তার নেই। ওই যে দূরে পুলিশ দাঁড়ানো। সে তার ডিউটি পালন করে ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। ওইযে চায়ের দোকানে কিছু যুবক, রিকশাওয়ালাদের ভীড়। তারাও নিজেদের কাজে ব্যস্ত। মধ্যকার যুবক ভাইটি হয়তোবা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে। অর্থাৎ সেই ভাইটিও ব্যস্ত নিজের জীবনে। আকাশে কাকটাও নিজের নিয়মের খেলাপ করছে না। কী আশ্চর্য! আকাশের কাকেরও তাওহীদের প্রতি কোনো মায়া হচ্ছেনা? কারোরই দেখি কিছু যায়-আসছে না। অবশ্য তার নিজেরও হয়তোবা কিছু যায়-আসছে না। তবে হাসান ভাইয়ের যাচ্ছে। হ্যাঁ, যাচ্ছেই তো। তাইতো লোকটা আশ-পাশ ভুলে তাওহীদের মাথা কোলে নিয়ে কাঁদছে। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। কান্নায় কোনো রাখ-ঢাক নেই। মন খুলে কাঁদছে। আবার তাওহীদের কপালে চুমুও খাচ্ছে। লোকটার বুদ্ধি আছে বটে। তাইতো তাওহীদকে মূল্য দিচ্ছে। যেই নির্দোষ, নিষ্পাপ মানুষটার জন্য দিন-দুনিয়ার সবার কষ্ট পাওয়া উচিত ছিল সেই মানুষটার জন্য সব কষ্ট হাসান ভাই একাই পাচ্ছে। ব্যাপারটা কী সুন্দর! ভেবেই ঠোঁট এলিয়ে হাসল প্রভা। তার ঠোঁটে মুগ্ধ হওয়া হাসি। যেন সে ভীষণ মুগ্ধ হচ্ছে সামনের দৃশ্যে। আচ্ছা, একটা নির্দোষ মানুষ যে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল – এতে কী কখনোই কারোর কিছুই যাবে আসবে না? কেউ কষ্ট পাবে না এই মানুষটার কথা ভেবে? কেন কষ্ট পাবে না? কেন যাবে আসবে না? তাওহীদ মন্দ দেখতে বলে? নাকি ও গরিব বলে? হ্যাঁ, এইজন্যই তো। ওহ, এই পৃথিবী তাহলে এতোই নিষ্ঠুর!
প্রভার ঘোরের মাঝেই জেলারটি তাওহীদের হাজতে থাকা সকল বস্তু দিয়ে গেল। প্রভা হাতে তুলে নিমেষ হারা হয়ে চেয়ে রইল একটি ছেঁড়া একশো টাকার নোট আর শুকনো গোলাপের দিকে। এবার বোধহয় অশ্রুকে আর আটকে ফেলা গেল না। পড়েই গেল ভীষণ অ-শাসনে।
_____
বাসায় পৌঁছেও প্রভা পড়ে রইল নীরব একটা ঘোরের মাঝে। অনুভূতি, বোধ, চেতনা হারিয়ে একভাবে দাঁড়িয়ে রইল তাওহীদের জানালায় দৃষ্টি দিয়ে। পানির পিপাসা বোধ করায় ফিরে এলো পানির তাড়নায়। ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে পানির বোতল হাতে নিতেই ভেসে এলো গানের কণ্ঠ। গানটা স্পষ্টভাবে শুনতে পাওয়া যাচ্ছেনা। বোতল রেখে ফ্রিজ বন্ধ করে, চলল সে গানের সন্ধানে। রান্নাঘরে আসতেই দেখতে পাওয়া গেল নিশীকে। সে রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার মেঝেতে বসে আছে। মাথা দরজার সাথে হেলিয়ে দেওয়া। মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছেনা। মাথা ভর্তি চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। প্রভা শুনল নিশীর কণ্ঠ। ভীষণ দরদ ঢেলে সে গাইছে –
প্রাণের প্রদীপ হয়ে তুমি
জ্বলছো নিশীদিন
কোন মোহরে শোধ হবে গো….
কোন মোহরে শোধ হবে গো
তোমার এই ঋণ
তোমার এই ঋণ
এতোটুকুতেই নিশী থেমে গেল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। প্রভার ভীষণ জানতে মনে চাইল তার বোনের এমন কান্নার কারণ। আচ্ছা, তার বোন কী কোনোভাবে তাওহীদের জন্য কাঁদছে? হতেও তো পারে। প্রভা নিস্তেজ তবে আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করল,
– কাঁদছিস কেন এইভাবে? কী হয়েছে?
নিশী প্রভার দিকে ফিরে চাইল। নিশীকে দেখে প্রভা ভীষণ অবাক হলো। চোখের কোল ভর্তি অশ্রু। চোখে জায়গা না পেয়ে কিছু গড়িয়ে গেল নীরবে। শ্যামবর্ণের মুখে থাকা কচি কিশলয়য়ের মতো ঠোঁট জোড়া কান্নার কারণে ফুলে গেছে। লালাভ ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
– সালমান শাহ এর জন্য কাঁদছি, আপা।
প্রভা আশাহত হলো। ফুলে-ফেঁপে ওঠা আগ্রহ ধপ করে নিভে গেল। সে হয়তোবা আশা করেছিল নিশী বলবে যে, তাওহীদ ভাইয়ের জন্য কাঁদছি, আপা। কিন্তু তা হলোনা। নিশীও তাওহীদের জন্য কাঁদছেনা। নিশীরও কিছু যায় আসেনা তাওহীদের জন্য। কেন আসে-যায়না? প্রভা কতো করে চাইছে এই দুনিয়ার সবাই কাঁদুক। সবাই কষ্ট পাক। সে নিজেকে মানাতেই পারছেনা যে, গরীব-নির্দোষ মানুষ মারা গেলে কেউ কষ্ট পায়না। কারোর কিছু যায়-আসেনা। তাওহীদ যদি ক্ষমতাধর কেউ হতো, কিংবা সে যদি বড়লোক হয়ে জন্ম নিত – তাহলে অবশ্যই তার জন্য সবাই কষ্ট পেত। অবশ্যই পেত।
নিশী ভীষণ আগ্রহ করে বলল,
– আনন্দ অশ্রু ছবি দেখেছি। ছবিটা এতো সুন্দর আর গভীর! সেখানে না সালমান শাহ আর শাবনূর মারা যায়। আর গানগুলো এতো সুন্দর! গান শুনলে আরোও কান্না পায়। তাই সব কষ্ট মিলিয়ে কাঁদছি। সাথে সালমান শাহ বাস্তবেও মারা গেছে ভাবতেই আরোও বেশি কান্না পাচ্ছে।
প্রভা যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দে চলে যেতে লাগল। পিছন থেকে ভেসে এলো নিশীর ডুকরে ওঠা কণ্ঠ,
– এমনিতে ছবির নায়ক গরীব হলে সেই নায়কের জন্য আমার দুঃখ হয়। এই নায়ক তো বড়লোক ছিল কিন্তু শেষে পাগল হয়ে যায়। তাই এই নায়কের জন্যেও আমার দুঃখ হচ্ছে, মায়া হচ্ছে।
_____
মৃত্যু এক ধ্রুব সত্য। কখন, কার, কেমন, কীভাবে হয় সামান্যটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। প্রতিদিন’ই অসংখ্য মানুষ মারা যায়। কেউ অসুখে, কেউ এক্সিডেন্টে, কেউ বা দিব্যি সুস্থতাতেও অনায়াসে ছেড়ে যায় এই অমলিন পৃথিবী। প্রভা নীরবে জড়বস্তুর ন্যায় বিছানায় বসে গেল। মনে প্রশ্ন এলো, এ কেমন মৃত্যু হলো তাওহীদের? এ কেমন ছেড়ে যাওয়া? প্রভার মানতেই ইচ্ছে হলো না যে, তাওহীদ মারা গেছে। হ্যাঁ, এইতো…. তিনদিন আগেও তো তাওহীদের সঙ্গে দেখা হলো। তাওহীদ আর সে কতো কথা বলল। তখন একবারো কী মনে হয়েছে যে, এই শেষ? হ্যাঁ, মনে বোধহয় হয়েছে। অদেখা ইন্দ্রীয় তাকে ঠিকই কিছু বলতে চেয়েছে। তিন দিন আগে সে যখনই ফিরে আসতে চাইল, কোথাও যেন কী একটা ঘটে গেল। বুঝতে পারল কোথাও কিছু ঠিক নেই, কিন্তু সেই জিনিসটা চিহ্নিত করা গেল না। আচ্ছা, যদিওবা যেত প্রভা কী করতো? প্রভা থাকতো? অবশ্যই থাকতো। অবশ্যই তাওহীদের পাশে থাকতো। দিন-দুনিয়াকে মিথ্যে করে, সকল রীতি-নীতিকে উপেক্ষা করেই সে থাকতো। কিংবা হারিয়ে যেত দু’জনে দূর অজানায়। তবুও তাওহীদকে হারাতে দিত না। প্রভার ভাবতেই অবাক লাগে, যে মানুষটাকে নিয়ে সে এতো ভাবনা জমা করল, সেই মানুষটাই কি না তাকে তুচ্ছ করে পালিয়ে গেল। আজ তাকে শুনতে হলো, তাওহীদ মারা গেছে। শুনতে হলো যে, দীর্ঘদিনের অত্যধিক মানসিক অসুস্থতায়, উচ্চরক্তচাপে তার মাথার রক্তনালি ছিঁড়ে গেছে, হৃদপিণ্ডে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালনে বাঁধা পেয়েছে। প্রভার চোখ ছাপিয়ে গলগল করে অশ্রু বয়ে গেল। স্বাভাবিক শ্বাস নিতে না পারায় ওষ্ঠদ্বয়ে ফাঁক তৈরি হলো আপনা-আপনি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হলো, সে ধর্ষিতা হলেও বোধহয় এতোটা যন্ত্রণা হতো না। এমন তীব্র অনুতাপে দিন-দুনিয়া সংকীর্ণ হয়ে আসতো না। সে হতো ধর্ষণ। নাম লেখাতো নতুন ‘ধর্ষিতা’র খাতায়। অন্ততপক্ষে, তাওহীদ তো থাকতো। এই দুনিয়াতে তো থাকতো। চোখের দেখা তো মিলত। একবার তাকিয়ে হাসা তো যেত। ওই দু’টো গভীর চোখে চোখ রাখা তো যেত। প্রভা আওয়াজ তুলে বিছানায় পড়ে গেল। হাত উঠিয়ে বুক খামছে ধরতেই কান্নার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। চোখের অবিরাম অশ্রুপাতে ভিজে গেল গাল, কান, চুল।
তাওহীদ! তাওহীদ! তাওহীদ! এতো ভয় আপনার? এতো ভয় বুকে পুষে বেঁচে ছিলেন আপনি? কেন এভাবে ছেড়ে গেলেন, তাওহীদ? দেখছেন না, এই দুনিয়ার সবাই কেমন হাসছে! আপনার ওপর হাসছে। আপনার ভয় দেখে হাসছে। তাওহীদ, একটিবার আমার সামনে আসেন। আমাকে সুপ্রভা বলে ডাকেন। আপনার মতো না কেউ আমায় ডাকে না। এতো আদর, ভালোবাসা, ভয় নিয়ে ডাকে না। আপনি তো জানেন না, তাওহীদ। আপনি জানেন না আমি কতোটা ভীতু! আমি অনেক ভীতু, তাওহীদ। আমার অনে….ক ভয়। এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার ভয়। আমার অনেক হারানোর ভয়। জানেন, আমি আজ আপনাকে হারিয়ে যখন ভাবতে গেলাম যে আমি আর কী কী হারাতে পারি। তখন ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার আর হারানোর কিছুই নেই। কিচ্ছু না। আমায় কেউ ভালোবাসে না, তাওহীদ। আমাকে কেউ পছন্দ করে না। তাওহীদ, একবার আসুন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। তাওহীদ! তাওহীদ!
প্রভা কান্নার, যন্ত্রণার প্রভাবে বুক চেপে মুড়িয়ে গেল। শুয়ে পড়ায় শ্বাস নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও প্রভা উঠে গেল না। বিছানাতে নিজের মুখ চেপে আওড়াল,
একটা ঘর হলো না আমাদের। একটা রূপকথার সংসার হলো না আমাদের। আপনাকে পাওয়া হলো না আমার। আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, একটা নাম হলোনা আমাদের সম্পর্কের। এই দুনিয়ার কাছে আপনার-আমার মতো অনাদৃত হয়ে রইল আমাদের সম্পর্ক। আমার খুব বুকে ব্যথা হচ্ছে তাও….
তীব্র যন্ত্রণায় পুরো বিছানা জুড়ে প্রভা গড়িয়ে গেল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বিছানায় মাথা দিয়ে আঘাত করতে করতে বলল,
– আমি আমার জীবনের বিনিময়ে….. আমার সম্মানের বিনিময়ে…..আমি আমার বিনিময়ে আপনাকে হারালাম। আপনাকে হারালাম তাওহীদ। আপনাকে হারিয়ে ফেললাম।
চোখ, চুল খামছে ধরল প্রভা। উঠে বসে দিশেহারা শিশুর মতো পুরো ভুবনে চোখ বুলানোর আকাঙ্ক্ষাতে সারা ঘরে চোখ বুলাল। কেউ নেই, কেউ না। তাওহীদ নামের তার মানুষটা এই ভুবনে নেই। আর কখনো আসবে না। হাজার কিছুর বিনিময়েও না। ভাবতেই হৃদপিণ্ডে কে যেন খামছে ধরল। প্রভা বুকে এক হাত রেখে উদ্ভ্রান্তের মতো এলোমেলো পায়ে ছুটল। কাঙ্ক্ষিত জিনিস পেয়ে ফোন লাগাল আফরিনের নাম্বারে। না, ফোন তো ধরে না। প্রভা দিশেহারা হয়ে আরোও চেষ্টা করল। তবুও ব্যর্থ হলো। ফোন কেন যাবে না? কেন না? প্রভা হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার সকল কিছুতে গেলেও বিশেষ লাভ তেমন হলো না। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যোগাযোগ সম্ভব নয়। ব্লক করে দিল? প্রভা অবুঝের মতো বসে চেয়ে রইল ফোনে। টাকা! পঞ্চান্ন হাজার টাকার তবে এতোই মূল্য ছিল? তাদের বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি? পঞ্চান্ন হাজার টাকা! প্রভার চোখের অশ্রু আবার গলগল করে বেরিয়ে গেল। প্রভা চোখ হাত রেখে অশ্রু ছুঁয়ে ভাবল, এতো দীর্ঘ, বড় ফোঁটার অশ্রু কীসের জন্য? কার জন্য? আফরিনের জন্য? যে কি না তার আট বছরকে মিথ্যে করে রেখে গেছে! যার কাছে কি-না অর্থের মূল্য মানুষের চেয়েও বেশি! না, প্রভার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। সে বিশ্বাস করবে না। কখনো করবে না। প্রভা উন্মাদের মতো উঠে টেবিলের সামনে গেল। তার সেই ডায়েরি। যেখানে ছিল তার না পাওয়ার তালিকা। প্রভা পেজ উল্টাতেই দেখল একটা অর্থহীন হেডলাইন – ‘আমার যা আছে’। নিচে লেখা,
১। আফরিন
২। তাওহীদ
প্রভা এক টানে ছিঁড়ে ফেলল সে পাতা। নিজের সকল যন্ত্রণা, অনুতাপ মিলিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করল সে পেজ। চোখে পড়ল টেবিলের কোণায় সযত্নে রাখা সাত হাজার টাকা। মূহুর্ত ব্যয় না করে সে টাকা তুলেও দু’হাতে ছিঁড়তে আরম্ভ করল। লাগবে না তার কোনো টাকা। যে টাকা তার থেকে তার মানুষ ছিনিয়ে নেয়, সে টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। টাকা ছিঁড়ে ফেলার মূহুর্তে থেমে গিয়ে বসে পড়ল প্রভা। ক্লান্ত শরীরে চিৎকার করতে লাগল। নিজের বুকে আঘাত করতে করতে ইচ্ছে হলো বুকের হৃদপিণ্ড টাই ছিঁড়ে নিয়ে ফেলে দিতে। তবে বোধহয় শান্তি মিলত। এই দুনিয়াতে শান্তির বুঝি এতোই অভাব!
সে দোষী। সে প্রকৃত দোষী। তার মা যে বলে, একদম ঠিক বলে। তার জন্মটাই ছিল ভুল। সেই ভুল জন্মের কারণে সে সকল কিছু বরবাদ করে গেল। একটা মানুষকে দুনিয়া থেকে মুছে দিয়ে গেল। মানুষটার জানাও হলো না প্রভার কাছে তার কতো দাম! কী অনায়াসে অভিমানেই না চলে গেল। একটিবার ভাবল না তার সুপ্রভা কথা? একটি বার ভাবলা না? করুণা করে হলেও না হয় থেকে যেত। প্রভার তো কেউ নেই, আজ থেকে কী তবে মেনে নিতে হবে যে, প্রভার তাওহীদ’ও নেই?
_____
ভুবনের অদেখা এক শুন্যতা বুকের মাঝে পুষে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রভা। দৃষ্টি কোথায় জানা নেই। নির্জীব, মৃত চোখে চেয়ে আছে দূর অজানায়। ইলেকট্রিসিটি নেই। এলাকা জুড়ে নিরবিচ্ছিন্ন আঁধার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রীষ্মের আরাম-শীতল প্রাণ জুড়ানো বাতাসে প্রভার প্রাণ জুড়োলো কি না বোঝার উপায় নেই। সম্ভবত ঘণ্টার একের মাঝেই স্যাঁতসেঁতে গরমের মাঝে বহুল প্রতীক্ষিত ঝড়ের দেখা মিলবে। এখন ঝড় হয় না বললেই চলে। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর ভারসাম্যে পরিবর্তন এসেছে; ঠিক যেমন এসেছে প্রভার ভারসাম্যে। পৃথিবী পরিবর্তন হয়েছে, প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে, প্রভা নিজেও পরিবর্তন হয়েছে।
মৃদুমধুর বাতাসে ঘরের পর্দাগুলো ধিমেতালে উড়ছে। ঘরজুড়ে নিরন্তর আঁধার। আচমকা ঘরের আঁধারের অবসান ঘটাতে জ্বলে উঠল মৃদু আলোর মোমবাতি। খানিক সময় পরেই প্রভা নিজের কাঁধে অনুভব করল কারোর মন না মানা উপস্থিতি। বেশ কিছুক্ষণ বাদে কথা এলো,
– তোমার পরিবার কিন্তু আমাকে ভুলভাল তথ্য দিয়েছে, প্রভা। আমাকে বলা হয়েছিল তুমি ভয়ানক রাগী একজন মেয়ে। অথচ তোমার কাজকর্মে কিন্তু এমন কিছুই নজরে এলো না। উলটো আমি আশ্চর্য হয়ে প্রতিনিয়ত দেখে চলেছি তোমার নীরবতা।
প্রভা চোখ বুজে নিল। না, না….প্রভা কাঁদছে না। তবে চোখে জ্বলুনি হচ্ছে। মস্তিষ্কে কিছু একটা খুঁচিয়েই চলেছে। প্রভা শুকনো ঢোক গিলে নীরবে পড়ে রইল। সৌরভ নিজে থেকেই আদর কণ্ঠে বলল,
– উম….আমার সকালের বোধহয় ভয়ংকর মন খারাপ। তবে আমি যে আমার সকালের মন খারাপ মানতে পারি না। আমাকে কী বলা যায় না মন খারাপের কারণ? কারণ জানলে বোধহয় সৌরভের সুরভি দিয়ে সকালকে সকালের মতো প্রাণবন্ত, সুগন্ধিময় করতে পারতাম।
না চাইতেও বুকের পাড় ভেঙে অশ্রুধারার শুরু হলো। জ্বলে ওঠা চোখ আবারো পূর্ণ হলো অথৈ দুঃখে। সকাল। তাওহীদের সকাল। তাওহীদের পবিত্র সকাল। তবে তাওহীদ তো নেই। এই ভুবনে কোথাও নেই। তাই তো ‘তাওহীদের সকালের’ অস্তিত্বও নেই। এখন যে সকাল আছে সে সৌরভের সকাল; তাওহীদের নয়। না তো সে তাওহীদের সুপ্রভা, আর না তো সে তাওহীদের সুন্দর সকাল। এখন তার অস্তিত্বের অধিকারী কেবল আর কেবল সৌরভ।
কাঁপন অনুভব হতেই ম্লানমুখে প্রভাকে নিজের দিকে ফেরাল সৌরভ। চক্ষুভর্তি অপর্যাপ্ত জলে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা দেখাচ্ছে তার স্ত্রীকে। প্রভার এমন অসহনীয় নিঃস্ব ব্যাথায় জর্জরিত হয় সৌরভ নিজেও। মুখের ম্লানতার সরে গিয়ে দেখা মেলে আশ্চর্য বিষাদের। সৌরভ বেদনার্ত কণ্ঠে বলতে চায়,
– প্রভা তুমি এভাবে….
কথা সম্পূর্ণ হয় না। তার আগেই বুকের মাঝে মাথা গুঁজে দেয় প্রভা। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নীরবে নিভৃতে। সৌরভ নিজের স্ত্রীর এমন দুঃখে নিজেও দুঃখী হয়। ম্লান কণ্ঠে বলে,
– বিয়ের পর থেকেই তোমাকে কাঁদতে দেখি প্রভা। থেকে থেকে কেঁদে উঠো তুমি। অথচ কারণ জানতে চাইলে বলো না। বাবা-মার জন্যে মন খারাপ, আমার বাবা-মা তোমাকে কষ্ট দিয়েছে না কি আমার আচরণে তুমি কষ্ট পেয়েছ কিছুই বলো না। না বললে আমি বুঝব, প্রভা? বলো তুমি?
প্রভা মাথা তুলে না। তোলার শক্তি আসে না।
সৌরভ নিজে থেকেই প্রভার মন ভালো করতে বলে,
– আমি আরোও ভাবলাম রাগী একটা বউ পাব। সকাল-বিকাল ধমক খাব। তবে না জমতো! রাগ দেখাও না কেন বলোতো?
প্রভা কান্না থামায়। তবে মাথা তোলে না। বলতে পারে না, তার রাগ কেবল একজনের জন্যেই ছিল। তার রাগের অধিকার কেবল একজনের জন্যেই লেখা ছিল, যা সে নিয়ে চলে গেছে। প্রভাকে করে গেছে রাগশুন্য মানবী।
সৌরভ প্রভার কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
– প্রভা , ও প্রভা! আমার সকাল! আমার প্রভা!
আদর কণ্ঠে ডেকে ডেকেই সৌরভ নিজের বাঁধন গাঢ় করে। শক্ত করে জড়িয়ে রাখে প্রভাকে। খানিক বাদে প্রভা শান্ত হলে সৌরভ নিজেই প্রভার মুখ সযত্নে তুলে নেয় নিজের আঁজলায়। মিঠে কণ্ঠে বলে,
– এমন করে আর কখনো কেঁদোনা। এমন দুঃখ নিয়ে কেউ কাঁদে? খারাপ লাগে না আমার?
প্রভা আহত চোখে চেয়ে রয় সৌরভের দিকে। বলতে হয়তো মন্দ শোনায়, তবুও প্রভা আঁকড়ে ধরতে চায় সামনে দাঁড়ানো মানুষটিকে। এতো দুঃখ, এতো প্রতারণা পেয়েও বোধ করি তার শিক্ষা হয় নি। তাই তো এক ফোঁটা ভালোবাসা, আশকারা পেয়ে আবার হামলে পড়ছে সে। আবার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে ‘বন্ধুত্বের’ হাহাকারে।
রাগ হয়, যন্ত্রণা হয়। তবুও নিজেকে বাঁধতে পারে না। নিয়ন্ত্রণ করতে জানে না। আচ্ছা, বন্ধুত্ব শব্দটাতে কী আছে? কেন প্রভা বারে বারে কেবল বন্ধুত্বের পেছনে ছুটতে চায়? না, না। প্রভা নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইল। সৌরভ তার কোনো বন্ধু নয়। তার স্বামী। তার বন্ধু চাই না। তার সৌরভকেও চাই না। মনে মনে সৌরভকে নিজের পাশে আশা করলেও কখনোই সে মুখ ফুটে বলবে না। মুখে এই স্বীকার করবে যে, তার কেউ নেই। এই পর্যন্ত যতো যাই সে ‘আছে’র তালিকাতে স্থান দিয়েছে, সবাই নাই হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে। সৌরভকে হারাবে না। সৌরভকে থাকতে হবে। প্রভার পাশে থাকতে হবে। আর কিছু না হোক, এই যে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেওয়া, তার দুঃখ শুনতে চাওয়া, একটু ভালো করে কথা বলা – এর জন্যই থাকতে হবে। নয়তো প্রভা বাঁচবে কেমন করে? সৌরভ নিশ্চয়ই মিথ্যা মিথ্যা বলে না? করে না? না কি সেও আফরিনের মতো আস্তরণ মেখে থাকে? মুখোশ পড়ে অভিনয় করে? আজও, আজ এতোদিন পরে এসেও নিজের জীবনকে, জীবনের মানুষকে, সকল ঘটনাকে প্রভার ভ্রম বলে বোধ হয়। মনে হয় যেন তার পুরো জীবনটাই একটা ঘোর। বিশ্বাস করতে চায় না, তবুও করতে হয়। বুকে খুব শক্ত কষ্ট চেপে নিজের জীবনকে বিশ্বাস করে প্রভা। খুব কষ্ট হয়, তবুও করে। করতে হয়। এই তো জীবন।
সৌরভ প্রভার চোখে চোখ রেখে ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করল। প্রভা উত্তর দিল না। নামিয়ে রাখল চোখ। সৌরভ প্রভাকে এক হাতে আগলে নিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। দু’জনে ঘন আঁধারে তাকিয়ে রইল নীরবে। এমন গাঢ় আঁধারে এক ফালি আলোর ছটা নজরে পড়তেই সেদিকে চোখ ফিরিয়ে চাইল। লহু স্বরে বলল,
– আপনি এই মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেললেন?
সৌরভ মোমবাতির দিকে তাকিয়ে বলল,
– হুঁ, মোমবাতিটা কোই পেয়েছে তুমি? এতো দারুণ নকশার! তোমার কাছে দেখার পর থেকেই তো এইটা আমার প্রিয় হয়ে গেছে।
প্রভা মথা তুলে সৌরভের দিকে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল,
– জ্বালিয়ে রাখলে তো শেষ হয়ে যাবে। তাই না?
সৌরবকে একটু দ্বিধান্বিত দেখায়। পলক ফেলে ফেলে বলে,
– আমি…অন্ধকারে তো লাইট পাচ্ছিলাম না। আর তুমি মোমবাতিটা সবসময় ছোট টেবিলেই রাখো। তাই ভাবলাম… আচ্ছা, তোমার খারাপ লাগলে নিভিয়ে দিচ্ছি।
বলেই সৌরভ ছোট্ট মোমবাতিটা হাতে তুলে নিলে প্রভা হাত থেকে নিয়ে রেখে যথাস্থানে রেখে দেয়। সৌরভ এতো ভালোবেসে জ্বালিয়েছে, নেভাতে ইচ্ছে হয় না। এই যে মানুষটা তার সঙ্গে মিষ্টি আচরণ করে, তাকে বন্ধু করতে চায়, এর প্রতিদান না হয় মোমবাতিটা ফুরিয়ে দিক। সৌরভ প্রভার এমন আচরণে মৃদু হেসে, মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নিল। সৌরভের বুকে মাথা রেখে প্রভা নির্নিমেষ চেয়ে রইল মোমবাতির দিকে। এই মোমবাতিটাও একদিন ফুরিয়ে যাবে, এর কথাও সকলে ভুলে যাবে, এর আলোও একদিন নিরাকার হবে। ঠিক যেমন তাওহীদের আলো হয়ে গেছে। প্রভার মাঝেমধ্যে মনে হয়, তাওহীদ’ই সম্ভবত তাকে ‘সৌরভ’কে দিয়ে গেছে। নিজে লুকিয়ে পড়েও প্রভার কথা ভুলে বসেনি। করুণা করে হলেও দিয়ে গেছে একজন মানুষকে। হতে পারে একারণেও প্রভা মারা যায় নি। বেঁচে আছে। শ্বাস নিচ্ছে। নয়তো কবেই তো দমবন্ধ হয়ে তার মরে যাওয়ার কথা। প্রভা মলিন হাসল। জীবনের এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে সৌরভকেও আর আপন ভাবতে ইচ্ছে হলো না। এক মন বলে, সে আপন। তো অন্য মন বলে, সেও পর। কেউ তার আপন নয় – এই ধ্রুব, কঠিন সত্যকেই বুকে ধারণ করে বেঁচে চলে প্রভা। এমন সত্য সে মেনে নিলেও, মন মানল না। বুক তলিয়ে গেল ধূঁ ধূঁ শুন্যতায়। গ্রাস করে নিল তীব্র একাকীত্ব। ভাবতেই অবাক লাগল, চারিপাশে এতো এতো মানুষ থাকার পরেও, একটা জনম সে তার নিজস্ব মানুষ খুঁজতেই কাটিয়ে দিল; অথচ একটা মানুষ তার হলো না।
প্রভা মোমবাতিটার দিকে দৃষ্টি রাখা অবস্থাতেই হঠাৎ ভেসে এলো কিছু বছর পুরোনো নিশীর সেই দরদী কণ্ঠস্বর –
প্রাণের প্রদীপ হয়ে তুমি
জ্বলছো নিশীদিন
কোন মোহরে শোধ হবে গো
তোমার এই ঋণ
তোমার এই ঋণ
সমাপ্ত।
_____