অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-১৩

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সোহিনীর কথা শুনে মোটেই ভরকায় না শাহনওয়াজ সিদ্দিকী। বরং তার মুখে এমন সাহসী কথা শুনে বেশ ভালোই লাগে তার। শাহনওয়াজ সিদ্দিকী গলাঝাড়া দিয়ে বলে,
“আমার স্থির বিশ্বাস তুমিই আমার তানহা। কেননা, আমি তানহার বাবা মায়ের থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে তানহার আর কোন যমজ বোন নেই, কখনো ছিল না। যদি এমনটাই হয় তাহলে দুটো মানুষ কিছুতেই দেখতে একরকম হতে পারে না।”

সোহিনী বিরক্তির স্বরে বলে,
“আবার আপনি আগের মতো নাটক শুরু করে দিলেন? কি প্রমাণ আছে যে আমি তানহা? প্রমাণ ছাড়া আপনি এমনটা আর দাবি করতে পারেন না।”

শাহনওয়াজ এবার সোহিনীকে নিজের ফোন থেকে তানহার একটা ছবি বের করে দেখিয়ে বলে,
“এই দেখো, এটা আমার তানহার ছবি। এরপরেও কি তোমার কিছু বলার আছে আর?”

সোহিনী অবাক স্বরে বলে,
“এ তো একদম আমার মতো দেখতে…”

সোহিনী ভীষণ অবাক হয়। কারণ সে নিজেও ভাবতে পারে নি যে তার আর তানহা নামক মেয়েটার চেহারায় এতোটা মিল। শাহনওয়াজ বিচক্ষণ চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“এবার বলো তুমি কি বলবে৷ এরপরেও কি তোমার সত্যটা অস্বীকার করবে।”

সোহিনী দাবি করে,
“আমি জানি না, আমার আর এই তানহা নামক মেয়েটার চেহারায় এত মিল কিভাবে হলো। তবে সত্য এটাই যে, আমরা দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ।”

শাহনওয়াজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তার পাশে দাঁড়ানো নিজের সেক্রেটারি আকবরকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে,
“তোমার কি মনে হয় আকবর? এখন আমার কি করা উচিৎ? ও তো কিছুতেই সত্য স্বীকার করছে না।”

“এখন একটা উপায় আছে স্যার, তানহা ম্যামের দেহ বলে যা সন্দেহ করা হচ্ছে তো এখনো মর্গে আছে। যদি কোনভাবে ওটা পোস্টমর্টেম করানো হয় তাহলে সব সত্য সামনে আসবে। এজন্য তানহা ম্যামের বাবার ডিএনএ স্যাম্পল কালেক্ট করলেই হবে।”

“গুড আইডিয়া৷ এবার তাই করতে হবে।”

বলেই শাহনওয়াজ সোহিনীর দিকে তাকায়। মেয়েটার হাবভাব তার ভালো লাগছিল না। এবার এই ডিএনএ টেস্টেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে।

★★
ডিএনএ টেস্টের জন্য তানহার বাবা স্যাম্পল দিয়ে গেছে৷ এখন শুধু টেস্টের রিপোর্ট আসা বাকি৷ এজন্য অপেক্ষা করে চলেছে শাহনওয়াজ। তার পাশেই সর্বক্ষণিক সাথী হয়ে আছে আকবর। আকবর শাহনওয়াজের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“স্যার রিপোর্ট যাই হোক এবার আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে সত্যটা জানার জন্য।”

শাহনওয়াজ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সে জানে আজ হয়তো অনেক বড় একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। শাহনওয়াজ বারংবার প্রার্থনা করে যেন রিপোর্টটা না মেলে।

​শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর অস্থিরতার শেষ নেই। প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে এক একটা শতাব্দীর মতো লাগছে। আকবর ঠিকই বলেছিল, তাকে সত্যটা জানার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু মন তো মানে না। তার মন কেবল একটাই প্রার্থনা করে চলেছে, রিপোর্টটা যেন না মেলে। যদি রিপোর্ট মিলে যায়, তাহলে যে তার সব আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

তানহাকে পুনরায় সে ফিরে পাওয়ার আশা করছে, সেই আশাটুকুও মিলিয়ে যাবে।
​অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার শাহনওয়াজের দিকে তাকালেন। ডাক্তারের মুখের ভাব দেখে শাহনওয়াজ কোনো আন্দাজ করতে পারলেন না, কিন্তু বুকটা ধক করে উঠল। আকবর এগিয়ে এসে রিপোর্টটা হাতে নিতে চাইল, কিন্তু শাহনওয়াজ ইশারায় তাকে থামালেন। তিনি রিপোর্টটা নিজেই নিতে চান। ডাক্তার রিপোর্টটা শাহনওয়াজের হাতে তুলে দিলেন।

​শাহনওয়াজ কাঁপা হাতে খামটা খুললেন। ভেতরের কাগজটা বের করে ধীরে ধীরে চোখের সামনে আনলেন। প্রথম কয়েক লাইন পড়ার পরই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। রিপোর্টটা বলছে,
“মৃতদেহের ডিএনএ স্যাম্পল এবং তানহার বাবার ডিএনএ স্যাম্পলের মধ্যে ৯৯.৯% মিল রয়েছে।”

​গোটা পৃথিবীটা যেন এক মুহূর্তে থমকে গেল শাহনওয়াজের কাছে। তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। এতদিন ধরে যে আশার প্রদীপটা সে জ্বালিয়ে রেখেছিল, সেই প্রদীপটা এক ফুৎকারে নিভে গেল। না, এটা তানহা নয়। যে মেয়েটা সোহিনী পরিচয়ে তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে তানহা নয়। আর এই রিপোর্টটা নিশ্চিত করছে, ট্রেনে কাটা পড়ে যে মেয়েটা মারা গেছে, সে-ই তানহা।
​শাহনওয়াজের হাত থেকে রিপোর্টটা মাটিতে পড়ে গেল। আকবর দ্রুত সেটি তুলে নিল। সে রিপোর্টটা পড়ে সে নিজেও আশাহত হলো। আকবর শাহনওয়াজের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“স্যার… রিপোর্টটা… রিপোর্টটা মিলে গেছে।”

​শাহনওয়াজ কোনো কথা বললেন না। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তার জীবনে এমন অসহায় মুহূর্ত বোধ হয় আর আসেনি। এতদিন ধরে যে মিথ্যা আশাকে সে আঁকড়ে ধরেছিল, সত্যের কঠিন আঘাত সেই আশাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তাহলে সোহিনী কে? যদি তানহা মরেই গিয়ে থাকে, তাহলে এই সোহিনী কেন দেখতে তার মতো? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তার জানা নেই।

​ডাক্তার শাহনওয়াজের নীরবতা দেখে বুঝতে পারলেন, সে কতটা কষ্ট পাচ্ছেন। ডাক্তার নরম স্বরে বললেন,
“মি. সিদ্দিকী, আমি জানি এটা আপনার জন্য কতটা কষ্টের। কিন্তু আপনাকে এটা মেনে নিতে হবে। রিপোর্টটা নিখুঁত। ডিএনএ কখনো মিথ্যা বলে না।”

​শাহনওয়াজ শূন্য চোখে ডাক্তারের দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো ভাষা নেই, কেবল গভীর হতাশা। তিনি মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে বললেন,
“তাহলে…তাহলে আমার তানহা আর নেই।”

তার কণ্ঠস্বর ভেঙে যাচ্ছিল। এই একটা কথা বলার পরই সে নিজেকে আর সামলাতে পারছিল না। এই একটা কথা যেন তার বুকে জমে থাকা পাথরটাকে নামিয়ে দিল।
​আকবর তাকে ধরে বসিয়ে দিল।

“স্যার, আপনি নিজেকে সামলান।”

​শাহনওয়াজ নিঃশব্দে কাঁদছেন। তার চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই, কোনো আশা নেই। শুধু এক তীব্র যন্ত্রণা। তিনি এখন বুঝতে পারছেন, সোহিনী নামক মেয়েটার হাবভাব কেন তার ভালো লাগছিল না। সে কেন বারবার নিজেকে তানহার থেকে আলাদা দাবি করছিল। কারণ সে সত্যটা জানত। তারা দু’জন সত্যিই ভিন্ন মানুষ।

​এই কঠিন সত্যটা মেনে নেওয়া তার জন্য অনেক কষ্টকর ছিল। কিন্তু রিপোর্টটা সব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে দিয়েছে। যে মেয়েটি তানহা নামের পরিচয়ে ছিল, সে আর নেই। এখন শুধু তার স্মৃতিই রয়ে গেছে। আর এই স্মৃতি নিয়েই শাহনওয়াজকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।

​শাহনওয়াজ ধীরে ধীরে উঠল। আকবর তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাহনওয়াজ আকবরকে ইশারা করল চলে যাওয়ার জন্য। আকবর দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলল,
“স্যার, এখন আমরা কী করব?”

​শাহনওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“কিছু না। আমার আর কিছু করার নেই। সব শেষ।”

তার এই কয়েকটি শব্দে মিশে ছিল এক বুক হতাশা এবং অপার শূন্যতা।

এমন সময় সোহিনী সেখানে এসে উপস্থিত হয়। সে এসেই বলে ওঠে,
“রিপোর্ট পেয়েছেন তো? এবার নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আর কোন সন্দেহ নেই।”

শাহনওয়াজ এবার সোহিনীর দিকে চোখ তুলে তাকায়। কি মনে করে হঠাৎ বলে ওঠে,
“আপনিও ডিএনএ টেস্ট করুন..আমি দেখতে চাই আপনার ডিএনএ টেস্টের কি রিপোর্ট আসে।”

শাহনওয়াজের কথা শুনে সোহিনী বলে ওঠে,
“কি?”

“আমি চাই আপনার সাথেও তানহার বাবার ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট করানো হোক। কেননা, যমজ বোন না হলে কেউ এরকম একরকম দেখতে হয় না। আপনি ডিএনএ টেস্ট করলেই সব পরিস্কার হবে।”

সোহিনী আমতাআমতা করে বলে,
“আমি ডিএনএ টেস্ট করাবো না..!”

শাহনওয়াজ সোহিনীর হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“করাতে হবেই!”

বলেই সে সোহিনীকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨