অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-১৫

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সোহিনী আফনান সিদ্দিকীর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। আফনান সিদ্দিকী সোহিনীর কাজের প্রশংসা করে বলে,
“আপনি যেভাবে সবটা সামলেছেন সেটা সত্যিই অতুলনীয়। এভাবে অন্য কেউ এত সুন্দর ভাবে কাজটা করতে পারত না। এত বড় মাফিয়াকে এভাবে ঘোল খাইয়ে দিলেন।”

সোহিনী হেসে বলে,
“সবসময় গায়ের জোর দিয়ে সব লড়াই জেতা যায় না। মাঝে মাঝে মনের লড়াই খেলতে হয়,,একে ম্যানিপুলেশন বলে৷ আর এটায় আমি অনেক ভালোই পারদর্শী।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি৷ ঐ বেচারা শাহনওয়াজের জন্য তো আমার ভীষণ করুণা হয়। তানহা রূপে আপনার কিছুটা চোখের জল দেখেই বেচারা গলে গেল।”

“এটাই তো আমার পরিকল্পনা ছিল। সেজন্যই তো সেদিন আমি ওনার ডেরায় উপস্থিত হয়েছিলাম। তারপর ওনার সামনে সতী সাবাত্রী সাজার নাটক করলাম। আর তারপর তো এত কিছু হয়ে গেল।”

“সত্যি বলছি, এত সুন্দর অভিনয়ের জন্য আপনি অস্কার ডিজার্ভ করেন। ঐ শাহনওয়াজ বেচারা বুঝতেই পারল না, আপনার পুরো পরিচয়, পরিবার সব মিথ্যা।”

” মাঝে মাঝে এমন নাটক করতে হয়। আর এর ফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়। এই দেখুন না, এই সময় ঐ শাহনওয়াজ তানহার শোকে এতটা ভেঙে পড়েছে যে নিজের মাফিয়া সাম্রাজ্যের দিকে তার কোন নজরই নেই। এখন সে পুরোপুরি দেবদাস মুডে চলে গেছে। এটাই তার উপর হামলা করার সেরা সুযোগ। তার মাফিয়া গ্যাং চট্টগ্রাম শহরে অনেক অন্যায়, অনিয়ম করেছে। এবার সবকিছুর জন্য তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”

বলেই সোহিনী ফোনটা রেখে দেয়। তারপর হালকা হেসে শুরু থেকে নিজের সব পরিকল্পনার কথা মনে করে। সে মনে করে কিভাবে ইন্টালিজেন্স অফিসার হওয়ার পর থেকে সে শাহনাওয়াজের কেস স্টাডি করছিল। তার আগে বিভিন্ন অফিসার এই দায়িত্ব পেয়েছিল কিন্তু কেউই সফল হতে পারেনি। সোহিনী আগেই বুঝে গেছিল সামনে থেকে লড়াই করে শাহনওয়াজ সিদ্দিকীকে সে হারাতে পারবে না। এজন্যই সে একটা সুযোগ খুঁজছিল। আর এই সুযোগ সে পেয়েও যায় যখন শাহনওয়াজ বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে। সেদিন সোহিনী মিথ্যা পরিচয়ে শাহনওয়াজের জীবনে প্রবেশ করে। এমনকি তার পুরো পরিবারের সবাই নকল ছিল। মর্জিনা বেগম, মিম সবাই। এরপর পরিকল্পনামাফিক তার বাড়ি অব্দি পৌঁছে যায়, তার বাগদত্তাও বনে যায়। এমনকি তার সাথে বিয়ের আসর অব্দি পৌঁছে যায়। সবশেষে তো পরিকল্পনামাফিক বিয়ের দিন মিথ্যা মৃত্যুর নাটক করে শাহনওয়াজকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলে। এরপর পুনরায় সোহিনী রূপে তার সামনে এসে শাহনওয়াজকে কনফিউজড করে দেয়া। সবকিছুই ছিল সোহিনী চৌধুরীর নিখুঁত পরিকল্পনা। সোহিনী এসব ভেবেই নিজেই নিজের প্রশংসা করে বলে,
“কথায় আছে সকল পুরুষের উন্নতির পেছনে একজন নারীর অবদান আছে..কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হয়ে গেল মিস্টার শাহনওয়াজ। আপনার অবনতির পেছনে একজন নারী তথা আমার অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।”

★★
শাহনওয়াজ চুপচাপ নিজের ঘরে বসেছিল। একের পর এক মানসিক চাপ তাকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলেছে পুরো। এখন সে কোথাও এক মুহুর্ত শান্তিতে বসে থাকতে পারছে না। শাহনওয়াজ নিজের রুমেই বসে ছিল এমন সময় হঠাৎ করে আকবর তার রুমে চলে আসে। আকবরকে দেখে শাহনওয়াজ বলে ওঠে,
“কিছু বলবে তুমি?”

আকবর হালকা শ্বাস ফেলে বলে,
“জ্বি, স্যার,,,আপনাকে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।”

“কি কথা?”

“আমার স্পেশাল ডেরায় পুলিশ রেট করেছে..আমাদের অনেক গোপন নথি এতে করে ফাঁস হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।”

“এটা কিভাবে হলো?”

“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। স্যার, আমাদের এবার কিছু করতে হবে।”

শাহনওয়াজ কিছু বলতে যাবে এমন সময় তানহার চিন্তা আবারো তার মাথায় চলে আসে। সে বলে ওঠে,
“আমি কিছু ভাবতে পারছি না আকবর..তুমিই কিছু করে নাও।”

“এখন আমাদের এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না, স্যার। এসব তথ্য সামনে চলে এলে আমাদের সবার বিপদ হবে।”

“কোন বিপদের কথা বলছ তুমি আকবর? আমার জীবনে কোন বিপদ ঘটা বাকি আছে কি? আমার যা ছিল সবই তো আমি হারিয়ে ফেলেছি..আমার তানহা..যাকে ঘিরে আমি আমার জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করতে চেয়েছিলাম তাকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি। তাই এখন আমি আর কোন কিছুর পরোয়া করি না। যা হবার হতে দাও।”

“এসব আপনি কি বলছেন স্যার? আপনার এই তিল তিল করে গড়ে তোলা মাফিয়া সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে আর আপনি তা বসে বসে দেখবেন? ভুলে গেছেন আপনি আপনার গুরুকে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন? নিজের জীবন দিয়ে হলেও এই মাফিয়া সাম্রাজ্যকে আপনি টিকিয়ে রাখবেন। আপনি সেই প্রতিজ্ঞার অলঙ্ঘন করতে পারেন না।”

শাহনওয়াজ রাগী স্বরে বলে,
“আমি কি বললাম তুমি শুনতে পাও নি? আমার কিছু যায় আসে না। দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামন থেকে।”

আকবরও এবার মেজাজ হারিয়ে বলে,
“কেন এমন করছেন স্যার, আপনি? ঐ তানহা নামের একটা সামান্য মেয়ের মৃত্যু আপনাকে এতোটা দূর্বল করে দিল যে তার কাছে আপনার সবকিছুই ফিকে হয়ে গেল। আরে ওমন মেয়ে আপনি আরো দশটা পাবেন আর..”

আকবর নিজের কথা শেষ করতে পারে না তার আগেই শাহনওয়াজ আকবরের কলার ধরে তাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। আকবত হতবাক হয়ে যায়। সে ভাবতেও পারে নি যেই শাহনওয়াজকে সে সবসময় নিজের বড় ভাইয়ের মতো দেখত, সে তাকে এত নির্দয়ভাবে মারতে পারে। মারতে মারতে আকবরকে আধমরা করে সে বলে,
“আমার তানহার নামে বাজে কথা বলার সাহস তুই কোথায় পেলি..তোকে আজ আমি মেরেই ফেলব..”

এমন সময় তাদের গ্যাং এর কিছু সদস্য এগিয়ে এসে আকবরকে রক্ষা করে। তারা শাহনওয়াজকে টেনে দূরে সরায়। শাহনওয়াজ চেচিয়ে বলে,
“দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে। আর কখনো আমার সামনে আসবি না তুই..নাহলে তোকে আমি মেরেই ফেলব।”

আকবরও আবেগের বশে বলে ফেলে,
“স্যার..আজ আপনি যা করলেন তার জন্য একদিন খুব পস্তাবেন দেখবেন। বাস্তবতা একদিন আপনাকে বুঝিয়ে দেবে আপনি কত বড় ভুল করেছেন।”

কয়েক দিন পর,
সকালের সূর্য উদয় হয়েছে নীল আকাশে। কিন্তু শাহনওয়াজের জীবনে এসে পৌঁছাতে পারছে না সেই আলো। সে এখনো নিজেকে ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ করে রেখেছে। শাহনওয়াজ সেই দিনের পর থেকে আজ অব্দি ঘরের বাইরে এক পাও রাখেনি। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে নিজের কাছে সংরক্ষিত তানহার একটা ছবি দেখে বলে,
“বিশ্বাস করো তানহা..আমি আর বাঁচতে চাই না..আমি তোমার কাছে যেতে চাই…তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্তও আমার আর কাটাতে ইচ্ছা করছে না এই জঘন্য পৃথিবীতে।”

শাহনওয়াজের ভাবনার মাঝেই আচমকা তার রুমে কেউ নক করে। শাহনওয়াজ গিয়ে দরজা খোলার সাথে সাথেই একসাথে অনেকে তার উপর হামলে পড়ে। শাহনওয়াজ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতে হাতকড়া পড়ানো হয়। শাহনওয়াজ পুরো কিয়ংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ে।

কিছু সময় পরেই আফনান সিদ্দিকী এগিয়ে এসে বলে,
“তোমার খেলা শেষ মাফিয়া কিং শাহনওয়াজ সিদ্দিকী। এবার যাও, জেলের হাওয়া খেয়ে এসো। উপস..আর তো আসতে পারবে না তুমি। এবার সারাজীবন জেলের চার দেয়ালেই কাটাতে হবে।”

শাহনওয়াজ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। যেন সে এটার জন্য প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই। তবে এরপরই তার জন্য এমন কিছু অপেক্ষা করছিল যা সে স্বপ্নেও ভাবে নি। শাহনওয়াজকে অবাক করে সোহিনী তার সামনে এসে বলে,
“অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আমায় এই দিনটা দেখার জন্য অবশেষে আমার পরিকল্পনা সফল।”

শাহনওয়াজ সিদ্দিকী হতবাক হয়ে বলে,
“তুমি!”

আফনান বলে,
“শাহনওয়াজের তানহাই তাকে টানতে টানতে জেলে নিয়ে যাক। এই ব্যাপারটা দেখা খুব ইন্টারেস্টিং হবে।”

বলেই আফনান ও সোহিনী সমস্বরে হেসে ওঠে। শাহনওয়াজের মন পুরো ভেঙে যায়। দুচোখ জলে পরিপূর্ণ। এত বড় ধোকাও সম্ভব জীবনে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨