#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৬(নতুন চমক)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
শাহনওয়াজ সোহিনীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। তখনো সে নিজের দুই চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিছুটা সময় নীরব থাকার পর শাহনওয়াজ সিদ্দিকী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। চোখের জলটাকেও তখন তার বৃথা মনে হয়। সে করুণ স্বরে সোহিনীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুমিই আমার তানহা, তাই না?”
সোহিনী হালকা হেসে বলে,
“একদম ঠিক ধরেছেন আপনি মাফিয়া কিং। কিন্তু আফসোস, ধরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল। এখন আর এটা জেনেও কোন লাভ নেই৷ বাকিটা সময় জেলের ঘানি টানার জন্য প্রস্তুত হন।”
বলেই সোহিনী এগিয়ে এসে শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দেয়। শাহনওয়াজ কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। হাতকড়া পড়ানোর পর সোহিনী আলতো হেসে বলে,
“কি ভেবেছিলেন? এত এত অন্যায় করে পার পেয়ে যাবেন। খুব অহংকার ছিল না আপনার যে কোনদিন আইন আপনার অব্দি পৌঁছাতে পারবে না? আজ দেখুন, আমি আপনার সেই অহংকার কিভাবে চূর্ণ করে দিলাম। এবার কি বলবেন আপনি? আর কিছু বলার আছে আপনার?”
শাহনওয়াজ বলে,
“ভালোই অভিনয় করলে। ঠিকই বলে মানুষ,নারীরা সত্যিই ছলনমায়ী। তবে একটা কথা কি জানো? তুমি আমাকে যতটা না ঠকিয়েছ তার থেকে কয়েক গুণ বেশি তুমি নিজে ঠকে গেছ। আমার হৃদয়ে এক সময় তোমার জন্য যেই খাটি ভালোবাসা ছিল আজ তা পুরোটাই ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। তুমি আজ হয়তো কিছু উপলব্ধি করতে পারছ না। তবে একদিন যখন বুঝতে পারবে কি হারিয়েছ তখন ঠিকই আফসোস করবে।”
সোহিনী শাহনওয়াজের থেকে এমন কথা আশা করে নি। সে যারপরনাই অবাক হয়। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফনান সিদ্দিকী বলে ওঠে,
“ওর এসব বাজে কথায় কান দিও না। দ্রুত গ্রেফতার করো। এরকম অপরাধীর আবেগঘন কথায় গলতে নেই। আজ তোমার না আমারও একটা বড় ইচ্ছা পূরণ হলো। এই শাহনওয়াজ সিদ্দিকীকে ধরার জন্য আমি নিজের বাবার অন্যায়ের পথ ছেড়ে আইনের পথ বেছে নিয়েছি। একজন গোয়েন্দা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। আজ আমার সকল পরিশ্রম সার্থক।”
সোহিনী একবার শাহনওয়াজের চোখের দিকে তাকায়। ঐ চোখে যেন আগুন জ্বলছিল৷ যেই আগুন সবকিছু ছাড়খাড় করার ক্ষমতা রাখে। সোহিনী কিছু বলবে তার আগেই হঠাৎ করে একটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয় ও চারিদিক ধোঁয়ায় ভড়ে ওঠে। সোহিনী সহ অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা সবাই ধোয়ার কারণে কিছুই চোখে দেখতে পায় না। এক সময় ধোয়ার চোটে সবাই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
★★
“স্যার, আপনি ঠিক আছেন তো?”
আকবরের কণ্ঠস্বর কানে আসতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে শাহনওয়াজ। আজ তাকে একদম পরাজিত সিংহের মতো লাগছে। আকবর শাহনওয়াজের দিকে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না।
শাহনওয়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“কেন আমায় এভাবে পালিয়ে নিয়ে এলে আকবর? আমি তো এটাই ডিজার্ভ করি..ভালোবাসায় এতটা অন্ধ হয়ে গেছিলাম যে আগুপিছু কিছু ভাবিনি। তুমি আমাকে বারবার সতর্ক করে গেছ কিন্তু আমি তোমার কোন সতর্কবার্তাকে মূল্যায়ন করি নি। আজ আমার এই বোকামির ফল পোহাতে হচ্ছে আমাকে। ভালোবাসাই আমার কাল হলো আকবর। ঐ তানহার জন্য আমি তোমাকে কিভাবে না মারলাম আর ও কিনা এভাবে..”
আকবর শাহনওয়াজের কাধে হাত রেখে বলে,
“এভাবে ভেঙে পড়বেন না স্যার। এই কষ্ট, প্রতারণা এগুলোকে নিজের শক্তি বানান, দূর্বলতা নয়। আপনি জীবনে ভালো কিছু ডিজার্ভ করেন৷ ঐ তানহা আপনার যোগ্য নয়।”
“তানহা নয়..ওর নাম ইন্সপেক্টর সোহিনী।”
“তার মানে ওর পুরো পরিচয় মিথ্যা ছিল? আমিও আন্তরিকভাবে দুঃখিত স্যার। এর দায় আমিও এড়াতে পারি না। কোথাও না কোথাও আমার খামখেয়ালিপনার জন্য।”
“তোমার কোন দোষ নেই আকবর। ওরা আটগাট বেঁধেই মাঠে নেমেছিল।”
“তাহলে এবার আপনি কি করবেন স্যার?”
“প্রতিশোধ নেভ আমি। আমার প্রতি করা সব প্রতারণার।”
“আমিও আপনার পাশে আছি, স্যার।”
“ঐ সোহিনী আমাকে যতই না কষ্ট দিয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট আমি ওকে দেবো। এতদিন ও আমার ভালোবাসা দেখেছে এবার আমার ঘৃণা দেখবে।”
★★
সোহিনী মন খারাপ করে বসে ছিল তার অফিসে।
আফনান সিদ্দিকী তার কেবিনে প্রবেশ করলো। সোহিনীর বিষন্ন চেহারা দেখে বললো,
“তুমি এখনো আপসেট?”
“আপসেট হবো না? ঐ মাফিয়াটাকে ধরার জন্য এত দিন ধরে আমি কত পরিশ্রম করলাম..কত নিখুঁত সব পরিকল্পনা সাজালাম অথচ কি হলো? আমার সব পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল ও।”
“আরে চিল..এত দুঃখ পাবার কিছু নেই।”
“দুঃখ পাবো না? এত কিছু হবার পরেও..”
আফনান আচমকা সোহিনীকে কাছে টেনে নিলো। অতঃপর বলল,
“এসব পরে ভাবা যাবে..অনেক দিন তোমায় কাছে পাইনি..আজ চলো দুজনে একটু রোম্যান্টিক সময়..”
সোহিনী আফনানকে ঠেলে দূরে সরায়। তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বলে ওঠে,
“আমার এখন এসব ভালো লাগছে না আফনান..”
“কি হলো সোহিনী? তুমি এমন ওভার রিয়্যাক্ট কেন করছ? ভুলে গেছ আমরা বিগত দুই বছর থেকে রিলেশনে আছি। এর আগেও তো আমরা বহুবার ক্লোজ হয়েছি কিন্তু তুমি তো তাতে কোন আপত্তি করো নি। তাহলে আজ কেন করছ?”
সোহিনী থমকায়। আসলেই তো। আফনানের সাথে তো তার অনেক বছরের পুরানো সম্পর্ক। তাদের একসাথে কত সুন্দর মুহুর্ত আছে। কখনো তো তার এমন অস্বস্তি হয় নি। তবে আজ কেন হচ্ছে? সোহিনী দুচোখ বন্ধ করলো। সাথে সাথেই তার মস্তিষ্কে শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর ছবি ভেসে উঠলো। সোহিনী থমকাল। দ্রুত এক ঢোক পানি খেল। আফনান সিদ্দিকী নীরব চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করল।
সোহিনী নিজের মাথা চাপড়ে বলল,
“এটা হতে পারে না..এটা আমি কিভাবে করতে পারি..এ কেমন অনুভূতি খেলা করছে আমার মনে? কেন আমি ওর কথা ভাবছি। আই নিড সাম টাইম টু হ্যাং ওভার।”
★★
শাহনওয়াজের আপাতত কিছুদিন গা ঢাকা দেয়া প্রয়োজন। তাই সে চট্টগ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে চট্টগ্রামের রাউজানের অন্তর্ভুক্ত ছোট্ট একটি গ্রামে। আকবরের এক সুসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসা এই গ্রামে। আকবরই শাহনওয়াজকে নিয়ে এলো এই গ্রামে। গ্রামের নাম কুসুমপুর। গ্রামে পৌঁছে যেতেই আকবর শাহনওয়াজকে অভয় দিয়ে বললো,
“এই গ্রামটা অনেকটা সুরক্ষিত কেননা, এটি বেশ প্রত্যন্ত এলাকায় তাছাড়া এখানে তেমন বাইরের লোকজনেরও আনাগোনা নেই। এখানে আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদে অবস্থান করতে পারবেন এবং এখান থেকেই নিজের পরবর্তী পরিকল্পনার গুটি সাজাতে পারবেন।”
শাহনওয়াজ গাড়ি থেকে নামতেই প্রথমে তার চোখে পড়লো সুদূরে কিছু বাচ্চারা মিলে কিতকিত খেলছে। শাহনওয়াজ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর চোখ ফিরিয়ে সামনে হাটা ধরবে এমন সময় আচমকা কারো সাথে সে ধাক্কা খেলো। শাহনওয়াজকে খুব জোরে ধাক্কা দিয়েছে বিপরীতদিক থেকে ছুটে আসা কেউ, তাতে শাহনওয়াজের বেশি কোন ক্ষতি হয়নি। তবে যে তাকে ধাক্কা দিয়েছে সে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। শাহনওয়াজ দ্রুত আগলে নেয় সে পড়ে যাবার আগেই। আর অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, পরনে একটা পুরাতন সালোয়ার কামিজ ও কোমড়ে গামছা বাধা একটা মেয়ে, বয়স আনুমানিক ১৮/১৯ হবে। মেয়েটার চোখেমুখে চঞ্চলতার রেশ। মেয়েটার মায়াভরা চেহারা দেখে শাহনওয়াজ চোখই ফেরাতে পারে না। এদিকে মেয়েটা দ্রুত শাহনওয়াজের থেকে দূরে সরে যায়৷ অতঃপর বলে ওঠে,
“সুদানির পোয়া.. দেখলে কি মাথা ঠিক থাহে না! এইডা কিয়া হতা!”
এমন সময় পেছন থেকে এক মধ্যবয়সী নারী বলে ওঠে,
“ঐ তানহা.. থাম..”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨