অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-১৭

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শাহনওয়াজ তার সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে অদ্ভুতভাবে দেখছিল। এদিকে মেয়েটা গালি দিয়ে আর এক সেকেন্ডও সেখানে রইলো না। দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করলো। শাহনওয়াজ সিদ্দিকী দেখল একজন ভদ্রমহিলা মেয়েটির পিছু নিলো।

কিছু সময় পর ভদ্রমহিলাটি মেয়েটির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসতে লাগল। মেয়েটি এবার বেশ অসহায় সুরে বলতে লাগল,
“ও খালা এইবারের মতো মাফ করে দেও। আমি কথা দিচ্ছি, আর কখনো রাতবিরেতে ঐ উত্তর দিকের জঙ্গলে যাব না।”

এদিকে মহিলাটি দ্বিগুণ রাগী স্বরে বলে,
“চুপ কর একদম। তোর উপর আমার আর বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। তোকে আমি কতবার বলেছি রাত-বিরেতে জঙ্গলে যাবি না..জ্বিনের আছড় হতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এত চঞ্চল কেন তুই?”

তানহা উত্তরে কিছু বলতে পারে না। এদিকে মহিলাটিকে দেখে আকবর এগিয়ে গিয়ে বলে,
“কুলসুম আন্টি, আপনি কেমন আছেন?”

হঠাৎ করে আকবরকে দেখে কুলসুম বেগম হতভম্ব হয়ে যান। আকবর তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। আজ বহুদিন পর আকবরের মুখোমুখি হতে হলো তাকে। কুলসুম বেগম নিজের অবাক ভঙ্গি কাটিয়ে বলেন,
“আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি ভালো আছ?”

আকবর মাথা নাড়ায়। অতঃপর তানহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মেয়েটাকে এভাবে মারছিলেন কেন আন্টি? এত বড় মেয়েকে এভাবে মারা কি সমীচীন দেখায়?আর কে এই মেয়েটা?”

কুলকুল বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“মারছি কি আর সাধে..ও হলো তানহা..আমার বোনের মেয়ে ছিল ও। বোনটা তো অকালে চলে যাব। তারপর ওর বাপে ওরে অনেক অত্যাচার করত। সেসব জেনে আমি আর থাকতে পারিনি। আল্লাহ তো আমায় সন্তানসুখ দেয় নি। তাই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলাম নিজের কাছে। নিজের সন্তানের মতো ওকে মানুষ করেছি। কিন্তু এই মেয়েকে আদর একটু বেশিই দেয়া হয়ে গেছে। তাই না এই মেয়ের মুখে কোন লাগাম আছে আর না হাতে-পায়ে..যখন দেখো শুধু লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। তুমিই বলো, পাড়া গায়ের মেয়ের এতো চঞ্চলতা কি মানায়? মেয়ে মানুষ হবে চুপচাপ, শান্তশিষ্ট তা না..গ্রামের লোক তো নানা কথা বলে এসব চঞ্চলতা নিয়ে। তার উপর ও রাতের বেলা ঐ উত্তরের জঙ্গলে যায় আমাকে কিছু না বলে। তাও আবার কিছু বনজ পাতা আনতে।”

তানহা এবার আর চুপ থাকতে না পেরে বলে,
“পাতা গুলো তো তোমার জন্যই আনা খালা। এই সব পাতা বেটে দিলে বাতের ব্যথার উপশম হয়। সেজন্যই তো আমি ঝুঁকি নিয়ে যাই আর তুমি..”

​তানহার কথায় কুলসুম বেগম কিছুটা নরম হন। তিনি বলেন,
“আমি বুঝি রে মা, তুই আমার জন্যেই যাস। কিন্তু তোর যদি কিছু হয়ে যায় তখন? তোর কি একবারও চিন্তা হয় না আমার জন্য? তোর তো মাথা খারাপ, যেকোনো বিপদ ঘটাতে পারিস। এই রাতের বেলায় তুই আমাকে কিছু না জানিয়ে এমন একটা জায়গায় গেছিস, যেখানে মানুষ দিনের আলোতেও ভয়ে যায় না। ”

​তানহা তার খালার দিকে অসহায়ভাবে তাকায়। কুলসুম বেগমের রাগ কমে এসেছে দেখে সে একটু সাহস পায়। সে আকবরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি তো সত্যি কথাই বলছি। আমি আমার খালার জন্যেই গিয়েছিলাম।”

​আকবর তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সে বুঝতে পারে মেয়েটি ভীষণ সরল। এই মেয়ে শহরের কপটতা থেকে অনেক দূরে। আকবর কুলসুম বেগমকে বলে,
“আন্টি, ও তো আপনার জন্যই ঝুঁকি নিয়েছে। আপনি বরং ওকে ক্ষমা করে দিন।”

​কুলসুম বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তিনি তানহার হাত ছেড়ে দেন। তানহা তার হাত ঝেড়ে দেয় এবং একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। কুলসুম বেগম আকবরের দিকে ফিরে বলেন,
“তোমার সাথে কে এসেছে? তোমার সাথে যে ভদ্রলোকটি আছে, তিনি কি শহরে থাকেন?”

​আকবর শাহনওয়াজের দিকে ইশারা করে বলে,
“উনি আমার বন্ধু। শহরেই থাকেন। উনার শরীরটা খারাপ, তাই একটু গ্রামের শান্ত পরিবেশে থাকতে এসেছেন।”

​কুলসুম বেগম শাহনওয়াজের দিকে ভালো করে তাকান। শাহনওয়াজের চোখে মুখে একটা ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ভাব। তিনি বুঝতে পারেন, এই মানুষটি হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছে। গ্রামের মানুষরা সহজে অতিথিদের প্রতি বিরূপ হয় না। তাই তিনি শাহনওয়াজকে তাদের বাড়িতে থাকতে বলেন।

​আকবর অবাক হয়ে যায়। সে কুলসুম বেগমকে বলে, “আন্টি, আমরা কি এখানে থাকতে পারি? যদি আপনার খুব বেশি অসুবিধা না হয়।”

​”কেন পারবে না? আমাদের বাড়িটা কি অত ছোট? আমাদের তো বেশ বড় বাড়ি। আমার বাড়িতে থাকার জায়গার অভাব নেই ”

​আকবর আর কিছু বলতে পারে না। শাহনওয়াজও চুপ করে থাকে। সেও বুঝতে পারে কুলসুম বেগম কত ভালো মনের মানুষ। তিনি কোনো কিছু না ভেবেই অপরিচিত একজনকে তার বাড়িতে থাকতে বলছেন।

​কুলসুম বেগম তানহাকে বলেন,
“যা, তানহা, ওদেরকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যা।”

​তানহা অবাক হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না কি করবে। তার খালা হঠাৎ করে অপরিচিত লোকজনকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলছেন। তানহা একটু ইতস্তত করে। কিন্তু তার খালার কঠোর দৃষ্টি দেখে সে আর কিছু বলে না। সে চুপচাপ কুলসুম বেগমকে অনুসরণ করে।
​শাহনওয়াজ এবং আকবর কুলসুম বেগমের বাড়িতে আসে। বাড়ির চারপাশে গাছপালা আর সবজি বাগান। ভেতরে ঢুকতেই একটা ঠান্ডা বাতাস এসে তাদের মন ভালো করে দেয়। কুলসুম বেগম তাদের থাকার জন্য একটা ঘর দেখিয়ে দেন। ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কুলসুম বেগম বলেন,
“তোমরা এই ঘরে থাকতে পারো। আর এখন যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো। তারপর আমি তোমাদের খেতে দিচ্ছি।”

​শাহনওয়াজ এবং আকবর হাত মুখ ধুয়ে আসে। কুলসুম বেগম তাদের জন্য গরম ভাত, ডাল আর সবজি নিয়ে আসেন। শাহনওয়াজ এত সাধারণ খাবার দেখে কিছুটা অবাক হয়। সে শহরের বড় বড় রেস্টুরেন্টে দামি দামি খাবার খেত। কিন্তু কুলসুম বেগমের রান্নার স্বাদ অদ্ভুতরকমের ভালো। শাহনওয়াজ বুঝতে পারে এই খাবারগুলো ভালোবাসার পরশ দিয়ে রান্না করা হয়েছে।

খাওয়ার সময় তানহার প্রতি কুলসুম বেগমের অতিরিক্ত যত্ন দেখে ​শাহনওয়াজ বুঝতে পারে কুলসুম বেগম তানহাকে কতটা ভালোবাসেন। সে বুঝতে পারে তানহার চঞ্চলতা দেখেও কুলসুম বেগম কেন তাকে কিছু বলেন না। কুলসুম বেগমও বলেন,
“এই অসহায় মেয়েটার আমার জীবনের সব। ওকে আমি জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি। হয়তো মাঝে মাঝে অনেক রাগ হই কিন্তু তা আমার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।”

​আকবর বলে,
“আমি জানি আন্টি, আপনি তানহাকে অনেক ভালোবাসেন। ”

​কুলসুম বেগম হাসেন। তিনি বলেন,
“হ্যাঁ, আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ও আমার জীবন। ওর কারণে আমার জীবনটা এতটা সহজ হয়ে গেছে। ”

​শাহনওয়াজ খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহিনীর কথা তার মনে পড়ে। সেও একসময় শাহনওয়াজের জীবনে এসেছিল। কিন্তু সে তার জীবনকে সহজ করার জন্য আসেনি। সে এসেছিল শাহনওয়াজের সবকিছু কেড়ে নিতে।

​খেয়ে উঠে শাহনওয়াজ আর আকবর ঘরটার দিকে ফিরে যায়। শাহনওয়াজের মন খুব খারাপ। সে বুঝতে পারে না কি করবে। সে জীবনে প্রথমবার এমন অসহায় বোধ করছে। সে যাকে এতদিন ভালোবাসতো, সেই ভালোবাসাই তাকে আঘাত করেছে।

​”স্যার, আপনার কি হয়েছে? আপনি কি এখনো ঐ সোহিনীর কথা ভাবছেন?”

আকবর জিজ্ঞেস করে। ​শাহনওয়াজ আকবরের দিকে তাকায়। সে বলে,
“হ্যাঁ, আমি ভাবছি। আমি বুঝতে পারছি না কেন এমন হলো।”

​আকবর বলে,
“স্যার, আপনি এতো ভেঙে পড়বেন না। আপনি আপনার জীবনে নতুন করে শুরু করতে পারেন।”

​শাহনওয়াজ চুপ করে থাকে। সে কোনো উত্তর দেয় না।

​রাতে শাহনওয়াজ তার ঘরে বসে থাকে। সে ঘুমাতে পারছে না। সোহিনীর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সে বুঝতে পারে না কিভাবে সোহিনীর প্রতারণার কথা ভুলে যাবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨