অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-০২

0
12

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

তানহা নিজের মতো রান্না করছিল। কারণ সে জানে রান্নাটা ঠিকমতো নাহলে তার শাস্তির মেয়াদ বাড়বে। এমন সময় হঠাৎ করে সে কয়েকটা গাড়ির আওয়াজ শুনল রান্নাঘর থেকে। তানহা অবাক হয়ে বলল,
“আমাদের এলাকায় আবার কে গাড়ি নিয়ে আসলো?”

মর্জিনা বেগম ও মিহি সোফায় বসে গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে। এমন সময় হঠাৎ তাদের বাড়ির দরজা খুলে যায়। মর্জিনা বেগম চমকে উঠে দাঁড়ান। মিহিও ভীষণ অবাক হয়। দরজা খুলে যাওয়ার পরই রাজকীয় ভঙ্গিতে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে শাহনওয়াজ সিদ্দিকী। তাকে দেখামাত্রই মিহি অবাক হয়ে যায়। মর্জিনা বেগম অবশ্য তাকে চেনেন না। তাই তিনি বলে ওঠেন,
“কে আপনি?”

সাথে সাথেই মিহি মর্জিনা বেগমের হাতে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে বলে,
“আম্মু, সাবধানে কথা বলো। উনি এই শহরের বিখ্যাত মাফিয়া শাহনওয়াজ সিদ্দিকী।”

কথাটা শুনেই মর্জিনা বেগমের কন্ঠস্বর নিচু হয়ে যায়। তিনি বিড়বিড় করে বলেন,
“হায় খোদা! ইনি আমাদের এখানে কেন এসেছেন? আমরা আবার কি করলাম ওনার সাথে?”

“দাঁড়াও, আমায় ব্যাপারটা বুঝতে দাও।”

শাহনওয়াজ সিদ্দিকী কারো পরোয়া না করে তাদের বাড়ির নরম সোফায় গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়ে। চারিদিকে তার সমস্ত গার্ডরা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। মর্জিনা বেগমের তো ভয়ে অজ্ঞান হবার জোগাড়। তিনি মিহির উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“কি হচ্ছে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“বুঝতে তো আমিও পারছি না, আম্মু। এনাদের সাথে কথা বলার সাহসও তো হচ্ছে না।”

“তুই এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে যা না গিয়ে তোর আব্বুকে ডেকে নিয়ে আয়।”

এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন এই বাড়ির কর্তা আসগর ইসলাম। তিনি এসেই বলে ওঠেন,
“এ কি? কে আপনারা? আর আমার বাড়িতে কি করছেন?”

একই সময় তানহারও আগমন ঘটে সেখানে। তানহাকে দেখে শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর মুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে। নিজের পকেট থেকে একটা কানের দুল বের করে তিনি সবাইকে দেখিয়ে অতঃপর সেই কানের দুলটা সোফার সামনে থাকা ডেস্কে রেখে বলেন,
“এটা দেয়ার জন্য এসেছিলাম।”

তানহার হাত চলে যায় তার কানে। এটা তো তারই কানের দুল। কোনভাবে হয়তো খুলে পড়ে গেছিল। তানহার মনে এবার ভয় কাজ করতে শুরু করে। এই লোকটা কেন এই দুল নিয়ে এখানে এলো?

মিহি এতক্ষণে সাহস করে বলে,
“আম্মু এই দুলটা তো..”

মর্জিনা বেগমের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তানহার পানে। তানহার একটি কানে দুল নেই। শাহনওয়াজ এবার উঠে দাঁড়িয়ে তানহার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কালকে রাতটা অনেক মজার ছিল। আশা করি এমন মজা আবারো হবে।”

তানহা বিস্ফোরিত চোখে শাহনওয়াজের দিকে তাকায়। শাহনওয়াজ এরপর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একে একে তার সব গার্ডসরাও বেরিয়ে যায়। সবাই বেরিয়ে যাবার পর মর্জিনা বেগম এগিয়ে আসেন। তানহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার চুলের মুঠি টেনে ধরে গালে ঠাস করে থা*প্পড় বসিয়ে দিয়ে বলেন,
“তারমানে আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। রাতের আধারে নিজের দেহ বিক্রি করতে গেছিলি তুই।”

তানহার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মিহিও নিজের মায়ের তালে তাল মিলিয়ে বলে,
“একদম ঠিক বলেছ আম্মু। সবসময় তো সতী-সাবিত্রী সেজে থাকে। এখন আসল চেহারা বেরিয়ে এলো। দেখেছ এই মেয়ের বুদ্ধি। কেমন চালাকি করে রাঘব বোয়ালকে জালে ফাসিয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক টাকা কামিয়েছে।”

কথাটা শুনেই মর্জিনা বেগমের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। এর মাঝে তানহা অনেক আশা নিয়ে এগিয়ে গেলো তার বাবা আসগর ইসলামের দিকে। করুণ স্বরে বলল,
“আব্বু বিশ্বাস করো, আমি এমন কিছু করিনি…আমি তো শুধু..”

আসগর ইসলাম এক ধাক্কায় তানহাকে দূরে সরিয়ে বললেন,
“দূরে থাক আমার থেকে। খবরদার আমায় আব্বু বলে ডাকবি না। এই তুই তোর মায়ের সাথে মরে গেলি না কেন রে? আমার সম্মান একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিলি! ছি! আমার মেয়ে কিনা এসব করছে। ভাবতেও আমার গা গুলিয়ে উঠছে।”

মিহি এবার মর্জিনা বেগমের কাছে গিয়ে বলে,
“এই সুযোগ আম্মু। এই সুযোগে এই আপদটাকে বিদায় করো।”

মর্জিনা বেগম বলেন,
“দাঁড়া, আমায় আগে ব্যাপারটা ভালো ভাবে বুঝতে দে।”

“কি বুঝবে তুমি আম্মু?”

“যদি সত্যিই ঐ শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর সাথে তানহার কোন সম্পর্ক থাকে তাহলে নিশ্চয়ই ওকে অনেক টাকা দিয়েছে। সেই টাকার ভাগ না নিয়ে ওকে কিভাবে ছাড়ি।”

“ঠিক বলেছ তো, এটা তো আমার মাথায় আসেনি।”

মর্জিনা বেগম এবার তানহার কাছে গিয়ে তাকে টেনে তুলে বলেন,
“চল, এক্ষুনি তোর রুমে গিয়ে তোর সব জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছি। মানে মানে কেটে পর তো এখান থেকে।”

বলেই তিনি তানহাকে টানতে টানতে তার রুমে নিয়ে যান। মিহিও তার সাথে যায়। রুমে এসেই মর্জিনা বেগম ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে বলেন,
“অনেক হয়েছে তোর সতীপনা। এবার মানে মানে টাকা বের কর।”

“কিসের টাকা আম্মু?”

“মাগো মা! কি ন্যাকামো! কিসের টাকা মানে? কাল রাতে যে ঐ মাফিয়াটার বিছানা গরম করেছিস তার বিনিময়ে যে টাকা পেয়েছিস তার কমিশন আমাদের দিবি না?”

তানহা বলে ওঠে,
“আমি এমন কিছু করিনি।”

মিহি তানহার চুল টেনে ধরে বলে,
“এই একদম অভিনয় করবি না। এতদিন ধরে যে তোকে আমরা পেলেছি এখন তোকে এমনিই ছেড়ে দেব ভেবেছিস। যা আয় করেছিস তার ভাগ আমাদের দিতে হবে। নাহলে..”

“বিশ্বাস করো আমি সত্যি এমন কিছু করিনি।”

মর্জিনা বেগম বলেন,
“বুঝেছি, ভালোয় ভালোয় তুই মানবি না। মিহি আয় তো, পুরো ঘর আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজব। টাকা নিশ্চয়ই এখানেই কোথাও রেখেছে।”

দুজনে পুরো ঘর এলোমেলো করে দেয়। কিন্তু এক কানাকড়িও পায় না। মিহি ক্লান্ত হয়ে বলে,
“কিছুই তো পেলাম না।”

মর্জিনা বেগম এবার ক্ষিপ্তবেগে এগিয়ে যান তানহার দিকে। তানহার চুলের মুঠি ধরে বলেন,
“ভালোয় ভালোয় বল, কোথায় রেখেছিস নাহলে..”

বলেই তিনি তানহার কান থেকে সোনার দুল ও তার হাতে থাকা সোনার বালা খুলে নেন। তানহা অনুনয় স্বরে বলে,
“এগুলো আমার মায়ের শেষ চিহ্ন। এগুলো কেড়ে নিও না..”

কিন্তু নির্দয় মহিলার কানে কোন কথা যায় না। তিনি এগুলো খুলে মিহির হাতে দিয়ে বলে,
“এ তো ভালো কথা শোনার মেয়ে নয়,,,এবার যাই একে এর জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি।”

বলেই মর্জিনা বেগম তানহাকে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে বের করে দেন। তানহা হাজারো আকুতি করলেও সেসব কানে নেন না। দরজায় এনে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তানহা মর্জিনা বেগমের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে,
“দয়া করে আমায় বের করে দিও না আম্মু। আমি কোথায় যাব এখন? আমার যে এই শহরে আর কোন আপনজন নেই।”

“যেই নাং এর বিছানা গরম করেছিস তার কাছেই যা। পারলে কিছু টাকা জোগাড় করে আনিস। নাহলে এই বাড়িতে তোর আর কোন ঠাই হবে না।”

বলেই তানহার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দেন তিনি। তানহা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে। কিছু সময় পর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়। জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। তানহা ভয়ে হাত দিয়ে কান ঢেকে ধরে। তানহা পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ তানহার মাথায় কেউ ছাতা ধরে। তানহা অবাক হয়ে মাথা উচু করে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। কারণ এটা ছিল সেই শাহনওয়াজ সিদ্দিকী! তানহা বলে ওঠে,
“আপনি!”

শাহনওয়াজ গম্ভীর স্বরে বলে,
“আমার গাড়িতে উঠে বসো।”

“আপনার জন্য আমার আজ এই দশা। আপনার জন্য সবাই আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।”

শাহনওয়াজ নিজের ধৈর্য বজায় রেখে বলে,
“নিজের ভালো চাইলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো..নাহলে..”

“নাহলে কি? আমাকে বাড়ি থেকে বের করেও আপনার শান্তি হয়নি..এবার কি জান মারতে চান।”

বলেই ডুকরে কেদে ওঠে। শাহনওয়াজ বিরক্তিতে চ জাতীয় শব্দ করে বলে,
“নারীজাতীর এই এক সমস্যা কিছু হতে না হতেই ভ্যা করে কাঁদবে।”

বলেই সে তানহাকে আচমকা কোলে তুলে নেয়। তানহা অবাক হয়ে বলে,
“কি..কি করছেন ছাড়ুন আমায়।”

“হুশ,নো মোর ওয়ার্ডস।”

বলেই শাহনওয়াজ তানহাকে গাড়িতে তুলে নেয়। তানহা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। সে বলে,
“আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?.”

শাহনওয়াজ ঠাট্টা করে বলে,
“তোমায় বন্দর থেকে পাচার করে দেব।”

তানহা ভয়ে জড়িয়ে যায়। শাহনওয়াজ তানহার এই অবস্থা দেখে হেসে ফেলে। বিড়বিড় করে বলে,
“পাগলী একটা!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨