অগ্নিদগ্ধ ভালোবাসা পর্ব-০৪

0
11

#অগ্নিদগ্ধ_ভালোবাসা
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

তানহা একটি বড় সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে। পার্লার থেকে লোক এসেছে তাকে সাজানোর জন্য। তানহাও বেশি কিছু না ভেবে সাজতে বসে গেছে। তার কাছে এই সবকিছুই যেন নতুন অভিজ্ঞতা। সৎ মা ও বোনের অত্যাচারে বড় হওয়া তানহার মৌলিক চাহিদাগুলোই কখনো পূর্ণতা হতো না। সেখানে আজ সে এত কিছু উপভোগ করতে পারছে। তানহার কিছুটা ভালো লাগছে। আবার শাহনওয়াজের গতকালকের বলা কথাগুলোর জন্য খারাপও লাগছে।

কিছু সময় পর তানহাকে নিয়ে যাওয়া হয় ড্রেসিং রুমে। সেখানে খুব সুন্দর একটি লাল গাউন পড়িয়ে সাজানো হয় তানহাকে। সাথে ম্যাচিং পেন্ডেন্ট। তানহা আয়নায় যখন নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তখন যেন সে নিজের দুই চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার মধ্যে যে এত সৌন্দর্য লুকানো ছিল তা সে নিজেও জানত না। তানহা এমনিতে দেখতে সুন্দর তবে এভাবে সাজার পর তার সৌন্দর্য যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তানহা আয়নায় নিজেকে দেখছিল তখন নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিল না। এমন সময় শাহনওয়াজ সেখানে উপস্থিত হয়ে একদম তানহার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার উপস্থিতি টের পেয়েই তানহার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। শাহনওয়াজ বাকা হেসে বলে,
“বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তো। এখন তো মনে হয়, তোমাকে বিক্রি করে সত্যিই অনেক টাকা পাওয়া যায়।”

সাথে সাথেই তানহার হাসিমুখ মিলিয়ে যায়। শাহনওয়াজ কিছুটা দূরে সরে আসে তানহার থেকে। শাহনওয়াজের সেক্রেটারি আকবর আড়চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিল। শাহনওয়াজের এই পরিবর্তন তাকেও ভাবাচ্ছে। শাহনওয়াজ তো শুরুতে মেয়েটার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করল, তারপর আবার তার সব বায়োডাটা জোগাড় করল। অতঃপর এভাবে নিজের ম্যানশনে নিয়ে এসে এখন তাকেই বিয়ে করতে চাইছে। আকবর বুঝতে পারে না কি চলছে তার বসের মনে। এরমধ্যেই হঠাৎ করে একজন সিকিউরিটি গার্ড দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে বলে,
“স্যার, বাইরে দুজন মহিলা ভীষণ ঝামেলা করছে ভেতরে ঢোকার জন্য। ওনারা তানহা ম্যামের সাথে দেখা করতে চাইছে।”

তানহা অবাক স্বরে বলে,
“আমার সাথে?”

শাহনওয়াজ বিরক্তির স্বরে বলে,
“আজ আমার জন্য একটা স্পেশাল দিন। আমি কোন সিনক্রিয়েট চাইছি না। তাই যারাই এসে থাকুক তারা যেন কোনভাবেই ভেতরে ঢুকতে না পারে।”

তানহা সহসা এগিয়ে এসে সিকিউরিটি গার্ডের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“ওনারা কারা কিছু বলেছে?”

“বলছে ওনারা নাকি আপনার মা ও বোন..”

তানহা বলে ওঠে,
“ওনাদের ভেতরে আসতে দিন।”

শাহনওয়াজ বিরক্তির স্বরে বলে,
“আমি ওনাদের এখানে এলাউ করব না।”

তানহা আকুতির স্বরে বলে,
“দয়া করুন আমার উপর। আমি অনুরোধ করছি, আমাকে ওদের সাথে কথা বলতে দিন।”

শাহনওয়াজ তানহার কথা শুনে বিরক্তিতে ভ্রু কুচকায়। মনে মনে ভাবে,
“কি দিয়ে তৈরি এই মেয়ে? যারা ওকে এভাবে বাড়িতে বের করে দিল তাদের সাথে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠছে।”

শাহনওয়াজ তবুও নরম হয় না। চোয়াল শক্ত করে বলে,
“এটা আমার ম্যানশন, এখানে আমি যা বলবো তাই শেষ কথা।”

তানহার দুচোখে বিন্দু বিন্দু জল জমে শাহনওয়াজের কথায়। তানহার দুচোখে জল দেখে শাহনওয়াজের মনে কেমন জানি একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এই প্রথম অন্যরকম হিন্দোলে কেপে ওঠে সে। তার মতো শক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষও নরম হতে বাধ্য হয়। কিছুটা নমনীয় স্বরে সিকিউরিটি গার্ডকে বলে,
“ওনাদের ভেতরে আসতে দিন।”

কিছু সময় পর মর্জিনা বেগম ও মিহি দুজনেই একপ্রকার দৌড়াতে দৌড়াতে সিদ্দিকি ম্যানশনে প্রবেশ করে। দুজনেই চোখমুখ বিস্ময়ে ফেটে পড়ে। চারিদিকে এত আলোকসজ্জা,এত দামি দামি সব জিনিস আর এত বড় বাড়ি,,,,এসব তাদের কল্পনার রাজ্যের থেকেও সুন্দর। মিহি ফিসফিস করে বলে,
“আম্মু এতো পুরো রাজপ্রাসাদ..”

মর্জিনা বেগম বলে,
“তাই তো দেখছি রে,,যাইহোক ভালো করে অভিনয় করার জন্য প্রস্তুত হয়। ঐ তানহাকে আমি কিছুতেই একা এই রাজপ্রাসাদে রাজত্ব করতে দেব না।”

বলেই তিনি এগিয়ে যান তানহার দিকে। তানহাও মৃদু স্বরে বলে,
“আম্মু, মিহি তোমরা এখানে..”

দুজনেই পরিকল্পনামতো তানহার পায়ের কাছে বসে পড়ে। তানহা তো পুরো বিস্ময়ে থ বনে যায়। তাকে আরো অবাক করে দুজনে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

শাহনওয়াজ বিড়বিড় করে বলে,
“ননসেন্স ড্রামা,,,”

তানহা বলে,
“তোমরা কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?”

মিহি বলে,
“আমরা তোর সাথে আমরা অনেক অন্যায় করেছি আপু৷ তার ফল এখন আব্বু পাচ্ছে।”

“আব্বু? কি হয়েছে আব্বুর?”

মর্জিনা বেগম বলেন,
“তোর আব্বু ভীষণ অসুস্থ রে..তুই বাড়ি থেকে বের হবার পরই উনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একেবারে যায় যায় অবস্থা। মনে হয় আমি শীঘ্রই বিধবা হতে চেলেছি।”

তানহার বুক ছ্যাত করে ওঠে।

“কোথায় আব্বু? আমি এখনই ওনার সাথে দেখা করতে চাই। আমি ওনার কিছু হতে দেব না।”

শাহনওয়াজ আকবরকে ইশারা করতেই আকবর এগিয়ে এসে বলে,
“আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আমি আপনার বাবার জন্য ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

তানহা তবু শান্ত হতে পারে না। সে বলে,
“নাহ, আমি আমার আব্বুর সাথে দেখা করতে চাই।”

“এটা সম্ভব নয়। আজ আপনার এনগেজমেন্ট…”

তানহা হতবাক স্বরে বলে,
“কি বলছেন এসব? আমার এনগেজমেন্ট মানে?”

মিহি বলে ওঠে,
“এত অবাক হচ্ছিস কেন আপু? এমন ভাব করছিস যেন কিছু জানিসই না। আজ তো তোর আর শাহনওয়াজ সিদ্দিকীর এনগেজমেন্ট।”

তানহা পুরো জমে যায়। সে তো এসব কিছু জানত না৷ শাহনওয়াজের দিকে তাকাতেই সে চোখ ফিরিয়ে বলে,
“তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। দ্যাটস ফাইনাল।”

“কিন্তু..”

মর্জিনা বেগম বলে ওঠেন,
“উনি তো ঠিকই বলছেন। তোকে এখন কোথাও যেতে হবে না। ওনারা তো বললেন ডাক্তারের ব্যবস্থা করবেন। তোর আব্বু ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর মিহিও খুব ক্লান্ত রে।”

তানহা বলে,
“আমি খেয়ালই করিনি।”

সে শাহনওয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আম্মু আর মিহিকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ। আর পারলে আব্বুকেও নিয়ে আসুন।”

শাহনওয়াজ কিছু বলতে যাবে কিন্তু তানহার আকুতিভরা টলটলে চোখ দেখে থেমে যায়। আকবরকে কিছু একটা ইশারা করতেই সে বুঝে যায়। মর্জিনা বেগম ও মিহির কাছে গিয়ে বলে,
“চলুন আমার সাথে।”

আকবর তাদের গেস্টরুমে নিয়ে যায়। এত সুন্দর রুম দেখে তাদের শোক যেন মুহুর্তেই উড়ে যায়। দুজনেই নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মিহি বলে,
“বাহ, কি নরম বিছানা। একদম তুলোর মতো। রুমটাও কত সুন্দর।”

সে সব জিনিসপত্র হাত বুলিয়ে দেখে। আকবর বিড়বিড় করে বলে,
“এনাদের তো অভিনয়ের জন্য নোবেল দেয়া উচিৎ। এখনই কিরকম মরা কান্না কাঁদছিল আর এখন দেখো..”

মর্জিনা বেগম আকবরকে এভাবে তাকাতে দেখে বলেন,
“এভাবে কি দেখছ? আমি এই বাড়ির হবু মালকিনের মা, বুঝলে? আমার দিকে এভাবে তাকাবে না।”

আকবরের ইচ্ছা করছিল মুখের উপর কিছু কথা শুনিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত রাখল। এরমাঝে শাহনওয়াজ কল দিল তার ফোনে।

“হ্যালো, স্যার বলুন।”

“কি বুঝলে?”

“সবটাই এদের অভিনয় স্যার।”

“সেটা আমি আগেই জানতাম। শোনো, ওদের উপর নজর রাখো। আমি চাই নি, আজকের দিনে তানহার মন খারাপ হোক। তাই ওদের এখানে থাকতে দিয়েছি। কিন্তু ওদের উপর আমার একটুও বিশ্বাস নেই। আজ যেন কোন ঝামেলা হয়।”

“জ্বি, স্যার।”

শাহনওয়াজ ফোনটা রেখে দেয়। আকবর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“স্যারের এত নমনীয় রূপ আমি কখনো দেখিনি। কেন উনি ঐ মেয়েটার সামনে বারবার দূর্বল হয়ে পড়ছে? শুধুই কি প্রতিশোধের নেশা নাকি…!”

তার ভাবনার মাঝেই আসগর ইসলাম দৌড়ে দৌড়ে রুমে এলেন। এসেই দল আনন্দে লাফিয়ে মর্জিনা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“তানহার ভাগ্যটা তো সোনায় গড়া দেখছি।”

আকবর ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এনার নাকি যায় যায় অবস্থা ছিল, এখন তো দেখছি ডিস্কো ডান্সার! পুরো ড্রামাবাজ পার্টি!”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨