#অচেনা_অতিথি (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মধ্যরাতে চাচা আমার সঙ্গে বাজে কাজ করার চেষ্টা করলে চিৎকার দিয়ে উঠি। সেই চিৎকার শুনে সবাই ঘরে এলো। অতঃপর সবাই আমাকেই কলঙ্কিনী, খারাপ মেয়ে বলে বাড়ি থেকে বের করে দিলো। অন্ধকার রাত, অজানা ভয়, আতংক সব মিলিয়ে আমি গন্তব্যহীন পথে ছুটে চলছিলাম। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আপনার ঘরের সামনে আশ্রয় নিলাম। এতরাতে আমার কোন যাওয়ার জায়গা নেই। রাতটুকু আপনার ঘরের বাহিরে একটু বসে কাটাতে চাই। আমাকে এতটুকু দয়া করুণ।
উপরোক্ত কথাগুলো বলে বেলী ভয়মিশ্রিত চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকায়। সে যে বাড়ির সামনে আশ্রয় নিয়েছে, সেই বাড়ির মালিক ভদ্রলোক। বেলী চোখ সরিয়ে নিয়ে হাতজোড় করে বলে,“প্লীজ রাতটুকু এখানে থাকতে দিন। সকাল হলেই চলে যাবো।”
“আচ্ছা ভেতরে আসো।”
লোকটির কথায় বেলী হতচকিয়ে যায়। সে কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে বলে,“ভেতরে?”
লোকটি অর্থাৎ নয়ন বেলীর দিকে তাকায়। তার গায়ের চুরিদারটি ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। কিছুটা কেঁপে উঠছে। হয়তো ঠান্ডা লেগে গেছে। সেই সঙ্গে বেলী চোখে স্পষ্ট ভয় দেখতে পায় নয়ন। সে বেলীর দিকে লক্ষ্য রেখে স্বাভাবিক গলায় বলে,“ভেজা অবস্থায় এখানে এভাবে থাকলে তোমার শরীর খারাপ করবে। তাই বলছিলাম ভেতরে এসে বসো। আমি শুকনো কাপড় দিচ্ছি সেসব পড়ে নাও।”
বেলী নয়নের কথা শুনে ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে। তার মনের মধ্যে চলছে নয়ন খারাপ লোক হতে পারে। তার উদ্দেশ্য খারাপ হতে পারে। যেখানে সে নিজের চাচার খারাপ নজরের শিকার সেখানে অপরিচিত এক লোককে যে তার বিশ্বাস হবে না এটাই স্বাভাবিক। নয়ন এসব বুঝতে পারে। সে তাকে বলে,“তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আর আমি যদি তোমার কোন ক্ষতি করতেও চাই তাহলেও বোধহয় তুমি আমাকে বাঁধা দিতে পারবে না। এতটা শক্তি তোমার নেই। সেজন্য বলছি বিপদ আছে জেনে পা না বাড়ানোটা বোকামি। জীবনের সবক্ষেত্রেই বিপদ রয়েছে।”
একটু থেমে নরম গলায় বলে,“ধরো আমি খারাপ মানুষ। এখন এটা জেনে নিশ্চয় তুমি এখানে থাকতে চাইবে না। তো এই বৃষ্টির রাতে তুমি কোথায় যাবে? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে? সেখানে তুমি নিরাপদ থাকবে তো? সেজন্য বলছি চাইলে আমাকে ভরসা করতে পারো। আমি চেষ্টা করবো তোমার ভরসার মান রাখতে।”
নয়ন কথাটি বলে দরজা খোলা রেখে ঘরের ভেতরে চলে যায়।গভীর রাত, আকাশ ঢেকে আছে কালো মেঘে। চারপাশ অন্ধকার, কেবল বিদ্যুতের ঝলক মাঝে মাঝে আকাশকে ছিঁড়ে আলো ছড়াচ্ছে, আর তার সঙ্গে বজ্রপাতের গর্জন যেন পৃথিবী কেঁপে উঠছে। মুষলধারে বৃষ্টির একটানা শব্দ চারদিক ভরিয়ে তুলেছে, যেন আকাশের সব জল ঝরে পড়ছে অবিরাম।
গাছপালাগুলো ঝড়ো হাওয়ায় দুলছে, পাতাগুলোতে বৃষ্টির ধারা নেমে এসে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে নিচে। চারদিক ভিজে মাটির গন্ধে ভরে আছে, যেন প্রকৃতিই ভিজে এক গভীর নিস্তব্ধতাকে ডেকে এনেছে।
এই আবহের মাঝে, একটি ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বেলী। তার গায়ে ভিজে সেঁটে আছে হালকা রঙের চুরিদার, কাঁধ থেকে চুল গড়িয়ে নামছে বৃষ্টির ফোঁটা। চোখে-মুখে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছে, তবুও সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে বৃষ্টির গর্জনের ভেতর তার উপস্থিতি যেন এক অদ্ভুত নীরব প্রতিচ্ছবি। ভেজা শরীর, মাটির গন্ধ আর ঝরঝর শব্দের সঙ্গে মিশে গেছে তার নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকা। সব মিলিয়ে বেলী ভয় ভয় চোখ নিয়ে দরজা দিয়ে ভেতরে তাকায়। সে মনেমনে সিদ্ধান্ত নেয়,“এভাবে এখানে রাতটা পার করা যাবে না। তাই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করাই ভালো।”
এটা ভেবে ভয়ে ভয়ে বেলী দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। সে আস্তে করে ঘরের ভেতর নিজের ভেজা পা রাখতে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। বেলী হঠাৎ ভয় পেয়ে যায়। সে দ্রুত পিছিয়ে যায়। নিজেকে সামলে বুকে হাত দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে বেলী আবার পা সামনে বাড়িয়ে দেয়। অতঃপর এক পা এক পা করে ভেতরে প্রবেশ করে। পুরো ঘর অন্ধকার। সেই মূহুর্তে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে নয়ন বসার ঘরে আসে। বেলী নয়নকে দেখে আবার একটু পিছিয়ে যায়। সে ভীষণ ভয় পাচ্ছে। নয়ন বিষয়টি বুঝে তার দিকে মোমবাতি ধরিয়ে দিয়ে বলে,“এটা নাও। আমি তোমার জন্য শুকনো কাপড় এনে দিচ্ছি।”
বেলী কাঁপা কাঁপা হাতে মোমবাতিটি ধরে। তার মনে হচ্ছিলো এই বুঝে নয়ন তার হাতটি দিয়ে তার দিকে থাবা দেয়। কিন্তু না। সেরকম কিছুই ঘটেনি। নয়ন তার হাতে মোমবাতি দিয়ে নিজে মোবাইলের ফ্লাশ নিয়ে তার বেডরুমে চলে গেল। বেলী মোমবাতির আলোয় বসার ঘরটি দেখছিলো। কিছু মূহুর্তের মাঝে নয়ন একটি সুতির শাড়ী নিয়ে এলো। সেটা বেলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,“পাশের ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় বদলে নাও। আর বেশি ভয় হলে সেখানেই দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো।”
বেলী কোন কথা না বলে কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড় নেয়। সে মোমবাতি নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে এই বাড়িতে নয়ন ছাড়া কেউ নেই। এজন্য তার বেশি ভয় হচ্ছে। নিজেকে সামলে বেলী হাতের কাপড়টা দেখে নেয়। গায়ের ভেজা কাপড় বদলে সুতির শাড়ীটা পড়ে নেয়। ব্লাউজটা যদিও বড় হয়েছিলো তবে সে সামনের দিকে টেনে একটা গিট্টু দিয়ে সামলে নিয়েছে। এরই মাঝে মৃদু বাতাসে মোমবাতিটি নিভে যায়। বেলী অন্ধকারের মাঝে বিছানার কাছে যেতে গিয়ে কিছু একটার সঙ্গে বেজে পড়ে যায়। বেলী পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে নয়ন এগিয়ে আসে। সে বসার ঘরে সোফায় বসে ছিলো। নয়ন এগিয়ে এসে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বলে,“তুমি ঠিক আছো? কিসের শব্দ হলো?”
“হ্যাঁ ঠিক আছি। ঐ অন্ধকারে পড়ে গিয়েছি।”
বেলীর কথা শুনে নয়ন ঠান্ডা গলায় বলে,“অন্ধকার? মোমবাতি নিভে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
বেলীর মুখে এই কথা শুনে নয়ন তাকে সাহস দিয়ে বলে,“ভয় পেও না। সমস্যা নাহলে দরজাটা খোলো। আমি তোমাকে লাইটার দিয়ে দিচ্ছি, আবার মোমবাতি জ্বালিয়ে নিও।”
“আচ্ছা।”
এটা বলে বেলী নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। বাহিরে দরজার ফাঁকা দিয়ে নয়নের হাতের ফোনের ফ্লাশের আলো আসছে। সেই আলোতে বেলী গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আস্তে করে দরজাটা খুলে দেয়। বেলী দরজা খুলতে নয়ন তার দিকে তাকাতে কিছুটা থমকে যায়। বাহিরে অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি। চারপাশ ঢেকে আছে কেবল ঝমঝম শব্দ আর বৃষ্টির রেখা, যেন আকাশ থেকে ছিন্নদার সুতোর মতো ছুটে আসছে অগণিত ফোঁটা। রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক সবকিছুকে আলোকিত করে দিচ্ছে মুহূর্তের জন্য, তারপর আবার ঘন আঁধার।
সেই ভিজে ওঠা পরিবেশের মাঝখানে নয়নের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেলী। তার গায়ে লাল-কালোর সংমিশ্রণে থাকা সুতির শাড়ি। খোলা ভেজা চুল কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে, ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল ও কপাল বেয়ে।
কোনো অলঙ্কার নেই, সাজের ছোঁয়াও নেই।তবু এই বিনাসাজে বেলী যেন অপরূপা। প্রকৃতির বৃষ্টিমাখা উন্মাদনা আর তার সেই নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকা একসাথে মিলে তৈরি করেছে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য, যা নয়নের চোখে জমে উঠছে এক নীরব কাব্যের মতো। কয়েক মূহুর্তের মধ্যে নয়ন নিজেকে সামলে পকেট থেকে লাইটার বের করে বলে,“নাও মোমটা জ্বালিয়ে নাও। ঘরের ভেতর তোয়ালে আছে সেটা দিয়ে চুলটা মুছে নিও।”
“আচ্ছা।”
বেলী আস্তে করে কথাটি বলে লাইটার নেয়। অতঃপর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে যায়। নয়ন দাঁড়িয়ে আছে৷ সে দ্বিধায় পড়ে যায় দরজা বন্ধ করবে কি-না। নয়ন কোন কথা না বাড়িয়ে আবার গিয়ে সোফায় বসে।
___
বেলী চুল মুছে মোমবাতিটা ঘরে রেখেই বাহিরে আসে। সে নয়নকে সোফায় চিন্তিত হয়ে বসে থাকতে দেখে। সে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে দূর থেকেই বলে,“আপনি ঘুমাবেন না?”
“না। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”
এটা বলে নয়ন বেলীর দিকে একপলক তাকায়। বেলী খুব শান্ত গলায় বলে,“আমার ঘুম আসছে না।”
এটা বলে বেলী নির্দিষ্ট দূরত্বে মেঝেতে বসে পড়ে। নয়ন এটা দেখে বুঝতে পারে এই মেয়ে তাকে ভীষণ ভয় পাচ্ছে এবং সে ঘুমিয়ে পড়লে যদি নয়ন সুযোগ নেয় তারও ভয় পাচ্ছে। এটা বুঝতে পেরে নয়ন মনেমনে বলে,“দরজা বন্ধ করে ঘুমালে আমি সুযোগ কিভাবে নিবো? যতসব ঢং।”
এটা বলে নয়ন মনেমনে হেসে দেয়। অতঃপর মুখে বলে,“চাচা তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করলো এই কথা তোমার বাবা, মায়ও বিশ্বাস করলো না। তারাও তোমাকে তাড়িয়ে দিলো। পারলো তাড়িয়ে দিতে?”
“আমার বাবা, মা নেই।
তারা থাকলে জীবনটা এত কঠিন হতো না। দুই বেলা ভাতের জন্য গাধার মতো খাটতে হতো না। না অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হতো। বাবা, মা থাকলে আমিও হয়তো রাজকন্যার মতোই বড় হতাম।”
এটা বলে বেলী ছলছল চোখে নয়নের দিকে তাকায়। নয়ন বেশ অবাক হয়। বেলীর হঠাৎ তার জীবনের কষ্টগুলো মনে পড়ে যায়। তার চোখটা ভিজে উঠে। নয়ন শান্ত গলায় বলে,“যেহেতু ঘুম আসছে না চলো আমরা আমাদের জীবনের গল্প বলি।”
’
‘
চলবে,