#অচেনা_অতিথি (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
বেলী বলে,“আমাদের মতো অসহয় মানুষদের সম্মানের কথা কে বা ভাবে।” নয়ন এই কথাটি শুনে বিব্রত হয়। সে কিছুটা কঠিন গলায় বলে,“কেউ ভাবে না বলে কী নিজে ভাববে না? নিজের সম্মান নিয়ে নিজেকেই ভাবতে হয়। বুঝলে মেয়ে?”
নয়নের কথায় বেলী মাথা নাড়ায়। অতঃপর দুজন বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে। গল্পের মাঝে বেলীর চোখটা লেগে আসে। এটা দেখে নয়ন বলে,“ঘরে গিয়ে ঘুমাও যাও।”
বেলী মাথা নাড়ায়। সে যেতে নেয় তখন নয়ন বলে,“কাল সকালে যাবার সময় কিছু টাকা নিয়ে যেও। সেই টাকা দিয়ে মাথা গোজার একটা ঠাঁই খুঁজে নিও।”
“আপনার টাকা নিবো কেন?”
এই কথা শুনে নয়ন ম্লান হাসে। সে শান্ত গলায় বলে,“ধার হিসাবে নিও। নিজের একটা ব্যবস্থা করতে পারলে এসে দিয়ে যেও।”
“আপনি চাইলে আমি এখনই দিতে পারি।”
বেলীর কথা শুনে নয়ন হতবাক হয়। বেলী তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। অতঃপর যা ঘটে তার জন্য নয়ন প্রস্তুত ছিলো না। বেলী তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। নয়ন তাকে দূরে সরিয়ে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। কঠিন গলায় বলে,“মাথা ঠিক আছে। কী করছো এসব?”
“আমার আপনাকে ভালো লেগে গেছে।
এতক্ষণ আপনার সাথে গল্প করার পর আমার মনে হলো আপনি খুব চমৎকার মানুষ। এই মানুষটার সঙ্গে সময় কাটানো যায়।”
এই কথা শুনে নয়ন বেলীকে ঘরে যেতে বলে। সে খুব ঠান্ডা গলায় বলে,“একা ঘরে আমরা দুজন আছি বলে তোমার এমন অনুভব হচ্ছে। হয়তো বলা যায় নির্জন এই রাতে দুজন মানুষের মাঝে কিছু একটা কাজ করছে। হতে পারে সেটা শয়তানের ধোঁকা। আমি এমনটাই ধরে নিলাম। তবে প্লীজ শান্ত হও। এমন কিছু করো না যাতে চোখ তুলে তাকাতে না পারো।যাতে আয়নার সামনে দাঁড়াতে কখনো দ্বিধা না হয়।”
বেলী এসব কথা শুনে ‘স্যরি’ বলে। নয়ন দূর থেকে তাকে অনেককিছু বোঝায়। অতঃপর ঘরে গিয়ে টাকা এনে তার হাতে দিয়ে বলে,“সকালে হলেই এখান থেকে চলে যেও। আমাকে ডাকার প্রয়োজন নেই।”
এই কথা বলে নয়ন তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। নয়ন কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায়। হঠাৎ করে বেলী এমন আচরণ কেন করলো? যেই মেয়েটা এতক্ষণ তার সামনে ভয়ে ছিলো। তার থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছিলো। এত ভয় যার চোখে ফুটে উঠেছে সে কি-না এমন করলো। এটা ভেবে নয়ন কষ্ট পায়।
____
২. ভোরের আলো ফুটতে প্রেমার ঘুম ভাঙে। সে জারিফকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে,“এই সকাল হয়ে গেছে। এবার উঠো।”
জারিফের ঘুম ভাঙতে চায় না। সে উঠতে চায় না। এটা দেখে প্রেমা বলে,“আরে উঠো। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। সকাল হয়ে গেছে। নয়নের যা স্বভাব এতক্ষণে দেখা যাবে আমার বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়ে দিছে। সে আশার আগে আমার যেতে হবে।”
“তোমার মনে হয় ওমন এক রাত কাটিয়ে সে এখন তোমার খুঁজে আসবে?”
এটা শুনে অবশ্য প্রেমা হাসে। তবে সে রিস্ক নিতে চায় না। যদি তার উদ্দেশ্য মতো সব না হয়। তখন তো সমস্যা হয়ে যাবে। এটা শুনে জারিফও না করতে পারে না। তারা দুজন উঠে তৈরি হয়।
অতঃপর বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়। জারিফকে জড়িয়ে ধরে বাইকের পিছনে বসে আছে প্রেমা। জারিফ প্রেমার এত ভালোবাসা দেখে মনেমনে বলে,“একবার তুমি নয়নের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে যাও। তারপর সেটা আমি নিজের নামে নিয়ে তোমাকে তোমার রাস্তায় বের করে দিবো। স্যরি সোনা। যাকে ফ্রী পাওয়া যায় তাকে কেউ ঘরনি বানায় না। তুমি যেমন সম্পত্তির জন্য নয়নের সঙ্গে এখনো রয়ে গেছো, আমিও তেমনই তোমার সঙ্গে রয়েছে।”
এসব ভাবতে ভাবতে জারিফ বাইক চালাচ্ছিলো৷ সেই মূহুর্তে সামনে দেখে নিয়ন্ত্রণ হারানো একটি ট্রাক এসে তার বাইকে লাগিয়ে দেয়। বাইক এবং ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। জারিফ, প্রেমা এবং ট্রাক ড্রাইভার গুরুতর আহত হয়। র ক্তাক্ত অবস্থায় প্রেমার চোখটা যখন নিভু নিভু সেই মূহুর্তে তার স্মৃতিতে নয়নের স্মৃতিই ভেসে উঠেছে। হ্যাঁ এই মূহুর্তে সে জারিফকে নয় বরং নয়নের সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ সময়টা মনে করছিলো।
____
নয়নের ঘুম ভাঙলে সে পাশের ঘরে এসে প্রথমে চেক করে। বেলী সেখানে নেই। বিছানার উপর প্রেমার শাড়ী পড়ে রয়েছে। যেটা গতকাল রাতে বেলী পড়েছিলো। সেই শাড়ীর সঙ্গে একটি চিঠিও রয়েছে। এটা দেখে নয়ন কিছুটা অবাক হলো। সে এগিয়ে এসে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। কিছুটা কৌতূহল নিয়েই চিঠিটা খুলে। চিঠিটা পড়ে নয়ন একদম থ হয়ে যায়।
চিঠিতে লেখা ছিলো,“বেলী নামটা সুন্দর। আপনি গতকাল বলেছেন। কিন্তু আমার নাম বেলী নয়। না মিথ্যা বলিনি। নাম বেলী কোন একসময় ছিলো। তবে সেটা সময়ের সঙ্গে রানী হয়ে গেছে। অন্ধকার জগতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত দুনিয়া বদলে গিয়েছে। আমি বেলী থেকে রানী হয়ে গেলাম। গতকাল রাতে আমি আপনাকে আমার যে গল্প বলেছি সবটা মিথ্যে ছিলো। নিজেকে দুঃখী প্রমাণ করে আপনার কাছাকাছি আসাটাই ছিলো আমার উদ্দেশ্য। আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোই ছিলো মূখ্য বিষয়। কারণ এই কাজের জন্য আমি টাকা পেয়েছি। এটাই আমার কাজ। যদিও এর আগে অবশ্য সবসময় কাস্টমাররা নিজেরা চয়েজ করতো৷ তবে আপনার বিষয়টা ভিন্ন। আপনি নন অন্য একজন আমাকে আপনার জন্য চয়েজ করেছে। আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারবেন না তবে সেই একজন আপনার স্ত্রী প্রেমা। হ্যাঁ আপনার ভালোবাসার মানুষ। আপনি ভাবেন প্রেমা মা হতে না পারার ডিপ্রেশনে আপনার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে যায়। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। সে চাইলেই মা হতে পারে। কিন্তু হচ্ছে না। কারণ সে আপনার নয় অন্যকারো সন্তানের মা হতে চায়। আমি আসলে পুরো বিষয়টা জানি না। তবে যতটা ধারণা করেছি প্রেমা হয়তো আপনাকে ব্লাকমেইল করে ডিভোর্স এবং আপনার সম্পদ নিতে চায়। আমার কথাগুলো অবিশ্বাস হলে পুরো ঘর চেক করবেন। নানা জায়গায় ক্যামেরা পেয়ে যাবেন। যেই ক্যামেরায় গতকাল রাতের আপনার এবং আমার ঘনিষ্ঠ কিছু মূহুর্ত বন্দি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হয়নি। কারণ আপনি খুব ভালো মানুষ। আমি চাইলে আপনাকে সিডিউস করতে পারতাম। কিন্তু নিজেরই ইচ্ছে হলো না। আমি বুঝতে পেরেছি গতকাল রাতে যদি ভুল করেও আমাদের মধ্যে কিছু হয়ে যেতো তাহলে আপনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না। আমি চাই না, আমার মতো আপনিও আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় পান। লজ্জা পান। তাছাড়া আপনি অচেনা অতিথি হিসাবে আমাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করেছেন, সম্মান করেছেন। সেই সম্মান যেটা আমাকে কেউ করে না। হয়তো আপনি যদি জানতেন আমি প তিতা তাহলে আপনিও আমায় সম্মান করতেন না। তবে আমি বিশ্বাস করি নারী হিসাবে হয়তো আপনি প তিতা হলেও আমাকে সম্মানটা করতেন। এই বিশ্বাস নিয়ে আপনাকে কলঙ্কিত না করে চলে গেলাম। পারলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আর হ্যাঁ আপনি অপাত্রে ভালোবাসা দান করছেন। তাই বলবো ভালোবাসাটা সঠিক মানুষকে দিন। সবশেষে ভালো থাকবেন। স্মৃতির পাতায় আপনার এই এক রাতের অচেনা অতিথিকে একটু জায়গা দিয়েন। এটা পেলে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন হয়তো আমার মুখ আপনা আপনি হেসে উঠবে।”
এসব পড়ে নয়নের মাথায় হাত। এতকিছু ঘটে গেল তার আড়ালে। এজন্য গতকাল রাতে বেলী বলেছিলো,“ভালোবাসা ভালো। কিন্তু অন্ধ ভালোবাসা নয়। আমি অন্ধ ভালোবেসে হেরেছি। হয়তো আপনিও হারছেন।” নয়ন তার কথা বুঝতে না পারলে বেলী প্রসঙ্গ বদলে ফেলে। সে আর কথা বাড়াতে চাইনি। নয়ন এবার সেই কথার পুরো ভাবার্থ বুঝতে পেরেছে।
____
জারিফ ঘটনাস্থলে মা রা গিয়েছে। অন্যদিকে প্রেমা এখন কোমায় রয়েছে। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে প্রেমার পরিবার এবং নয়ন হাসপাতালে এসেছে। তবে নয়ন প্রেমার অবস্থায় কষ্ট পেলো না। প্রেমা তাকে তার ভালোবাসাকে যে কষ্ট দিয়েছে তার কাছে এটা কিছুই নয়। যদিও সে বেলীর কথা প্রথমে বিশ্বাস করেনি। অতঃপর বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে সত্যি ক্যামেরা পেয়েছে। এরপর যখন শুনলো প্রেমা জারিফ নামক কারো সঙ্গে বাইকে ছিলো। তখন তার কাছে সব পরিস্কার হয়। বেলী সত্যি বলেছে। তাই এখন প্রেমার এই অবস্থা তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। হ্যাঁ তার আফসোস হচ্ছে। তাকে এতবড় ধোঁকা দেওয়ার পরও নয়ন প্রেমাকে নিজ হাতে শা স্তি দিতে পারলো না। এটার জন্য আফসোস হচ্ছে। তবে ডাক্তার যখন বললো, প্রেমা যেকোন সময় কোমা থেকে বের হয়ে আসতে পারে তখন সে খুশি হয়। প্রেমা সুস্থ হলে সে তার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের শা স্তি নিজ হাতে প্রেমাকে দিবে। এটাই সে চায়।
নয়ন কেবিনের বাহির থেকে ভেতরে থাকা প্রেমাকে দেখছিলো। সেই সঙ্গে তার চোখে রাতে হঠাৎ আসা বেলীর মুখটা ভেসে উঠে। বেলীর ছলছল দুটি চোখের কথা কল্পনা করে নয়ন বলে,”তোমার বলা গল্পটা হয়তো মিথ্যা ছিলো। তবে তোমার চোখের ঐ পানিটা মিথ্যা নয়। আমি চেষ্টা করবো তোমায় মুক্তো জীবন দেওয়া। তোমার খোঁজে আমি আসছি৷ অপেক্ষা করো অচেনা অতিথি।”
এটা বলে মুচকি হাসে নয়ন। সেই মূহুর্তে কল্পনার বেলীর মুখটা বিলীন হয়ে সামনে থাকা প্রেমার মুখটা স্পষ্ট হতে সে রাগে দরজা শক্ত করে চেপে ধরে। তার কানে বাজতে থাকে প্রেমার প্রতারণার গল্প। যা নয়নের চোখে হিংস্রতার জন্ম দিচ্ছে৷ হিংস্র চোখে নয়ন প্রেমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
(সমাপ্ত)