অজানা_সুখপাখি
পর্বঃ২(শেষ পর্ব)
সামি_আদনান
সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়েই যাব। আবার শ্বশুর বাড়ির এই মানুষগুলোর জন্যও খা’রাপ লাগে। ওরা অনেক ভালোবেসেছে আমায়। একদম নিজেদের মেয়ের মতো। তাইতো স্বামীর মৃ’ত্যুর পরেও ওদের কাছেই আছি। নানা বাড়ি থেকে কেউ আমাকে ফিরিয়ে নিতেও চায় নি। এখানে তো এখনো ভালোই আছি। তাই ওদের মুখের উপর বিয়ের ব্যাপারে না বলতে পারিনি।
আমার ভাসুরের স্ত্রীর নাম রিতা। আমার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল রিতা ভাবীর। আমার স্বামীর মৃ’ত্যুর পরেও ফোনালাপ হয়েছে ভাবীর সাথে। আমার বিয়ের পরে ছয় মাসের মতো আমরা একসাথে শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়েছিলাম। উনি আপন বোনের মতো ভালবাসতেন আমায়। কিন্তু ওনার মনের কথা কখনোই বুঝতাম না। আমার বিয়ের মাস ছয়েক পরেই রিতা ভাবি পালিয়ে যান তার প’রকীয়া প্রেমিকের সাথে। আমার ভাসুরের সাথে সাত বছরের সংসার ছিলো। বিয়েও করেছিলেন প্রেম করে। কিন্তু রিতা ভাবি ব’ন্ধ্যা ছিলেন। এই ব্যাপারটা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা ছিল। মনে হচ্ছে সমস্যা থেকে জড়িয়ে পড়েছিলেন প’রকীয়ায়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালিয়ে গিয়েছেন কলেজ লাইফের সেই প্রেমিকের সাথে। সেখানে বিয়েও করেছেন। আমার ভাসুরকে ডিভোর্স না দিয়েই বিয়ে করেছেন। এক বছর হলো রিতা ভাবি চলে গেছে সংসার ছেড়ে। আমার ভাসুর নিজেও কিন্তু এখনো ডিভোর্স দেয় নি রিতা ভাবিকে। আমি আইন কানুন সম্পর্কে কম জানি। শাশুড়ি আমায় বলল, ‘অন্য পুরুষকে বিয়ে করলে এমনিতেই ডিভোর্স হয়ে যায়! আমার ছেলের সাথে রিতার এখন আর ধর্মীয়ভাবে কোনো সম্পর্ক নেই। তোমার কোনো ভয়ও নেই! রিতা ফিরে এলেও আমার ছেলে আর গ্রহণ করবে না।’
আমার আপত্তি এখানেই। রিতা ভাবিকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিক। কি সমস্যা ডিভোর্সে? আমার ভাসুর যদিও আর কখনো কথা বলেনি রিতা ভাবির সাথে। তবুও মনে হয় ভাবি ফিরে আসতে পারেন। যেহেতু ডিভোর্স হয়নি। কিন্তু অন্য জায়গায় তো বিয়ে করে ফেলেছেন ভাবি। তারপরও আমার মনে হয় ডিভোর্স না হলে, আমি যেন অন্যের স্বামীকে কেড়ে নিচ্ছি। যদিও ভাসুরের সাথে এ ব্যাপার নিয়ে আমার আলাপ হয়নি। আলাপ হয়েছে শাশুড়ির সাথে। উনি বারবার বোঝাচ্ছেন ডিভোর্স হয়ে গেছে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী। আমি মনে করি রিতা ভাবির নতুন বিয়েটাই হয় নি। উনি এখনো আমার ভাসুরেরই স্ত্রী। কারণ এক স্বামীকে ডিভোর্স না দিয়ে নতুন বিয়ে করলে সে বিয়েই হয় না। এসব ভেবেই সব গুছিয়ে নিয়েছি। এখন সকাল সাড়ে ছয়টার মতো বাজে। ফজরের নামাজ পড়ে শ্বশুর-শাশুড়ি আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। ভাসুর হয়তো তার রুমেই আছেন। ননদরা এখনো আসেনি বিয়ে উপলক্ষ্যে। বাকি মেহমানও আসবে আজ বিকেল থেকে। এখন বাড়ি একটু ফাঁকা। আমাকে এখনই পালাতে হবে।
আমি গুছানো ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম শ্বশুরবাড়ির পেছন দিয়ে। ছোট একটি গেট আছে। গেট খুলে বের হয়েছি। এটা বাড়ির পেছনের রাস্তা। গেটের সামনে আমাকে অপেক্ষমান দেখে একটা সিএনজি এগিয়ে এসেছে। এ সময়টায় সাধারণত রাস্তা নীরব থাকে। সিএনজিরও চলাচল কম থাকে। কিন্তু আজ মনে হয় পেয়ে গেলাম। ভেতরে সম্ভবত একজন যাত্রী আছেন। সিএনজিটা এসে থামলো আমার সামনে। ভেতরের লোকটিকে দেখে আমি ফ্রিজ হয়ে গেলাম। আমার ভাসুরই এসেছেন সিএনজি করে; যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। উনি নেমে গেছেন সিএনজি থেকে। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। সিএনজিতে উঠে বসবো নাকি ঘরের দিকে ফিরে আসবো; মাথা কাজ করছে না। ভাসুর কখনো আগ বাড়িয়ে তেমন কথা বলেন নি আমার সাথে। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন তিনি। আমি এখনো নীরবে দাঁড়িয়ে আছি। উনি হাত নেড়ে সিএনজিটাকে চলে যেতে বললেন। সিএনজি চলতে শুরু করলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার পাশেই। ভাসুর গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘পালিয়ে যাচ্ছিলে নাকি?’
আমি জবাব দিলাম না। উনি বরাবরই গম্ভীর। গম্ভীর ভঙ্গিতেই আমার পানের চেয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমারও কি কেউ আছে নাকি? যদি গোপন কোনো প্রেমিক থাকে তবে পালিয়ে যাও! আমি বাধা দেব না। আর যদি কেউ না থাকে তাহলে আমার হাত ধরো। তোমার হাত আমি কখনো ছাড়বো না।’
ভাসুরের কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর কেমন যেন লাগলো। মনে হল উনি অনেক কষ্ট থেকে এভাবে বলেছেন। আমি আর পা বাড়াতে পারিনি। বাড়ির গেটের দিকেই ঢুকে যচ্ছিলাম। ভাসুরও বুঝতে পারলেন আমি ফিরে যাব না। তিনি আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিলেন। ধীর কন্ঠে বললেন, ‘মায়ের কাছে গতকালই শুনেছি তুমি রিতার ডিভোর্স চাও। তুমি যা চাও, সেটাই হবে। ধর্মীয় মতে রিতা অলরেডি ডিভোর্সড হয়ে গেছে। তারপরেও আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবো। ওকে ডিভোর্স দিয়েই তোমাকে বিয়ে করবো!’
আমি চুপটি করে রইলাম। উনি আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড়। মিনিমাম দশ বছরের মত হবে। তারপরেও কেন যেন বিশ্বাস এলো ওনার উপরে। যে বিশ্বাসটা এতদিন শাশুড়ির কথায় খুঁজে পাইনি। শাশুড়ি বারবার ওই ডিভোর্সের ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। অথচ উনি কত সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। আমি ঘরে ফিরে এলাম ভাসুরের সাথেই। উনি আমার হাত ব্যাগটা দিতে দিতে বললেন, ‘যাও, চা বানিয়ে নিয়ে আসো। একসাথে চা খাব।’
আমি চলে যাচ্ছিলাম ভেতরের দিকে। তিনি পেছন থেকে ডেকে বললেন, ‘স্বর্ণকারের বাড়িতে গিয়েছিলাম এই সাত সকালে। তোমার জন্য চুড়ি বানাতে দিয়েছিলাম তো! ঐটাই নিয়ে এসেছি। স্বর্ণকার লোকটা গতরাতে ফোন দিয়ে বললো বেড়াতে যাবে। আসবে এক সপ্তাহ পরে। উনি চলে গেলে বিয়েতে যদি তোমায় চুড়ি দিতে না পারতাম! তাই সকাল সকাল গিয়ে নিয়ে এলাম।’
আমি অবাক হলাম ভাসুরের কথা শুনে। কোথায় যেন সুখ সুখ অনুভূত হল। স্বামীর মৃ’ত্যুর পরে এই প্রথম কারো কথা অনেক বেশি ভালো লাগলো। আমি মনটাকে স্থির করলাম। আর কোন লুকোচুরি নয়। ভাসুরকেই গ্রহণ করব স্বামী হিসেবে। তিনিই হয়তো হবেন আমার বাকি জীবনের অজানা_সুখপাখি।
সমাপ্ত।