#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
৬
তিরতির করে কাঁপছে গাছের সবুজ রঙের পাতাগুলো। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। কমলা মিশ্রিত আকাশটা আজ অনেকটাই মায়াবী লাগছে। ডিঙি নৌকায় বসে পা ভিজিয়ে মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছে আওয়াদ। বর্তমানে আওয়াদ যেখানে বসে আছে সেটা অনেক বড়ো একটা ঝিলের পাড়। যতোদূর চোখ যায় ঠিক ততোদূরে শুধু জলের সমাহার। কপোত-কপোতীদের আনাগোনা একটু বেশিই এখানে। ঝিলের পাড়ে অসংখ্য নাম না জানা গাছ রয়েছে। রয়েছে নীরবে পরিদর্শন করার মতো বসার স্থান। সবুজ রঙের পানিতে দু একটা মাছ ভেসে উঠছে মাঝে মাঝেই। আওয়াদকে যখন এখানে আসার কথা বললো তোহফা, আওয়াদ কিছুটা অবাক হয়েছে। এই ঝিল পাড়ের কথা জানা থাকলেও কখনো এখানে আসা হয়নি। তবে আজ মনে হলো, না এসে মিস করেছে এই ঝিলের পাড়ের সৌন্দর্যকে। ফুরফুরে বাতাসে ভগ্ন মনোরথে নিজের জন্য বরাদ্দ করা কিছুটা ভালোবাসা জেগে উঠেছে হৃদয়ে । ইচ্ছে করছে এখানেই অনেকটা সময় থেকে যেতে। আওয়াদ অবাক হলো এই ঝিলের পাড়ে ডিঙি নৌকা দেখে। যা পরে রয়েছে বড্ড অবহেলায়। আওয়াদের মনে হলো নৌকাটার কিছুটা তার মতোই অবস্থা। পায়ের গোড়ালি থেকে প্যান্টটা খানিক উঁচু করে আওয়াদ ডিঙি নৌকায় গিয়ে বসলো। তোহফার এখনো কোনো খবর নেই। প্রায় ঘন্টা পেরিয়েছে আওয়াদ এখানে, তবে এখনো তোহফার কোনো খোঁজ নেই। সেদিনের পর কেটে গেছে তিনদিন। এই চলে যাওয়া তিনটে দিন আওয়াদের কাছে তিনটে বছরের সমান লম্বা মনে হয়েছে। সে গভীর ভাবে ভেবেছে তিনটে দিন। তোহফাকে পাবে না ভাবতেই কী তীব্র ব্যথা অনুভব করেছে বক্ষঃস্থলে! তাহলে বাকি সময়টা সে কীভাবে থাকবে? এই একটা প্রশ্ন বারবার এলোমেলো করে দিয়েছে তার সকল চিন্তাকে। যখনই ভাবছে তোহফা অন্য কারো ছিলো, আছে বা ভবিষ্যতে থাকবে তখনই আওয়াদের পাহাড় সমান কষ্ট হচ্ছে।
“উহুম, উহুম। আমি কি আসতে পারি ওখানে?”
আওয়াদের চিন্তায় ভাটা পরলো কারো কথায়। পিছন ফিরে দেখলো তোহফা দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হয়ে গেলো দু’জনার । তোহফা চোখ সরিয়ে অন্য দিকে ফিরলো। আওয়াদকে দেখামাত্রই হার্টবিট বেড়ে যেতে ভুলেনি। তোহফা নিজেকে নিজেই শাসিয়ে বললো,
“যদি কোনো বাজে পরিস্থিতিতে পরতে হয় তোর এই উত্তেজনার জন্য, মনে রাখিস তিন সেকেন্ড আমি শ্বাস নিবো না। তোকে কষ্ট দিবো কিন্তু? নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য দেখা করতে এসেছি তিনদিন সময় নিয়ে। এরপরেও যদি কোনো উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটে গেছে তাহলে বুঝতেই পারছিস কি হতে পারে।”
নিজের সাথে কথা বলা শেষ করেই তোহফা আওয়াদের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমি আসবো, নাকি আপনি আসবেন এখানে?”
আওয়াদ তখনো ঘোরে আছে। তোহফা আজ কালো রঙের বোরকা সাথে কালো রঙের হেজাব পরে এসেছে। চোখের কোণায় সেদিনের মতোই গাড় কাজল। এই কাজল চোখের কোণে আওয়াদ একরাশ মায়া খুঁজে পায়। মনে হয় এই মেয়েটা তার চোখের চাহনি দিয়েই আওয়াদকে শতবার খুন করবে। অথচ মেয়েটা তার সহজ সরল মনকে খুন করেছে না পাবার ধারালো ছুরি দিয়ে। ক্ষত-বিক্ষত করেছে হৃদয়ের চারপাশ ধারালো নখের আঁচড় দিয়ে। মেয়েটা কি বুঝতে পারে কাউকে না পাবার তীব্র ব্যথাটা কতোটা ভয়াবহ হয়? আচ্ছা তোহফার সেই প্রেমিক পুরুষ কি খুবই সুদর্শন ছেলে? যাকে দেখলে তোহফার হার্টবিট বেড়ে যায়। থরথর করে কাঁপে সারা শরীর? দুনিয়া সহ ঘুরতে থাকে মন, মস্তিষ্ক। আচ্ছা তোহফা কি খুব বেশিই ভালোবাসে তার প্রেমিক পুরুষকে? এমন হাজারো প্রশ্ন আওয়াদের মনে বিষাদ এঁকে যায়। আওয়াদ নিজেকে সামলে বলে,
“আমিই আসছি।”
আওয়াদ নৌকা থেকে নেমে তোহফার পাশাপাশি দাঁড়ায়। তোহফা সন্তর্পণে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। ওকে লক্ষ করে আওয়াদও তার সঙ্গ নেয়। পাশাপাশি হেঁটে চলছে দু’জন মানব-মানবী। তাদের মুখে নেই কোনো কথা। হাজারো জড়তার জন্য হয়তো বাক নেই মুখে। সকল জড়তা কাটিয়ে প্রথমে আওয়াদ মুখের বুলি ফোটালো।
“ঝালমুড়ি খাবেন?”
ঝালমুড়ি খাওয়ার অফারে তোহফা নীরবে হেসে মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলো, খাবে। আওয়াদ কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝালমুড়ি ওয়ালার কাছে ছুটে গেলো। দু’হাতে ভরে ঝালমুড়ি এনে এক প্যাকেট তোহফার হাতে অন্য প্যাকেট নিজের কাছেই রেখে দিলো। আবারও নীরবতায় ছেয়ে গেলো চারিপাশ। তোহফা নেকাব খুলে আপন মনে ঝালমুড়ি খাচ্ছে আর আওয়াদ তাকে মুগ্ধ চোখে দেখতে রইলো। কে বলবে সেদিন এই মেয়েটা শুধুমাত্র আওয়াদের কণ্ঠস্বর শুনেই জ্ঞান হারিয়েছিলো। অবাক কান্ড আজ তোহফার মাঝে কোনো হেলদোল নেই। সে আপন মনে হেঁটে চলেছে। আচ্ছা তোহফার এমন আচরণের পিছনে কি অন্য কোনো কারণ আছে? তোহফার সেই প্রেমিক পুরুষ এখানে আসেনি তো? আসতেই পারে। অন্য পুরুষের কাছে তার ভালোবাসার মানুষটি আসছে শুনে হয়তো সেও এসেছে। হঠাৎ আওয়াদ চারিদিকে একবার চোখ বোলালো। তাদের আশেপাশে কোনো সন্দেহজনক মানুষ আছে কিনা দেখতে! তবে তেমন কাউকে চোখে পড়লো না। তোহফা আওয়াদের এমন বোকামি দেখে মুখ টিপে হাসলো। মুখে ঝালমুড়ি দিতে দিতে বললো,
“কেউ নেই। কাকে খুঁজছেন? ”
“হুঁ?”
“বললাম কেউ আসেনি আমার সাথে। আমি একাই এসেছি।”
“না, তেমন কিছু না।
আওয়াদ খানিক লজ্জা পেলো। কোনোমতে কথা ঘুরিয়ে বললো,
“আচ্ছা তোমার ওই ছেলেটার সাথে কীভাবে পরিচয়?”
তোহফা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন ছেলে?”
“যাকে তুমি ভালোবাসো।”
তোহফা আওয়াদের কথায় মুখে দেওয়া ঝালমুড়ি খাওয়া বন্ধ করে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,
“ওই যে বললাম না ক্লাস নাইন থেকে পরিচয়।”
“ওহ্।”
“হুম।”
তোহফার হুটহাট হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না আওয়াদ। কিছু জিজ্ঞেস করলেই আগে কিঞ্চিৎ সময় হেসে নিয়ে উত্তর দিচ্ছে। আবারও নীরবতা ঘিরে ধরলো। এবার বেশি সময় নীরবতা রইলো না। তোহফা বলে উঠলো,
“খালি পায়ে হাঁটবেন এই পড়ন্ত বিকেলে? অনেক মজা। হাঁটবেন?”
তোহফার কথায় আওয়াদ অবাক চোখে তাকালো। তোহফা ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে বললো,
“এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা খাওয়া যেমন আপনার শখ, তেমনি এই পড়ন্ত বিকেলে খালি পায়ে হাঁটার বহুদিনের শখ আমার। হাঁটবেন? ”
তোহফার এমন আবদার আওয়াদ ফেলতে পারলো না। তাই সে ঝটপট জুতো জোড়া খুলে ফেললো। তোহফাও নিজের স্লিপার জোড়া সেখানে রেখে সামনে হাঁটতে রইলো। আওয়াদ তোহফার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“যদি কেউ নিয়ে যায় তখন?”
“আপনি এক জোড়া কিনে দিবেন, সাধারণ বিষয়। এটা বুঝতে আপনার এতো কষ্ট হচ্ছে? আপনার সাথে দেখা করতে এসেই তো শখটা জেগে উঠলো, তাহলে দোষটা কার? তা পারবেন না কিনে দিতে চুরি হলে?”
তোহফার এমন সহজ সরল কথায় আওয়াদ অবাক হলো। কিঞ্চিৎ ভালোলাগাও তাকে ঘিরে ধরলো। ভালোবাসার মানুষকে কিছু দিতে পারবে এটাই তো অনেক! তবে সে খালি পায়ে হাঁটতে পারছে না। অভ্যাস নেই তাই হয়তো। তবুও প্রিয়জনের প্রিয় একটি আবদার রাখতেই নিজের কষ্ট চেপে গেলো। তোহফা কি সুন্দর খালি পায়ে হেঁটে চলেছে। তিরিং বিরিং করে এদিক ওদিক হেঁটে চলেছে। তোহফাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ খুশি। দীর্ঘদিন পুষে রাখা শখ যখন হুট করেই পূরণ হয়ে যায় তখন মানুষ যেমন খুশি হয় ঠিক তেমন। আওয়াদ বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে বসে তোহফাকে,
“শখটা বুঝি আপনার প্রেমিক পুরুষ পূরণ করেনি কখনো?”
আওয়াদের কথায় চলন্ত পা জোড়া থেমে গেলো তোহফার। সে পিছু ফিরে আওয়াদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আওয়াদের হার্টবিট বেড়ে গেলো তোহফা এতোটা কাছাকাছি আসায়। সেদিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মেয়েটা এতো সাহস কোথায় পেলো সেটাই বুঝে উঠতে পারলো না এই মুহূর্তে। আওয়াদকে চমকে দিয়ে তোহফা আওয়াদের হাতের ঝালমুড়ির প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিলো। আর বললো,
“খাবেন না যখন দিয়ে দিতেন। শুধু শুধু হাতে রেখে কী লাভ বলুন তো? দেখুন মুড়িগুলো একদম নেতিয়ে পড়েছে ঠিক আপনার মতো।”
কথাগুলো বলেই তোহফা সামনে হাঁটতে শুরু করলো। আর অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আওয়াদ। খুব সাবধানে প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো তোহফা এটা ভালোই বুঝলো। এই মেয়ের আজ হয়েছেটা কী? আওয়াদ চোখ তুলে তাকাতেই দেখলো তোহফা খানিক দূরে চলে গেছে। ওর সঙ্গ নিতেই আওয়াদ দৌড় লাগালো। আওয়াদ ভাবনার স্মারক হয়েছিল তাতেই তোহফার থেকে কিছুটা পিছনে পড়ে যেতেই এখন তাকে দৌড় লাগাতে হচ্ছে। তোহফার পাশাপাশি দাঁড়াতেই আওয়াদ জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তোহফা স্মিথ হেসে বললো,
“মিস্টার একটু দৌড়ে এভাবে হাঁপিয়ে গেছেন, অথচ আমার পিছনে সারাজীবন দৌড়ানোর জন্য দায়িত্ব নিতে অনুমতি চেয়েছিলেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। এতো দুর্বল শরীর নিয়ে তোহফার পিছনে ছুটা যাবে না।”
তোহফার কথায় খুকখুক করে কাশতে রইলো আওয়াদ। বাড়ি থেকে বের হবার আগে কতকিছু ভেবে এসেছিলো, অথচ তোহফাকে দেখে, তার কথা শুনে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা তোহফা এমন ব্যবহার করছে কেনো? ও কি প্রশ্নে করবে? নাকি প্রশ্ন করবে না? তার থেকে না হয় যা করছে করুক। এমন চিন্তা করতে করতেই আওয়াদ দ্বিতীয়বার বোকা প্রশ্ন করে বসলো,
“আপনি যেমন আচরণ করছেন, দেখে মনে হচ্ছে আপনি অষ্টাদশী কন্যা আর আমি আপনার প্রেমিক পুরুষ।”
তোহফা আওয়াদের কথায় পিছু ফিরে তাকিয়ে আচমকা খিলখিল করে হেসে উঠলো। এমন হাসিতে আওয়াদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকালো। সে কি এমন বলেছে যে মেয়েটা এভাবে হাসছে! তোহফা সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“আপনিই না সেদিন বললেন একটা পড়ন্ত বিকেল যেন আপনাকে দেই যেটা শুধু আপনারই থাকবে! তাই দিচ্ছি, এখানেও আপনার প্রশ্ন! আজব তো।”
তোহফার উত্তরে আওয়াদের হাসিখুশি মুখটা চুপসে গেলো। বুঝে গেলো তোহফার এমন আচরণের আসল কারণ। আওয়াদের মুখে আর হৃদয়ে নেমে এলো শ্রাবণ। কালো মেঘ ছেয়ে গেলো তার মুখে। বুকে ভর করলো হারিয়ে ফেলার তীব্র ব্যথা। আওয়াদের পরিবর্তন তোহফার চোখে পড়লো। তোহফা হুট করেই নিজের পায়ের গতি কমিয়ে দিলো। আওয়াদ তার পাশাপাশি এসে দাঁড়াতেই সে সমান তালে তাল মিলিয়ে হাঁটতে রইলো। সামনের দিকে চোখ রেখে তোহফা বললো,
“আজ আকাশে বৃষ্টি নেই কেনো বলুন তো? বৃষ্টি হলে আমার ভিষণ ভালো লাগে। বৃষ্টির সাথে জড়িয়ে থাকা সকল মেঘনাদ কাব্যের কাহিনিবিস্তার শুনতে ভালো লাগে। ইচ্ছে করে বৃষ্টির রাতে আপন মানুষ গুলোর সাথে নিজের দুঃখ-সুখ ভাগাভাগি করে নিতে। যে বৃষ্টি আমার সকল ব্যথা নিরাময় করে দিয়ে ভেসে যাবে দূর-দূরান্তার পথের বাঁকে। গর্জন করে উঠবে আকাশ আমি শিউরে উঠে মায়ের আঁচলে গিয়ে লুকাবো! কিনবা খুব প্রিয় কারো বুকে মুখ লুকাবো। সে যত্ন করে আমায় আগলে নিবে। তবে আমি মাঝে মাঝেই স্বপ্নে দেখি এক ভারি বর্ষণে আমি বড্ড অবহেলায় অযত্নে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার শরীরময় বিষাক্ত ব্যথায় টনটন করে উঠছে। আমি চেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে পারছি না। কেনো এমন হয় আপনি জানেন? জানলে প্লিজ আমায় জানাবেন। এই দেখেন কথা বলতে বলতে চা খাওয়ার কথাই ভুলে গেছি। ওই যে চায়ের দোকান চলুন চা খাই। বাড়ি ফিরতে হবে যে। সকলে চিন্তা করবে দেরি করে বাড়িতে ফিরলে। আজ এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা খাওয়ার কথাই তো হয়েছিলো আমাদের, সেটা না খেয়ে তো আর যেতে পারি না। ”
তোহফা ছুটে চলে গেলো চায়ের ছোট্ট দোকানে। অন্য দিকে আওয়াদ তোহফার কথার অর্থ খুঁজে চলেছে। কি বললো মেয়েটা? মেয়েটার সাথে এটাই শেষ দেখা এটা আওয়াদ জানে, তবুও আওয়াদের মেয়েটার প্রতি মায়া ক্রমশঃ বাড়তে রইলো। পুরোটাই জুড়ে মেয়েটার অস্তিত্ব কেমন-ই যেনো বিচরণ করতে রইলো হৃদয় জুড়ে। কীভাবে এই মেয়েটাকে নিজের করে পাবার থেকে আটকাবে আওয়াদ। মেয়েটার সাথে আর কখনো এমন একটা বিকেলে দেখা হবে না এটা ভাবতেই তো হৃদয়টা চৌচির হয়ে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে পিপাসায়। তোহফাকে দেখার পিপাসা যে আওয়াদের এখনি লেগে যাচ্ছে, তাহলে পরবর্তী কি হবে আওয়াদের এই মেয়েটাকে ছাড়া?
সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীতলে। দরজার সামনে পায়চারি করছে জাহানারা বেগম। চিন্তায় তার অবস্থা বেসামাল। দু’টো ছেলে মানুষ করতে তাকে বেগ পেতে হয়নি যতোটা বেগ পেতে হয়েছে একটা মেয়ে মানুষ করতে গিয়ে। মেয়েটা একাই পুরো বাড়ি মাথায় তোলার জন্য যথেষ্ট। শাশুড়ী মাকে এভাবে পায়চারি করতে দেখে ইলা এগিয়ে এলো।
“কি হয়েছে মা? এভাবে হাঁটছেন কেনো?”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ তোহফার কোনো খবর নেই। চিন্তায় মাথা দপদপ করছে আমার।”
শাশুড়ী মায়ের কথায় ইলা নিজেও চিন্তায় পড়ে গেলো। সত্যি তো তোহফা কখনোই সন্ধ্যার পর বাড়ির বাহিরে থাকে না, আজ তাহলে এখনো আসছে না কেনো? ইলা নিজের চিন্তা দূরে ঠেলে শাশুড়ী মায়ের উদ্দেশ্য বললো,
“মা চিন্তা করবেন না তোহফা ফিরে আসবে খুব শীঘ্রই। নিশ্চয়ই কোনো কাজে আঁটকে গেছে।”
“ননদের পক্ষ আর কতো নিবে বলবে আমায় ইলা? এই একটা মেয়ে ঘরের সুখ-শান্তি। কোনো বিপদ হলে তোমার শ্বশুর, স্বামী, দেওর আমাকে ছেড়ে কথা বলবে ভেবেছো। পারলে তোমার শ্বশুর আমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসবে।”
শাশুড়ী মায়ের এমন আহ্লাদী অভিযোগে ইলা মুখ টিপ হাসে। ইলা জিজ্ঞেস করে,
“মা প্রথম যেদিন তোহফা জন্ম গ্রহণ করে সেদিন আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো?”
জাহানারা বেগম ছেলের বউয়ের আজগুবি প্রশ্নে রাগী দৃষ্টিতে তাকান। ইলা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলে,
“বলুন না মা সেদিন কি হয়েছিলো। আমাকে তৌসিফ বলেছে সেদিন বাবা একটা কান্ড ঘটিয়েছিলো। তবে কান্ডটা কি সেটা সে জানে না। প্লিজ মা বলুন আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করে।”
“যে কান্ড ঘটিয়েছিলো তা শুনলে চোখ কপালে উঠে যাবে। বলবো তবে আজ না অন্য একদিন। আজ টেনশনে কিছু মনে পড়ছে না। তুমি আগে খোঁজ নাও মেয়েটা গেলো কোথায়?”
“তোহফা আওয়াদ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেছে মা, এমনটাই তো মনে হলো।”
জাহানারা বেগম এবং ইলা লিমার কথায় পেছন ফিরে চাইলো। ইলা খানিক অবাক হলো লিমার কথায়। তোহফা আওয়াদের সাথে দেখা করতে গেছে কই তাকে তো কিছু জানায়নি। জাহানারা বেগম লিমার নিকট এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমাকে বলে গেছে?”
“না মা। আসলে ফোনে কথা বলছিলো সেটা শুনেই বুঝেছি। দুঃখিত মা আমি জানতাম না আপনারা জানেন না। না হলে আগেই জানিয়ে রাখতাম।”
“না, ঠিক আছে। আচ্ছা তোমরা ঘরে যাও আমিও ঘরে যাচ্ছি।”
ঘরে যাচ্ছি বলে একরাশ চিন্তা নিয়ে জাহানারা বেগম ঘরের দিকে এগোলেন। ওদিকে লিমা ও ইলা দু’জন দু’জনার দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো। বুঝতে পারলো তোহফা বাড়ি না ফেরা অবধি তাদের শাশুড়ী চিন্তামুক্ত হবেন না। উপর উপর যতোই রাগ দেখাক তিনিও কি কম ভালোবাসে নাকি মেয়েকে।
অন্য দিকে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে খুব আয়েশ করে তোহফা চুমুক দিচ্ছে। সেই দৃশ্য অপলকভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আওয়াদ। মেয়েটার সব কিছুতেই একরাশ মুগ্ধতা জড়ানো থাকে। যতোই দেখে ততোই মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মায়াবতী অষ্টাদশী কন্যা কিনা তার হবার নয়, তবে কেনো তার প্রতি এতো দুর্বলতা জন্ম নেয় আওয়াদের মনের কোণে?
খুব দক্ষ হাতে চায়ের কাপটা আগলে আছে আওয়াদ। এপাশ ওপাশ করে দেখছে চায়ের কাপটার চারিপাশ। ছোট্ট এই মাটির ভাঁড়টা আওয়াদ খুব নিপুনভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে, কারণ এই ভাঁড়ে তোহফার ওষ্ঠদ্বয়ের ছোঁয়া লেগে আছে। চারিদিকে তখন অন্ধকারে আবৃত হয়ে গেছে। কপোত-কপোতীর ভীড় কিছুটাও কমে এসেছে। আওয়াদ নিজের এমন কান্ডে অবাক হচ্ছে। এই বয়সে এসেও কেমন করে প্রিয় মানুষের ছোঁয়া আগলে রাখার চেষ্টা করছে, অথচ সে প্রিয় মানুষটাকে আগলে রাখতে ব্যর্থ। হয়তো প্রিয় মানুষটা অন্য কারো তাই হয়তো এমন আচরণ। পাশেই আওয়াদের এমন পাগলামি দেখছে তোহফা। সে মুখ টিপে হাসছে। কিছুক্ষণ পর সে আওয়াদের উদ্দেশ্য বললো,
“ওভাবে কি দেখছেন?”
আওয়াদ নিজের ভাবনা জগৎ থেকে বেরিয়ে তোহফার নিকট তাকায়। মাথা নাড়িয়ে বলে, কিছু না। ঝটপট চায়ের বিল পরিশোধ করে তোহফার চোখের আড়ালে কাপটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলো। তোহফার উদ্দেশ্য বললো,
“চলুন।”
তোহফাও যথারীতি মাথা নাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলো। আবারও নীরবতায় ছেয়ে গেলো চারিপাশ। ক্ষণেক্ষণে মিষ্টি হাওয়া ছুঁয়ে দিতেই ভালো লাগা দ্বিগুন হয়ে ধরা দিচ্ছে দু’জনার মনের কোণে। এই সময়টা আর ফিরবে না ভেবেই আওয়াদ হয়তো পাওয়া সময়টুকু উপভোগ করছে। আর তোহফা হয়তো নিজের মনের জল্পনা কল্পনায় ব্যস্ত হয়ে সময়টুকু উপভোগ করছে। হঠাৎ করেই আওয়াদের হাতের সংস্পর্শে তোহফা চমকে উঠলো। শিহরণ বয়ে গেলো তার শরীরে। আওয়াদ তার হাত আগলে ধরেছে। তোহফা পলকহীন তাকিয়ে রইলো আওয়াদের হাতের দিকে। আওয়াদ খুব যত্নে তোহফার হাতটা ধরে আছে। এই স্পর্শের বিবরণ তোহফা দিতে পারবে না। তোহফা অবাক হয় আওয়াদের এমন আচরণে। আওয়াদের ছোঁয়ায় কোনো নোংরামো নেই, আছে শতভাগ ভালোবাসা। এই স্পর্শে তোহফা নিজেকে অনুভব করলো নতুন রূপে শুধু। মনে হলো এমন স্পর্শের জন্য হলেও তার আওয়াদকে চাই। আওয়াদ ছেলেটা একটু বেশিই ভালো। অন্যদিকে নিজের অজান্তেই তোহফার হাতটা স্পর্শ করে আওয়াদ বেশ অস্বস্তির মাঝে পরেছিলো। মনে হলো এই বুঝি তোহফা তাকে ধাক্কা দিয়ে অপমান অপদস্ত করবে। তবে তোহফার তেমন কোনো ভাবান্তর না দেখে মনের আরো বেশি আকাঙ্খা পূরণে সে একটু শক্ত করে তোহফার হাত আগলে নিলো। তোহফা আবারও শিউরে উঠলো। তবে সেটা ভেতরে ভেতরে। আড়চোখে তোহফা আওয়াদের দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়ে গেলো। তোহফা নিজেকে এবার আড়াল করতে পারলো না। লজ্জায় যেনো নুইয়ে পড়লো। তোহফার এমন লজ্জা মিশ্রিত চেহারা দেখে আওয়াদ আবারও নতুন করে প্রেমে পড়লো। এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না তাই তো তোহফার আদলে নেশামিশ্রিত চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেই বাড়ি থেকে বের হয়েছো বুঝতে পেরেছি। এমন রোগে আক্রান্ত করলে যে রোগের তুমি ছাড়া কোনো ঔষধ বাজারে নেই। এমন প্রেম নেশায় নেশাগ্রস্ত না করলেও পারতে। শোনো কাজল চোখের মেয়ে, আমি মরলে একটাই দাবি, একগুচ্ছ শুভ্র নির্মল কদম হাতে দেখা করতে যেও কবরের কাছে। বর্ষণের দাপটে চোখ পিটপিট করে একবার আমায় দেখো মন ভরে। তবে মেয়ে ভুল করেও চোখে কাজল দিও না, কারণ সেদিন যে আমি তোমায় দেখতে পাবো না।”
আওয়াদের এমন নেশাময় কন্ঠে তোহফার নিজেকে পাগল পাগল লাগলো। আওয়াদের বিপক্ষে কিছু বলার মতো ভাষা সে খুঁজে পেলো না এই মুহূর্তে। জোর পায়ে সামনে হাঁটতে নিলেই আওয়াদের শক্ত বাঁধনে আঁটকে গেলো চলন্ত দু’পা। হাতটা মোড়ামুড়ি করে ছাড়াতে চাইলেই সেটা আরো মজবুত করে আওয়াদ নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। তোহফা পিছন ফিরে বলতে পারলো না,
“আমাকে ছেড়ে দিন দয়া করে। নাহলে যে আমি এখনি জ্ঞান হারাবো।”
একজোড়া চোখ নিবিড়ভাবে পরখ করছে তোহফাকে। তোহফার ছটফটানি মনে অনুভব করছে। হৃদয়ের ঢিপঢিপ আওয়াজকে আড়াল করতেই এক ভয়াবহ কান্ড করে বসলো সে। আওয়াদের হাতে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকা তোহফার হাতে গভীর ভাবে একটা চুম্বন করে বসলো সে। আওয়াদের আকস্মিক স্পর্শের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেলো শৈথিল্যের হাওয়া। থরথর করে কাঁপতে রইলো তোহফার সমস্ত শরীর। নিজেকে সামলে রাখা তার বড্ড কঠিন হয়ে গেলো। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সেখানেই বসে পড়লো সে। তোহফা বসে পড়তেই আওয়াদ নিজেকে তোহফার মুখোমুখি বসিয়ে বললো,
“কিছু নিষিদ্ধই আমার কাল হোক। তোমাকে এভাবে ছোঁয়ার অপরাধে আমার মৃত্যুদন্ড হোক। তবুও এই অপরাধ আমি বারবার করবো! কেনো করবো জানি না তবুও করবো।”
হার্টবিট প্রোডাকশন বেড়ে গেছে তোহফার। ঢিপঢিপ সেই শব্দ আওয়াদের কর্ণকুহর ভেদ করে যেনো বললো,
“আমাকে ছেড়ে দিন আমি বাড়ি যাবো।”
মেয়েটা তো এমনই, সিরিয়াস সময়ে তার বাড়ির কথা মনে পড়ে সব সময়। সে জানে এটা তার ঘোর অন্যায়। তবুও কেনো জানি এই অন্যায়টা করে তার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না। উল্টো প্রথম প্রেমকে এভাবে ছুঁয়ে দেওয়ার অনুভূতিকে গভীরভাবে অনুভব করছে। তোহফাকে আবারও চমকে দিয়ে আওয়াদ তোহফার অধর স্পর্শ করে বললো,
“তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো এটাই তো মানতে পারছি না। তবে তুমি আমার না হয়ে অন্য কারো হও এটা কীভাবে মানি? শোনো মেয়ে আমি চাই তুমি আমায় অনুভব করো একটু হলেও তাই এমন কান্ড। তবে তোমার আমাকে কষ্ট দেওয়ার টেকনিক্যাল সফটওয়্যার ব্যবহার করতে তুমি ভুল করে ফেললে, আমার আড়ালে চায়ের কাপটা ব্যাগের মাঝে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে। অবশ্য বাকি সবটা তোমার নিখুঁত ছিলো। আমি সত্যি কষ্ট পাচ্ছিলাম। তবে তুমি যখন চায়ের কাপটা ফেলে দিয়েও আমার আড়ালে ওটা যত্ন করে ব্যাগে রাখলে আমি বুঝে গেলাম পিছনে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের কথা। আমি না হয় তোমায় ভালোবাসি তাই তোমায় চা খাওয়া ভাঁড়টা যত্ন করে নিজের করে রেখে দিলাম, তুমি কেনো রাখলে? শোনো মেয়ে উত্তর দিতে হবে না শুধু এতটুকু বলো, আমাকে কষ্ট দিয়ে কতোটা তুমি শান্তি পেয়েছো?”
নিজের ছোট্ট ভুলের জন্য এভাবে ধরা পড়ে যাবে তোহফা তা যেনো মানতেই পারছে না। তবে এই মুহূর্তে সে কিছু বলতেও পারছে না আওয়াদকে। তোহফা এদিক ওদিক করে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তোহফার এমন আচরণে স্মিত হাসলো আওয়াদ। তোহফার হাত ধরে বসা থেকে দাঁড় করালো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। অন্ধকারে কারো মুখই তেমন একটা স্পষ্ট না। দু’জনার ঘন নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে একে-অপরের আদলে। তোহফাকে অবাক করে আওয়াদ কিশোর বালকের মতো গেয়ে উঠলো,
“পারবি না তুই ভুলতে আমায় ইচ্ছে যদি আসে। জানিস রে তুই এ মন তোকে কতো ভালোবাসে। আপন ভেবে করে দিস কিছু ভুলের ক্ষমা, উজাড় করে রাখবো জীবন তোরই হাতে জমা।”
দুই লাইনের গানটা শেষ করে তোহফার হাতে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে আওয়াদ নিষ্পলক চোখে হাসলো শুধু। আর তোহফা তখন অনুভব করলো আওয়াদের নিখুঁত ভালোবাসা প্রকাশের অনুভূতিকে।
———–
মেয়েটার সাহস দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। তোমাদের আহ্লাদে মেয়েটা বিগড়ে যাচ্ছে তা কি তোমরা দেখছো না। পৌনে আটটা বাজতে চলেছে এখনো তার ঘরে ফেরার নাম নেই। আমি বলে রাখছি এখনো সময় আছে মেয়েকে শাসন করো।
স্ত্রীর কথায় আরিফুল ইসলাম কানের মধ্যে আঙুল দিয়ে চুলকে এমন ভাব নিলেন যেনো তিনি কিছু শুনতে পাননি। আরিফুল ইসলামের কান্ডে বেজায় রেগে গেলেন জাহানারা বেগম। তিনি চেয়ার থেকে উঠে বিছানার উপরে বসে থাকা স্বামীর নিকট তেড়ে এসে বললো,
“কথা কানে ঢুকছে না। ঢুকবে যেদিন অঘটন ঘটে যাবে সেদিন! তখন বুঝবে আমি কি বলেছি।”
স্ত্রীর কথায় বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে আরিফুল ইসলাম বললেন,
“মেয়ে মানুষের এই একটা বাজে স্বভাব, তারা সামান্য ঘটনাকে অঘটন বানিয়ে দিতে পারে। আচ্ছা তোমাদের এতো মেধা নিয়ে রাতে ঘুমাও কীভাবে? শুনলেই তো মেয়েটা আওয়াদের সাথে দেখা করতে গেছে তারপরও এতো টেনশন কেনো?”
“যদি মা হতে তাহলে বুঝতে কেনো এতো টেনশন করি।”
“ভাগ্যিস তোহফার মা হই না আমি, হলে নিশ্চিত আমি ভিলেন হয়ে যেতাম ওর কাছে তোমার মতো।”
“কি বললে তুমি, আমি ভিলেন। তুমি ভিলেন, তোমার নানা ভিলেন, তোমার দাদা ভিলেন।”
“বাদ রেখে গেলে কিছু একটা। ”
” কি বাদ রেখেছি।”
“আমার চোদ্দগুষ্টি ভিলেন সেটা বলা বাদ রেখে গেলে।”
“আল্লাহ এই লোক আমার জীবনটা তেজপাতা করে দিলো।”
“শুকরিয়া করো তেজপাতা বানিয়েছি নিমপাতা না। ”
“ওরে তৌসিফ এদিকে আয় দেখে যা তোর বাবা আমায় কি বলছে। ”
জাহানারা বেগমের আহাজারিতে ছুটে এলো তৌসিফ, তৌহিদ, ইলা, লিমা। সবাইকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে জাহানারা বেগম ঘাবড়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন নিজের বোকামির ফলাফল কোথায় গিয়ে থেমেছে । অন্যদিকে সবাই কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা-মায়ের সামনে। তৌসিফ আর তৌহিদ আরিফুল ইসলামকে প্রশ্ন করলেন,
“কি হয়েছে বাবা? মা চিৎকার করলো কেনো?”
“কি হয়েছে সেটা তোর মা’কেই জিজ্ঞেস কর। ”
তৌহিদ মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“মা কি হয়েছে বাবা কিছু বলেছে তোমায়?”
জাহানারা বেগম তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারলেন না। মুখটা কাচুমাচু করে বললো,
“না আসলে তোর বাবা আমার গায়ে—।”
“বাবা তোমার গায়ে হাত তুলেছে কি বলছো এসব।”
জাহানারা বেগম নিজের কথা শেষ করতে পারলেন না। বলতে পারলেন না তোদের বাবা আমার সাথে গায়ে গা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। তার আগেই ‘গা’ কথাটা শুনেই তৌসিফ উল্টো মানে বের করে নিলো। ছেলের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন জাহানারা বেগম। ছি ছি, কি বিচ্ছিরি ব্যাপার-স্যাপার।
সবার উদ্দেশ্য আরিফুল ইসলাম বললেন,
“জীবনে কখনো তোদের মায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস আমার ছিলো না, কি করে ভাবলি এই বুড়ো বয়সে এসে তোর মায়ের গায়ে হাত তুলবো। আমি আবার ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না।”
আরিফুল ইসলামের কথায় পুত্র বঁধু সাথে ছেলেরা মুখ টিপে হাসলেন। কিন্তু জাহানারা বেগম রেগে আগুন হয়ে তেড়েফুঁড়ে ছুটে এসে বললো,
“আমি ছুঁচো, তুমি ছুঁচো সাথে তোমার—
বাকিটা বলার আগেই ইলা তার শাশুড়ীর মুখ চেপে কানে কানে বললো,
“মা তাকিয়ে দেখুন আপনার ছেলেরা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে সংযত করুন নাহলে আজ মান-ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে।”
ইলার কথায় জাহানারা বেগম চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো। পরিবেশ বুঝতে পেরে বিরবির করে বললো,
“আজ তোমার খবর আছে।”
জাহানারা বেগম চলে গেলেন ঘর ছেড়ে। জাহানারা বেগম চলে যেতেই হো হো করে হেসে উঠলো আরিফুল ইসলাম। বাবাকে এমন হাসতে দেখে তৌহিদ প্রশ্ন করলো,
“বাবা তুমি মায়ের সাথে লাগতে যা-ও কেনো বলোতো? আর এতো সহ্য শক্তিও বা তুমি কোথা থেকে পাও ঝগড়া করার জন্য ।”
আরিফুল ইসলাম বললেন।
“যার রাগ বেশি তার হৃদয়ে ভালোবাসা বেশি। যদি তুমি তোমার স্ত্রীকে সারাজীবনের জন্য বন্ধু হিসেবে পেতে চাও, তাহলে তোমার মনে একটা কবর তৈরি করো যাতে তুমি তোমার স্ত্রীর ভুলগুলো মনে দাফন দিতে পারো। সাথী যতোই খারাপ হোক না কেনো তার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করো না, কেননা পানি যতই খারাপ হোক না কেনো তা পিপাসা মিটাতে না পারলেও আগুন ঠিকই নিভিয়ে দেবে। তোমাদের মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা ঠিক তেমনই। এই যে রাগ করে গেলো, কিছুক্ষণ পর মনে করে খাবার আগের ঔষধটা কিন্তু ও-ই আমাকে দিয়ে যাবে। ঝগড়াঝাটি হলেও আমরা কখনো নিজেদের একেঅপরের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা থেকে পিছু হাঁটিনি। মনে রাখিস তিক্ততা না থাকলে মিষ্টির কদর্য বোঝা যেতো না।“
একজোড়া চোখ তীক্ষ্ণ নজরে আওয়াদ আর তোহফাকে দেখতে রইলো। জলন্ত সিগারেটে ফুঁকতে ফুঁকতে ফোনের ডায়াল কলে কাঙ্খিত নাম্বারে ফোন লাগালো। কিছুক্ষণ রিং হতেই ফোনটা রিসিভ হলো। লোকটা দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
” কৈ মাছের জান হচ্ছে এই মেয়েটার। যখনই ক্ষতি করতে চাই কেউ না কেউ বাঁচিয়ে নেয়। আর এই নিব্বা-নিব্বিদের এতো প্রেম ভালোবাসা দেখে আমার ইচ্ছে করছে নতুন করে প্রেমে পড়ি কারো। তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবার আগেই যদি ছেলেটাকে খুন করে ফেলি কেমন হয় বলুন তো? কেউ হারানোর ব্যথায় জ্বলবে আর আমি আমার পাওনাকড়ি লুফে নিবো। আচ্ছা এটা বলুন তো এতো ক্ষোভ কেনো আপনার ওদের প্রতি। আমিই বা এসব জিজ্ঞেস করছি কেনো? যাইহোক কাজটা দ্রুতই সেরে ফেলবো, আমি তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে পারি না। আমার কাজ নিখুঁত হাতের, না থাকে বাঁশ, না বাজে বাঁশি হা হা হা হা।
আজ আকাশে চাঁদ নেই। নেই চাঁদের সিগ্ধ আলোর চিহ্ন মাত্র । তবে আছে মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো শৈথিল্যের হাওয়া। জানালার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আনমনে কিছু ভাবছে ইলা। সে মাঝেমধ্যে এমন উদাস হয়ে কি ভাবে সেটা ভালো করেই জানে তৌসিফ। মেয়েটাকে শত বুঝিয়ে কোনো লাভ হয় না। তৌসিফ গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় ইলার নিকট। ইলার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখতেই ইলা চমকে পিছন ফিরে তাকায়। তৌসিফকে দেখে আবারও স্বাভাবিক ভাবে সেদিকে তাকায় যেদিকে সে তাকিয়ে ছিলো। স্ত্রীর তেমন কোনো ভাবান্তর না পেয়ে তৌসিফ কাশি দিয়ে ইলার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। অবশ্য সে সফলও হয়। ইলা তৌসিফের মুখপানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কিছু বলবে?”
তৌসিফ আবারও বুকে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে বলে,
“অনেক কিছুই তো বলতে চাই, তবে বউয়ের এমন গোমড়া মুখ দেখলে কিছু বলার আগ্রহ থাকে না।”
স্বামীর অভিমানী অভিযোগে ইলা কিঞ্চিৎ হাসে। তৌসিফ মানুষটা এমন-ই। সে যখনই কোনো কিছু নিয়ে মন খারাপ করে ঠিক তখনই মন খারাপ দূর করার ঔষধ নিয়ে হাজির হয় তার সামনে মানুষটা। তৌসিফের আদলে হাত বোলায় ইলা। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ইলার হাত সুরসুর করে ওঠে মুহূর্তেই। ছেলেটা মাত্রাধিক সুন্দর না হলে-ও খুব বেশি অসুন্দর বলা যায় না। ভাসা চোখ, সরু নাক, সিগারেটে পোড়া কালো ঠোঁট, মুখে অসংখ্য গর্ত যা তার পক্সের দাগ। তবুও মানুষটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং সুন্দর ইলার কাছে। ছেলেটার গম্ভীর কন্ঠ ইলার সব সময় ভালো লাগে। ভালো লাগে তার অতি রেগে যাওয়ার পরে-ও শান্ত থাকাটা। খুব কঠিন সময়ে নিজেকে সামলে নেওয়া! সব, এ-সব কিছুই ভালো লাগে ইলার। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে মানুষটাকে বলতে,
“আপনি আমায় ভুলে যান, নতুন করে সংসার পাতুন অন্য কারো সাথে। কি হবে আমার মতো একটা অক্ষমতায় ভরা মেয়ের সাথে বাকি জীবনটা থেকে।”
তবে কেন জানি ইলা বলতে পারে না। যখনই এমন চিন্তা সে মাথায় আনে তখনই তার বুকটা ক্রমশ ভারি হয়ে আসে। চিনচিন ব্যথা অনুভব হয় বুকে। সে কেনো জানি এই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবলেই ইচ্ছে করে মরে যা-ই। মনে হয় পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, তবুও মানুষটা একান্ত তার হয়েই থাক। ইলার দয়ার শরীর নয় তাই হয়তো সে তার অক্ষমতার কথা চিন্তা করলে-ও তৌসিফকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারে না। সত্যি বলতে ইলা নিজের অক্ষমতার জন্য কখনোই চায় না তৌসিফ তার থেকে দূরে সরে আসুক। আর সেটাই হয়েছে, কখনোই তৌসিফ তাকে ছেড়ে দেবার কথা কল্পনা তেও আনতে পারেনি। শুধু তৌসিফ কেন? এই বাড়ির কোনো সদস্য ভাবেনি। তার শাশুড়ীর এক কথা, “সন্তান দিয়ে বংশ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা বা ইচ্ছে আমার নেই। আল্লাহ যদি চায় তাহলে এমনই হবে। আমি সেকেলে শাশুড়ী নই যে একটা নাতি বা নাতনীর জন্য ছেলেকে বলবো বউ তালাক দিয়ে দাও। শোনে ইলা যেদিন তোমার মনে হবে আমি তোমায় শাসন করতে গিয়ে ভুল করে সন্তান না হওয়ার জন্য খোঁটা দিয়েছি, সাথে সাথেই তুমি আমাকে শুধরে দিয়ো। মা চামড়ার মুখ তো অনেক কিছুই বেরিয়ে যেতে পারে না বলতে চাইলেও। তবুও তুমি রাগ করে বা নিজের অক্ষমতার জন্য আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা স্বপ্নেও এনো না।” তার বলা সেদিনের কথায় হাউমাউ করে কেঁদেছিলো ইলা। ইলার কান্নায় সেদিন আকাশও ভারি কষ্ট পেয়েছিলো হয়তো। একদিন একরাত পুরো মেঘে ছেয়ে ছিলো। একফোঁটা সূর্যের আলোক রশ্মি দেখা যায়নি ধরনীর বুকে। তবে তার শাশুড়ী সেদিন বললেও বিয়ের সাত বছর পরে-ও এই বিষয়ে তার শাশুড়ী আজ পর্যন্ত তাকে কিছু বলেনি। এমনকি লিমা দুই বছর আগে এই বাড়িতে পা দেওয়ার কিছুদিন পরেই তার শাশুড়ী এই বিষয়ে লিমাকে সাবধান করে দিয়েছে। লিমাটা ঠিক তেমনই তার শাশুড়ীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। কখনো লিমা প্রশ্ন করেনি, “কেন ইলার এখনো বাচ্চা হচ্ছে না?”
অন্যদিকে আবারও ইলাকে অন্যমনোষ্ক দেখে তৌসিফ হাত উপর নিচ করে ইলার চোখের সামনে নামালো ওঠালো। ইলা ভাবনার স্মারক থেকে বেরিয়ে বললো,
“বলো কি বলবে, আমার মন খারাপ আর নেই।”
“হঠাৎ মন খারাপি হওয়ার কি কারণ, আর মন ভালো হবারও বা কি কারণ বলো তো একটু শুনি।”
“ওই যে এতো ভালো সংসার মহান রাব্বুল আলামিন দিলেন সাথে দিলেন এমন সুপুরুষ স্বামী, স্বপ্নের মতো শ্বশুর, মায়ের মতো শাশুড়ী, বোনের মতো ননদ, বান্ধবীর মতো জা, ছোট ভাইয়ের মতো একটা মিষ্টি ভাই কিন্তু একটা বাব—-!”
বাকি কথা বলার আগেই তৌসিফ ইলার মুখ চেপে ধরলো। আর বললো,
“মানুষ নিরানব্বই ধাপ এগিয়ে গিয়ে নিরানব্বইটা পুরুষ্কার গ্রহন করে একটা পুরুষ্কারের জন্য যখন আফসোস করে তখন তাদের কি বলে জানো?”
” কি।”
খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইলা। তৌসিফ উত্তর দিলো,
“বোকা।”
“যাহ, এটা কোনো যুক্তিসঙ্গত কথা হলো নাকি।”
“জি মেডাম, হয়েছে।”
“কেমন করে?”
“মনে করো তোমার খুব তেষ্টা পেয়েছে। তোমার সামনে একগ্লাস শরবত দেওয়া হলো বিনিময়ে তোমার কাছে যা আছে সেটাই দিতে বলা হলো, আর অন্য দিকে একগ্লাস শুধু পানি দেওয়া হলো তবে তোমার থেকে বিনিময়ে কিছুই চাওয়া হলো না এখন তুমি করবে?”
“সহজ উত্তর তো, আমি শুধু পানি খাবো। আমার তেষ্টা মেটানোর প্রয়োজন সুস্বাদু বা দামি কিছু নয় তাহলে আমি কেনো একগ্লাস লেবুর শরবতের জন্য নিজের সবটা দিয়ে দিবো! আমি কি বোকা নাকি।”
“এই তো বউ আমার জায়গায় এসে থেমেছে। তাহলে এবার তুমিই বলো! আমি বা আমার পরিবার তোমাকে ভালোবাসার পর কখনো বিনিময় চেয়েছি, তাহলে তুমি কেনো ওই লেবুর শরবত না পাবার যন্ত্রণাটা ভুলতে পারছো না। যেখানে তোমার তেষ্টা আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি পুষিয়ে দিয়েছি।”
ইলা তৌসিফের কথার মানে বুঝতে পেরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর তৌসিফকে জড়িয়ে নীরবে কাঁদতে রইলো। তৌসিফ পরম যত্নে ইলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েরা হলো নরম তুলো, তাদের আপনি একটু ভালোবাসা দিলে সারাদিনের সকল ক্লান্তি দূর করে আপনাকে একটা শান্তির ঘুম উপহার দিবে। আর সে-ই উপহার আপনার সকল ব্যথা, কষ্ট নিরাময় করে দিবে ইন শা আল্লাহ।
ইন শা আল্লাহ চলবে…….