#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১০
“উনি ঠিক আছে আব্বু তবে মা রেগে গেছে। মা বড়ো ভাবিকে নিয়ে হয়তো কোথাও যাচ্ছে, মায়ের অবস্থা কিন্তু আমার ভালো ঠেকলো না।”
মেয়ের কথায় স্বস্তির শ্বাস নিলো আরিফুল ইসলাম। ফের তিনি তার জায়গায় গিয়ে বসলেন এবং খবরের কাগজটা টি-টেবিল থেকে তুলে নিলেন হাতে। বাবাকে এমন নিশ্চিন্ত দেখে তোহফা প্রশ্ন করলো,
“বাবা! মা রেগে গেছে, আর তুমি এখানে খবরের কাগজ পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছো।”
মেয়ের কথায় চোখের চশমাটা ঠিক করে আরিফুল ইসলাম বললেন,
“নিঝুমের মায়ের উপর তোমার মা রেগেছে , তাই আমার টেনশন হওয়ার কারণ দেখছি না।”
“মনোয়ারা কাকির উপর মা কেনো রেগেছে?”
“তিনি তোমার বড় ভাবিকে কটু কথা শুনিয়েছে।”
“ভাবিকে? কেনো?”
“বাচ্চা হয় না তাই সে অপয়া না-কি! এই জন্য আমরা সবাই তার মেয়ের বিয়েতে গেলেও যেনো ইলা না যায় সেটাই ইলার নিকট আর্জি করেছে।”
“তুমি জানতে এটা।”
“হুম।”
“মা’কে তুমি বলেছো?”
“হুম, সকালেই বলেছি।”
“তাহলে মা এখন রাগলো কেনো?”
“ইলা এখন বলেছে তাই। তোমার মা ইলার মুখে শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো।”
“তাহলে আমিও যা-ই, ক’টা কথা শুনিয়ে আসি।”
“না ।”
“কেনো?”
“তোমার মা একাই একশো তাই। ”
“মনোয়ারা কাকির সাহসটা একটু বেশিই বেড়েছে, আজ মা তার সাহসের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে আসুক আমিও একটু দেখি। শয়তান বেডি সারাদিন ভাবির পিছনে পড়ে থাকে।”
“আজ থেকে বাদ দিয়ে দিবে।”
“একদম ঠিক বলছো।”
“মা আমার কথাটা একটু শুনুন, এভাবে কারো বাড়িতে যাওয়া ঠিক না। তার উপর তাদের বাড়িতে মেহমানে গিজগিজ করছে প্লিজ মা আমার কথাটা একবারের জন্য শুনুন। আর মনোয়ারা কাকি তো ঠিক কথাই বলেছে। সত্যিই তো আমি অপয়া। আজ আট বছর হয়ে গেলো একটা সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পারিনি কেমন মেয়ে আমি। তাই দয়া করে ঝামেলা বাড়াবেন না।”
“চুপচাপ আমার সাথে চলো ইলা! দ্বিতীয় কোনো কথা বললে ফাটিয়ে একটা চড় মারবো। এতোদিন আমি চুপ ছিলাম সব জেনেও কারণ তুমি এসব আমার থেকে লুকিয়ে গেছো। এর আগে মনোয়ারা ভাবি তোমায় যা বলেছে সে-সকল কথা তোহফা, লিমা এবং তৌহিদ আমায় জানিয়েছে তবে আমি কিছু বলিনি কারণ তুমি কোন কথা আমায় জানাওনি। তোমার উপর অভিমান করেই আমি চুপ ছিলাম। তোমার কষ্ট তুমি শেয়ার না করলে আমরা কীভাবে তোমার কষ্ট কমাবো। বাদ ছিলো তোমার শ্বশুর, তিনিও আজ অভিযোগ করলো আমার নিকট। তিনি আমায় জানিয়েছে হাসপাতাল থেকে ফিরতেই কতোগুলো কথা তোমায় তিনি শুনিয়েছে। আমি চুপচাপ হজম করছিলাম তোমার জন্য। আজ যখন তুমি কথা বলেছো নিজের কষ্ট থেকে! আমি তো উনাকে দেখে ছাড়বো। আর কি বললে মেহমান! তার মেহমান দিয়ে আমি কি করবো যদি তিনি আমার ঘরের রহমতকে এভাবে অপমান করতে দ্বিধাবোধ না করে। শুনে রাখো ইলা, তোহফার থেকে তুমি বা লিমা কোন অংশে কম না আমার কাছে। তাই আজ এর বিহিত আমি করবোই তাতে তুমি আমায় হাজারবার বারণ করা শর্তেও। কিছু মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে শিক্ষা না দিলে তারা সঠিকটা দেখতে পায় না। তাই তাদের দেখাতেই আমি যাচ্ছি। তারা অনেক কিছু ভুলেও গেছে সেগুলোও মনে করানো প্রয়োজন। তুমি একদম মোচড়ামুচড়ি করবা সোজা একদিনের জন্য ঘরবন্দী করে রাখবো! চব্বিশ ঘণ্টা আমি কথা বলবো না। লিমার সমস্যা নিয়েও কথা বলবো না। বারো ঘন্টা তোহফার কাছে ঘেষতে দিবো না। তিন ঘন্টা রান্নাঘরে প্রবেশ করা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবো। তোমার শ্বশুরকে দিয়ে বাজার করাবো তোমার কথা অমান্য করে। সবশেষে তৌহিদ, তৌসিফ ও তোহফাকে পটল ভাজি আর কৈ মাছ দিয়ে গোটা একটা দিন ভাত খাওয়াবো। এবার সিদ্ধান্ত তোমার আজ প্রতিবাদ করবে না-কি চুপ থেকে তোমার জন্য এতোগুলা মানুষকে কষ্ট দিবে। As your wish.
অতিরিক্ত কলিং বেলের শব্দে মনোয়ারা বেগমের মেজাজ বিগড়ে গেলো। পুরো বাড়িতে মেহমান গিজগিজ করছে সেখানে এমন অসভ্যতার মতো কে কলিং বেল বাজাচ্ছে ভেবে মনে মনে কতোগুলো গালি দিলো। কপালে ভাজ ফেলে দরজার নিকট এগিয়ে গেলো৷ দরজা খুলতেই জাহানারা বেগমের আদল চোখে পড়লো মনোয়ারা বেগমের। জাহানারা বেগমকে দেখে একটু আগের রাগ তরতর করে শীতল জলের মতো গলে পড়লো। গোমড়া মুখটা হাসি হাসি করে করে বললো,
“আরে ভাবি আপনি, আমি তো মনে করেছি কোনো অসভ্য ছেলেমেয়ে বারবার কলিং বেল বাজাচ্ছে। দু’চার গালাগালিও দিয়েছি। বুঝতেই পারছেন বিয়ে বাড়ি লোকজনের সমাগম একটু বেশি। আসেন আসেন ঘরে এসে বসেন।”
মনোয়ারা বেগমের কথায় জাহানারা বেগমের বেড়ে যাওয়া রাগ একটুও কমেনি। উল্টো আরো বেড়ে গেলো তার মুখ দেখেই। জাহানারা বেগম জোর গলায় নিঝুম বলে চিৎকার করে উঠলো। জাহানারা বেগম হঠাৎ নিঝুমকে ডাকতে দেখে মনোয়ারা বেগম ঘাবড়ে গেলেন। কিছু একটা আন্দাজ করে বললো,
“ওকে ডাকছেন কেনো? আমায় বলেন আমি শুনছি! ও ব্যস্ত আছে।”
“কিন্তু কথা তো আমার নিঝুমের সাথে ভাবি। তাই ওকে ডাকছি। আর ইলা তুমি পিছনে কেনো? সামনে আসো।”
এবার মনোয়ারা বেগমের আন্দাজ সঠিক প্রমাণিত হলো। ততক্ষণে নিঝুমও চলে এসেছে। জাহানারা বেগম নিঝুমকে ইশারায় বাসার ছাদে যেতে বললো। নিঝুম জাহানারা বেগমের ইশারায় তার পিছু হাঁটতে রইলো। আর তাদের দু’জনকে অনুসরণ করে ইলা ও মনোয়ারা বেগমও হাঁটলেন। চলতি পথে চোখ কটমট করে ইলার দিকে তাকাতে মনোয়ারা বেগম ভুললেন না। আর অন্যদিকে ইলা তার শাশুড়ীর আচরণের ভয়ে চুপসে গেছে তার অন্য কোথাও খেয়াল নেই। সবাই ছাদে উঠতেই তপ্ত দুপুরের কড়া রোদ চোখে-মুখে আছড়ে পড়লো । নিঝুমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাহানারা বেগম বললেন,
“আমি চাইলেই তোমাদের সকল আত্মীয় স্বজনদের সামনে তোমার মা’কে অপমান করতে পারতাম কিন্তু করিনি, কেন করিনি জানো? কারণ আমি কখনোই কোনো মানুষকে ছোট করতে চাই না। এটা আমার শিক্ষায় বরাদ্দ নেই। আমাকে একটা কথা বলো তো নিঝুম, সেদিন তোমাকে কলেজের সামনে ফেলে কিছু ছেলেরা যখন উত্ত্যক্ত করছিলো তখন আমার এই অপয়া বউমা প্রতিবাদ করায় তোমার কোন ক্ষতিটা হয়েছিলো? এটাও বলবে সেদিন যখন তোমার বোন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পা স্লিপ করে পড়ে যাচ্ছিলো আমার অপয়া বউমা তাকে ধরায় কি এমন ক্ষতি হয়েছিলো তার বাচ্চার এবং তোমার বোনের যে আজ তোমার মা তোমার বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার সময় বলে এসেছে! আমরা তোমার বিয়েতে এলে-ও যেনো ইলা না আসে। কারণ সে অপয়া। তোমার মায়ের দাওয়াত দিতে ইচ্ছে না হলে দিতো না, কিন্তু এমন ভাবে আমার ঘরের রহমতকে কেনো অপমান করলো তুমি জিজ্ঞেস করো। উনার সাহস কি করে হয় আমার বউমা’কে অপয়া বলার। কে অধিকার দিয়েছে আমার বউমা’কে কথায় কথায় বাচ্চা না হওয়ার খোঁটা দেওয়ার। আমার ঘরের বংশের বাতি জ্বলুক বা না জ্বলুক তাতে তোমার মায়ের গায়ে এতো লাগছে কেন? ইলা তার খায় না পড়ে সে উঠতে বসতে আমার ছেলের বউকে কথা শোনায়। তোমার মা’কে সাবধান করে দাও নিঝুম আমি কিন্তু এরপর আমার ছেলের বউকে কিছু বললে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।”
ফর্সা মানুষ রেগে গেলে এমনই তাদের চেহারা থেকে আগুন ঝড়ে, আর তার উপর যদি সে-ই রাগী চেহারায় কড়া রোদে তাপ পড়ে তাহলে কেমন দেখায় এই মুহূর্তে সেটা উপলব্ধি করতে পারলো না ইলা। তার শান্তশিষ্ট শাশুড়ীকে এমন অশান্ত দেখে ইলার খারাপ লাগলো, তবে কোথাও ভালো লাগাও জড়িয়ে নিলো তাকে। ইলা এতোক্ষণ তার শাশুড়ীর সকল কথাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো, আচমকা ইলা তার শাশুড়ীর গলা জড়িয়ে ধরে আবেগপ্রবণ হ’য়ে পড়লো। হিচকি তুলে কাঁদতে রইলো। জাহানারা বেগম ইলাকে জড়িয়ে মনোয়ারা বেগমের উদ্দেশ্য বললেন,
“আমার ঘরের রহমতকে আমার সন্তান একটা কটুবাক্য শোনাক এটাই যেখানে আমি মানতে পারি না, সেখানে আপনি ভাবলেন কি করে আপনাকে আমি ছেড়ে দিবো। মনে রাখবেন নিজের খেয়ে পরের মোষ তাড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়।”
মনোয়ারা বেগমের সকল বাঁধ এবার ভেঙে গেলো জাহানারা বেগমের কথায়। তিনি রেগেমেগে ছুটে এসেছে জাহানারা বেগমের নিকট আঙুল উঁচু করে বললো,
“এই ছেলের বউ যখন বাড়ি থেকে বের করে দিবে তখন যেনো ভাবি ভাবি বলে আমাদের কাছে আইসেন না। আজ যার হয়ে প্রতিবাদ করছেন সে-ই না একদিন ঘার ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় আবর্জনার স্তূপ বলে। আরে জীবনে এমন কতো দেখলাম! উনি নতুন করে এসেছে ছেলে-বউ ছেলে-বউ করে অন্যের মাথা খেতে। আমার তো ইচ্ছে করছে তোমায় আরো দু’চার কথা শুনি—
“দয়া করে আঙুল নামিয়ে কথা বলুন চাচি, নাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি আমার বয়সে এবং সম্পর্কে বড়ো হন। আপনি ভুল করে ভুল জায়গায় আঙুল উঁচু করে ফেলেছেন তাই আঙুল নামিয়ে এবং চোখ নামিয়ে কথা বলুন। কথায় আছে চোরের মায়ের বড়ো গলা যেমনটা আপনি এখন করছেন। আমি কথা বলিনা, মাথা নাড়াই না তাই বলে আমি যে কিছু বুঝি না এটা ভাববেন না। আপনার একমাত্র বউ কেন আপনার সাথে থাকে না সেটা আজ ভালো করেই বুঝলাম। আপনি যে কি চিজ মাইরি তা ভালো করে দেখেও নিলাম। আপনার সাথে বোবা মেয়েও একছাদের নিচে থাকতে পারবে না, সেখানে একজন শিক্ষিত, স্মার্ট মেয়ে কীভাবে থাকবে? তার উপর চাকরি করা মেয়ে। সময় এলে হয়তো আপনিই আপনার ছেলে বউয়ের ঘাড় ধাক্কা খাবেন, বলাতো যায় না তখন কষ্ট শেয়ার করতে আমাদের কাছেই এলেন। আর রইলো বাকি আমি আমার শাশুড়ীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা! যেখানে আমি তার মেয়ে এবং তিনি আমার মা সেখানে একে-অপরকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? সন্তান আমাদের হলে, কোল পূর্ণ আমার আর তৌসিফের হবে আপনি এতো নাচানাচি করছেন কেন? দাদি হলে মা হবে, আর না হলে তাদের কষ্ট পাবার কথা আপনি কেনো পাচ্ছেন? এতো কষ্ট পাবেন না অন্যের কষ্টে! দেখা যাবে কিছু একটা হয়ে যাবে। চলুন মা।”
ইলা কথা শেষ করেই দম নিলো। জাহানারা বেগমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো নিচে। মনোয়ারা বেগম রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কিছু বলতে উদ্যোগ হলেই নিঝুম এবার মুখ খুললো। নিঝুমের গলা পেতে ইলা ও জাহানারা বেগমও দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“সারাজীবন অন্যের ঘরের হাঁড়ির খবর বাজারে তুলতে তুলতে ভুলে গেছো তোমার হাঁড়ির খবরও কারো না করো কাছে থাকতে পারে। তারা-ও চাইলে সে খবর পুরো মহল্লায় ছড়িয়ে দিতে পারে। মানুষকে ছোট করতে নেই এটা আমি আমার টিউশনির বাচ্চাদের শেখাই, এখন দেখছি আমার ঘরের আসল মানুষের শিক্ষার অভাব! অন্যদের রেখে তাকেই আমার সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিৎ। তবে সত্যি বলতে জাতের কচু অল্প জ্বালে সেজ, অজাতের কচুতে শুধু গলা চুলকাতে জানে। তুমি হচ্ছো সে-ই অজাতের কচু যাকে বলে অকৃতজ্ঞ। সেদিন ভাবি যদি না থাকতো ওখানে হয়তো আমার সম্মানহানি হতো! কারণ ওরা আমার ওড়না ধরে টানাটানি করছিলো। ভাবি যদি বড় আপাকে না ধরতো আজ তোমার বড়ো মেয়ের এই বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যেতো চিরতরে। এতো উপকার করা মানুষটাকে কীভাবে তুমি অপয়া বলতে পারলে মা! ছিহ মা! ছিহ! আমার কষ্ট লাগছে এটা ভেবে এমন মানুষগুলো আমার বিয়েতে আমি চাইলেও আর আসবে না শুধুমাত্র তোমার জন্য। ”
একদমে কথাগুলো বলে নিঝুম ইলার হাত আঁকড়ে ধরে বললো,
“মায়ের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি ভাবি তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না। কিছু মানুষ অকৃতজ্ঞ এরা যে থালে খায়, সে-ই থালই ফুটো করে।”
ইলা নিঝুমের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“শক্ত ইটে আঘাত করতে সবাই ভয় পায় নিজে আঘাত পেতে পারে ভেবে! অথচ পেরি কাঁদায় পা দিয়ে চটকাতে খুবই মজা পায়। দু’টোই মাটি। একটা নরম আর অন্যটা শক্ত। এই জন্যই বলে শক্তের ভক্ত, নরমের যম।”
ইন শা আল্লাহ চলবে…..
অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।