#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১১
তোহফা বালতি ভরে কুসুম গরম পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তোহফাকে ঘরে আসতে দেখে আওয়াদ কোন মতে উঠে বসলো। আওয়াদ উঠে বসতেই তোহফা বললো,
“আমি পানি নিয়ে এসেছি আপনার শরীর মুছিয়ে দিতে।”
তোহফার কথা তোয়াক্কা না করে আওয়াদ বললো,
“তখন দৌড়ে গেলেন কিছু কি হয়েছে? ”
আওয়াদের কথায় তোহফা ফাঁকা নিশ্বাস টেনে বললো,
“আমাদের বাড়ির অতি শান্তিপ্রিয় মানুষটা অশান্ত হয়ে গিয়েছিলো তাই দৌড়ে গিয়েছি।”
“কে? আন্টি?”
“আপনি বুঝলেন কীভাবে মা সে-ই মানুষটা?”
“আমি আরো অনেক কিছুই বুঝি। এখন বলুন কি নিয়ে অশান্ত হয়েছে। ”
আওয়াদকে তোহফা সব খুলে বললো। সব শুনে আওয়াদ বললো,
“এই সমাজটা কিছু নষ্ট মানুষের মন-মানসিকতার জন্য নর্দমার কিট হয়ে গেছে আজকাল। সন্তান আল্লাহর নিয়ামত, তিনি যখন চাইবে তখন হবে! এখানে ভাবির কি করার আছে।”
“এটাই ঐ কাকিকে কে বোঝাবে। তাই আজ মা আচ্ছা করে বোঝাতে গেছে।”
“একদম ঠিক আছে। এসব মানুষকে কখনো কখনো শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন আছে।”
“আচ্ছা ওসব বাদ, এখন একটা কথা বলবো।”
“হ্যাঁ বলুন।
” আমি আপনার শরীর মুছিয়ে দেওয়ার সময় প্লিজ আপনি কোনো কথা বলবেন না।”
“কেন?”
“কেনোর কোনো কারণ নেই, কথা বলতে বারণ করেছি ব্যাস।”
“তাহলে কি গান গাইবো।”
“সে আপনার খুশি। ও আরো একটা কথা।”
“কি?”
“আপনি চোখ বুঁজে থাকবেন আপনার শরীর মোছাবো তখন।”
“আপনি কি আমাকে বোবা, অন্ধ করে সারাজীবন ঘরে রাখার পরিকল্পনা করছেন না-কি?”
“না না এমন কিছু না, আসলে..”
“আসলে কি আপনার লজ্জা লাগবে।”
“আপনার মুখের লাগাম নেই হুট করে এমন কিছু বললেন আমি হার্টঅ্যাটাক করে মরে গেলাম।”
” মেয়ে বলে কি? বিয়ে করলাম এখনো চব্বিশ ঘণ্টা হলো না, বাসর হলো না এখনই বউ হার্টঅ্যাটাক করে মরে যাওয়ার কথা বলছে। এটা কিন্তু ভারি অন্যায় হচ্ছে আমার সাথে।”
আওয়াদের এই লাগামহীন কথায় তোহফার কান গরম হয়ে গেলো। চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
“এই জন্যই আপনাকে চুপ থাকতে বলেছি। কোনো কথায় সুতো দিয়ে বাঁধা নেই।”
“বাঁধা থাকবে কেনো আপনি কি পাশের বাড়ির ভাবি না-কি?”
“বাহ্ পাশের বাড়ির ভাবির দিকে ভালোই নজর দেখছি। তা পাশের বাড়ির ভাবিকেও আপনি বলেই সম্মোধন করেন তো আমাকে যেমন করছেন?”
“এভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অযথা সময় নষ্ট না করে আপনি বলতেই পারেন আপনাকে তুমি বলে সম্মোধন করতে।”
“উঁহু, আমি এটা কখন বললাম?”
“বলেননি, তবে আমি বুঝে নিয়েছি।”
“এতো বুঝলে পরে বিপদে পড়তে হবে।”
“আর নতুন করে বিপদ দিয়ে কি হবে! বিয়ে করলাম অথচ বউকে ছুঁতে পারছি না এ-ই যে হুট করে আসা বিপদের জন্য এই কষ্ট আমি কাকে দেখাবো?”
কথাটা আওয়াদ ব্যান্ডেজ করা হাত ও পায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। আওয়াদের কথায় কপালে সরু ভাজ করে তোহফা বললো,
“আশ্চর্য মানুষ আপনি! কোন কথা কোথা পর্যন্ত নিয়ে যান।”
“কোন যান বললেন, প্রাণের জান না-কি সরে যান।”
“আপনার মাথা বলেছি। একদম চুপচাপ হয়ে বসে থাকুন। আমাকে কাজের কাজ করতে দিন।”
“বারণ করলাম কখন? তবে একটা কথা বলবো সুন্দরী?”
সুন্দরী উপাধি দিতেই তোহফার হার্টবিট আচমকাই বেড়ে গেলো। এই জন্য ভয় লাগে মানুষটার কাছে আসতে তোহফার। কখন কি বলবে আর তোহফার অবস্থা বেসামাল হবে। তোহফাকে এমন ভাবুক হয়ে থাকতে দেখে আওয়াদ বললো,
“বলছি আমার বুকে অনেক মায়া, এতোদিন সেগুলো পাশের বাড়ির ভাবিদের জন্য ছিলো, এখন তা একান্তই একজনের জন্য বরাদ্দ হয়ে গেছে। সে-ই সকল মায়ার কালো জাদুতে কেউ যদি দুম করে জ্ঞান হারায় আমি কিন্তু তাকে সামলাতে পারবো না। তাই আগে থেকেই তাকে সাবধান করলাম এ-ই আরকি।”
আওয়াদের কথার মানে বুঝতে না পেরে তোহফা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আওয়াদের মুখোপানে। তোহফাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আওয়াদ বললো,
“বলছি সুন্দরী ওভাবে তাকাবেন না, ভুল টুল কিছু হয়ে যেতে পারে দরজা খোলা আছে যে। আর কারো ঘোর ওই মায়াবী চেহারাখানায় অদৃশ্য এক টান অনুভব হয় এই যে বুকের এখানে। হয়তো সে-ই টান থেকে শরীরের ব্যথা ভুলে গেলাম ঠিক তখনই একটা ভুল হয়ে গেলো।”
তোহফা আওয়াদের নেশাময় কন্ঠে অভিধানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সকল কথা হারিয়ে ফেললো। শুধু বললো,
“মুখে কিছু আঁটকায় না অসভ্য লোক একটা।”
“আপনি আমার শরীর মুছিয়ে দিচ্ছেন, না-কি শরীরের ময়লাকে ছুঁয়ে বলছেন, আসুন, বসুন, থাকুন আমি সেবা করছি আপনার।”
“এই আপনি একটু চুপ করবেন? শুধু বকবক করে। এতো কথা ছেলেরা বলে আপনাকে না দেখলে জানতামই না।”
“এতো কথা না বলে কি করবো বলুন তো? অন্যদিকে ফিরে অস্বস্তি নিয়ে আমার শরীর মুছিয়ে দিচ্ছেন। মনে হচ্ছে কেউ আপনাকে জোর করে হোমওয়ার্ক করতে দিয়েছে এবং আপনি সেজন্য খুব বিরক্ত।
আপনার থেকে আমার ব্যথা হাতে আমি ভালো মুছতে পারি।”
তোহফা কিছু বলতে চেয়েও চুপ হয়ে গেল। নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। এই ছেলেটা তোহফাকে একদিন না একদিন হার্টঅ্যাটাক করিয়েই ছাড়বে। তখন কালো মায়া বলতে আওয়াদ তার বুকের কালো লোমের কথা বলেছে। ফর্সা বুকের মাঝে কালো লোমশ স্পর্শ তোহফাকে বারবার এক অদ্ভুত শিহরণ জাগিয়ে তুলছে বুকে। এই শিহরণের কোন বিশেষ মানে খুঁজে পেল না সে। তা-ই তো নিজের পল্লব জোড়া ওই আকর্ষণ কালো লোমের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখছে। আওয়াদের শরীর মুছিয়ে দেওয়া শেষ হতেই চটজলদি তোহফা উঠে দাঁড়ালো। তোহফাকে এভাবে উঠে যেতে দেখে আওয়াদ আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমার কাজ শেষ তাই এগুলো রেখে আসছি।”
“সেটা তো বুঝতে পারছি, কিন্তু আমাকে এভাবে রেখে কই যাচ্ছেন? হুট করে যদি কেউ এসে পরে তখন?”
তোহফা আওয়াদের কথায় নিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বুঝলো আওয়াদের শরীরে এই মুহূর্তে কোন পোষাক নেই। হঠাৎ আওয়াদের ভেজা কালো লোম চোখে পড়তেই তোহফার দৃষ্টিতে ঘোর লেগে যায়। সে কোনমতে নিজের দৃষ্টি সামলে বললো,
“আমি আসছি।”
তোহফা ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আর আওয়াদ অসহায় হয়ে সেখানেই বসে রইল। কিছুক্ষণ যেতেই তোহফা তার ছোট ভাই তৌহিদের একটা হাপ হাতার গেঞ্জি নিয়ে এল। যত্ন করে খুব সাবধানে সেটা আওয়াদকে পরিধান করিয়ে চলে যেতে নিলে আওয়াদ তার ডান হাত দিয়ে তোহফাকে আঁটকে দিল। তোহফা পিছন ঘুরে জিজ্ঞাসু চোখে বললো, “কী?” আওয়াদ বলল,
“একটা অনুরোধ করবো আপনাকে?”
আওয়াদের কথায় অনেক আকুতি মিশে ছিলো যা তোহফাকে নিমেষেই তরল পদার্থে পরিণত করল। তোহফা তার বাকি হাতটা দিয়ে আওয়াদের হাত জড়িয়ে বললো,
“কি?”
“ফ্রেশ হয়ে যখন ঘুমাতে যাবেন প্লিজ, এখানে আমার পাশে ঘুমাবেন। প্রমিজ করছি একটা অহেতুক কথা বলে আপনায় বিরক্ত করবো না। পোড়ার চোখে আপনাকে দেখার ভ্রম জেগেছে, যদি তাকে তৃপ্তি না দেই! হয়তো সে আরো একটা রাত জেগেই কাটাবে।”
এক অদৃশ্য মায়া ছিলো আওয়াদের কথায় তাই হাজার অস্বস্তি থাকলে-ও তোহফা আওয়াদকে না করতে পারল না। সে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। তোহফার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানো দেখে আওয়াদ মুচকি হাসল। সেই মুচকি হাসিতে আওয়াদকে ভয়ংকর সুন্দর লাগল তোহফার কাছে। তোহফা আবারও নতুন করে আওয়াদের প্রেমে পড়ল। এই ছেলেটার সামনে আসার সাথে সাথেই শত অস্বস্তি হুট করেই হাওয়া হয়ে মিলিয়ে যায় শূন্যে। ইচ্ছে হয় যতটা সময় আছে ততটাই সুমিষ্ট স্বাদে গ্রহণ করি তাকে। তোহফাকে পলকহীন নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে আওয়াদ মনে মনে বলল, মেয়েটার ঐ কাজল চোখে একরাশ সিগ্ধ আলোক রশ্মিতে ভরা। মনে হয় চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে ঝলঝল করছে তার আঁখি জোড়া। সে যখন অবাক হয়ে তাকায়! মনে হয় পৃথিবীর সকল অদ্ভুত শিহরণ তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মনে হয় যুগ যুগান্তর ওই মায়াবী চেহারাখানা দেখে পার করা যাবে অনায়াসেই। তোহফা যখন আশেপাশে থাকে মনে হয় সব থেকে মূল্যবান হিরা তার কাছেই। ভালোবাসা বুঝি এভাবেই ধরা দেয় হৃদয়ের কোণে?
রান্নাঘরের ঝনঝন শব্দ শুনে এক-পা দু-পা করে রান্নাঘরে প্রবেশ করল আরিফুল ইসলাম। তিনি জানেন এই মুহূর্তে তার স্ত্রী বেজায় রেগে আছে। তবে তার স্ত্রীর এই রাগী মুডের চেহারাখানা এই মূহুর্তে না দেখলে সে অনেক কিছু মিস করতে পারে তাই চলে আসে। আরিফুল ইসলাম রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই তিনি দেখলেন জাহানারা বেগমের সাথে ইলাও আছে। তাই তিনি কাশি দিয়ে নিজের অবস্থান জানান দিলো। অন্যদিকে শ্বশুরের কাশির আওয়াজ পেয়ে ইলা পিছন ঘুরে তাকালো। শ্বশুরকে দেখে ইলা বললো,
“বাবা আপনি? কিছু প্রয়োজন?”
ইলার কথায় জাহানারা বেগমও পিছু ফিরে চাইলেন। আরিফুল ইসলামকে দেখেও না দেখার ভান করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন আবারও । ইলাকে আরিফুল ইসলাম বললেন,
“তোমাকে তৌসিফ ডাকছে শুনলাম? দেখতো কোনো প্রয়োজন কি-না? ”
শ্বশুরের কথায় ইলা মাথা দুলিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ছেলেবউ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই জাহানারা বেগম বললেন,
“ছেলেমানুষী করা এখন আর তোমার মানায় না। কি দরকার ছিলো মিথ্যা বলার ইলাকে।”
স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে গেছে ভাবতেই আরিফুল ইসলাম খুক খুক করে কাশলেন। এই একটা মানুষের কাছে কখনোই নিজেকে সে আড়াল করতে পারে না। আরিফুল ইসলাম এগিয়ে স্ত্রীর পাশাপাশি দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
“ভাগ্য করে একটা বউ পেয়েছি ইসস। ”
“হয়েছে আর তেল দিতে হবে না! কি বলবে বলো যখন তখন কেউ চলে আসতে পারে।”
“আসলে আসবে তাতে আমার কি? আমার স্ত্রীর কাছে আমি এতে কে কি বলবে।”
“ইসস কথা শুনে গা জ্বলে ওঠে।”
“সারাজীবন তো এই একটা ডায়লগ দিয়েই গেলে! অথচ কথা না বললে সব থেকে বেশি তুমিই কষ্ট পা-ও।”
“ঘাট হয়েছে আমার, এরপর থেকে আর কষ্ট পাবো না।”
“এই দেখো দেখি কখন বললাম কষ্ট পাবে না, পা-ও। তবে এখন থেকে একটু বেশি পেয়ও। ”
“শোন তৌসিফের বাবা।”
“বলো।”
“আমি কি লোভী?”
স্ত্রী এমন আজব প্রশ্ন শুনে অবাক হয় আরিফুল। তিনি বুঝতে পারলেন না এমন প্রশ্ন করার কারণ কী? তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
” আগে তুমি বলো।”
“জাহানারা একটা কথা কি জানো? যখন গ্লাসের পানিতে একটা পিঁপড়া পড়ে তখন আমরা পানিটা ফেলে দেই! তবে শরতের বেলায় কিন্তু ভিন্ন। চামচ দিয়ে কেটে পিঁপড়াটা ফেলে দিয়ে শরবত পান করি। কারণ আমাদের পরিশ্রম করে আনা চিনি ও লেবু আছে ওখানে। সত্যি বলতে আমরা সবাই লোভী, সময় সুযোগ পেলেই প্রকাশ করি। কিন্তু হঠাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ কি?”
“কিছু না।”
“অনেক কিছু, যা তোমার চেহারা বলে দিচ্ছে বলো কি হয়েছে। ”
“রান্নাঘরে ঢুকতে যাব তখন শুনছি লিমা ওর মা’কে বলছে,
“আজ পর্যন্ত আমার শ্বশুর বাড়িতে এক টাকার সুতো দিলে না অথচ তাদের ছেলের থেকে শুধু নিয়ে যাচ্ছো তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত মা। আমার শাশুড়ী আজ বলছে না, কাল যদি বলে তখন কি করবে। সেটাও বাদ দিলাম, যদি কখনো প্রশ্ন করে তার ছেলে কেন তোমাকে এতো দিবে তখন?”
আচ্ছা তুমি বলো আমি আজ পর্যন্ত আমার ছেলে বউদের সাথে এমন কোন ব্যবহার করেছি যে ওরা আমাকে নিয়ে এসব চিন্তা করছে।”
স্ত্রীর অভিযোগে অনেক আক্ষেপ লুকিয়ে আছে বুঝতে পারলেন আরিফুল। তার স্ত্রী সবাইকে নিয়ে পজিটিভ চিন্তা করে! অথচ সেই মানুষগুলো যখন তাকে নিয়ে নেগেটিভ বলে তখন সে খুব কষ্ট পায়। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, আমি যা নই আমাকে কেন সবাই সেটা ভাববে। বুকের ভেতরে দীর্ঘশ্বাস টেনে আরিফুল ইসলাম স্ত্রীর গালে হাত দিয়ে বললো,
“তুমি তো জানোই ওদের পরিবারের কি অবস্থা, হয়তো কথার কথা বলেছে ওর মা’কে। তুমি কষ্ট পেয়ও না।”
স্বামীর কথায় খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না জাহানারা বেগম। তবে তেমন কিছু আর বললেন ও না। খানিক বাদেই রান্নাঘরে ইলা চলে এলো। ইলাকে দেখে আরিফুল ইসলাম চলে গেলেন। শ্বশুর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ইলা বললো,
“মা।”
“হুম।”
“একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“বাবা আপনাকে খুব ভালোবাসে তা-ই না?”
“হঠাৎ এমন প্রশ্ন?”
“আমি দেখেছি, বাবা সব সময় আপনাকে লুকিয়ে এটা ওটা এনে দেয়। মাঝে মাঝেই বাগান থেকে বকুল ফুল এনে নিজ হাত মালা গেঁথে খোঁপায় গুঁজে দেয়। বাড়ির প্রতিটা সদস্য উপস্থিত হয়ে একসাথে খেতে বসলেও তিনি ততোক্ষণ পর্যন্ত মুখে কিছু দেন না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি তার প্লেটে কিছু তুলে দেন। হোক সেটা ভাজি বা একটু তরকারির ঝোল। আপনি যখন রেগে যান মানুষটা কেমন শান্ত হয়ে সব কিছু শুনে যায়। হয়তো মাঝে মাঝেই আপনাকে একটু রাগিয়ে দিতে খোঁচা মারে, তবে কখনোই কটুবাক্য শোনায় না। সত্যি বলতে এমন ভালোবাসা আমি আমার বাবা-মায়ের মাঝে-ও দেখিনি। মাশাআল্লাহ এমন সম্পর্ক অনেক সুন্দর। ”
ছেলে বউয়ের মুখে এমন প্রসংশা শুনে জাহানারা বেগমের খানিক লজ্জা পাওয়ার কথা তবে তিনি পেলেন না। উল্টো একগাল হেসে জবাব দিলেন,
“তোমাদের বাবার সাথে আমার বিয়েটা হুট করেই হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরেই জানতে পারি আমাদের গ্রামের অপর গ্রামের ছেলের সাথে আমার বিয়ে। বোঝো তখন আমার অবস্থা কি। বাদ আছর আমাদের বিয়ে হলো। তাদের গ্রামে যখন আমাকে নিয়ে পৌঁছালো তখন ধরণীতে সন্ধ্যা নেমেছে। গ্রামের বিয়ে তাই দল ধরে একে একে সবাই এলো আমাকে দেখতে। আমি তো অস্বস্তিতে শেষ। একে নতুন জায়গা তারউপর ভারি শাড়ি, গহনা। আমার অবস্থা নাজেহাল। তখন গ্রামে কারেন্ট ছিলোনা, হারিকেনের আলোয় সবাই আমাকে দেখছিল। আমার যখন দম বন্ধ হবার অবস্থা তখন আমার শাশুড়ী আর তোমার শ্বশুর এলেন। সবাইকে বললেন,
“রাইতের আন্ধাঁরে আমার ছেলেবউ কালো লাগবো তাই তোমরা হগলে কাইল সক্কালে আইয়ো।”
আমার শাশুড়ীর কথায় তো বেজায় রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো আমার দাদি শাশুড়ী। তিনি বলে উঠলো,
“বউ এহন দেখবো না তো কাইল বাসিবউ দেখবো না-কি? এই তোমরা হগোলে এহনি বউ দেগবা।”
এবার আমার শাশুড়ী কিছু না বললেও তোমার শ্বশুর বলে উঠলো,
“বুড়ি পরে আছো তো পাতলা ফিনফিনে সুতি শাড়ি, বুঝবে কি করে ওই ভারি শাড়ি পরে এই গরমে কি কষ্ট। আমার বউ আমি এখন কাউকে দেখতে দেবো না। আমার বউয়ের সাথে পার্সোনাল কথা আছে, সবাই বিদায় হও।” শেষের কথাটা ঘরে উপস্থিত থাকা মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে বললো। সকলে যা নয় তাই বলে গেল তোমার শ্বশুরকে। আর আমার শাশুড়ী তার শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলেন। কারণ তার কথা অমান্য করলেও নাতির কথা তিনি অমান্য করতে পারবে না। সবাই বেরিয়ে যেতেই আমার দাদি শাশুড়ী আশ্চর্যজনক একটা কথা বললেন যা শুনে আমার, আমার শাশুড়ী এবং তোমার শ্বশুরের কান গরম হয়ে গেল লজ্জায়। তিনি বললেন, “হালা বউয়ের লগে কসলাকসলি করার লাই তর সইতাছে না। আহুক তোর বাজান আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন।”
তার ঐ কথা শুনে তোমার শ্বশুর কি বলল জানো?”
ইলা অবাক চোখে জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
“বললো, বুড়ি তুমি তো আমার দাদারে এমন জাপটায় ধরছো যে হেয় মরিচ ক্ষেতে গিয়ে পলাইছে। এতদিন আমার আদর সোহাগ একা ভোগ করেছো, এখন আমার বউ আসছে ওমনি ভাগে কম পড়ছে তা-ই না। তয় তুমি চিন্তা কইরো না, একঘন্টা আমার বউয়ের লগে রোমান্স করমু আরেক ঘন্টা তোমার লগে সমান সমান। আমি আবার কাউকে ঠকাই না রাজি?”
সে-ই কথা শুনে আমার এতো হাসি পাচ্ছিলো যে হাসতে না পারার জন্য দম আঁটকে যাবার অবস্থা। আমার শাশুড়ী তো শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে হাসলেন। আর তোমার শ্বশুরের কথা শুনে আমার দাদি শাশুড়ী মুখ হা করে বলল,
“নাউজুবিআল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ।”
একথা বলেই উনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। উনি বেরিয়ে যেতেই আমার শাশুড়ী খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে আমার গায়ে ঢলে পড়ে বললো,
“তুমিও হাসো অসুবিধা নেই আমি কিছু মনে করবো না।”
আমি সেদিন একজন মনখোলা এবং চঞ্চল নীলপরি দেখেছি। যার কথা থেকে শুরু করে হাসিটা পর্যন্ত মানুষকে মুগ্ধ করতো। সেদিন বুঝে নিয়েছি এই বাড়িতে আমার দাদি শাশুড়ী ছাড়া বাকি সবাই খুব ভালো মনের মানুষ। আর নতুন করে তোমার শ্বশুরকে নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। সবাই বলেনা আমি এতো ভালো শাশুড়ী কীভাবে হলাম? আমার শাশুড়ীর থেকে। তিনি নিজ শাশুড়ীর অত্যাচার সহ্য করেও আমাকে নিজের মেয়ের মতো দেখেছেন। সেখানে থেকে আমি মনে মনে ঠিক করেছি আমিও আমার শাশুড়ীর মতো ভালো শাশুড়ী হবো আমার ছেলে বউদের কাছে। কতটা হতে পেরেছি জানি না, তবে চেষ্টা করছি।
ইলা মুগ্ধ হলো, সাথে হলো অবাক। এমন মানুষটা তার শাশুড়ী ভাবতেই কেমন খুশি খুশি লাগে। ইলা মনে মনে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া করল। দোয়া করল তার জীবনের বাকিটা সময় যেন এই মানুষটা তার সঙ্গে থাকে। “সম্পর্ক সুন্দর, সম্পর্ক ভেজালহীন, সম্পর্ক মজবুত, সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ভালোবাসার বাক্স। তাকে যতো যত্ন করবে সে ততোই সৌন্দর্য ছড়াবে মনের কোণে।”
ইন শা আল্লাহ চলবে…..