অতঃপর গল্পটা তোমার পর্ব-১২+১৩

0
200

#অতঃপর_গল্পটা_ তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১২

মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যান গটগট আওয়াজ তুলছে। অতিরিক্ত গরমের জন্য ব্যান্ডেজ করা জায়গায় অসম্ভব চুলকাচ্ছে আওয়াদের। সে চাইলেও নিজের মতো করে কিছু করতে পারছে না। এপাশ ওপাশ করে হাজার চেষ্টা করলে-ও ঘুম তার চোখে ধরা দিলো না। তোহফা সে-ই কখন গেছে গোসলে, এখনো ফেরার নামগন্ধ নেই। নিরাশ হয়ে আওয়াদ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দরজার নিকট তাকাতেই দেখল তোহফা মাত্র ঘরে ঢুকছে। তার চুলের গোছা বেয়ে ঝড়ছে জলের বিন্দু। জলের বিন্দু বেয়ে তোহফার নীল রঙের থ্রি পিছ ভিজে একাকার। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা মুক্তর সন্ধান দিলো আওয়াদের মনের কোণে। ইচ্ছে হলো বলতে,

“আমার কাছে এসো তোহফা ও-ই মুক্ত গুলো একটু ছুঁয়ে দেই।” তবে বলা হলো না। মনের কথা মনের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়ে গেল। তোহফা কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে বসলো। ভেজা চুলে চিরুনী অভিযান শেষ করেই উঠে দাঁড়ালো। বিছানার কোণে তাকাতেই সে দেখল আওয়াদ গভীর তন্দ্রায় নিমজ্জিত। মাথায়, পায়ে এবং হাতে ব্যান্ডেজ। তোহফার ভেতরে ভেতরে খুব অনুশোচনার সৃষ্টি হলো। মানুষটাকে নিয়ে মজা না করলে হয়তো এমন পরিস্থিতি হতো না। কোথাও তার জন্য মানুষটা এতো কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ তোহফা কি ভেবে এক-পা দু-পা করে আওয়াদের কাছে এগিয়ে গেল। পল্লব জোড়া বন্ধ। ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাড়িতে মানুষটাকে একটু বেশিই আকর্ষণ লাগে। ছেলেদের গোলাপি ঠোঁট সে বহু দেখেছে তবে আওয়াদের গোলাপি ঠোঁট কেন জানি তোহফাকে একটু বেশিই মুগ্ধ করে। আওয়াদকে পা থেকে মাথা অবধি পরখ করে তোহফা আওয়াদের আরো একটু কাছে এগিয়ে গেল। খুব কাছে যেতেই ঢিপঢিপ করে আওয়াজ তুলল বক্ষঃস্থল। শরীর কাঁপতে রইল। সব কিছু উপেক্ষা করে তোহফা ধীরে ধীরে তার মাথা নিচু করে আওয়াদের কপাল বরাবর তার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিলো। একবার দু’বার তিনবারের সময় আচমকা আওয়াদ চোখ খুলে তাকাতেই তোহফা একলাফে পিছুপা হতেই ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। মাগো বলে চিৎকার করে উঠতেই আওয়াদ হা হা করে হেসে উঠলো। অন্যদিকে তোহফা নিজের বোকামির জন্য এভাবে ধরা পরে গেছে ভাবতেই লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। আর আওয়াদ তো হাসতে হাসতে তার ডান হাত পেটে চাপ দিয়ে বলল,

“ভুল টাইমে চোখটা খুলে ব্রেক করে ফেললাম দেখি! ইসস বউটা ব্যথা পেলো খুব। তবে মনে হচ্ছে ব্যথার থেকে বেশি লজ্জা পেলো। সুন্দরী বউ যদি এভাবে লজ্জা পায় তবে এই অসুস্থ বরের ইচ্ছে করে ওই লজ্জা মালতীকে একটু ছুঁয়ে দেই।”

তোহফা মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল লিমা ও ইলা। লিমা ও ইলাকে দেখে তোহফার নিজেকে আরো অসহায় মনে হল। আজ সবাই তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে নিশ্চিত। অন্যদিকে ননদকে এভাবে ফ্লোরের বসে থাকতে দেখে ইলা দৌড়ে তুলতে এলো তাঁকে।

“তুমি পড়লে কীভাবে তোহফা?”

ইলার কথায় তোহফা অসহায় চোখে আওয়াদের দিকে তাকালো। আওয়াদ তখনো হেসে যাচ্ছে। আওয়াদকে এমন হাসতে দেখে লিমা জিজ্ঞেস করল,

“আপনি এভাবে হাসছেন কেন? আর তোহফা পরে গেল কীভাবে?”

আওয়াদ দুই ভাবির কথায় হাসতে হাসতে বলল,

“ভা-ভাবি আপনাদের ননদ চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে গেছে। তাই এভাবে মেঝেতে আসন পেতে বসে পড়েছে।”

কথাটা বলতে বলতে আরো হেসে উঠলো আওয়াদ। আওয়াদের কথায় ইলা এবং লিমা দু’জনে একে-অপরের চেহারায় চেয়ে বুঝতে চাইলো কি হয়েছে। তৎকালীন কিছু না বলে রয়েসয়ে ইলা জিজ্ঞেস করল,

“চুরি করতে গিয়ে ধরা পরেছে কীভাবে? আর কি চুরি করতে গেছে? ”

“আপনাদের ননদ–”

” ভাবি উনার কথা একদম বিশ্বাস করবে না, আমার ঘরে আমি কি চুরি করবো বলো তো?”

তোহফার কথায় ওরা দু’জন সায় দিলো। ওদের সায় পেয়ে আওয়াদ নিজের হাসি কন্ট্রোল করে বললো,

“সেটা আপনার ননদকে জিজ্ঞেস করেন? সে কি চুরি করতে গিয়ে ধরা পরলো।”

আওয়াদের কথায় ইলা তোহফার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে তাকাতেই তোহফা ঢোক গিলে বলল,

“তোমাদের মা ডাকছে এখনি চলো। আমিও আসছি। উনি ব্যথায় উল্টো পাল্টা বকছেন উনার কথা কেউ বিশ্বাস করো না। চলো চলো।”

দুই ভাবিকে টেনে নিয়ে ঘরের বাহিরে চললো তোহফা। পিছু ফিরে আওয়াদের দিকে কটমট করে এক নজর চাইতে ভুললো না সে। ও-ই চোখের নজরে তোহফা বলছিলো, “অসভ্য লোক একটা, ইচ্ছে করে দি একটা।”

আর তোহফার এমন দৃষ্টি দেখে আওয়াদ অভিনয় করে ডান হাত বুকে রেখে তোহফাকে চোখের ইশারায় বুঝালো, “ইসস ওই চাহনিতে আজ আমি শেষ।”

সময় ঘড়িতে বিকাল পাঁচটা। পনেরো মিনিট আগেই আছরের আজান শেষ হয়েছে। তোহফা আড়মোড়া ভেঙে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ফিরেছে। তন্দ্রা হাল্কা হতেই টিপটিপ করে চোখ খুলতেই সে ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। তোহফাকে বসতে দেখে আওয়াদ নিজেও ভয় পায়। হঠাৎ তোহফার ভয় পাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না। তোহফা কোনমতে চোখ ডলতে ডলতে বলে,

“ওভাবে কী দেখছিলেন? আমি তো ভয় পেলাম।”

তোহফার কথায় আওয়াদ চোখ মোটা করে বলে,

“ঘরের বউকে দেখছি। দেখা কি বারণ নাকি না পাপ? এখানে ভয় পাওয়ার কী আছে?”

“না সেটা হতে যাবে কেন? এমনই বললাম আরকি। তবে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলেন আমার বুকটা ধক ধক করছে ভয়ে।”

“না, আমি মনে করলাম খুব বড় অপরাধ করে ফেলেছি তাকিয়ে থেকে। তবে কথা সেটা নয় তোমার ওভাবে ভয় পাওয়ার কারণ কী?”

আওয়াদের কথায় তোহফা মাথাটা তার হাঁটুর মাঝে গুঁজে মুখটা আড়াল করে বলে,

“একা রাজত্ব করা এই ঘরে ডাকাত আসলো কোথা থেকে সেটা ভেবেই ভয় পেয়েছি।”

“নাউজুবিল্লাহ, মেয়ে বলে কী! স্বামীকে ডাকাত বলছে, তওবা করো তওবা পাপ হবে পাপ।”

“কিছু হবে না। সত্যি বলছি আমি কয়েক সেকেন্ডে ভুলে গেছিলাম আমার গেছেকাল রাতে বিয়ে হ’য়েছে।”

“এই মেয়ে, তোমার কী ভুলে যাবার রোগে ধরেছে নাকি শাশুড়ীর ছোঁয়া পেতেই? সর্বনাশ আমাকে ভুলে যাবে নাতো?”

“আশ্চর্য আপনাকে ভুলব কেন? আর আপনি আমার ভুলোভালা শাশুড়ীকে এভাবে বলছেন কেন?”

“কীভাবে বললাম।”

“এই যে।”

“কই যে।”

“কিছু না। আজান দিয়েছে কিনা আছরের সেটা বলুন।”

“সেটা তো জানি না।”

“জানেন না মানে? জেগে ছিলেন দেখলাম।”

“হ্যাঁ এটা ঠিক জেগে ছিলাম, তবে ঘোরে ছিলাম।”

“ঘোর, কীসের ঘোর?”

“তোমাকে দেখার ঘোর।”

তোহফা আওয়াদের কথায় আর বাক না বাড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। আর আওয়াদ মুচকি হাসে। মেয়েটাকে যা-ই বলে তাতেই লজ্জা পায়। আওয়াদ নিজের হাতের দিকে নজর দিতেই মনে মনে কিছু কথা আওড়ায়,

“সত্যি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। কিছু খারাপ হয় ভালো কিছু হবার জন্যই। এই যে শরীর তুই আঘাত পেলি আর হৃদয় পেল তার শান্তির স্থান। শোন হৃদয়, তাকে কখনো অজান্তেও কষ্ট দিস না যেন। মনে রাখিস সে তোর অস্তিত্ব। আজ তাকে পেয়ে আমি সত্যি আনন্দিত। জীবনের পুরো পথটা যেন তার সাথেই আমার অতিক্রম হয়।”

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
১৩

ধরনীতে সন্ধ্যায় নেমেছে। পাখির দলেরা আপন নীড়ে ফিরে গেছে। কর্মস্থলের মানুষগুলো ব্যস্ত পায়ে হেঁটে চলেছে শান্তির নীড়ে ফিরবে বলে। ব্যস্ত নগরীতে সবাই ব্যস্ত। আমি তুমি আমরা সবাই। কেউ কাউকে আনন্দ দিতে ব্যস্ত কেউবা কাউকে কষ্ট দিতে! তবে সবাই ব্যস্ত নিজের স্থানে। গগনে নতুন সরু চাঁদের দেখা মিলল আজকের সন্ধ্যায়। সেই চাঁদের পানে তাকিয়ে খুব গোপনে দীর্ঘ এক নিশ্বাস বুকের ভেতরে টেনে নিলো লিমা। আপন মনে অনেক কথা সাজিয়ে বারান্দায় চোখ বুলায়। তার শখের বারান্দার অবনতি দেখে আফসোসের সুরে বলে,

“হায়রে আমার বাগান বিলাস করা আর হলো কই! তুই কই আর আমি কই? সুখের তাড়নায় আমি দিশেহারা আর পানিবিহীন তুই মৃত প্রায়।”

লিমা নিচু হয়ে তার নয়ন তারা গাছের আগা ছুঁয়ে দিতেই এক ফোঁটা মুক্তোর দানা ঝড়ে পড়ল তার চোখ থেকে নেতিয়ে থাকা বাদামী রঙের পাতায়। হঠাৎ লিমার মনে হলো গাছটা বলছে,

“তুই কাঁদিস না লিমা! একদিন তুই তোর লক্ষ্য ঠিক পৌঁছে যাবি। আজ যত কষ্টে তোর দম বন্ধ লাগে, একদিন তত সুখে তোর খুশি লাগবে।”

লিমা আপন মনে হাসে। উঠে দাঁড়ায়। বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরে যেতেই পুরো ঘরে চোখ বুলায় খানিকটা সময়। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তার বাবার রুমে যায় যেখানে তার বাবা প্যারালাইসিস হয়ে শুয়ে আছে। বিকালে সে তার বাপের বাড়ি এসেছিল একটা জরুরি কাজে। কাজ শেষ হলেও বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। তাই সে কিছু সময় এখানে কাটিয়ে এখন বাড়ির ফেরার উদ্যোগ হয়। মনির হোসেন চোখ বুজে শুয়ে আছেন। লিমা পাশে বসে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মনির হোসেন চোখ খুলে তাকান। মেয়েকে দেখে কিঞ্চিৎ হাসে। কাঁপা কাঁপা হাতে লিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তবে বেশিক্ষণ সে হাত লিমার মাথায় রাখতে পারেন না পড়ে যায় বিছানায়। লিমা বাবার হাতটা আঁকড়ে বলে,

“জানোই তো হাতে শক্তি নেই, তবুও এত কষ্ট করার মানে কী?”

মেয়ের কথায় আবারও মলিন হাসেন মনির হোসেন। তারপর সময় নিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

“তোর মা’কে টাকা দিস না মা। যখন তখন টাকা চাইলেই দিবি না।”

“কেন কী হয়েছে বাবা?”

“কিছু হয়নি তবে হতে চলেছে। হয়তো তোর মায়ের আমাকে এখন ভালো লাগে না, তাই সব সময় ফোনে কার সাথে যেন কথা বলে। আর মাঝে মাঝেই তোর থেকে টাকা নিয়ে তাকে দেয়। সেদিন শুনলাম বলছে, ” সময় এলেই আমি চলে যাব তোমার কাছে।”

লিমা আশ্চর্য হয় তার বাবার কথায়। নিজেকে স্থীর করে বলে,

“বাবা তুমি শিওর।”

“হ্যাঁ। ”

লিমা উঠে দাঁড়ায়। মনির হোসেনের উদ্দেশ্য বলে,

“ব্যপারটা আমি দেখছি বাবা চিন্তা করো না। আর তুমি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করো। আর শোন প্রয়োজন পড়লে মাহিন চাচা এলে আমাকে ফোন দিতে বলো।”

“এখনি চলে যাবি মা?”

“হ্যাঁ বাবা। একদিন সময় করে এসে ক’দিন তোমার কাছে থেকে যাব।”

“আচ্ছা।

” মা ফিরলে বলো আমি চলে গেছি।”

“হুম।”

লিমা তার গতি বাড়িয়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। আপন মনে অনেক হিসেব কষাকষি করে। এক সময় তার মনে হয় তার বাবার বলা কথাগুলো কতটা সত্যি এটা তার জানা প্রয়োজন। তাকে দেখতে হবে এমন কিছুই হয়েছে কিনা। চিন্তায় বিভোর হয়ে বড় রাস্তার পথ ধরে হাঁটতে থাকে। সেখান থেকেই রিক্সা বা অটো নিয়ে ওবাড়িতে ফিরতে হবে। ফোনের পাওয়ার বাটনে চাপ দিতেই হাস্যোজ্জ্বল ভাইয়ের চেহারাটা ভেসে এলো। বুকটা ধক করে উঠতেই ফোনটা বুকের মাঝে লুকিয়ে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,

“এভাবে কেন হারিয়ে গেলি ভাই। তোকে যে আমি খুব মিস্ করি। মৃত্যু কেন এত ভয়ানকভাবে তোকে আমাদের থেকে নিয়ে গেল। আজ তুই চলে যাওয়ায় আমাদের সুখের সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। তোর মৃত্যুর খবরে বাবা হার্টঅ্যাটাক করে আজ বিছানায় পড়ে আছে। মা রোজ টাকা টাকা করে আমার মাথা খারাপ করে দেয়। আমার সেই অতি শখের বারান্দায় কোনো প্রাণ নেই, নেই কোনো আনন্দ। কারণ কেউ যে রোজ সন্ধ্যায় আমার বাগানের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর নেয় না, কেউ জানতে চায় না এবার কোন ফুলের চারাগাছ এনে দিব? শোন ভাই, যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস। আল্লাহ তোকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক, আমিন।”

হাসপাতালের সিড়ির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে তৌসিফ ও ইলা। ইলার চোখেমুখে বিষণ্ণতা। কিছুক্ষণ সে এপাশে কিছুক্ষণ ওপাশে পায়চারি করছে। ইলার অস্থিরতা দেখে তৌসিফ হাত ধরে ইলাকে দাঁড় করায়। দু-কাঁধে হাত রেখে বলে,

“এভাবে পায়চারী করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ইলা।”

তৌসিফের কথায় ইলা মুখটা আরো বিষণ্ণতায় ছেয়ে ফেলে। তা দেখে তৌসিফ মলিন হেসে বলে,

“যা হবে ভালোই হবে টেনশন করে লাভ নেই। শোন, টেনশন করে যদি লাভের লাভ কিছু হতো তাহলে বাড়ির সকলেই টেনশন করতো তোমার সাথে। তাই দয়া করে টেনশন করো না।”

তৌসিফের কথায় ইলা মুখটা কালো করে বলল,

“হঠাৎ ডাক্তার জরুরি খবর দিলো কেন তৌসিফ এটা ভেবেই আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। আমার ভয় হচ্ছে এতদিন যে আশাটা ছিল সেটাও কী হারিয়ে যাবে।”

“আবারও এক কথা বলে চলেছো। শোন ইলা একটু আল্লাহর উপর ভরসা করো ইনশাআল্লাহ ভালো কিছুই হব…”

“মিস্টার তৌসিফ?”

হঠাৎ একজন নার্সের ডাকে ইলা ও তৌসিফ সামনে তাকায়। তৌসিফ এগিয়ে বলে,

“জি আমি তৌসিফ। ”

“আপনাদের ভেতরে ডাকছেন ম্যাম চলুন।”

“জি চলুন।”

তৌসিফ ইলাকে ইশারা করতেই ইলা তৌসিফের হাত খামচে ধরে ভয়ে। কি হতে পারে ভাবতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তৌসিফ চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে বলে “চলো।” দু’জনেই ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করতেই ডাক্তার সুইটি মুচকি হাসে। কিছু রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে ওদের উদ্দেশ্য বলে,

“দেখুন মিস্টার তৌসিফ, আমি আগেও বলেছি এখনও বলছি আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর কারোর মাঝেই কোনো সমস্যা নেই। আল্লাহ চাইলে ইলা খুব শীগ্রই কনসিভ করবে। অনেকের কিছু ছোট্ট সমস্যার জন্য বেবি কনসিভ করতে দেরি হয়! তবে আপনাদের তেমন ছোট সমস্যাও আমি দেখছি না। আমার মন বলছে আপনারা খুশির খবরটা খুব দ্রুত পাবেন। তাই আপনাদের খবর দিয়ে এভাবে দেখা করতে বলা। আমি আমার এক বন্ধুর সাথে আপনাদের নিয়ে আলোচনা করেছি, তিনি আমায় বলেছেন অনেক সময় বাচ্চা কনসিভ করতে দেরি হয়! কেউ কেউ জীবনের শেষ বয়সে এসেও মা হয়। এই তো আমার বন্ধুর একজন পেসেন্ট প্রায় বিয়ের তেতাল্লিশ বছর বয়সে মা হয়েছে। বুঝতে পারছেন কত বছর পর। শুধু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিলেন মহান রাব্বুল আলামিনের উপর। আল্লাহ তাদের শেষ বয়সে হলেও মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন। তাই ডাক্তার হিসেবে নয়! একজন মানুষ হিসেবে বলব আপনারা ধৈর্য ধারণ করুন আল্লাহর উপর। আল্লাহ চাইলে নিশ্চিত আপনাদের কোল আলো করে একটা ফুটফুটে সন্তান জন্ম নিবে। আশা করছি আমি আপনাদের বোঝাতে সক্ষম। আমি মিস্টার তৌসিফকে চিনি তাই তাকে বেশি কিছু বলবো না শুধু আপনাকে বলব মিসেস ইলা, এত অধৈর্য না হয়ে একটু আল্লাহর উপর ভরসা করুন দেখবেন ভালো কিছুই হবে।”

ডাক্তারের সাথে কথা শেষ হতেই তৌসিফ ও ইলা বেরিয়ে আসে চেম্বার থেকে। দু’জনে ফুটপাতের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তৌসিফ ইলাকে খুব যত্ন করে আগলে হাঁটছে। ইলা তৌসিফের সাথে একদম লেপ্টে হেঁটে চলেছে। ওদের দিকে পথচারীরা একটু কটু চোখে তাকালেও তাদের তাতে হেলদোল নেই। বরাবরই ডাক্তার সুইটি তাদের এভাবেই একবুক আশা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে দেয়। তবে সেই আশা কবে পূর্ণ হবে তা একমাত্র জানেন মহান রাব্বুল আলামিন। সত্যি বলতে গাইনী বিভাগের বহু ডাক্তার তারা দেখিয়েছে তবে উনার মতো করে কেউ কখনো আশা দেয়নি। এখানে এলে ইলার মন ফুরফুরে হয়ে যায়। তাই তো তৌসিফ বুদ্ধি খাটিয়ে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। তৌসিফ জানে সে হাজার চেষ্টা করলেও ইলা শান্ত হয় না তাই এটা করা। আজকের পর প্রায় মাস দুয়েক ইলার মন ভালো থাকবে। ভালোবাসার মানুষটার ভালো থাকা নিয়ে কথা! তাতে নিজের সবটুকু দিতেও তৌসিফ রাজি। তৌসিফ ইলার মুখপানে তাকিয়ে বলল,

“ফুচকা খাবে ইলা?”

ইলা তৌসিফের কথায় চোখ তুলে তাকায়। কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়,

“এখানে খাব না। বাড়ির জন্য পার্সেল করে নিয়ে চল সবাই মিলে একসাথে খাবো।”

“আচ্ছা। ”

তৌসিফ ফুচকাওয়ালাকে বলল ফুচকা পার্সেল করে দিতে। বিল পরিশোধ করে দু’জন আবারও হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতে রইল শান্তির নীড়ে। যেখানে দুঃখ কম ভালোবাসা বেশি। সেখানে ভুল বোঝাবুঝি নয়, সঠিকটা বোঝার মানুষ বেশি। একটা একান্ত আপন নীড়। ওদের মনটা আজ খুব ভালো। আর মন ভালো তো পৃথিবীর সকল কিছু ভালো।

বিছানায় শুয়ে আওয়াদ এপাশ ওপাশ করছে। মুখে তার একরাশ বিরক্ত। তোহফা দু’কাপ চা নিয়ে সবে ঘরে ঢুকছে। আওয়াদের এমন অস্থিরতা দেখে তোহফা বুঝতে পারে মানুষটার আর শুয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তোহফা চায়ের কাপ টি-টেবিলে রেখে আওয়াদের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,

“মন খারাপ? বিরক্ত লাগছে এভাবে শুয়ে বসে থাকতে?”

আওয়াদ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত করে, তারপর রয়েসয়ে বলে,

“আমার পিঠ চুলকাচ্ছে তোহফা, প্লিজ হেল্প।”

আওয়াদের কথায় তোহফা মুচকি হাসে। এগিয়ে গিয়ে আওয়াদের দেখানো জায়গায় চুলকে দিতেই আওয়াদ স্বস্তির শ্বাস নেয়। তোহফা বলে,

“বারান্দায় যাবেন, তাহলে মনটা ভালো হয়ে যাবে।”

“আমার ইচ্ছে করছে বাহিরে যেতে। এভাবে শুয়ে-বসে থাকতে থাকতে আমার খারাপ লাগছে।”

“বারান্দায় চলুন ভালো লাগবে সত্যি বলছি।”

“কী আছে তোমার বারান্দায় যে গেলেই মন ভালো হয়ে যাবে?”

“দেখুন আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনি এই বাড়ির রাজকন্যাকে বিয়ে করেছেন। তাই রাজকন্যাদের যা থাকে আমারও তাই আছে।”

“বাহ্ তাই নাকি।”

“জি।”

“তাহলে বলো শুনি কী কী আছে।”

“দোলনা আছে, দু’টো ময়না আছে, একটি টেবিল আছে, অনেক অনেক ফুলগাছ আছে। এসেছেন ধরে তো এখানেই আছেন আপনি জানবেন কী করে।”

“তোমার জানানো উচিত ছিলো তোহফা। কারণ একটা মানুষ কখনোই সারাক্ষণ বদ্ধ ঘরে আটকে থাকতে পারে না।”

“বদ্ধ ঘর কোথায় পেলেন! আমার ঘরটা যথেষ্ট উন্মুক্ত। ”

“হ্যাঁ তুমি ছাড়া এখানের সব উন্মুক্ত। ”

“মানে?”

“তিনহাত ঘোমটা দিয়ে বলছে ‘মানে?'”

কথাটা আওয়াদ বিড়বিড় করে বলে যেন তোহফা শুনতে না পায়।

“বিড়বিড় করছেন কী?”

“কিছু না।”

“আচ্ছা তাহলে যাবেন না।”

“কখন বললাম যাব না।”

“যাবেন যে সেটাও তো বলছেন না।”

“বর্তমানে আমার এই অবস্থা এখন কী তোমার কথায় একছুটে বারান্দায় চলে যাব।”

“এমা! এটা কখন বললাম।”

“বলছো না বাদও রাখছো না।”

“এই আপনি কি জানেন আপনি খুব ঝগরুটে। ”

“হ্যাঁ জানি।”

“বাহ ভালো মনের মানুষ তো আপনি।”

“এতকথা না বলে আমাকে ধরো আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।”

“ও হ্যাঁ।”

তোহফা আওয়াদকে ধরে বারান্দার নিকট এগিয়ে যায়। আওয়াদ বারান্দায় পা রাখতেই তার নাকে ভেসে আসে নাম না জানা ফুলে ঘ্রাণ । চারিদিকে চোখ ঘুরাতেই দেখতে পায় ছোট্ট এই বেলকনিতে কতকিছু দিয়ে তোহফা সাজিয়ে রেখেছে। হাল্কা সোনালী রঙের মরিচ বাতি দিয়ে পুরো বেলকনিটা সাজানো। এককোনায় স্টিলের দোলনা, তারপাশেই একটি খাঁচায় দু’টি ময়না পাখি। আর চারিদিকে নানান ফুলের গাছ। বেলকনির শক্ত লোহার রডে ঝুলে আছে মাধবী লতা। তার কিছু ডালে ফুলও ফুটেছে। দোলনায় বসিয়ে দিতেই আওয়াদের মনে এমন অনুভব হল সে রাজা। চারিদিকের এত সৌন্দর্য তাকে বরণ করছে। মুগ্ধ করছে তাদের অপরূপ সৌন্দর্য্যের আলোক রশ্মিতে।

হঠাৎ আওয়াদ বলল,

“রানী বিহীন এই মহারাজা শূন্য, তাই আপনি পাশে বসে আমাকে পূর্ণ করুন।”

“না না, আমি বসব না।”

আশ্চর্য হয়ে আওয়াদ বলে,

“কেন?”

“আসলে সত্যি কথাটা বললে আপনি হাসবেন তাই বলব না।”

“বলো কী সমস্যা?”

“আগে বলুন হাসবেন না।”

“আচ্ছা হাসবো না, এবার বলো।”

“লোকলজ্জায় বলা হয়নি কখনো আমি দোলনায় উঠতে পারি না আমার মাথা ঘুরায়। ”

আওয়াদ তোহফার কথায় চোখ মোটা করে তাকায়। এই মেয়ের বেলকনিতে দোলনা আর সেই কিনা দোলনায় উঠে না আশ্চর্য। আওয়াদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

“সত্যি তুমি দোলনায় উঠতে পারো না।”

“না।”

” তাহলে এই দোলনা।”

“এটা আমার শখ।”

“আল্লাহ কি বলো এটা!”

“হ্যাঁ সত্যি বলছি।”

“কবে এই শখ মনে বাসা বাঁধল।”

“ক্লাস সিক্সে।”

“এই তোহফা তুমি কখনো কেঁদেছ?”

“মনে পড়ছে না।”

“তোহফা…”

“হুম।“

” একটা কথা বলব।”

“বলেন।”

“না থাক। একটা গান শুনাবে তোহফা।”

আওয়াদের আবদারে তোহফা চোখ তুলে তাকায় তবে তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারে না, সময় নিয়ে উত্তর দেয়,

“যদি কেউ শুনাতে চায় আমি শুনতে রাজি তবে আমি গান গাইতে পারি না।”

তোহফার কথা শেষ হতেই আওয়াদ গুনগুন সুরে গেয়ে ওঠে,

“দেখো আলোয় আলো আকাশ, দেখো আকাশ তারায় ভরা! দেখো যাওয়ার পথের পাশে ছুটে হাওয়া পাগল পারা, এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা তোমায় ছাড়া। ভরে থাকুক তোমার মুঠো দুই চোখে থাকুক ধারা। এলো সময় রাজার মতো হলো কাজের হিসেব ছাড়া….

” কী বলছেন এসব।”

তোহফা আওয়াদের মুখ চেপে ধরল। তোহফার হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে তোহফার হাত চুমু খায় আওয়াদ। তোহফা শিউরে ওঠে। চোখ বুজে অনুভব করে আওয়াদের স্পর্শ। আওয়াদ তোহফার বন্ধ হওয়া পল্লব জোড়ায় হাত বুলিয়ে বলে,

“সত্যি তোহফা এত আনন্দ আয়োজন সবই বৃথা তোমায় ছাড়া। এই আমি টাও হয়তো তুমি ছাড়া বৃথা।”

ইন শা আল্লাহ চলবে…..

অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ।