অতঃপর গল্পটা তোমার পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
1

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার
সমুদ্রিত সুমি
২০ শেষ পর্ব।

তৌসিফ প্রশ্ন চোখে তাকাতেই রাব্বি বলল,

“আপনাদের বাড়ির ছোট বউ ওরফে লিমা হচ্ছে এসব মাস্টার প্ল্যানের মাথা।”

সকলেই তখন অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় লিমার দিকে। লিমা তখনো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। নিজেকে নির্দোষ বা ভালো বলার তাড়া তার মাঝে নেই। তখনই রাব্বি হোসেন আবারও বলে,

“আপনারা জানতেন লিমার বড় ভাই এক্সিডেন্টে মারা গেছে। কিন্তু কখনোই জানতে চাননি সে আসলে কবে এবং কোন এক্সিডেন্টে মারা গেছে। মিস্টার তৌসিফ আপনার বন্ধুর ভুলের শাস্তি তাকে দিতে না পারলেও আপনি তাকে কেন আইনের আওয়াতায় আনেননি এই ভুলের শাস্তি আপনাকে পেতে না হলেও আপনার বোনকে পেতে হয়েছে। সেদিন আপনার বন্ধু যার শরীরের উপর থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলো সে আর কেউ না লিমার বড় ভাই। বাকিটা নিশ্চয়ই আমাকে আর খুলে বলতে হবে না। আসলে সে আপনাদের সুখ কেঁড়ে নিতে চেয়েছে। তাই আপনাদের সুখকেই সে টার্গের করেছে। আপনাদের পরিবারের সুখ তোহফা ছিলো৷ তাই সে তোহফাকেই পথ থেকে সরিয়ে ফেলেছে।”

সময়টা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিবারেের প্রতিটা মানুষের কন্ঠনালিতে যেন কেউ বিষ ঢেলে দিয়েছে এমন জ্বালা করছে। চোখের পাতা স্থীর। অনবরত সেখান থেকে বৃষ্টির ন্যায় নোনাজল গড়িয়ে পরছে। অতিশোকে যেমন মানুষ পাথর হয় তেমনই তাদের অবস্থা। আচমকা তৌহিদ ছুটে গিয়ে লিমার গলা চেপে ধরে,

“কালনাগিনি, ওরে বিশ্বাসঘাতক। আমার খেয়ে আমাদের এতবড় সর্বনাশ করলি। তোকে তো আজ খুন করেই ফেলবো। প্রতিশোধ নেওয়ার স্বাদ একদম মিটিয়ে দেবো। তোর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আমার বোনটা তোর জন্য কি কি করেনি। আমার বোনটা তোকে বড়বোনের মতো ভালোবেসেছে আর তুই কিনা আমার বোনকে শেষ করে দিলে। এই বেঈমান কীভাবে কীভাবে পারলি তুই আমার বোনটার সাথে এতবড় অন্যায় করতে। আজকে তো তোকে আমি একদম শেষ করে দিবো।”

তৌহিদের চোখ থেকে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। ওই চোখ দিয়েই যেন আজ লিমাকে সে মেরে ফেলবে। লিমার দম আঁটকে গেছে। চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেছে। হাত পা ছোটাছুটি করছে বাঁচার জন্য। ছুটফট করছে গলা কাটা মুরগীর ন্যায়। তবে আজ যেন তৌহিদের শরীরে অসুরের শক্তিভর করেছে। পারলে সে সেকেন্ডের মাঝেই লিমাকে মেরে ফেলে। রাব্বি হোসেন, মামুন ছুটে তৌহিদকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তবে দু’জন পুলিশ অফিসার সাধারণ একজন মানুষের কাছে আজ শক্তিতে পারছে না। কয়েক মিনিট ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তারা লিমাকে ছাড়াতে সক্ষম। তবে এরমধ্যে তৌসিফ, আওয়াদ বা আরিফুল ইসলাম কেউ নিজেদের জায়গা থেকে উঠলেন না। ইলা তো পাথর হয়ে শুধু চোখের জল বিসর্জন দিতে রয়েছে। এক ছাদের নিচে এই মেয়েটার সাথে ছিলো অথচ এই মেয়েটা কিনা পরিবারের সুখে হাত বাড়িয়েছে তারা টের পেলো না। হায় আল্লাহ মানুষ এতটাও হিংস্র হয়৷ হয় বোধহয় যার জলজ্যান্ত প্রমাণ লিমা নিজে। রাব্বি কনস্টেবল কুসুমকে ইশারা করলো লিমাকে নিয়ে যেতে। কুসুম এগিয়ে লিমাকে নিয়ে যায়। লিমা নির্বাক। গলা ধরে কাশতে কাশতে সে বেরিয়ে যায়। আচমকা দরজার কাছে গিয়ে পিছু ফিরে। খুব শান্ত স্বরে বলে,

“কারো পরিবারের সুখ কেঁড়ে নিলে ঠিক কতটা কষ্ট হয় এখন বুঝতে পারছেন তো আপনারা? সেদিন তৌসিফ ভাইয়া আপনার ভুলের জন্য আমার ভাইকে অকালে চলে যেতে হয়েছে। আমাদের জীবনের সুখ কেঁড়ে নিয়েছেন। আমার মা আজ পরকীয়ায় আসক্ত। আমার বাবা আজ বিছানায় মিশে আছে। তাই আমি চেয়েছি আপনাদেরও সুখ ধ্বংস করতে। আজ আপনার ভুলের জন্য আপনার বোনের এই অবস্থা। আমি পেরেছি আপনাদের সুখ কেঁড়ে নিতে। আমার পরিবারটা যেমন ভেঙে গেছে আজ তেমনি আপনাদেরকেও ভেঙে দিলাম। আজ আমি ভিষণ খুশি।”

লিমার কথায় সকলেই নির্বাক। ঠান্ডা মাথায় পুরো গেমটা খেলে গেলো অথচ কেউ টের পেলো না। সকলের মুখে কোনো শব্দ নেই। সবাই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। রাব্বি হোসেন কুসুমকে আবারও ইশারা করলেন লিমাকে নিয়ে যেতে সাথে মামুনকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এবং শেখর তোহফার পরিবারকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালে। টানা দেড় ঘন্টার পথ অতিক্রম করে তারা হাসপাতালে পৌঁছালেন। ঘড়িতে তখন সকাল দশটা পঁচিশ মিনিট৷ তিনতলায় পৌঁছাতেই রাব্বি হোসেনের ফোনটা বেজে উঠলো। তিনি ফোনের স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই বুঝলেন কে ফোন করেছে। তিনি ফোনটা কেটে দিয়ে ইমারজেন্সি রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানেই দেখা হয়ে গেলো আরেক অফিসারেরে সাথে। সোহেল স্যারকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন,

“স্যার আমি আপনাকেই ফোন করছিলাম।”

সোহেলের কথায় রাব্বি চুপ করতে ইশারা করে।

“ওরা ভিক্টিমের পরিবার। চলো আমার সাথে। ”

আওয়াদ, তৌসিফ, আরিফুল ইসলাম ক্ষুদ্র পায়ে হাঁটছেন। বুকটা ধক ধক করছে এই ভেবে ভেতরে গিয়ে ঠিক কতটা ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। তোহফার অবস্থা ঠিক কতটা শোচনীয়। আওয়াদ এই মুহূর্তে শুধুমাত্র তোহফার সুস্থতা কামনা করছে। ওর পরিবারও সেটাই চাইছে। তৌসিফ বোনের ওই নৃশংস ঘটনার কথা কীভাবে ভুলবে যা তার ভুলের জন্য হয়েছে। তৌহিদও বা কীভাবে মানবে তার ভালোবাসার মানুষটির কথাতেই তার ছোট্ট আদরের বোনটার আজ এই করুণ পরিস্থিতি। একজন বাবাও বা কীভাবে দেখবে রোজ খবরে পরা হাজারো অসহায় মেয়েদের মতো আজ তার মেয়েও এক নরপশুর খাদ্যের শিকার হয়েছে। অফিসার রাব্বি ভাবছে, এমন একটা ফুটফুটে মেয়ে ঠিক কীভাবে একজনের প্রতিশোধের তোপে ছিলো। ফুটফুটে মেয়েটার ছোট শরীরটা ঠিক কতটা যন্ত্রণা পেয়ে কাতরাচ্ছে ওই ছোট্ট বেডে শুয়ে। যে চোখে হাজারো স্বপ্ন ছিলো সেই চোখে আজ ভয়। যে হাত ধরে বাবা-ভাইয়ের এবং জীবন সঙ্গীর সাথে ছোটাছুটি করেছে সেই হাতে ভয়াবহ আঘাত করা হয়েছে। I.C.U রুমের সামনে এসে সকলেই দাঁড়ায়। তখনই ভেতর থেকে আকাশী রঙের পোশাক পরিধান করা একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসে। রাব্বি হোসেনকে দেখে তিনি তার মুখের মাক্স খুলে ফেলেন। শব্দ করে শ্বাস টেনে নিয়ে আবারও ছাড়েন। এবং ছোট্ট করে বলেন,

She is no more…..

ছোট্ট তিনটি শব্দ। সে আর নেই। অথচ এতটা ভয়াবহ ভাবে এই শব্দ তিনটি আঘাত আনলো যে সাথে সাথেই আরিফুল ইসলাম ফ্লোরে পরে গেলেন। তৌসিফ, তৌহিদ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের ওই ঠোঁটের দিকে। আসলে তারা বোঝার চেষ্টা করছে ডাক্তার ঠিক কি বলেছে। সে আর নেই। কে নেই? তাদের বোন? তাদের বোন আর নেই। ফাজলামো নাকি নেই বললেই কি নেই হয়ে যায় নাকি। একদম না তাদের বোন আছে এবং ভালো আছে। এখনি ভেতর থেকে কেউ ছুটতে ছুটতে আসবে এবং বলবে স্যার রোগীর হার্টবিট পাওয়া গেছে। সে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ খুলে তাকিয়ে। কিন্তু তাদের এই ভাবনা সত্যি হলো না। ভেতর থেকে কেউ এলো না। কাকতালীয় বলতে কোনো ঘটনা তাদের সাথে ঘটলো না। আওয়াদ নিঃসাড় হয়ে কিছুক্ষণ অফিসারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আমার এখন কি করা উচিত বলবেন অফিসার? আমার কি আমার স্ত্রীর শোকে পাগল হওয়া উচিত! নাকি এই হাসপাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার করে আল্লাহর নিকট আর্জি করা উচিত তাকে ফিরে পাবার। আমার ঠিক করা উচিত অফিসার।”

রাব্বি, সোহেল এবং ডাক্তার ইউনূস পরলেন দোটানায়। আসলে তারা বুঝতে পারছেন না তারা কাকে রেখে কাকে সামলাবেন। বাড়ির মহিলাদের না-হয় সামলানো যায় কিন্তু পুরুষকে কীভাবে সামলানো যায়! তাও আবার চার চারজন শক্তিমান পুরুষদের। তবুও তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করলেন। তবে আশ্চর্য জনক ভাবে মিনিট সাতেক পর আওয়াদ উঠে বসলো। সে অফিসারকে বলল,

“আমি আমার স্ত্রীর কাছে যেতে চাই।”

রাব্বি মাথা দোলালেন। ডাক্তারকে ইশারা করতেই আওয়াদকে নিয়ে যাওয়া হলো। আওয়াদ গুটিগুটি পায়ে যখন তোহফার লাশের কাছে এসে দাঁড়ালো, পৃথিবী যেন সেখানেই তার থমকে গেলো। এত সুন্দর ধরণী অন্ধকারের রূপ নিলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস যেন আওয়াদের নিতে কষ্ট হতে থাকলো। মনে হলো তার দম বুঝি এখনি বন্ধ হয়ে যাবে। এত কষ্ট এত ব্যথা কীভাবে সইবে সে৷ গতকাল এই সুন্দর পৃথিবীতে তোহফা নামের মেয়েটা নিশ্বাস নিয়েছিলো। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটার বরাদ্দকৃত নিশ্বাস ফুরিয়ে গেছে। আহহ পৃথিবী তুমি কতো নিষ্ঠুর। একটা সহজ-সরল মেয়েকে ঠিক কতটা ভয়াবহ কষ্ট দিয়ে নিয়ে গেলে। এতটা কঠিন না হলেও তো তুমি পারতে। এত কঠিন হয়ে তুমি কি প্রমাণ করলে তুমি সুখি মানুষকে এভাবেই কষ্ট দাও। সাদা বর্ণের চাদরটা নার্স সরিয়ে দিতেই ছিন্নভিন্ন মুখটা ভেসে উঠলো। গোলাপি ঠোঁট কালো হয়ে আছে। মুখে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। চোখের কোণায় সাদা জলের ছাপ। আহহ কতটা কষ্ট পেয়ে তোহফা পৃথিবী ত্যাগ করলো। এতটাই কষ্ট পাবে বলেই বুঝি কষ্ট কখনো ওকে ছুঁয়ে দেখেনি৷ এতটা নির্যাতিত হয়ে এই ধরণীর বুক খালি করবে বলেই গোটা পরিবার তাকে একটা ফুলের টোকা অবধি দেয়নি কখনো। যত্ন করে পোষা পাখির ন্যায় আদরে রেখেছে। যার আবদার রাখার জন্য সর্বদা প্রতিটা মানুষ হাজির আজ তার মৃত মুখ দেখার… আওয়াদ হাতটা বাড়িয়ে তোহফার গালে হাত ছোঁয়াল। শরীর এখনো গরম। তবে দেহে প্রাণ নেই। প্রাণ পাখি উড়াল দিয়েছে। আহহ কি নিদারুণ নিষ্ঠুর সেই দৃশ্য যা দেখে কঠিন মনের রাব্বিও চোখের জল ফেললো। আওয়াদ নিচু হয়ে তোহফার কানে কানে বলল,

“আমাদের দু’জন থেকে তিনজন হবার আগেই তুমি আমাকে একা করে দিলে তোহফা এই কষ্ট আমি কাকে বলবো। এই ব্যথা আমি কীভাবে সইবো। আমাদের যে হতে চলা সংসারটাও হয়ে ওঠেনি। আমাদের জোসনা বিলাস করা হয়নি। আমাদের হাজারো স্বপ্ন যে তুমি ধূলিসাৎ করে আমাকে একা করে চলে গেলে। তোহফা সেদিন তো জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি শেষ কবে কেঁদেছিলে! কিন্তু সারাজীবনের জন্য আমাদের কাঁদিয়ে যাবে জানলে কখনোই এই কথা জিজ্ঞেস করতাম না৷ এতটা নিষ্ঠুর তো তুমি নও তোহফা তাহলে এতটা কঠিন হয়ে কেন এখন ঘুমিয়ে আছো। ওরা তোমাকে এত কষ্ট দিলো যে তুমি আর আমি অবধি পৌঁছাতে পারলে না। ওপারে অপেক্ষা করো তোহফা আমার জন্য। এপাড়ে না হলেও ওপাড়ে না-হয় আমাদের না-হওয়া সংসারটা পূর্ণ করবো। অপেক্ষা করবে তো তোহফা আমার জন্য। তোমার আওয়াদের জন্য। তোমার একমাত্র শখের পুরুষের জন্য। এতটা শান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে আছো অথচ দগদগে দাগ গুলো আমাদের জন্য রেখে গেলে তোহফা। একটু কথা বলো তোহফা, এই তোহফা তোমার আওয়াদ তোমার সাথে কথা বলতে চায়। তোমার আওয়াদ তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবে? তোমার বাবা ভাইয়েরা কীভাবে সামলাবে নিজেদের। তাদের পরিবারের একমাত্র সুখের অঙ্কুরের শেষ কীভাবে তারা দেখবে। এই তোহফা এতটা নিষ্ঠুরতম মানুষদের মাঝে তুমি থেকো না। তুমি তো আমাদের নরম মনের তোহফা। আহহ তোহফা কথা বলো। তোহফা রে এই তোহফা কথা বলো না। কেন চুপ করে আছো। ওরা তোমাকে এত কষ্ট দিলো একটু কষ্ট আমাকেও দিতো তোমাকে কষ্ট কম দিয়ে। আমরা সবাই তোমার কষ্ট ভাগাভাগি করে নিতাম তোহফা তবে তোমাকে কেন এতো কষ্ট পেতে হলো। তোহফা রে ও তোহফা কথা বলো, আমার তোহফা কথা বলো, তোহফা কথা বলো!…..

“মিস্টার আওয়াদ আপনার শ্বশুর হার্টঅ্যাটাক করেছেন। তিনি মারা গেছেন মিস্টার আওয়াদ আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন মিস্টার আওয়াদ? মিস্টার আওয়াদ……

তীব্র চিৎকারে ইজিচেয়ার থেকে ধরফরিয়ে উঠে বসে আওয়াদ। বৃদ্ধি শরীরটা সামলে উঠতে পারেনি আচমকা উঠে বসাটা। তাই তো শরীরটা অসম্ভব কাঁপছে। কিঞ্চিৎ সময় নেয় সে কোথায় বোঝার জন্য। কয়েক মিনিট পর সে বুঝতে পারে সে তার অফিসে বসে আছে। এতক্ষণ চিৎকার করে তার এসিস্ট্যান্ট আকবর আলী তাকে ডাকছিলো। দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা মনে করতে করতেই সময় কখন শেষ হয়ে গেছে তা আওয়াদ বুঝতে পারেনি। অফিস ছুটি হয়ে গেছে আরো ঘন্টা কয়েক আগেই। হয়তো আওয়াদকে নিজের কেবিন থেকে বের হতে না দেখেই আকবর এসেছে তাকে ডাকতে। আকবর কি জানে আওয়াদ তার ফেলে আসা অতীতে পদার্পণ করেছিলো। হয়তো জানে না, জানলে নিশ্চয়ই এভাবে চিৎকার করে ডাকতো না। আওয়াদ তার ভারি শরীরটা টেনে নিয়ে যায় ডেস্কের দিকে। কালো ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে লাঠিটা হাতে তুলে নেয়। সেই শক্তপোক্ত শরীরটা ভেঙে গেছে। বয়সটা সাতাশ থেকে ছাপান্নতে থেমেছে। মনের কষ্ট ভুলে থাকার জন্যই কাজের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে রাখে। নতুন করে তার জীবন সংসার সাজানো হয়নি। তোহফার মৃত্যুর সংবাদ শুনে সেই যে ফ্লোরে পরেছিলো তার শ্বশুর আর উঠে দাঁড়ায়নি। বাবা এবং মেয়েকে একই দিনে পাশাপাশি মাটি দেওয়া হয়েছে। মেয়ে এবং স্বামী হারোনোর শোকে জাহানারা বেগম মানুষীক ভারসাম্য হারিয়ে বেঁচে ছিলেন মাত্র নয় মাস। তৌহিদ বোনকে এবং বাবাকে দাফন করে সেই যে ঘর ছাড়লো আর কখনোই ফিরে আসেনি। তৌসিফ ও ইলা বেঁচে আছে বেঁচে থাকতে হবে বলেই। যে সুখবরটা সর্বপ্রথম তোহফাকে জানানোর কথা ছিলো! সেই সুখবরটা দুঃসংবাদে পরিণত হয় তোহফার মৃত্যু সংবাদের সাথে সাথেই। হ্যাঁ ইলার মিসক্যারেজ হয়েছে। ইলার ওটাই প্রথম এবং সেটাই শেষ প্রেগন্যান্সি ছিলো। স্বামী স্ত্রী একটা এতিমখানা খুলে সেখানে হাজারো বাচ্চার বাবা-মা হয়েছে। লিমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। তার খোঁজ কেউ নেয়নি। হয়তো ঘৃণায় আর নেওয়া হয়নি। যে পরিবার তাকে এত দিলো সেই পরিবারটা ধ্বংস করে সে হয়তো সাময়িক সুখি হতে পেরেছে তবে বিবেকের কাঠগড়ায় সে কীভাবে নিজেকে দাঁড় করাবে সে কি কখনো তা ভেবেছে? ভাবেনি হয়তো। ভাবলে এতবড় জঘন্য কাজ নিশ্চয়ই করতে পারতো না। আওয়াদ সে ভালোই আছে। কারণ প্রতি পূর্ণিমার রাতে তোহফা তার সাথে দেখা করতে আসে। আজকে সেই দিন। আওয়াদ চশমটা চোখে দিয়ে অফিস-রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেই আকবর বলে,

“স্যার আজ-ও ওখানে যাবেন?”

“হ্যাঁ, তোমাদের মেডাম আসবে তো। না গেলে আবার ভিষণ রাগ করবে।”

আওয়াদ হাসতে হাসতেই বেরিয়ে যায়। সময়টা তখন রাত ন’টা। একটা রিক্সা নিয়ে চলল সেই ঝিলের পাড়ে যেখানে প্রথম তাদের ভাব বিনিময় হয়েছিলো। যেতে যেতে প্রায় ঘন্টা কয়েক সময় লাগলো। শহরের এই জ্যামে ভরা রাস্তা পৃথিবীর অন্যতম বিরক্তিকর জায়গা। আওয়াদের হাতে আজ বেলি ফুলের মালা। আওয়াদ টুকটুক করতে করতে ঝিলের পাড়ের ছোট্ট একটা বেঞ্চিতে এসে বসে। দূর দুরান্তে চোখ বুলায়। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় চিকচিক করা জল দেখে। চাঁদের আলোয় জল যেন হিরের মতো চকচক করছে। এই সৌন্দর্য যেন হার মানবে কোনো পাহাড় কিনবা ঝর্ণার কাছে। আচমকা শীতল হাওয়া বয়ে গেলো আওয়াদের পিঠে। পিছন ফিরতেই তোহফাকে সে দেখতে পেলো। সাদা রঙের শুভ্র শাড়ি পড়েছে তোহফা। ফুরফুরে হাওয়ায় চুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে। চোখেমুখে লেপ্টে আছে আনন্দের অনুভূতি। খোলা চুলে আজও আওয়াদ তোহফার প্রেমে পরে। ভালোবাসা, অনুভূতি সেই আগের মতোই! শুধু মানুষটা আজ আর আগের মতো নেই। মানুষটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বুকভরে শ্বাস টেনে ছেড়ে দিয়ে আওয়াদ মুচকি হেঁসে বলল,

“এসে গেছো তোহফা?”

তোহফা মুখ ভার করে বলল,

“ধরে ফেললেন আজও?”

আওয়াদ তোহফাকে গাল ফোলাতে দেখে বলে,

“এরপরের বার থেকে বুঝলেও কথা বলবো না ঠিক আছে?”

“আপনি প্রতিবার এই কথাই বলেন! কিন্তু সামনে এলেই আপনি ঠিক আমার উপস্থিতি বুঝে ফেলেন।”

“আজ এত দেরি করে এলে যে?”

“আপনার মতো ওতো সময় মেপে আসতে পারি না বাপু। আমি তো আপনার মতো পাগল নই।”

“সে তো আমি জানি।”

“জানেন যখন তাহলে জিজ্ঞেস কেন করেন?”

“ভালো লাগে। তোমার সাথে কারণে অকারণে কথা বলতে আমার ভালো লাগে তোহফা। একটা দিন আসো। তাও হাতে অল্প সময় নিয়ে। যেটুকু পাই তাতে মন ভরে না কথা বলে। তুমি জানো এই একটা দিনের অপেক্ষায় আমার গোটা দিনগুলোতে ঘুম আসে না। এই একটা দিনের অপেক্ষায় আমার দীর্ঘ বছরের মতো লাগে।”

“আপনি না সত্যিই পাগল।”

“সত্যিকারে পাগল হলাম কই। দিব্যি তো তোমায় ছাড়া হাঁটছি, খাচ্ছি প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।”

“রোজরাতে যে পাগলের মতো বালিশ ভিজিয়ে কান্না করেন সে কি আমি জানি না বলে ভাবছেন?”

“জানোই যখন তাহলে দূরে কেন? আমাকে কাছে টেনে নিচ্ছো না কেন? আর বিরহ সহ্য হচ্ছে না। আর পারছি না। এবার এই বিষাক্ত বাতাস থেকে আমাকে মুক্তি দাও।”

“সময় হোক তখন না-হয় নিয়ে যাবো।”

“আসো তো কাছে আসো! তোমার খোলাচুলে বেলিফুলের মালা গুঁজে দেই।”

তোহফা এগিয়ে আসে। যত্ন করে তোহফার চুলে মালা গুঁজে দেয়। তোহফা আওয়াদের কাঁধে পরম শান্তিতে মাথা রাখে। আওয়াদ তোহফার হাতদুটো আগলে নিয়ে বলে,

“ জানো তোহফা! তুমি চলে আসার পর আমাদের গল্পটা আর বড় হয়নি। যে গল্পটা তুমি শেষ করেছিলে সেটা সেখানেই থেমে আছে। আর কেউ লিখেনি।”

“আপনি আর আমি মিলে তারপর না-হয় একসাথে লিখতে বসবো। গল্পের শুরু এবং শেষ।”

“শেষ তো তুমিই করেই দিলে। নতুন করে আর শেষ হবার নেই।”

“ওভাবে বলছেন কেন! এই দেখুন এই আঘাতের চিহ্ন আমাকে আপনার থেকে দূরে নিয়ে গেছে। আমার এখনো আপনার কাছে আসতে দ্বিধা করে! পাছে যদি আপনি আমায় ঘৃণা করেন।”

“ওভাবে বলো না তোহফা, তুমি আমার কাছে সর্দফোঁটা কামিনীফুলের মতোই, শুভ্র এবং পবিত্র। ও কথা বলে আমার পাপের বোঝা বাড়িয়ে দিও না। আমার মনে হয় সেদিন আমার জন্য……

আওয়াদ হু হু করে কেঁদে ওঠে। তোহফা যত্ন নিয়ে আওয়াদের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,

“আপনাকে কাঁদলে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে আওয়াদ! মনে হয় আমি পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার কান্না মুছে দিচ্ছি।”

আওয়াদ হেঁসে তোহফাকে বুকে আগলে নেয়। আবারও একা একা কথা বলতে থাকে আওয়াদ। দেখতে পায় পাশেই তার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে তোহফা। অন্যদিকে পেছন থেকে এমন দৃশ্য দেখে চোখের জল মুছে আকবর। স্যারের পিছু সে প্রতিবার আসে। স্যারের এই একা একা বলা কথাগুলোও সে নীরবে শুনে যায়। প্রতিবার তার কান্না পায় এবং সে কাঁদে। বাড়িতে ফিরে এই পাগল প্রেমিকের কথা তার স্ত্রীকে শোনায়। তার স্ত্রী প্রথম প্রথম আগ্রহ নিয়ে শুনলেও এখন কেন জানি বিরক্ত প্রকাশ করে। হয়তো আকবরের মতো সামনে থেকে দেখে না বলেই তার এত বিরক্ত। কই আকবরের তো বিরক্ত লাগে না। তার তো প্রতিবার এই দৃশ্য দেখলে কান্না পায়, যেমন এখনো পাচ্ছে। একটা মানুষের মৃত্যু অথচ কতগুলো গল্পের সমাপ্তি হলো। একজন মানুষ যে একাই অনেকগুলো গল্পের ইতি টানলো৷ সকল মানুষের গল্প একটা মানুষের মাঝেই আঁটকে। অতঃপর গল্পটা তোহফা নামের মেয়েটার। যে চলে যাবার সাথে সাথেই সব গল্পের ইতি হয়েছে। আওয়াদ বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ালো। কারণ তার কল্পনার রাজ্য থেকে তোহফা আপাতত বিদায় নিয়েছে। হয়তো নতুন পূর্নিমায় তাদের আবারও দেখা হবে, কথা হবে। ভাব বিনিময় হবে, হবে অনুভূতি প্রকাশ করা স্বপ্ন। হাঁটতে হাঁটতেই আওয়াদ বিরবির করলো, অতঃপর গল্পটা যে তোমার হয়েই রইলো। অতঃপর গল্পটা তোমার তোহফা।

সমাপ্তি