অতঃপর প্রণয় পর্ব-০১

0
547

#অতঃপর_প্রণয়
#তাফসিয়া মেঘলা
#সূচনা

বিয়ের বরের ভেসে শেরওয়ানি পরে রেলওয়ে স্টেশন এ দাঁড়িয়ে আছে কাউন্সিলর পূত্র শোভন৷ হাতে জলন্ত সিগারেট৷ গুরোগম্ভীর হয়ে আছে৷ রাগে কিছুক্ষণ পর পর ফোস করে উঠছে৷ মাঝ রাস্তায় গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে৷ গাড়ি ড্রাইভারের কাছে রেখেই স্টেশনে এলো ভেবেছে ট্রেন পাবে৷ কিন্তু আসতে আসতে ট্রেইনটা ও চলে গেলো৷
পায়চারি করছে শোভন, মাঝে মাঝে রাগী ভঙ্গিতে সিগারেট ফুকছে৷ আরেক হাতে ফোন বার বার কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে৷
পুরো রেলস্টেশন টা পিনপতন নিরবতা খুব একটা মানুষ নেই বললেই চলে৷ অদুরে কয়েকজন ভিক্ষুক ঘুমিয়ে আছে৷ কয়েকজন গোল হয়ে জুয়া খেলছে৷

এর মাঝেই বেশ হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে প্রবেশ করলো কেউ, শোভন বিরক্ত ভঙ্গিতে কিঞ্চিৎ সে দিকে তাকালো৷ একটা মেয়ে দৌড়ে এসেছে পরনে শাড়ি, আর শরীরে শাল৷ হাতে গিটারের মত কিছু একটা আছে আর লাগেজ৷ একটা মেয়ে এত রাতে এখানে কি করছে?
আজকালের মেয়েরাও বটে৷ এদের বাড়িতে কি বাবা মা নেই? আশ্চর্য৷ মেয়েটার মুখশ্রী এখনো দেখেনি মাস্ক পরনে৷ অতঃপর ফের নিজের কাজে ব্যাস্ত হলো৷

মেয়েটা লাগেজ টেনে এলো এদিকটায়৷ বেশ খানেক দূরত্ব নিয়েই দাঁড়ালো কয়েকবার এদিক ওদিক তাকিয়ে উশখুশ করতে করতে প্রশ্ন ছুড়লো আমতা আমতা করে,
“”ট্রেন চলে গেছে?”
আশ্চর্য রকম প্রশ্ন মেয়েটা কি সময় দেখেনি নাকি? অদ্ভুত৷ রাগ হলো শোভনের৷ এমনি ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বেশ রেগে আছে৷
শোভন ক্ষানিকটা দাতে দাত চেঁপে বললো,
“এখন কয়টা বাজে?”
মেঘলা ক্যাবলাকান্তের মত হেসে উঠলো৷ শোভনের হাতের দিকে ইশারা করে বললো,
“ঘড়ি তো আপনার হাতে৷ ”
ভ্রু কুঁচকে তাকালো শোভন৷ তপ্ত শ্বাস টেনে বিরবির করলো “রিডিকিউলাস এখন নিশ্চয়ই ট্রেন বসে থাকবে না?”

মেঘলা ভরকালো খানেক৷ যাক বাবা লোকটা কথা বলছে না কেন? মাথা চুলকালো অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে মেঘলা৷
লোকটা ভালো তো? চোর ডাকাত নয়তো৷ ভাবতে ফের তাকালো মেঘলা৷ সামনেই একটা বেঞ্চি লাগেজ আর নিজের গিটার টা নিয়ে সে দিকে গেলো৷ আড়ষ্ট হয়ে তাকালো লোকটির দিকে৷
উহু চোর ডাকাত বা নেশাখোর তো মনে হচ্ছে না৷ হাতে ব্রান্ড এর ঘড়ি৷ সাজপোশাক ও বেশ দামি ফোনটা ও এপ্যাল ব্রান্ড এর৷ নাহ! মাতাল টাতাল না৷ ভাবতে ভাবতে পা উঁচিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসলো মেঘলা৷ বেশ সময় কাটলো ট্রেনের দেখা মিললো না৷ ঘন্টাখানেক পার হলো সেই সুঠাম দেহের অধিকারী অচেনা পুরুষ টি এখনো দাড়িয়েই৷ মোবাইলে ডুবে আছে৷ মেঘলা এবার উঠলো খানিকটা হেটে রেললাইন এর সামনে এগোতে এগোতে বললো,
“আপনি কি ঢাকা যাবেন?”

লোকটা উত্তর দিলো না৷ অন্য দিকে চলে গেলো৷ মেঘলা নিরাশ হলো৷ কিঞ্চিৎ ভয় ভয় কাজ করছে৷ যতই হোক অচেনা একটা লোক৷
সামনে থাকা লোকটার ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো মেঘলার চঞ্চল মন৷ কিন্তু বুঝলো না৷ সে তো আর মনোবিজ্ঞানী না সব বুঝে যাবে৷
কেন যে এত রাত করেই রেহানার বাড়ি থেকে বের হতে গেলো৷ কিন্তু না বের হয়েই বা উপায় কি ছিলো? সেখানেও তো একটা কেলেংকারী ঘটতে যাচ্ছিলো৷

লোকটার এরুপ আচরণ দেখে মেঘলা আশ্চর্য বনে গেলো৷ যাক বাবা মানুষের সাথে কেউ এমন আচরণ করে? অদ্ভুত লোক৷ এদিকে মেঘলা ফের পায়চারি শুরু করলো৷ খানিক্ষন পর ফের থামলো৷ অদুরে শুয়ে থাকা একটি মধ্যবয়সী লোক ঘুম থেকে উঠলো৷ উঠে হেলতে দুলতে কেমন এ দিকেই আসছে৷ শুকনো ঢোক গিললো মেঘলা৷ সে মারামারিতে বেশ এক্সপার্ট তবে তা বন্ধুদের সাথে থাকলেই এখন তো কেউ নেই৷ সে দিক তাকাতে তাকাতেই এগিয়ে এলো শোভনের দিকে৷ বুঝতে দিলো না কিছু এবং বললো না৷ স্বাভাবিক ভাবে আমতা আমতা করে শুধালো,
“আপনি কি এই গ্রামেই থাকেন?”

মোবাইল ফোন থেকে দৃষ্টি সরালো শোভন৷ এবার কন্ঠটা বেশ নরম৷ মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুতে ভয় পেয়েছে বা পাচ্ছে৷ শোভন তাকালো মেয়েটির দিকে দাতে দাত চেপে উত্তর দিলো,
“না!বিয়ে করতে এসেছিলাম৷ ”
ফের ভরকালো মেঘলা৷ লোকটা কি বিরক্ত হয়ে এসব প্রশ্নের এমন উত্তর দিচ্ছে? তবে বিরক্ত হওয়ারি কথা৷ ও যা কথা বলছে৷ কিন্তু আদৌও কি চুপ থাকা যায়? এখন তো দু-জন একই পথের পথিক বলতে গেলে৷ সে ও ট্রেনের অপেক্ষায় ও নিজেও৷ একটু কথা বললেও কি খারাপ?
মেঘলা অসন্তুষ্ট হয়ে অন্য দিকে চলে গেলো৷ তবে শোভন যেন বুঝলো হাসলো কিঞ্চিৎ৷

তীব্র হাওয়া বইছে তখন ক্ষীণ বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, নভেম্বর এর শুরু সবে৷ তবে প্রকৃতির এ রুপ দেখে মনে হচ্ছে বৈশাখ এলো বোধহয়৷ সেই বেঞ্চিটায় বসলো মেঘলা৷ বিষন্ন এবং শূন্য নয়নে অপেক্ষারত হয়ে রইলো৷ একটা প্রবাদ আছে না? অভাগা যেখানে যায় সাগর শুকিয়ে যায়? তেমন হয়তো মেঘলার পরিস্থিতি? মা হীন পৃথিবী একটু অগোছালোই৷ উহু একটু না পুরোটাই৷

নিজের ভাগ্যে নিজে তাচ্ছিল্য হাসলো মেঘলা৷ দুঃখ যেন পিছু ছাড়ে না৷ সুখ হবে কবে তার? কবে মন খুলে শান্তিমত বাঁচতে পারবে?কবে তার দুঃখ গুলো ঘুচবে? ভাবতে ভাবতেই গিটার টা বের করলো ব্যাগ থেকে, এটা বেশ শখের টাকা জমিয়ে জমিয়ে কিনে ছিলো শখ করে৷ গিটার টায় হাত বুলিয়ে শাড়ির আচল দিয়ে মুছলো৷ টুংটাং শব্দ তুললো৷ এরি মাঝে বাতাসের বেগ দ্বিগুণ বাড়লো৷
শোভন এবার কৌতুহলী হলো, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পাশ ফিরে৷ মেয়েটা বেঞ্চিতে বসে গিটারে শব্দ তুলছে৷ অবাক হলো কিঞ্চিৎ৷ রাগ যেন বিগলিত হয়ে শুরু করলো এর মাঝেই গিটারের শুর যেন আরো সুমধুর ভাবে শুরু হলো এর সাথে বাতাসের ধ্বনি৷ আনমনে এগিয়ে গেলো সে দিকে৷ সাদা পাঞ্জাবীর উপর থেকে কারু কাজ করা শেরওয়ানিটা খুললো৷ এটা মূলত শেরওয়ানি বলা চলে না৷ সাদা পাঞ্জাবীর উপর বড় কোটির মত একটা কোট৷ মোবাইল টা পকেটে ঢুকালো৷

শোভন কে এগিয়ে আসতে দেখে থামলো মেঘলার হাত৷ ভ্রু কুঁচকে এলো শোভনের এর মাঝেই মেঘলা বিষন্ন গলায় বললো,
“ইশ আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম?”
ক্ষীণ ঠোঁট এলিয়ে হাসলো শোভন৷ মেয়েটা মন্দ না মনে হচ্ছে৷ তবে মেয়ে মানুষ বড়ই বিচিত্র শোভন বললো,
“মেয়ে আপনি বড্ড বেশি কথা বলেন৷ আপনাকে বলেছি আমি ডিস্টার্ব করেছেন? এটা আমার ঘর না পাবলিক প্লেস যার যা ইচ্ছে করবে৷ ”

মেঘলা মুখ ফুলিয়ে তাকালো৷ ফের নিজের কাজে মননিবেশ করলো৷ এর মাঝেই লোকটা সিগারেট ফুকতে ফুকতে বললো,
“মেয়ে মানুষ গিটার ও বাজাতে পারেন বাহ!”
পা নামিয়ে বসে হাসলো মেঘলা৷ নরম কন্ঠে বললো,
“কেন কোনো মেয়ে কে দেখেননি বুঝি? এটাতো আমার বেশ শখের৷ ”
তারপর কি মনে করে যেন সেই বেঞ্চের পাশের বেঞ্চিটিতে বসলো শোভন৷ মেঘলার হাত ফের টুংটাং শব্দ তুললো গিটারে৷
তারপর আকাশ যেন সব কিছু ভেঙে তান্ডব শুরু করলো৷ শুরু হলো বর্ষণ৷ বেশ কিছুক্ষণ সময় পার হলো বৃষ্টির তান্ডব বাড়লো যেন৷ কি যেন কি ভাবলো মেঘলা গিটার রেখে উঠলো৷ আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ছুটলো সামনের দিকে৷ শোভন পাত্তা দিলো না যা ইচ্ছে তাই করুক তার কি?

।।
লোকাল ওয়াশরুম গুলো নোংরা এত৷ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে শাড়ি ঠিক করছে মেঘলা এর মাঝেই হেলতে ধুলতে একটা মাতাল এসে দাঁড়ালো খানিকটা দূর৷ মাতালটা দেখে কিঞ্চিৎ আৎকে উঠলো মেঘলা৷ তাড়াহুড়ো করে স্থান ত্যাগ করবে তার আগেই লোকটা তার হাত চেপে ধরলো খপ করে৷ বিস্রি এক হাসি দিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কোথায় যাচ্ছো সুন্দরী? ”
গা ঘিন ঘিন করে উঠলো মেঘলার৷ রেগে বললো,
“এটা কেমন অসভ্যতামি৷ হাত ধরেছেন কেন?”
লোকটা বাজে ভঙ্গিতে বললো,
“অসভ্যতামির জন্যইতো হাত ধরেছি সুন্দরী৷ তুমিও তো এত রাতে অসভ্যতামির জন্যই এখানে এসেছো৷ ”
বলে আরেক হাত বাড়াতে যাবে মেঘলা ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে যাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে৷ লোকটার পেছনে আরো কয়েকটা লোক ও দেখা গেলো৷ এবার ভয় ঝেকে ধরলো মেঘলাকে৷ কি করবে এখন? লোক গুলো কে সুবিধার ঠেকছে না৷ এর মাঝেই পেছন থেকে একজন বললো,
“কিরে মামা নতুন শিকার পাইছিস নাকি?”
লোকটা হেসে উত্তর দিলো,
“এটা শিকার না মামা, মামনি এত রাতে নিজেই এসেছে আমাদের কাছে৷ ”
বলে টানটানতে বের করলো৷ মেঘলা চিৎকার করবে ঠিক তখনি মুখ চেপে ধরলো লোকটা৷ অনুভূতি শূন্য হয়ে রইলো মেঘলা এবার বুঝি শেষ রক্ষা হলো না আর….!!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

চলবে।