#অতঃপর_প্রণয়
#অরিত্রিকা_আহানা
#পর্ব:১৭
ইরিন জামাকাপড়ের ব্যাগ খুলে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ব্যাগের সব জামাকাপড় দলামোচড়া হয়ে আছে। এখন সে কি পরবে ? এখানে আসার আগে তাড়াহুড়োতে সব জামাকাপড় এলোমেলো করে ব্যাগে ঢুকিয়েছিলো। এখন ব্যাগ খুলতেই দেখলো সব কাপড় একেবারে দলামোচড়া হয়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। এদিকে সবাই মিলে শহরের মার্কেটে যাবে। যদিও বিয়ের শপিং সবার আগেই হয়ে গেছে তবুও মেয়েরা টুকটাক জিনিসপত্র কেনাকাটা করবে।
মার্কেট থেকে পার্লারে যাবে সবাই মিলে। মেয়েরা সবাই ফেসিয়্যাল করবে, মেনিকিউর, পেডিকিউর, চুল রিবোন্ডিং আরো কত কি? ইরিন আয়াজের কাছে থেকে পাঁচহাজার টাকা খসিয়েছে। আয়াজ প্রথমে দিতে চায় নি। এতগুলো টাকা শুধুমাত্র মুখের মাখামাখি আর চুলের কাটাকাটিতে চলে যাবে সে মানতে পারছে না। ইরিন বহুত জোরজবরদস্তি করে উদ্ধার করেছে। সবাই মার্কেটে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
কিন্তু ইরিন ব্যাগের দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। আয়াজ মাত্র বাজার থেকে এসেছে। বিছানায় ছড়ানো ছিটানো জামাকাপড়গুলো একসাইডে সরিয়ে ফ্যানের নিচে বসলো সে। ইরিনের কান্না পাচ্ছে। মার্কেটে কি পরে যাবে সে?
আয়াজ হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
—“সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। বসে আছিস কেন?”
—“আমি যাবো না।”
—“কেন?”
—“আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”
আয়াজ বুঝতে পারছে না তার কাছে থেকে জোর করে টাকা হাতিয়ে নেবার পরে হঠাৎ ইরিনের মতিভ্রম হলো কেন?
—“টাকা কি আরো লাগবে? মানিব্যাগে আছে নিয়ে যা।”
—“আমি যাবো না।”
—“কেন যাবি না কেন?”
—“আমার ইচ্ছে।”
আয়াজ ফ্রেশ হতে চলে গেলো। এই মেয়ের কখন কি খেয়াল উঠে সে নিজেও জানে না। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে এসে ইরিনকে আগের মতই চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ইরিনের কাছে এসে দাঁড়াল।
—“কি হয়েছে তোর?”
—“কিছু হয় নি।”
—“ইরিন এবার কিন্তু আমার হাতে মার খাবি?”
—“আমি বলেছি না কিছু হয় নি? আপনি আপনার কাজ করুন না। আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন?”
ইরিন হনহন করে বেরিয়ে যেতে নিলো। আয়াজ তার হাত চেপে ধরে বললো,
—“কি হয়েছে আমাকে বলবি তো? কেউ কিছু বলেছে?”
—“না।”
—“তাহলে?”
ইরিন তার জামাকাপড়ের দিকে ইশারা করে বললো,
—“আমার সব জামাকাপড় কুঁচকে গেছে। এই কুঁচকানো জামাকাপড় পরে আমি যাবো কি করে?”
—“আয়রন করে নিলেই তো হয়।”
—“এখন আয়রন করতে বসলে রেডি হবো কখন? দেরী হয়ে যাবে। ওরা এতক্ষন আমার জন্য বসবে না।”
—” যা তুই রেডি হয়ে নে। আমি আয়রন করে দিচ্ছি।”
—“ওরা যদি চলে যায়?”
—“আমি দিয়ে আসবো। যা তাড়াতাড়ি কর!”
ইরিনের চোখদুটো খুশিতে চকমক করে উঠলো। মেকআপ বক্স খুলে সাজতে বসে গেলো সে। আয়াজ জামাকাপড় হাতে নিয়ে বললো,
—“কোনটা পরবি দেখিয়ে দিয়ে যা?”
ইরিন ঘিয়ে রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ বের করে দিলো। আয়াজ বসে তার জামা আয়রন করছে,আর সে নিশ্চিন্ত মনে সাজুগুজু করছে। আয়াজের আয়রন করা শেষ কিন্তু তার সাজুগুজু শেষ হলো না। একটু পর মুক্তা এলো তাকে ডাকতে। তখনো ইরিনের সাজুগুজু কমপ্লিট হয় নি। মুক্তা প্রায় জোর করে টেনে তুলে নিয়ে গেলো তাকে।
★
ইরিন পায়ে আলতা দিয়েছে।নাকে নথ,কানে ছোট ছোট দুল,চুলগুলো দুদিকে বেনী করা।হলুদ রংয়ের একটা সুতি শাড়ী একপ্যাঁচি করে পরেছে,গাঁয়ের বধুদের মতো লাগছে ওকে।শুধু কোমরে একটা কলসি জড়ানো থাকলে পারফেক্ট হত! আজকে সুহানার হলুদে সবাই গায়ের বধু সাজবে ঠিক করেছে।
আয়াজ তার ঘরে বসে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। ইরিন সেজেগুজে দুএকবার উঁকি দিয়ে গেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার বর মহাশয় সেটা খেয়াল করেন নি। তিনি গভীর মনোযোগের সহিত মুভির ইন্ডিং পার্ট দেখছেন।
মুভি শেষ করে যখন উঠলেন তখনও ইরিন একবার ভেতরে এসেছে। আয়াজ তখন রুম থেকে বেরোচ্ছিলো, ইরিন দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তার সাথে ধাক্কা খায়। তখনও আয়াজ ভাবলেশহীনভাবে ইরিনের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ইরিনের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে, আয়াজ এমন কেন? মহসিন ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার তার বউয়ের প্রশংসা করে ফেলেছে। আর ইনি? তার বউ যে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটাই খেয়াল করেন নি। ইরিনের ইচ্ছে করে আয়াজকে বউ সাজিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে রাখতে। সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো যে খুব সহজ ব্যাপার নয় আয়াজকে বুঝিয়ে দিতে। শাড়ি পরিয়ে একগাদা মেকাপ মুখে মাখিয়ে দিয়ে বলতে, “দেখ কেমন লাগে।”
★
আয়াজ নিচতলার বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমনে শিলনোড়ায় হলুদ পেষা দেখছে। সুহানার গায়ে হলুদ আজকে সন্ধ্যায়।আজকাল তো শিলনোড়া বিরল বস্তু,ঘরে ঘরে ব্লেন্ডার থাকায় শিলনোড়ার ব্যবহার নেই বললেই চলে। তবে গ্রামে এখনো এর ব্যবহার আছে। ইরিন আয়াজের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,”আমার যদি সাহস থাকতো তাহলে আমি আপনাকে ঠিক এইভাবে শিলনোড়ায় পিষতাম। অসভ্য লোক।”
আয়াজ নিচতলায় নেমে এসেছে। ইরিন কাছে গিয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
—“আপনি হামানদিস্তা চিনেন?”
আয়াজ চেঁচিয়ে উঠে বললো,
—“কী?”
—“হামানদিস্তা!”
—“কি এটা?”
—“ওটা দিয়ে মষলা পিষে!”
—“তো এখন আমি কি করবো?”
—“করবো তো আমি!”
ইরিন বিড়বিড় করে বলল,”ওটার ভিতর নুন মরিচ ঢেলে আমি আপনাকে পিষবো! পিষে পিষে ভর্তা বানাবো। তারপর সেই ভর্তা ছাগলকে খাওয়াবো!”
আয়াজ তার কথার আগাগোড়া কিছুই শুনলো না শিলনোড়ায় পিষনের শব্দে।ইরিনের ঠোঁট দুটো নড়তে দেখে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি বিড়বিড় করছিস?”
—“কিছু না।”
আয়াজ ভেতরে চলে গেলো।ইরিন রাগে সামনের কাজের মেয়েটাকে সরিয়ে নিজে পিষতে বশে গেলো। আয়াজ কি অন্ধ? সে কি দেখতে পায় নি ইরিন সাজুগুজু করে আছে? কাঁচা হলুদের টুকরো গুলোকে আয়াজ ভেবে আচ্ছামত পিষলো কিছুক্ষন।হলুদ পেষার সময় আরো একটা কাজ করলো সে। হলুদে ইচ্ছেমত লবণমরিচ মেশালো।তা দেখে সামনে বশে থাকা মেয়েটা আতংকে চোখমুখ ফ্যাকাসে করে ফেলেছে। ইরিন উঠে চলে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ফিরে এসে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—“মরিচমেশানো হলুদ ফেলে দিও সুলতানা।”
—“জি আইচ্ছা।”
কিন্তু কাজের ফাঁকে সুলতানা হলুদ ফেলার কথা ভুলে গেছিলো ফলাফল স্বরূপ সেই মরিচ মেশানো হলুদই সুহানাকে লাগানো হলো।
★
সুহানার প্রচন্ড চিৎকারে সবার কানের তালা ফেটে যাওয়ার মত অবস্থা।অনবরত ঠান্ডা পানি ঢালা হচ্ছে মুখে,তাতে করেও চিৎকার কমছে না।সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।সবাই ওকে নিয়েই ব্যস্ত!হলুদের বাটিতে মরিচ আসবে কোথা থেকে?..কাজের মেয়েটাকে ডেকে আনা হলো!..অবশেষে প্রচন্ড ধমকাধমকিতে সে স্বীকার করে ফেললো যে হলুদের মরিচ ইরিন মিশিয়েছে।শুধু মরিচ না নুনও মিশিয়েছে! হেলাল সাহেব, সোহেলি,রেশমি সবাই অস্থির এই খবর শোনার পর। ইরিনের সাথে তো সুহানার আগে কখনো দেখাই হয় নি, ইনফেক্ট গ্রামে আসার পর পরিচয় হলো, তাহলে কিসের শত্রুতা থেকে ইরিন এমন একটা কাজ করলো?
★
ইরিন গোমড়ামুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আয়জ পাঞ্জাবী পরে রেডি হয়ে বেরোচ্ছিলো। ইরিনকে একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টেনে তাকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ঘরের লাইট অফ। আলমারির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইরিন। আয়াজ দাঁড়িয়েছে তার মুখোমুখি। একেবারে কাছাকাছি। ভ্রুজোড়া নাচিয়ে হাসিমুখে বললো,
—“কি ব্যাপার হরিণ? সাজুগুজু করে বারবার আমার সামনে ঘুরঘুর করছিস? মতলব টা কি তোর? মার্ডার করবি? খবরদার!”
—“ঢং। দেখি ছাড়ুন।”
—“চুপ। একদম চুপ। কোন কথা বলবি না তুই।”
ইরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একেবারে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ইরিন নড়তে পারছে না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়াজ তার কানের লতিকে আলতো করে একটা কামড় দিয়ে বললো,
—“হরিণ?”
ইরিনের ঘোর লাগছে। অন্ধকারে দুটো মানুষ কাছাকাছি, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একে ওপরের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। বুকের ভেতর ধুপধুপ করে ইরিনের। কোনরকমে জবাব দিলো সে,
—“হু?”
আয়াজের হাতদুটো ইরিনের কোমর চেপে ধরেছে। ফিসফিস করে বললো,
—“আয় চল আমরাও একটা বেবি নিয়ে ফেলি? আমার এভাবে থাকতে কষ্ট হয়। খুব কষ্ট। আন্টিকে আমি বুঝিয়ে বলবো। নাতি নাতনী আসার খবর শুনলে তিনি রাগ করে থাকতে পারবেন না। তোর পড়াশোনার কোন ক্ষতি হবে না। বাবুকে আমি দেখে রাখবো। কেমন?”
ইরিনের হাসি পাচ্ছে। এখন রোমান্স করার সময়? একটুপরেই সুহানার গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হবে। এই মানুষটা এমন কেন? সময়মত কিচ্ছু বলতে পারে না। অসময়ে সব গুলিয়ে একসাথে বলে দিচ্ছে।
—“ছাড়ুন আমাকে, সবাই অপেক্ষা করছে।”
—“না। ছাড়বো না। আমার শ্বাশুড়ি মা আমাকে কিসব উল্টোপাল্টা অনুরোধ করে বসে আছেন। আমি হাদারাম সেইটা ধরেই বসে আছি। আজকে থেকে সব বাদ! শুধু বউ আর আমি! তুই আর আমি।
ইরিন ঠোঁট কামড়ে হাসছে। আয়াজ ওর গালে হালকা কামড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
—“হাসবি না খবরদার।
—“উহ্! কামড় দিচ্ছেন কেন? ব্যথা পাই তো!”
—“ওয়াক থু। তোর গালে সব মেকাপ!”
ইরিন চোখ পাকালো। অতঃপর আয়াজ মুচকি হেসে তার গালে গভীর আবেগে চুমু খেতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে তার রোমান্সের বারোটা বাজিয়ে তখনই দরজায় নক। দরজার বাইরে মুক্তা দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর ভঙিতে জানালো হেলাল সাহেব ইরিনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইরিন মুচকি হেসে দ্রত বেরিয়ে গেল। আয়াজও তার পেছন পেছন বেরলো।হেলাল সাহেব হঠাৎ ইরিনকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন সে বুঝতে পারছে না ?
ভেতরে ঢুকে আয়াজ হেলাল সাহেবের পাশে বসলো। সোহেলিও আছে। হেলাল সাহেব শান্ত গলায় ইরিনকে প্রশ্ন করলেন,”হলুদে লবণ মরিচ মিশিয়েছো কেন মা?”
ইরিন চমকে উঠলো। প্রথমে জবাব দিলো না।মাথা নিচু করে বসে রইলো।হেলাল সাহেব পুনরায় নরম কন্ঠে বললেন,
—-“কি হলো চুপ করে আছো কেন মা?..তুমি কি ইচ্ছে করে হলুদের সাথে লবণ মরিচ মিশিয়েছো?”
ইরিনের নতমুখে বললো,
—“জি বাবা।”
হেলাল সাহেব, আয়াজ, সোহেলি সবাই চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকালেন। সোহেলি ধমক দিয়ে বললেন,
—“কি উল্টোপাল্টা কথা বলছিস তুই?”
ইরিন কেঁদে ফেললো। আয়াজ অসহায় চেহারা নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। কি হচ্ছে না হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইরিন কিসের হলুদে মরিচ মিশিয়েছে? কেন? ইরিন কান্না থামিয়ে আয়াজকে দেখিয়ে বললো,
—“আমি উনার ওপর রাগ করে হলুদের মরিচ মিশিয়েছি।”
আয়াজ তব্দা খেয়ে গেলো। ইরিন বলছে কি? অন্য সময় হলে হেলাল সাহেব হেসে উড়িয়ে দিতেন কিন্তু আজকে পারলেন না। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধের না। অহংকারী স্বভাবের। তার কানে এসব কথা পৌঁছালে লঙ্কাকাণ্ড বাধাবেন তিনি। হেলাল সাহেব বেশ কড়া কন্ঠেই ইরিনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
—“আয়াজের ওপর রাগ করে তুমি সুহানার হলুদে মরিচ মিশিয়েছো কেন?”
ইরিন পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
—“ভুল হয়ে গেছে বাবা।”
আয়াজ স্থির চোখে ইরিনের দিকে চেয়ে আছে। ইরিন তার ওপর রাগ করে হলুদে মরিচ কেন মিশিয়েছে সে বুঝতে পারছে না। কিসের রাগ তার ওপর ইরনের? ইরিনের কান্নার বেগ বাড়ছে। হেলাল সাহেবের ইশারায় সোহেলি টেনে ঘরে নিয়ে গেলো তাকে। তিনি ইরিনকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে না যেতেই আয়াজের বড় চাচা এবং চাচী ভেতরে ঢুকলেন। কাজের মেয়ের কাছ থেকে ইরিনের মরিচ মেশানোর খবর শুনেছেন তারা। আয়াজের চাচা যদিও চুপ করে ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী চুপ করে রইলেন না। কড়া মেজাজে হেলাল সাহেবকে ইরিন সম্পর্কে বেশ কিছু কটূ কথা শুনিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। অপমানে হেলাল সাহেবে মুখ লাল হয়ে গেছে। স্থিরভাবে বসে রইলেন তিনি।
আয়াজ বাবার সামনে নতমুখে বসে রইলো। ঘটনাগুলো এততাড়াতাড়ি ঘটেছে যে সে বুঝে উঠতে পারছে না তার কি করা উচিৎ? তবে সবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে দিলেও একটা জিনিসই তার খুব লাগছে। বাবার অপমান!
হেলাল সাহেব ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,
—“তুই কিছু মনে করিস না বাবা। তোর চাচী একটু রাগী।”
ছোটবেলা থেকেই আয়াজ দেখে এসেছে তার চাচা,চাচী বিদেশে থাকেন। এর মাঝখানে দু একবার বোধহয় দেশে এসেছিলেন। তাই বড় চাচী মানুষটি কেমন সে সম্পর্কে আয়াজের কোন ধারণাই ছিলো না। কিন্তু আজকে তার ভালোভাবেই বোঝা হয়ে গেছে এই মহিলা যতই ভালোমানুষি দেখাক না কেন প্রচন্ড দাম্ভিক এবং অহংকারী প্রকৃতির।
আয়াজ বাবার সামনে থেকে উঠে ঘরে চলে এলো। বাবা যেমন ছেলেকে বোঝে তেমনি ছেলেও বাবাকে বোঝে। হেলাল সাহেব কতটা অপমান বোধ করছেন সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তাদের নিজেদের ব্যাপার হলে নিশ্চই বাবা হাসিমুখে ইরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন,”এসব কোন ব্যাপার না মামনি। মন খারাপ করো না।” কিন্তু আজকের ব্যাপারটা আলাদা। বাবার জন্য দুঃখ হচ্ছে আয়াজের।
★
ইরিন কাঁদছে। সোহেলি বেগম তার পাশে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আয়াজ ভেতরে ঢুকে বললো,
—“তুমি বাইরে যাও মা। ইরিনের সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
সোহেলি প্রথমে যেতে চাইলেন না। আয়াজের কড়া নির্দেশে উঠে যেতে বাধ্য হলেন। আয়াজ দরজা আটকে ইরিনের সামনে এসে দাঁড়ালো ,
—“হলুদে মরিচ কেন মিশিয়েছিস ইরিন?”
ইরিন জবাব না দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আয়াজ আবারো জিজ্ঞেস করলো,
—“ইরিন কান্না বন্ধ কর। আমার কথার জবাব দে। হলুদে কেন মিশিয়েছিস মরিচ?”
—“আপনার ওপর রাগ করে।”
—“আমার ওপর রাগ করে? কেন?”
—“আপনার ওপর আমার রাগ উঠেছিলো তাই।”
আয়াজ ধারণা করে নিয়েছে ইরিন তার ওপর ছেলেমানুষি ধরনের কোন রাগ করে এই কাজ করেছে। পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
—“আমার ওপর রাগ উঠেছিলো যখন আমার মুখে ছুঁড়ে মারলি না কেন মরিচ? হলুদে কেন মিশিয়েছিস?”
ছোটবেলা থেকেই ইরিন এই পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে ভালোবাসা পেয়ে এসেছে। বিশেষ করে হেলাল সাহেব এবং সোহেলির কাছ থেকে। হেলাল সাহেব কখনোই তার সাথে এভাবে মুখ কালো করে কথা বলেন নি। এমনকি সে যখন সোহাগকে বিয়ে করবে বলেছিলো তখনো না। কিন্তু আজকে সামান্য একটা ভুলের জন্য সবাই তার সাথে খুব খারাপ ব্যাবহার করছে। অভিমানে কান্নার দলা পাকিয়ে আসছে তার।
—“আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি?”
—“না তুই ইচ্ছে করে করিস নি। কিন্তু করেছিস তো? তোর এই সব ছেলেমানুষির জন্য সুহানা বেচারি শুধুশুধু কষ্ট পাচ্ছে।”
—“আমি তো সুলতানাকে বলেছিলাম মরিচ মেশানো হলুদ ফেলে দিতে। সে ফেলেনি কেন?”
—“তুই নিজে যখন হলুদে মরিচ মিশিয়েছিস তখন তুই নিজে ফেলে দিয়ে এলি না কেন?”
—“আমার ভুল হয়ে গেছে।”
—“এটা ভুল নয় ইরিন। খামখেয়ালিপনা। ছেলেমানুষি। শুধুমাত্র তোর জন্য বড়চাচী বাবাকে যাচ্ছেতাই কথাবার্তা বলে চলে গেছেন। আমি শুধু হাঁ করে দেখে গেছি।তুই বুঝতে পারছিস আমার কতটা খারাপ লাগছে?”
—“আমার খারাপ লাগছে না? সবাই মিলে আমাকে বকছেন? মনে হচ্ছে যেন আমি সুহানা আপুকে বিশ মিশিয়ে খাইয়ে দিয়েছি!”
—“আর সেটুকুরই বাকি আছে বোধহয়।”
ইরিন মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আয়াজ একবারও তার মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছে না? ইরিনের কি খারাপ লাগছে না? সে চোখমুছে থমথমে গলায় বললো,
—“আপনি তো জানতেন আমি এমন। আমাকে বিয়ে করেছেন কেন?”
—“তুই প্রসঙ্গ বদলাচ্ছিস কেন?”
—“আগে আমার প্রশ্নের জবাব দিন।”
—“তুই তখন ছোট ছিলি তাই তোর কাজকর্মগুলো সবার কাছে ছেলেমানুষি মনে হয়েছিলো। কিন্তু এখন তুই যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এখন এসব পাগলামি বন্ধ কর। এখানে শুধু আমি আর তুই নই। আরো অনেকে লোক আছে। সবাই তোর এসব ছেলেমানুষি মেনে নেবে না।”
ইরিন দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
—“সবাই নয় বলুন আপনি মানতে পারছেন না। আপনি আমাকে নিজের মত করে চালাতে চাইছেন। আমি যাই করি তাতেই আপনার না। হলুদে মরিচ মেশানো নিয়ে কেউ আমাকে এত কথা শোনায় নি যতকথা আপনি আমাকে শুনিয়েছেন। কিন্তু একটা কথা ক্লিয়ারলি শুনে রাখুন আমি যেমন আছি তেমনই থাকবো। একটুও বদলাবো না।”
আয়াজ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে। ইরিন পুনরায় তিক্ত কন্ঠে বললো,
—” খারাপ লাগছে তাই না? সত্যি কথা শুনলে সবারই খারাপ লাগে। আপনারও লাগছে।”
ইরিন রাগ করে বেরিয়ে গেলো। মুক্তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো সে। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব তো ইরিনের ছেলেমানুষি কথাবার্তা নয়? খুবই কঠোর ধরনের কথাবার্তা। তবে ইরিন কি তাকে একটুও ভালোবাসে নি? হঠাৎ করে বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ারের ওপর বসে রইলো। মাথা থেকে ইরিনের বলা কথাগুলো কিছুতেই সরাতে পারলো না। কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠছে! অবশেষে আলমারি থেকে নিজের জিনিসপত্র বের করে গোছাতে শুরু করলো সে।
★
সোহেলি ছেলেকে শান্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।খবর শুনে হেলাল সাহেবও ছুটে এসেছেন। ছেলেকে বাধা দিয়ে বললেন,
—“রাগ করিস না বাবা। সবাই মিলে একসাথে রাগ করলে মেয়েটা যাবে কার কাছে।”
—“আমি ওর ওপর রাগ করি নি। আমি শুধু ওকে ওর মত থাকতে দিতে চাইছি। ”
হেলাল সাহেব মূর্তিমান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আয়াজ বাবামাকে সালাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বাবার হাত ধরে বললো,
—“আমি জানি বাবা, বড়চাচীর কথায় তুমি খুব কষ্ট পেয়েছো। তার জন্য তুমি ইরিনের ওপর রাগ করে আছো। তুমি ওর ওপর রাগ করে থেকো না বাবা প্লিজ। তুমি তো জানো ও ছেলেমানুষ। হুটহাট যা করতে মন চায় তাই করে বসে। লুকোচুরি করে কিছু করা ওর ধাতে নেই। তুমি প্লিজ ওকে ক্ষমা করে দিও। ইরিন আমার চেয়ে তোমাদের ওপর বেশি ভরসা করে। তুমি রাগ করেছো বলেই ওর বেশি অভিমান হয়েছে।”
হেলাল সাহেব ছেলের রাগটা ঠিক কোন জায়গায় হয়েছে বুঝতে পারলেন না। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
—“তুই একদম চিন্তা করিস না। তোর যা ঠিক বলে মনে হয় তুই কর। ইরিনকে আমরা সবাই মিলে দেখে রাখবো।”
★
মুক্তা এসে ইরিনকে আয়াজের চলে যাওয়ার খবরটা দিতেই ইরিন চমকে উঠলো। মুক্তা তার হাত ধরে টানাটানি করে বললো,
—“তুই এখনো বসে আছিস কেন? আয়াজ চলে যাচ্ছো তো?”
—“যাক।”
ইরিন একফোঁটাও নড়লো না। থম মেরে বসে রইলো। তবে ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। আয়াজের এত রাগ তার ওপর? এই তাকে ভালোবাসে আয়াজ? কচুবাসে। যাক! চলে যাক। ইরিনের কি? সে জীবনেও আটকাবে না। কেন আটকাবে? ইরিনের কি ঠেকা পড়েছে? তিনি নিজের ইচ্ছে তে যাচ্ছেন। ইরিন তো তাকে যেতে বলে নি? রাগের বশে দুটো কথা বলে ফেলেছে তার জন্য চলে যেতে হবে? এমন ভালোবাসার দরকার নেই ইরিনের।
মুক্তা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলো। আয়াজ ব্যাগ গুছিয়ে মুক্তার ঘরে এসে ঢুকলো। ইরিনের খাটের ওপর হাটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। আয়াজ শান্ত স্থির কন্ঠ বললো,
—“আমি যাচ্ছি ইরিন!”
ইরিন আগেই মতই বসে রইলো। তার চোখের পানি পায়ের পাতার ওপর পড়ছে। মুখটা নিচু করেই রাখলো। তার অভিমানিনী মুখটা আয়াজকে দেখাতে চাইলো মা। নিশ্চুপ ভাবে বসে রইলো। আয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—“তুই ঠিকই বলেছিলি ইরিন, তুই আমাকে একটুও ভালোবাসিস না। তুই তো শুধু রাগই করতে জানিস। যাইহোক, আমি যশোরে ফিরে যাচ্ছি। তুই তোর মত থাকিস। আমি আর তোর কোন কিছুতে বাধা দিবো না। কিচ্ছুতে না। তোর যখন যা করতে মন চায় তুই করিস। যদি মন চায় পড়াশোনাটুকু ঠিক মত করিস। তুই খুব ভালো ছাত্রী। একটু মনোযোগ দিলেই পারবি।আমি আসি।”
মুখে হাত দিয়ে ফোঁপানোটা আটকালো ইরিন। নিজেকে শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,
—“আপনার যেখানে ইচ্ছে যান। আমাকে বলছেন কেন?”
আয়াজ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধীরে ধীরে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো,
—“আমি যাচ্ছি ইরিন?”
—“যান।”
বস্তুত আয়াজ চাইছিলো ইরিন একবার তাকে সরি বলুক। একবার তাকে যেতে নিষেধ করুক। আর ইরিন চাইছিলো আয়াজ তাকে সরি বলুক! আগের মত ভালোবেসে ইরিনের রাগ ভাঙাক! কিন্তু না দুজনের একজনও কিছু বলতে পারল না। পরস্পরের অভিমান নিয়ে দূরে সরে রইল।দুপক্ষই চাইছে অপরপক্ষ আত্মসমর্পণ করুক কিন্তু কেউ নিজে আত্মসমর্পণ করতে রাজী নয়!
★
বিয়ের দিন ইরিন কাপড়ের ব্যাগ খুলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। তার সব জামাকাপড় আয়রন করে ভাঁজমত রাখা আছে। সেদিন ইরিন মার্কেটে চলে যাবার পর আয়াজ তার ব্যাগের সব জামাকাপড় আয়রন করে গুছিয়ে দিয়ে গেছে। ইরিন রাগে অভিমানে সব এলোমেলো করে ফেললো। এলোমেলো জামাকাপড় হাতে নিয়ে অনেক্ষন মেঝেতে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলো। বিড়বিড় করে বললো, “আপনার আয়রন করা জামাকাপড় আমি পরবো না। কিছুতেই না। ”
চলবে।