অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব-৩৪+৩৫

0
516

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব____৩৪
#কায়ানাত_আফরিন
পিটপিট করে চোখজোড়া খুললো রৌশিন। দেখলো কেউ ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে গহীন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ওকে। ওর শরীর কিছুটা দুর্বল। তাই চোখ খোলা মাত্রই অবয়বটিকে স্পষ্ট না দেখে খানিকটা অস্পষ্ট দেখতে পেলো। রৌশিন নিঃশ্বাস ফেললো বারকয়েক। শক্তি জুগালো নিজের দুর্বল শরীরে। কয়েক সেকেন্ড পরই ওর ঘোলাটে দৃষ্টি হয়ে আসতে লাগলো স্পষ্ট। কিছু অবয়বটিকে নিজের সদ্য ঘুমফোটা চোখে দেখা মাত্রই যেন চরম রকমের অবাক। রৌশিন প্রথমে আনমনে চিমটি কাটলো নিজেকে। মনে হলো এসব বুঝি স্বপ্ন, সেদিন নাটকে স্বপ্না নামের যেই চরিত্রটি অভিনয় করেছিলো সেই স্বপ্নার মতোই স্বপ্ন। রৌশিন হতাশা গ্লানিতে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠলো,

-রৌশিন রে ! জ্বর তোকে ভালোই কাবু করে ফেলসে। নাহলে এসব আজগুবি জিনিস দেখতি না।

পরক্ষণেই ও ভালোমতোই টের পেলো এ কোনো স্বপ্ন নয়। সত্যিই ফাহিম এসেছে এখানে। খাটের পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে বসা ওর মা। পায়ের কাছে তেরছাভাবে মারুফ আর ইলার উপস্থিতিও টের পাচ্ছে। ফাহিম রৌশিনের প্রেশার মেপে দেখলো যে প্রশার ফল করেছে। জ্বরটা আগের মতো নেই। শরীরে ঘাম লক্ষ্য করাতে বুঝতে পারলো হয়তো জ্বর সারা শুরু করেছে। রৌশিনের কপালে আলতো ভাবে হাত রাখলো ফাহিম। কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-শরীরটা কেমন লাগছে তোমার রৌশিন?

রৌশিন প্রতিবারই অনুভব করে ফাহিমের মুখে ওর নাম শুনার মধ্যে অন্যরকম এক মাদকতা আছে। ওর কন্ঠটা জানি কেমন। নরম , ভরাট তবে প্রানবন্ত ধরনের। শুনলেই একটা দার্শনিক টাইপ ফিলিং আসলেও দর্শনের উচ্ছিষ্ট টুকুও ফাহিমের মধ্যে নেই। কথা আছে না, মানুষের পাঁচটা আঙুল সমান হয়না। ফাহিমও ঠিক তেমন। ও প্রকৃতিপ্রেমী না, ফিলোসফি , সাহিত্য , কবিতা ,বইনেশা এগুলো ফাহিমের মধ্যে অনুপস্থিত। এককথায় রৌশিনের বিপরীত মুখী মানুষ বললেই চলে। তবুও রৌশিনকে ওর ভালোলাগে , কারন ফাহিম সামাজিক। খুবই মিশুক আর উচ্ছ্বাসিত মানুষ সে।রৌশিনের প্রতিউত্তর না পেয়ে ফাহিম পরন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা ওকে। হয়তো শরীরটা এখন সেরে ওঠেনি। রৌশিনের মা আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠলেন,

-কি হলো আমার মেয়েটার? সারাদিন গুমশুম হয়ে থাকে। হুটহাট জ্বর বাধিয়ে ফেলে। এতদিন পর কাল জ্বর সেরে রাতে আবার জ্বর এলো। কেনো, ডাকতে পারলি না আমাকে? তোর মা কি মরে গিয়েছিলো?

-আহা খালা বকেন না তো ওকে। ও তো এমনিতেও চাপা স্বাভাবের মেয়ে।

-তুমিই বুঝাও ওরে বাবা। পাগলিয়ে গেসে মেয়েটা।সারাদিন একলা একলা কিসব ভাবে আল্লাহ মালুম!

রৌশিন উঠে বসলো এবার। ফাহিম ব্যাগ্র হয়ে বলে ওঠলো,

-তোমার ওষুধ কিন্ত সব ঠিকমতো লিখে দিয়েছি। এখন বেড রেস্ট নাও। সাদ্দাফ ওষুধ নিয়ে আসবেদুপুরে তোমার জন্য। ঠিকাছে?

ফাহিম ইলা মারুফ আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালো রৌশিনের সাথে। রৌশিন ওপর দিয়ে একটু ভাবহীন থাকলেও ভেতরে ছুটে যাচ্ছে আনন্দের ঝড়। রৌশিনের মা আগেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওদের রেখে চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ ফাহিম ইলা আর মারুফকে বললো বাহিরে আফরা আর ফারহানের কাছে যেতে। ও কিছু জরুরি কথা বলবে। ইলা আর মারুফ বাধ্য হয়ে তা-ই করলো। রৌশিন ফাহিমের এরূপ কান্ডে কিছুই বুঝতে পারছে না।ফাহিম এবার এবার বসে পড়লো আফরার মুখোমুখি হয়।চোখে অল্পবিস্তর সন্দিহান রেশ। রৌশিন ভড়কে গেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফাহিম জিজ্ঞেস করলো,

-এবার বলোতো? কাকে ভালোবেসে এমন জ্বর বাঁধিয়েছো?

রৌশিন নিষ্পলক হয়ে রইলো। কি বলবে এটা সে ভেবে পাচ্ছে না। ফাহিমের চোখে মুখে সীমাহীন কৌতুহলতা।তাই সে আবার বললো,

-আরে বলে ফেলো মেয়ে। ভালোবাসা কোনো পাপ না। এইযে, আমিও তো পছন্দ করি আফরাকে।

প্রথম কথাটা শুনে রৌশিন যেমন প্রতিক‍িয়া করেছিলো শেষ কথাটি শুনে সে যেন আরও স্তব্ধ হয়ে গেলো। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি আফরা আপুকে পছন্দ করেন ভাইয়া?

-হুম করি। শুরুতে এমন কোনো ফিলিং ছিলো না। তবে দু’দিন আগে হুট করে মা বললো যে আফরার বাবার কাছে আমার আর আফরার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। তখন থেকেই আমি একটু নজর দিলাম আমার ফিলিংসের প্রতি। আমার মনে হয়না আফরার এতে আপত্তি থাকতে পারে। ‘কজ ও আমার সাথে প্রচুর ফ্রেন্ডলি। তবুও , দেখা যাক।

কথাগুলো রৌশিনের বুকে তীরের মতো বিধছিলো। শুরতে আফরাকে ওর হিংসে হলেও এখন নিজের ভাগ্যের পরিহাসে খারাপ লাগছে। ও মেকি হাসি দিয়ে বলে ওঠলো,

-ভালোবাসা চাইলেই পাওয়া যায় না ফাহিম ভাই। তাই আমি কখনোই কাউকে ভালোবাসতে পারিনি। তাই কারও ভালোবাসায় বুদ হয়ে জ্ব‌র আসার তো প্রশ্নই ওঠে না।

________________________

ফারহান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাহিরে। ফাহিম অনেক জোরাজোরি করেছিলো ওদের সাথে রৌশিনদের বাড়ির ভেতরে যেতে। কিন্ত ও শুনলো না। বাহিরে পিচঢালাই পথে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো নির্বিকার ভাবে। অদূরেই ছিলো আফরা। এতক্ষণ রৌশিনের মায়ের সাথে কথা বলার প্রচেষ্টায় ছিলো, কিন্ত পারলোনা। রৌশিনের মায়ের কথাবার্তায় একধরনের সিলেটি টান আছে, যেটা আফরার বুঝতে একটু না, মোটামুটি অনেক সমস্যাই হয়েছে। তাই কোনোমতে কথা বলে সে রৌশিনের সাথে কথা বলে শেষমেষ চলে গেলো ফারহানের কাছে। ফারহান নীরব, নিশ্চল। আজ ছেলেটা একটা সাদা রঙের শার্ট পড়েছে। সাথে অফ হোয়াইট জিন্স। শ্যামবর্ণের গায়ে এমন উজ্জ্বল রঙের সৌন্দর্য আসলেই বর্ণণাতীত। চুলগুলোও শ্রীমঙ্গলের শেষ সীমানার উত্তর গাঁয়ের হাওয়ার দাপটে উড়ে যেতে ব্যস্ত সমানতালে। আফরা কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিলো সেদিকে। তারপর এগিয়ে যেতেই ফারহান মিনমনিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-দেখা করা হয়েছে?

-হুম, আপনি যাবেন না?

-আমি কেনো যাবো দেখা করতে?

-তাহলে এসেছেনই বা কেনো?

আফরা কাট কাট গলায় এ প্রশ্ন করতেই ফারহান ভ্রু কুচকালো৷ কেনো যেনো মনে হচ্ছে মেয়েটা রেগে আছে। রেগে আছে বললে ভুল হবে,,হয়তো মনে অভিমান জমেছে। সকালের আফরার সাথে ওর কথোপকথন গুলো মনে পড়তেই ফারহান বুঝে নিলো কেন এই অভিমান৷ ভালো লাগে ওর এই বিদেশীনি কে রাগাতে। তাই তো আবার ছুটে এলো এখানে। ফারহান ঠোঁট চেপে বলে ওঠলো,

-আপনি কি ভেবেছেন যে আমি আপনার রাগ ভাঙানোর জন্য এসেছি এখানে?

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো আফরা। আড়নজরে ফারহানকে বারকয়েক দেখে অন্যদিকে মাথা ঘুরিয়ে বলে ওঠলো,

-না তো! আমি……….আমি এমন কেনো মনে করবো?

-তাহলে তো ভালোই। এমন কিছুই মনে করবেন না। কারন ফারহান জুবায়ের কারও রাগ ভাঙাতে অভ্যস্ত নন।

ফারহান কথাটি বলো দাম্ভিক কন্ঠে। আফরার মনে চাপা ক্ষোভ জমলো। এই মানুষটা সবসময়ই থাকে কিভাবে ওকে হেয় করা যায়। ফাহিম আর ইলা আসলে ঠিকই বলে, এই লোকটার সাথে যেচে যেচে কথা বলা উচিত। তন্মধ্যে এসে পড়লো ইলা আর মারুফ। ফারহান মৌন ভাবে ইলাকে জিজ্ঞেস করলো,

-ফাহিম কোথায়?

-একটু পরে আসছে।

এদিকে মারুফ তো বারবার আফরাকে দেখে যাচ্ছে। কি সুন্দর একটি মেয়ে। হাসলে যেন মুক্তা ঝরে পড়ে। মারুফের হিসেবে এই মেয়ে যদি মুভি করতো নিঃসন্দেহে হিট হয়ে যেতো। ইলা দেখছে মারুফের এই আহাম্মকি দৃষ্টিটা। তাই দাঁত দাঁত চেপে ওকে বললো,

-আফরা আপুরে বড় বইনের নজরে দেখ আহাম্মক ! তোর সাথে কখনোই তার যাবেনা।

-আরে আমি কি কইসি যে আমার সাথে আপু যাইবো। দেখতে ক্ষতি কি? নিঃসন্দেহে উনার মতো সুন্দরী এই জনমে আর দেখতে পারুম না।অ্যামেরিকান তো না-ই।

সকালের বাতাসটা কিছুটা শীতল। উত্তুরে হাওয়ার সমাগমে আশপাশের বিশাল বিশাল কাঠ গাছগুলোর পাতা নড়ে অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করছে। চায়ের রাজ্যের এই তো একটা সৌন্দর্য। দেখলেই মাথা কেমন যেন ঝিম ধরে যায়। আফরার ভালো লাগলেও গায়ের লোম কেনো যেন খাড়া হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে ঐই শীতল আবহাওয়াটা ও‌র পরনে পাতলা শার্টটির সঙ্গে মানানসই একেবারেই না। আজ দিনটাই খারাপ ভাবে শুরু হয়েছে। যার জন্য সুন্দর পোশাল পড়লো তার কোনো ধ্যান নেই বরং ঠান্ডায় কাপাকাপি করছে সে। হঠাৎই নিজের গায়ে একটা উষ্ণ আবরণ দেখে সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। মাথাটা চট করে ঘুরাতেই মুখোমুখি হলো একেবারে ফারহানের কাছে। ফারহান ওর ঠিক বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটাই কাছাকাছি। আফরা বুঝতে পারেনি যে ফারহান গায়ে ওর নিজের শার্ট জড়াতে গিয়ে এতটা কাছাকাছি এসে পড়বে তাহলে আফরা কখনোই মাথা চট করে ঘুরাতো না। ফারহানের দৃষ্টি নিচে থাকলেও আফরা ওর মুখোমুখি হওয়াতে গহীন দৃষ্টিতে দেখে নিলো আফরার মুখ। জড়ানো গলায় বললো,

-পড়ে নিন এটা। আমার জন্য এটা পড়ে এসেছেন আর তা পড়ে আপনার ঠান্ডা লাগছে এটা কি আর মেনে নেওয়া যায়?

ধক করে ওঠলো আফরার হৃদয়। ফারহানের কন্ঠে জড়ানো কেমন এক আড়ষ্ট অনুভূতি। এর মানে ফারহান কি জানতো এই জামাটি পড়ার উদ্দেশ্য? আফরার এখন নিজেকে নিতান্ত বোকা মনে হচ্ছে। ওর এমন পাগলামির জন্য কি ভাবছে ফারহান কে জানে?
.
.
.
~চলবে……ইনশাআল্লাহ

[রিচেক করা হয়নি। টাইপিং মিস্টেক বুঝে নেওয়ার অনুরোধ রইল।]

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#পর্ব___৩৫
#কায়ানাত_আফরিন

রৌদ্দুরের কড়া উত্তাপে তপ্ত আশপাশ। কাঠফাটা রোদে চা বাগানটা দেখতেও কেমন যেন মলিন মনে হচ্ছে। আফরা দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কিচেনে কথা বলতে ব্যস্ত মিসেস নাবিলার সাথে। উনি সবেমাত্রই টেবিল গুছিয়ে গাছিয়ে সব রান্নাঘরে রেখেছেন। বাসায় আর কেউ নেই। মিঃ ইফাজ গিয়েছেন দোকানে আর ফাহিম বরাবরের মতোই হসপিটালে। এসময় ওর ডিউটি না থাকলেও কিছু কাজের দেখভাল করার জন্য থাকতে হয়। ইলা তখনও মারুফের সাথে রৌশিনের বাসায়। ফাহিম আফরাকে নিয়ে এসেছিলো বাড়িতে। যদিও ওর অবচেতন মন বারবার বলছিলো যে ফারহান আসলে হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা অনেক গম্ভীর, নিজ থেকে হয়তো একটিও কথা বলবে না। তবুও ওর সঙ্গই আফরার ভালোলাগে। ফাহিম যে ওর বিরক্তির কারন তা-না। ফাহিম নিঃসন্দেহে চমৎকার মানুষ। তবে মানুষের ক্ষেত্রে একটি চরম প্রবাদ আছে, মানুষ মাত্রই নিজের পছন্দের জিনিসটাতে আকর্ষিত হয়। ফাহিম চমৎকার, তবে সে আফরার হৃদয়ে ক্ষুদ্র আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি যেটা ফারহান পেরেছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে হঠাৎ মিসেস নাবিলা বলে ওঠলো,

-আমার ছেলেটাকে কেমন লাগে তোমার আফরা?

আফরা হকচকিয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনি কি ফাহিমের কথা বলছেন?

-হ্যাঁ।

আফরার মনে হঠাৎ খটকা লাগে। সেদিন রাতে আফরার বাবাও জিজ্ঞেস করেছিলো ফাহিমের কথা। তাছাড়া শুরু থেকেই মিসেস নািলার আচরণ কেমন জানি অদ্ভুত। বাঙালিদের ট্রেডিশন মতে এখানে কখনোই যুবকের সাথে এক যুবতীর অবাধে ঘোরাফেরা হয়না যেটা আফরা করতে পারছে। তাছাড়া মিসেস নাবিলার বারবার ফাহিমকে রিপ্রেজেন্ট করা, ওর সাথে একান্তে সময় কাটানোর ক্ষেত্রে খুব সচেতন। কিন্ত কেনো?

-এত কি ভাবছো আফরা?

মিসেস নাবিলার ডাকে ওর ধ্যান ফিরলো। অবাক প্রসন্ন হয়ে বললো,

-আপনি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করছেন যে?

-একজন ছেলের মা কেন একটি মেয়েকে এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করে তা তোমার ধারনা আছে?

রহস্যের হাসির আদলে কথাটি বলেন মিসেস নাবিলা। আফরার মনের গভীর সন্দেহ এবার গভীর থেকেও আরও গভীরতর হলো। নিশ্চিত উনার কোনো একটা পরিকল্পনা আছে এসব নিয়ে। তই আফরা খুবই সুক্ষ্ণভাবে এড়িয়ে গেলো মিসেস নাবিলাকে। বললো,

-আমি একটু বাইরে টি এস্টেটটা ঘুরে আসি। ঘরে ভালোলাগছে না।

টি এস্টেটের নাম করে গেলেও আফরার উদ্দেশ্য ছিলো একবার ফারহানের সাথে দেখা করার। তবে সে বাড়িতে নাই। ঘরে তালা ঝুলে আছে। আফরা এতে অবাক না হয়ে পারলো না। ছেলেটা সেই যে সকালে উত্তর গাঁও থেকে গাড়ি নিয়ে বেরোলো , আর খবর নেই। অবশ্য ইলা বলেছিলো , যে ফারহান আগে নাকি ঘরেই থাকতো না। ফজরের আযানের পর বেরোতো আর ফিরতো রাত সাড়ে বারোটার পর।

সিলেটের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে রাত ১২ টায় বাহিরে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়। প্রায়শই সেনাবাহিনীর চার্জ পড়ে আশপাশে। তবুও ফারহানের হুঁশ হলো না। এই মিটিং-ওই মিটিং, এই নেতা-ওই নেতা’র সাথে সাক্ষাতের জন্য ছুটে যেতো যখন তখন। যদি হরতাল বা কারফিউ হয় তবে তো কথাই নেই। এ সময় হয়তো জেলে মামলা খাটা আসামি হয়েছে, নতুবা গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থেকেছে।

এমন একটা পাষাণ মানুষের তবুও মানুষের জন্য রয়েছে গভীর চিন্তা। এখনও তাই এখানকার মানুষদের প্রয়োজনে ছুটে যেতে দ্বিধা করেনা। কলেজ লাইফে ও শুধু ছাত্রদের অধিকারের জন্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেও পরে নিশে গেলো সাধারন মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে। ছেলেটা ছোট থেকে কষ্ট নিয়ে বড়ো হয়েছে, তাই একটু হলেও বুঝে মানুষের সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারটি।

আফরার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। তারপর পুরো দুপুর নিজ মনেই সবুজে সমারোহ চা বাগানের মাঝে বিচরণ করতে লাগলো। অদূরেই দেখা যাচ্ছে ভারতের মেঘালয়ের উচুঁ উচুঁ পাহাড়। সেই সাথে মনে পড়ছে এখানে এতদিনের থাকা সমস্ত ঘটনাগুলো। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি কোণায় বিচরনের মধুর স্মৃতিগুলো। হঠাৎই ওর পেছন থেকে শোনা গেলো এক শক্ত পুরুষালি কন্ঠ,

-মেঘালয়ের মতো আপনারও কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা আছে আফরা, আপনার এই ক্ষমতা মানুষকে এতটাই মুগ্ধ করবে যে আপনার কথাই নিউরনে আলোড়িত হতে বাধ্য।

আফরা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। কথাটা বুঝতে ওর পাক্কা দুই মিনিট লেগেছে কেননা ফারহানের এই কথাগুলো ছিলো খুবই কঠিন। তবে যেই না কথাগুলো ও ধারন করতে পারলো সারা শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি ছেয়ে গেলো। চোখে মুখে উৎফুল্লতার রেশ। ফারহান দাঁড়িয়ে আছে গাছে হেলান দিয়ে, হাত জোড়া ভাঁজ থাকলেও ঠোঁটে রহস্যময়ী হাসি। শ্যামবর্ণের এই লোকটি মুহূর্তেই যে কাউকে পাগল করার মতো তীব্র ক্ষমতা নিয়ে এসেছে বোধহয়। আফরা এবার খানিকটা এগিয়ে এলো ফারহানের কাছে। ফিসফিসালো কন্ঠে বলে ওঠলো,

-কাউকে মুগ্ধ করতে পারবো কিনা জানিনা , তবে আপনাকে মুগ্ধ করলেই চলবে।

নিঃসংকোচ কথা ওর। ফারহান ভেবে পায়না এই মেয়ে এতটা খোলামেলা সহজসরল কেনো, বাঙালি মেয়ে মানেই তো লজ্জার আবরণ আর অস্বস্তি ঘিরে থাকবে। তবে এসব কিছুই ওর মধ্যে নেই। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-আমার সাথে ফ্লার্ট করার ট্রাই করছেন?

-আগে প্রচুর ফ্লার্ট করতাম ছেলেদের সাথে। তবে আপনাকে দেখে ওসব ভুলে গিয়েছি। এমনকি ভবিষ্যতেও করবো না।

আরও একবার বিষয় খেলো ফারহান আফরার কথায়। এই মেয়ের রূপের তেমন তেজ কথাবার্তার তেজ যেন সীমা অতিক্রম করেছে। ভ্যাপসা দুপুর। তবুও বহমান ফুরফুরে হাওয়া। দুপুরের রোদ্দুর পশ্চিম দিকে খানিকটা হেলে যাওয়াতে জানান দিচ্ছে যে কিছুক্ষণ পরই বিকেল ঘনিয়ে আসবে। বর্ষাকালের বিকেলটা অনেক সুন্দর। অন্য এলাকাগুলোর কথা ফারহান তেমন জানে না তবে এই চায়ের রাজ্যের শেষ বিকেল ওর কাছে দুর্দান্ত লাগে। মাঝে মাঝে ক্লান্তি নিনির্মেষে এভাবেই সিক্ত পথের এক কোণে বসে নিবিড়ভাবে অনুভব করতো বিকেলটা। তবে ফারহানের সেই বিকেলগুলোতে কাজ করতো একধরনের শূণ্যতা। মনে হতো , কিছু একটা নেই ওর সাথে। ওর মধ্যে কিছু একটার কমতি আছে যার জন্য এই প্রকৃতি ওকে আপন করে নিচ্ছে না। ফারহান এসব ভাবনা বন্ধ করে গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই আফরাকে জিজ্ঞেস করলো,

-এই অসময়ে বাংলোর বাহিরে এখানে ঘুরছেন কেনো?

-এভাবেই ঘুরছিলাম। বাড়িতে মিসেস নাবিলা ছাড়া কেউই নেই তো। তাই ভালো লাগছিলো না।

ফারহান কিছু বললোনা। আফরা এবার চোখজোড়া ছোট ছোট করে বলে ওঠলো,

-আচ্ছা, আপনি তখন উত্তর গাঁও থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বলেন তো?

ফারহান এবার কি বলবে ভেবে পেলো না। কেননা সবার অগোচরে সে গিয়েছিলো নিজাম সাহেবের সাথে দেখা করতে। ইলেকশনের জন্য ওমর খুব ঝামেলা করছে। আর ফারহানের হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কেউই ভালো চোখে দেখছে না। আবার তখন ফারহান এই চক্রান্তের মূল কালপ্রট এর বিপক্ষে থাকার কারনে উপর মহল থেকে আগোচরে নির্দেশ এসেছে ফারহানকে মেরে ফেলার জন্য। নিজাম সাহেব তাই ওকে সাবধান করে বলে দিয়েছেন কিছুদিনের জন্য এলাকিটি ত্যাগ করতে। ওমরের হাত অনেক দূর পর্যন্ত। তাই ওকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাববে না।
ফারহান সুক্ষ্ম চালে এড়িয়ে খানিকটা সন্দিহান হওয়ার ভান করলো আফরার মুখপানে চেয়ে। জিজ্ঞেস করলো,

-আপনাকে কেনো বলবো? আমার লাইফ,,আমি যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে লিড করতে পারি। এট এনি চান্স আপনি কি আড়ালে আবডালে আমার ওপর নজর রাখছেন? ইন্টেরেস্টিং,,,,,,,,,!

শেষ কথাটি ফারহান বললো রম্য কন্ঠে, চোখে মুখে চরম কৌতুহলতার ছাপ। আফরা আমতা আমতা করে বললো,

-আমি…….আমি কেনো আপনার ওপর নজর রাখবো?

-সেটা তো আপনিই জানেন। কেনো নজর রাখেন আমার ওপর?

বলেই ফারহানের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আফরাকে এভাবে উত্যক্ত করে ভালো লাগছে বেশ। ফারহান জানে আফরা ওর প্রতি দুর্বল, আর এর সুযোগটা নিতে ফারহান কখনোই বিলম্ব করে না। আফরা মুখ ফুলিয়ে বললো,

-এমন কিছুই না। আমি,,,,,আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।

-আমায় নিয়ে আপনার একটু বেশিই চিন্তা আফরা। শুনুন, আপনি এখানে আমার জন্য চিন্তা করতে আসেননি , এসেছেন ঘুরাফিরা করতে। আর আপনি সেরকম কিছু না করে আমার পেছনে পড়ে আছেন । উফফফ! ইউ আর টু মাচ সিলি গার্ল আফরা।

আফরার রাগে অপমানে মুখ কালো হয়ে গেলো। একই সাথে নিজেকেও অবাধে গালি দিতে মন চাইছে। আগে তো ও এমন ছিলো না। তাহলে এখন এমন টিন এজারদের মতো আচরণ করছে কেনো ফারহানের সামনে। যতবারই ও চেষ্টা করে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করতে অমনেই সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। মানুষের কাছে এতটা প্রশংসা পেয়ে কি লাভ যদি পছন্দের মানুষটার সামনেই হাসির পাত্র হতে হয়?

আফরা এবার রাগে দুঃখে বাংলোর দিতে ফিরে যেতেই ফারহান ওর হাতের কব্জি চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। মিহি কন্ঠে বললো,

-এত রাগ কোথায় রাখেন আপনি? খালি কথায় কথায় ভুতের মতো এদিক ওদিক চলে যান?

আবারও। আফরার এবার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে। ফারহান ভ্রু উচিয়ে বললো,

-রাগ হচ্ছে আমার ওপর?

-অনেক।

-ইচ্ছে করছে আমায় একেবারের চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে?

-হুম।

-তাহলে তো আপনার রাগ ঠান্ডা করতে হয় দেখছি। তো! যাবেন আমার সাথে?

আফরা চুপসে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

-কোথায় যাবো?

-গেলেই নাহয় দেখতে পারবেন…………ইটস সারপ্রাইস মিস উইয়ার্ড গার্ল!

শেষ কথাটি ফারহান বললো আফরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে, একেবারে হৃদয় বিদীর্ন কন্ঠে। আফরার সারা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেলো এতে। আকাশ জানান দিয়েছে এখন বিকেলের প্রহর। রোদের হালকা মিষ্টি আলো ফারহানের মুখটা সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। কি ঘোরতর সেই দৃষ্টি। আফরার মনে হলো , এই লোক নিজের চাহিনী দিয়ে একেবারেই মেরেই ফেলবে ওকে। মাথার ওপরের গাছ থেকে ঝরে পড়ছে ছোট ছোট শিউলি ফুল। আফরা মাথা নাড়ালো। অর্থাৎ ফারহান ওকে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যেতেই ও রাজি। শ্রীমঙ্গলের প্রতিটি পথ-প্রান্তরে সে নাম লিখাবে ফারহানের সাথে।❤
.
.
~চলবে……..ইনশাআল্লাহ!