অতল গহ্বরে নীরবতা পর্ব-৩৩+৩৪

0
310

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩৩

ইশরা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে আমায়রার সামনে ধরলো। আমায়রা তাকিয়ে একদম হা হয়ে গেল।

রায়ানের সাথে হাত ধরে খালি পায়ে হাঁটার একটা ছবি রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরীর আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে একঘন্টা আগে। ছবিটা কখন তুললো জানে না আমায়রা। সে তে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত ছিলো। আর ছবিটাতো রায়ান তুলেনি। তাহলে কে তুলেছে? আমায়রার ভাবনার মাঝেই তার এক ক্লাসমেট রামিজা পিছন থেকে বলে উঠলো,
“ভালোই তো সিনিয়র ভাইয়ের সাথে চলছে আমায়রা। টপার, ধনী ছেলে পটিয়েছো আর কি লাগে! ভালোই বফ জুটিয়েছো।”

আমায়রা পিছু ঘুরে রামিজাকে দেখে হেসে বলল,
“ওও রামিজা যে, তুমি হয় তো জানো না উনি আমার একমাত্র সন্টুমন্টু বরমশাই। তাই উল্টোপাল্টা কিছু বলার আগে জেনেশুনে বলবে দয়া করে।”
রামিজা অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে বলল,
“কিহ!”

আমায়রা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“এতো কি কি না করে নিজের চরকায় তেল দেও।”

রামিজা ভ্রুকুচকে বলল,
“মিথ্যা কথা বলছো তাই না?”

আমায়রা হাসলো। ইশরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ক্লাসে চল”

বলেই রামিজাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

ক্লাস শেষে বের হতেই কিছু মেয়ে এসে ঘিরে ধরলো আমায়রা আর ইশরাকে। সবাই চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আমায়রার দিকে। আমায়রা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“কি সমস্যা?”

তাদের মধ্যে থেকে একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“রায়ান ভাইকে নিয়ে তুমি নাকি মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছো?”

আমায়রা কিছু বলতে নিবে তার আগেই আরেকটা মেয়ে বলে উঠলো,
“তোমাদের মতো মেয়েদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই, শুধু গল্প বানিয়ে বেড়াও। এইসব করে কারো ভালোবাসা পাওয়া যায় না। রায়ান ভাইয়ের মতো একজন সম্মানিত মানুষকে নিয়ে এভাবে মিথ্যা রটিয়ে বেড়ানোর সাহস কোথা থেকে পাও?”

আমায়রা হেসে বলল,
“ওহ আচ্ছা গল্প লাগছে তোমাদের কাছে। তা তোমাদের রায়ান ভাইকে গিয়েই না হয় জিজ্ঞাসা করো আমি তার কে? আর আমার বরাবরই বেশি। কাউকে সাহস দেওয়া লাগেনা। আমার নিজের মাঝেই যথেষ্ট সাহস আছে।”

আমায়রার কথা শেষ হতেই সেখানে শিহাব এসে বলল,
“ওটা তো তোমাকে বোকা বানিয়েছে সোনাপাখি।”

সবাই তাকালো শিহাবের দিকে। আমায়রা ভ্রুকুচকে তাকালো শিহাবের দিকে।

শিহাব হালকা হেসে সবাইকে পাশ কাটিয়ে আমায়রার সামনে এসে চোখের সানগ্লাস নাচিয়ে ঠোঁট উচিয়ে বলল,
“আহারে, তুমি কত বোকা তাই না। রায়ানটা তোমায় বোকা পেয়ে বাজি জিতে গেল।”

আমায়রা কপাল কুচকে বলল,
“বাজি মানে?”

শিহাব ওর সাথের ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হেসে বলল,
“দেখ দেখ মাইয়া এখনো বুঝেই নাই।”

বাকি ছেলেগুলোও হাসছে। আমায়রা চরম বিরক্ত হলো। ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিবে তখনি শিহাব ওর একটা হাত চেপে ধরে বলল,
“কোথায় যাও সুইটহার্ট, শুনে তো যাও।”

আমায়রা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো শিহাবের দিকে। দাঁত পিষে বলল,
“হাত ছাড়ো আমার”

শিহাব দাঁত বের করে হেসে বলল,
“বাহ মামনির তেজ আছে বলতে হবে। হাত আমি ছাড়বো না।”

আমায়রা তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,
“ছাড়বি না তো!”

শিহাব ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“না ছাড়বো না।”

আমায়রা তার অপর হাত দিয়ে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে শিহাবের গালে। শিহাবসহ বাকি সবাই থমকে গেল। শিহাব খানিকক্ষণ সময় নিলো কি হয়েছে তা বোঝার জন্য। বিষয়টা মাথায় খেলতেই। নাকমুখ খিচিয়ে শিহাব আমায়রাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে গায়ে হাত তুলতে নিবে তার আগেই এক বলিষ্ঠ শক্তিশালী হাত ধরে ফেলল তার হাতকে। শিহাব বিরক্ত হলো। নাকমুখ খিচিয়ে বলল,
“কেরে আমারে বাঁধা দেয়?”

বলেই পাশে তাকায় শিহাব। শিহাব তাকিয়ে দেখে রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরী তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। রায়ানকে বেশ শান্ত স্বাভাবিক লাগছে। রায়ানের উপস্থিতিতে চারপাশে মুহূর্তেই নীরবতা নেমে এসেছে। শিহাব প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে, কিন্তু রায়ানের চোখে যে সতর্ক বার্তা দেখা গেল, তা যেন শিহাবকে স্থির হতে বাধ্য করল।

রায়ান ধীরে ধীরে শিহাবের দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোর সাহস বেড়েছে বটে, শিহাব। তবে ভুলে যাস না, এখানেও আমি আছি। ওর দিকে আর একবারও এমনভাবে হাত তোলার চেষ্টা করলে পরিণাম কী হতে পারে, সেটা তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আগে থেকেই সতর্ক করলাম। এরপরে কিছু হলে আমাকে বলতে আসবিনা।”

শিহাব গলায় কথা আটকে রায়ানের শক্ত হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।

রায়ান তার হাত ঝাটকা দিয়ে ছেড়ে দিল, কিন্তু শিহাব তখনই পালিয়ে গেল না। সে ক্ষুব্ধ চোখে রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর তো কপালে বেশ সুখ দেখছি। এই মেয়েটা তোর জন্যই নিজের তেজ দেখাচ্ছে।”

রায়ান হালকা হেসে বলল,
“সুখ আর তেজের সংজ্ঞা বোঝার জন্য তোর আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। আর এখন এখানে দাঁড়িয়ে নিজের অপমান বাড়ানোর আগে এখান থেকে বেরিয়ে যা।”

শিহাব কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমায়রার দৃঢ় দৃষ্টির সামনে সে আর কিছু না বলে সেখান থেকে সরে গেল।

রায়ান আমায়রার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“সব ঠিক আছে তো?”

আমায়রা রায়ানের চোখের দিকে তাকাল। তার মনের ক্ষোভ একটু কমলেও সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“আমি নিজেই নিজের জন্য দাঁড়াতে পারি।”

রায়ান একটু হাসল,
“আমি জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে, কোনো কোনো যুদ্ধে একা না লড়া ভালো। পাশে কাউকে রাখা খারাপ নয়।”

আমায়রা চুপ করে রইলো। ইশরা এগিয়ে এলো সামনে। রায়ান মুচকি হেসে ইশরাকে বলল,
“ধন্যবাদ ঝামেলার কথা জানানোর জন্য।”

ইশরা বিনিময়ে হাসলো। রায়ান চারপাশের সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“কাদের জানি কি সমস্যা?”

সবাই চুপ করে রইলো। কেউ কিছু বলছেনা। রায়ান একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে আমায়রাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“আমি আমায়রাকে বিয়ে করেছি। আমায়রা আমার বিবাহিত স্ত্রী। তাই বলছি এরপর কারো কোনো কথা থাকলে সে যেন আমার সাথে এসে বলে।”

বলেই আমায়রার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো রায়ান। সোজা গেট পেরিয়ে বাইকের সামনে এসে থামলো সে।

রায়ান বাইকে উঠে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে বলল,
“চল, উঠো।”

আমায়রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। এই হঠাৎ করে রায়ানের ঘোষণা, তার পাশে দাঁড়ানো, এসবের মানে কী? সে কি সত্যিই তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, নাকি এ শুধুই পরিস্থিতি সামলানোর জন্য?

আমায়রা নীরবতা দেখে রায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ছোট মাথাটায় এতো চাপ দিও না বউ। কোন সময় না আবার বোমের মতো ফেঁটে যায়!”

আমায়রা চোখ গরম করে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান ঢং করে বলল,
“আরে বউ আমি তো সবসময়েই তোমার কাছে আছি পরে না হয় দেখো। রাস্তায় এমন করে তাকিয়ে থেকো না। তোমার ভোলাভালা বরটার যে লজ্জা করে।”

রায়ান এমন ঢঙের কথা শুনে আমায়রার গা জ্বলে উঠলো। দাঁত পিষে বলল,
“আপনি আপনার ফালতু কথা নিয়ে থাকুন। আমি একাই যেতে পারবো বাসায়।”

রায়ান মুচকি হেসে বলল,
“বউ, এত রাগ করলে তো চলবে না। এখন চল উঠো, দেরি হলে আবার আম্মু বকা দিবে।”

আমায়রা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
“আপনার এসব ন্যাকামি আমার একদম সহ্য হয় না। আর আমার বাসায় যাওয়ার জন্য আপনার সাহায্য লাগবে না।”

বলেই আমায়রা হাঁটা দিলো। রায়ান ওর পিছু পিছু বাইক নিয়ে আসতে লাগলো। আর বউ বউ করতে লাগলো। রাস্তার মানুষ সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমায়রা চরম বিরক্তি নিয়ে দাঁড়ালো। রায়ান ও দাঁড়ালো। আমায়রা ধুপধাপ বাইকে উঠে বসলো। রায়ান হাসলো। আমায়রা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চলুন, এখন যাচ্ছেন না কেন?”

রায়ান চোখের চশমা ঠিক করে লুকিং গ্লাসে আমায়রার বিরক্তি ভরা চেহারার দিকে তাকালো। মুচকি হেসে বাইক চালাতে লাগল।

—————

আবির ক্লাসে বসে ঝিমাচ্ছে। তার সবথেকে বিরক্তিকর টাকলা ব্যাটার ক্লাস করা লাগছে। একে তো রায়ানের জ্বালায় সকাল সকাল উঠে ওদের ছবি তোলা লাগছে চোরের মতো লুকিয়ে তার উপর এখন এই বিরক্তিকর ক্লাস করা সব নিয়ে যেন খিচুড়ি পেঁকে যাচ্ছে আবির মন মস্তিস্কে।

বেশ কিছুক্ষন যাবত তার পাশ থেকে তার বন্ধু তন্ময় তাকে খোঁচাচ্ছে। আবির বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”

তন্ময় ফিসফিসিয়ে বলল,
“স্যার তোর দিকে তাকিয়ে আছে।”

আবির ঝিমানো গলায় বলল,
“ভালো”

কাবিল স্যার এগিয়ে এলো আবিরের দিকে। রাশভারী গলায় বলে উঠলো,
“এই ছেলে দাঁড়াও।”

আবির কাচুমাচু মুখে উঠে দাঁড়ালো। কাবিল স্যারের ভ্রু একটু কুঁচকে আছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“তোমার ঝিমানো দেখে মনে হচ্ছে ক্লাসে তুমি খুবই আগ্রহী। বলো তো, আমি কি পড়াচ্ছি?”

আবির নিজের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠল,
“স্যার, ম্যাথ করাচ্ছেন।”

স্যার বিরক্ত গলায় বললেন,
“ঠিকই বলেছ। তবে কোন টপিক পড়াচ্ছি, সেটাও বলবে কি?”

আবির কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ক্লাসের বাকি সবাই চাপা হাসি হাসছে। পাশে তন্ময় চাপা স্বরে বলল,
“ক্যালকুলাস, ভাই ক্যালকুলাস!”

আবির এক মুহূর্ত থেমে মাথা চুলকে বলল,
“স্যার, ক্যালকুলাস পড়াচ্ছেন।”

স্যার কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার আত্মবিশ্বাস শুনে মনে হচ্ছে তুমি এই বিষয়ে ভালোই জানো। তা হলে বোর্ডে এসে একটা সমাধান করো।”

#চলবে

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩৪

আবির আমতা আমতা করতে লাগলো। ম্যাথের কিছুই সে দেখেনি এতক্ষন তাহলে পারবে কি করে? মনে মনে বলল,
“শালা টাকলা তুই খালি আমারেই বাঁশ দিতে পারিস। দেখছিস আমার ঘুম হয়নি কোথায় আমাকে ঝিমাতে দিবি। তা না এখন সামনে গিয়ে ম্যাথ করো। সব শালা ওই বিটকেলের দোষ। হারামখোর তোরে খালি বাগে পাই বাজিয়ে ছাড়বো।”

আবিরের ভাবনায় ছেদ ঘটলো কাবিল স্যারের ধমকে। আবির ভাবনার সুতো ছিড়ে এগিয়ে গেল সামনে। ম্যাথটা দেখে মাথার মধ্যে তালগোল পাকাচ্ছে তার। আবির সামনের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বুঝে উঠতে পারছিল না ম্যাথটা কোথা থেকে শুরু করবে। বোর্ডে ভরা সংখ্যাগুলো যেন তার দিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তাকিয়ে হাসছে।

কাবিল স্যার পাশে দাঁড়িয়ে চোখ গরম করে বললেন,
“কি হলো? দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছ কেন? শুরু করো।”

আবির মুখে একটা হাসি এনে বলল,
“স্যার, একটু সময় দেন তো, সমাধানটা মনে করার চেষ্টা করছি।”

কিন্তু আসলে সমাধান দূরের কথা, প্রশ্নটাই তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে তার কপাল। ব্যাক বেঞ্চে বসা বন্ধুরা চাপা হাসি দিয়ে ফিসফিস করছে,
“আবির তোর খবর আছে!”

কাবিল স্যার ধমকের সুরে বললেন,
“সময় নেই বেশি। শুরু করো।”

আবির বোর্ডের দিকে আবার তাকাল। মনে মনে বলল,
“শালার রং-বাজ ম্যাথ! এত কঠিন কেন? আর এই টাকলা স্যার, যেন আমার সর্বনাশ করার জন্যই জন্মেছে।”

শেষমেশ কিছু একটা লেখার ভান করে বোর্ডে একটা ভুল সমাধান টানল আবির। স্যার তার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
“এটা কি করেছ? এমন উত্তর কি কেউ দেয়?”

আবির মাথা নিচু করে আস্তে বলল,
“স্যার, একটু ভুল হয়ে গেছে মনে হয়।”

ক্লাসে হাসির রোল পড়ল, আর কাবিল স্যার বললেন,
“তোমার ভুল সবসময় তোমার সঙ্গী। চলো, আবার বসো। পরেরদিন প্রিপারেশন নিয়ে আসবে।”

আবির ভেতরে ভেতরে মুচকি হাসল। ভাবল,
“যাক বাবা এবারের মতো তো বেঁচে গেল। তবে ওই বিটকেলরে ছাড়ব না, এটা তো ঠিক করেই রেখেছি!”

আবির তন্ময়ের পাশে এসে ধপ করে বসে পরলো।

খানিকবাদে কাবিল স্যার বেড়িয়ে যেতেই ওরাও বেড়িয়ে পরলো। ব্যাগ কাধে নিয়ে মুখ ফুলিয়ে হাঁটছে আবির। মনে মনে রায়ানকে বকছে। বেখেয়ালিতে কার সাথে যেন ধাক্কা খেল আবির। চটে উঠে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবির ভালো করে দেখতেই চিনে ফেলল এ তো কাবিল স্যারের ছোট মেয়ে রোজা। রোজা বলে উঠলো,
“চোখ নেই আপনার। চোখ কি বাসায় রেখে এসেছেন?”

আবির মনে মনে বলল,
“নারে টাকলা স্যারের পকেটে রেখে এসেছি।”

মনের কথা মনে রেখেই সরি বলে চলে আসতে নিবে তখনি পেছন থেকে রোজা ডেকে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“এরপর চোখ বাসায় না রেখে নিজের চোখে নিয়ে হাঁটবেন।”

আবিরের কিছু বলার আগেই গটগট পায়ে চলে গেল রোজা।

রোজার কথায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আবির। মনে মনে বলল,
“এই টাকলা স্যারের মেয়েটাও দেখি টক্কর দিয়েছে বাপরে। কথার ঝাঁঝ দেখে তো মনে হচ্ছে, আমাকে বানিয়েই ছাড়বে ওর শত্রু।”

তন্ময় পাশে দাঁড়িয়ে গুটিগুটি হাসতে লাগল। বলল,
“কী রে, তুই তো দেখি কাবিল স্যারের ফ্যামিলির সাথেও ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলছিস!”

আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
“চুপ কর। স্যারই তো আমার দিন রাত তছনছ করছে, আর এখন মেয়েটাও শুরু করল। সব পৈতৃক ঐতিহ্য বোধহয়!”

তন্ময় মজা করে বলল,
“দোস্ত, তুইই তো শত্রু বানাচ্ছিস।”

আবির গম্ভীর মুখে বলল,
“তোর ফালতু কথা তোর বুক পকেটে রাখ। আজ থেকে এই রোজা মেয়েটাকেও আমার হিটলিস্টে ঢোকালাম।”

তন্ময় হেসে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, প্লেয়ার। কিন্তু মনে করিস, তুই বেশি চালাকির চেষ্টা করলেই শেষমেশ প্যাঁচে পড়বি।”

আবির চোখ ছোট করে বলল,
“তুই দেখতে থাক, এতো ভাবতে হবেনা তোকে আর আমি খেলা দেখাই।”

তন্ময় মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হ পরে আমার কাছে কানতে আসবিনা বলে দিলাম।”

আবির ও মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“যা যা যামুনা।”

————

ভার্সিটি থেকে আমায়রাকে নিয়ে বাসায় রেখে যাওয়ার পর আর রায়ানের দেখা বা খোঁজ খবর পায়নি আমায়রা।

ঘরিতে রাত আটটা আমায়রা বিছানায় বই খাতা রেখে এসাইনমেন্ট করছে মন দিয়ে। হুট করে কোথা থেকে যেন রায়ান রুমে এসে বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে আমায়রার কোলে মাথা রেখে মুখ গুজে দিলো ওর পেটে। আমায়রা সারা শরীর কম্পিত হলো রায়ানের স্পর্শে। রায়ানের উষ্ণ নিশ্বাস বারি খাচ্ছে আমায়রার উদরে। আমায়রার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। রায়ান এলোমেলো চুলগুলো খালি দেখা যাচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছেনা। আমায়রা ধীর গলায় বলে উঠলো,
“এ কি করছো আপনি? ওঠুন তো!”

রায়ান কোনো উত্তর দিল না, শুধু গভীর শ্বাস ফেলে আমায়রার পেটের ওপর মাথা গুঁজে রইল। আমায়রার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্র যেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরে উঠল। তার গলায় আরেকবার ঝাঁঝালো সুরে উঠে এলো,
“আপনি এমন করছেন কেন?”

রায়ান ধীরে ধীরে মাথা তুলল, আমায়রা রায়ানের বিধ্বস্ত মুখ দেখে অজান্তেই অস্থির হয়ে উঠলো।রায়ানকে এমন দেখাটা আমায়রার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। আমায়রা বলে উঠলো,
“কি হয়েছে আপনার?”

রায়ান আলতো হাতে আমায়রার গালে হাত রেখে ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
“আচ্ছা তুমি কি আমাকে ছেড়ে দিবে?”

আমায়রার কপালে ভাঁজ পরলো রায়ানের কথায়। হঠাৎ করে রায়ান এই কথা বলছে কেন মাথায় আসছেনা আমায়রার। আমায়রা বলে উঠলো,
“মানে, কি বলছেন আপনি এসব?”

রায়ান হুট করেই আমায়রাকে ছেড়ে উঠে বসলো। ধীর কন্ঠে বলল,
“কিছু না।”

বলেই রায়ান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমায়রা কপাল কুচকে তাকিয়ে রইলো রায়ানের যাওয়ার দিকে।

রায়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো, চোখমুখ ধুয়ে একেবারে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। আমায়রা ততক্ষণে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রায়ানের আচরণের কারণ বোঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই মাথায় আসছে না কেন রায়ান হঠাৎ এত অদ্ভুত আচরণ করছে।

রায়ান একটা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে আস্তে করে বলল,
“তোমার কাজ শেষ হলে রাতের খাবার শেষ হলে একটু ছাদে যাবে?”

আমায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
“রাতে?”

রায়ান জবাব দিল,
“হ্যাঁ। একটু কথা বলার দরকার আছে। তবে যদি তোমার অস্বস্তি লাগে, তাহলে থাক।”

রায়ানের কণ্ঠে এমন একটা গভীরতা ছিল যা আমায়রাকে না বলতে দিল না। সে একটু ইতস্তত করেই বলল,
“আচ্ছা।”

রাতের খাবার শেষ করে আমায়রা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে লাগলো আর ভাবতে লাগলো রায়ানের কি এমন হয়েছে যে সে এমন করছে?

আমায়রা ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে রায়ানকে খুঁজতে লাগলো। আর একটু সামনে যেতেই কানে ভেসে উঠলো মৃদু গলায় গান গাওয়ার আওয়াজ,
“Main aa likkhoon tu aa jaaye
Main baith likkhoon tu aa baithe
Mere shaane par sar rakhe tu
Main neend kahoon tu so jaaye
Main aa likkhoon tu aa jaaye
Main baith likkhoon tu aa baithe
Mere shaane par sar rakhe tu
Main neend kahoon tu so jaaye!”

আমায়রা দেখলো রায়ান ছাদের কাণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। আমায়রা ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রায়ানের কাছে। রায়ানের পাশে দাঁড়াতেই রায়ান শান্ত সুরে বলে উঠলো,
“আজকে কিছু কথা আমি তোমাকে জানাতে চাই। যা আবির ছাড়া কেউ জানেনা। প্লীজ মন দিয়ে কথাগুলো শুনো আর বোঝার চেষ্টা করো।”

রায়ানের কথাগুলো শুনে আমায়রার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। রায়ান সাধারণত এমন গম্ভীর হয় না। তার মধ্যে এক ধরনের রহস্য গ
খেলা করছিলো, যা আমায়রার নজর এড়ায়নি। রায়ানের গলা এবার একটু নরম হয়ে এলো।

রায়ান আবারো আমায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুনবে?”

আমায়রা ইতস্তত হয়ে উত্তর দিলো,
“বলুন”

রায়ান তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে আকাশের জ্বলজ্বল করা তারাগুলোর দিকে তাকালো। গলা খাকারি দিয়ে বলতে লাগলো,
“আমি যখন অনার্স ফাস্ট ইয়ার তখন আমি, আহাদ, ইয়াসিন আর আরুসা ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড।ছোট থেকেই আমরা একসাথে আছি।সারাদিন আড্ডা মজা মাস্তি এসব নিয়েই থাকতাম। তো হুট করেই কিছুদিন যাবত আরুসা অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। আমরা অনেকবার জিজ্ঞাসাও করেছিলাম কিন্তু কিছু বলে নি আমাদের। সে বছরে পরীক্ষায় ও খুব খারাপ রেজাল্ট করে। আমাদের সন্দেহ আরো গাঢ় হয় যে ওর কিছু একটা হয়েছেই। জানার খুব চেষ্টা করেছিলাম কি হয়েছে কিন্তু আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তারপর একদিন খবর আসে ও নাকি সুই*সাইড করেছে।”

থামলো রায়ান। কথাগুলো যেন গলায় আটকে আসছে তার। চোখের সামনে আরুসার হাসিমুখটা ভেসে উঠছে বারবার।

রায়ান থেমে যাওয়ায় আমায়রা অস্থির কন্ঠে বলল,
“আরুসা আপু হুট করে এমন কাজ কেন করলো? কি হয়েছিলো ওনার?”

রায়ান জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারো বলতে লাগলো,
“আমরাও প্রথমে থমকে গেছিলাম খবরটা শুনে। কারণ আরুসা অনেক স্ট্রং একটা মেয়ে ছিলো। কোনো ছোট খাটো বিষয় নিয়ে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মেয়ে ও না।”

রায়ান আবারো দম নিয়ে বলল,
“পরে বেশ ঘাটাঘাটি করতে লাগি আরুসা এমন করার কারণ কি তা জানার জন্য”

#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। বেশি বেশি রিয়েক্ট কমেন্ট করবেন।)