#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪১
রায়ান আমায়রার গাল টেনে বলল,
“রাগ করো কেন বলোতো!”
আমায়রা মুখ বাঁকালো। রায়ান মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা বাবা চলো বাসায় যাই।”
বলেই উল্টো পথ ধরলো। আমায়রার সেদিকে যেতে লাগলো। আমায়রা হাঁটতে হাঁটতেই দেখলো কিছু দূরে একলোক ছোট ফুচকা বিক্রি করছে। আমায়রা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“এই যে শুনছেন, আমি ফুচকা খাবো।”
রায়ান কপাল কুচকে তাকালো আমায়রার দিকে। আমায়রা রায়ানের বাহু ধরে বলল,
“চলুন না যাই। অনেকদিন খাই না।”
রায়ান কি যেন ভেবে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“যেতে পারি একটা শর্তে।”
আমায়রা কপাল কুচকে বলল,
“কিহ, খাওয়াতেও আপনার শর্ত!”
রায়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“হুম”
আমায়রা রায়ান দিকে নাক মুখ কুচকে তাকিয়ে বলল,
“বলুন তাহলে তাড়াতাড়ি।”
রায়ান দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“রাতে আমায় চুমু খেতে হবে।”
রায়ানের কথায় চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমায়রার। ব্যাটায় কয় কি? সামান্য ফুচকা খাওয়ানোর জন্য নাকি আমায়রা তার মত বদ ব্যাটারে চুমু খাবে। না এটা তো হতে পারে না। আমায়রা রায়ানের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“আমি একাই কিনে খেতে পারবো লাগবেনা আপনাকে।”
বলেই গটগট পায়ে ফুচকার দোকানের দিকে চলে গেল। ঝাল দিয়ে বেশি করে টক নিয়ে টপাটপ ফুচকা খেতে লাগলো আমায়রা। তার ব্যাগে সে সবসময়ই টাকা রাখে। এহহ ব্যাটা কয় ফুচকার বদলে চুমু শখ কত। রায়ানকে বকতে বকতেই একের পর এক ফুচকা চালান দিতে লাগলো নিজের মুখে। দুপ্লেট খেয়ে একবারে দম নিলো সে। প্রাপ্তির হাসি দিয়ে যেই না ব্যাগে হাত দিলো ওমনি যেন সে আকাশ থেকে পাতালে পরলো সে। একি তার ব্যাগের টাকাগুলো কোথায় গেল?
আমায়রা আশেপাশে তাকালো রায়ানও নেই। এখন কি করবে সে? মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল আমায়রার। তখনি মুখের সামনে এসে হাজির হলো রায়ান। ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
“কি হয়েছে মেডাম?”
আমায়রা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রায়ান হেসে বিল মিটিয়ে আমায়রার কাছে এগিয়ে এসে ঝুকে বলল,
“বউ কথা কিন্তু ওটাই ছিলো।”
আমায়রা কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। রায়ান কল রিসিভ করে কানে নিয়ে বলল,
“আসছি”
আমায়রার হাত ধরে গাড়িতে এনে বসালো। আমায়রাও আর কথা বাড়ালো না। রায়ান এবার সোজা আমায়রাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। আমায়রা নামতে নামতে বলল,
“আপনি আসবেন না?”
রায়ান শান্ত কন্ঠে বলল,
“কিছু কাজ আছে করে আসছি।”
আমায়রা রায়ানের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,
“সাবধানে যাবেন।”
আমায়রার কথায় রায়ান মুচকি হাসলো।
আমায়রা বাড়ির ভিতর চলে গেল। রায়ানও নিজের আস্তানার দিকে রওনা হলো।
——————-
সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছে জানালার গ্ৰীল ঘরে। দৃষ্টি তার দূর আকাশে। তখন থেকে এখানেই দাঁড়িয়ে আছে সে। দরজা বন্ধ করেনি তবুও বন্যা আসেনি বিরক্ত করতে। সুরাইয়া একামনেই বলতে লাগলো,
“প্রেম নামক দহনে পুড়িয়ে,
আজ আমি ছারখার।
কবে যে আসিবে বসন্তের রঙিন হাওয়া,
সে অপেক্ষায় অপেক্ষায় দিন যে কাটে না।”
চোখ বেয়ে দুফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো সুরাইয়ার চোখ বেয়ে। তখনি বন্যা রুমে ঢুকে বলল,
“সুরাইয়া, খেয়ে নেও অসুস্থ হয়ে পরবে তো।”
সুরাইয়া মলিন হেসে বলল,
“আর অসুস্থ, মানসিক ভাবে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। এই অসুখের শেষ নেই হয় তো।”
বন্যা সুরাইয়ার কাছে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“চিন্তা করোনা। দেখবে আল্লাহ তোমার জন্য ভালো কিছুই রেখেছে।”
সুরাইয়া বন্যার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
“আপু তুমি এতো ভালো কেন?”
বন্যা মুচকি হেসে সুরাইয়া কপালে আদুরে চুমু খেয়ে বলল,
“আমার থেকেও তুমি ভালো। তাই তো সবাই তোমার ভালো মনে হয়।”
সুরাইয়া আলতো হাসলো। বন্যা সুরাইয়াকে খাইয়ে দিতে লাগলো। সুরাইয়া বাধ্য মেয়ের মতো বন্যার হাতে খেতে লাগলো।
—————————
আস্তানায় ঢুকতেই আবির চিন্তিত মুখে এগিয়ে গড়গড়িয়ে বলল লাগলো,
“ভাই শিহাব কিভাবে যেন পালিয়ে গেছে। আমি কাজে কোনো গাফিলতি দেইনি। সব তো ঠিকিই ছিলো তাহলে কিভাবে যে ও পালিয়ে গেল।”
রায়ান আলতো হেসে আবিরের পিঠ চাপড়ে বলল,
“আরে রিলাক্স ভাই আমার। আমিই ওকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছি।”
আবির ধাক্কা খেল রায়ানের কথায়। এগুলো কি বলছে সে? রায়ান আবারো হাসি মুখে বলল,
“আরে পাগলা আমার নতুন ফাঁদে ও যে ফেঁসে গেছে।”
আবির অবাক হয়ে বলল,
“মানে, তুমি এগুলো কি বলছো ভাই?”
রায়ান এগিয়ে গিয়ে নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে বলল,
“কাল খবরের হেডলাইন দেখিস এখন নিজের কাজে যা।”
আবির বিরক্ত হলো। চরম লেভেলের বিরক্ত সে। এই চিন্তায় তার রাতের ঘুম হবেনা। আর সে সকাল পর্যন্ত কিভাবে অপেক্ষা করবে। না সে এখনি শুনবে। আবির অস্থির গলায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়ান হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন আমি আর কিছু শুনতে চাই না। যা আমি এখন কাজ করবো।”
“কিন্তু ভাই!”
রায়ান বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকালো আবিরের দিকে। আবির আর কিছু বলার সাহস পেল না। গটগট পায়ে বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। রুম থেকে হয়েই বকাবকি করতে লাগলো রায়ানকে। কি এমন হতো তাকে বললে।
রায়ান আবিরের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। দুপা টেবিলের উপরে তুলে গুনগুনিয়ে গাইতে লাগলো সে।
——————–
অনুভবের মনটা বেশ অস্থির হয়ে আছে। অনুভব নিজের অস্থিরতা কমাতে মায়ের রুমে গেল। আমেনা বেগম বসে বসে কাপড় গোছাচ্ছিলেন। অনুভব এগিয়ে গিয়ে নরম গলায় ডাকলো,
“মা”
আমেনা বেগম ঘুরে তাকালেন। ইশারায় কি হয়েছে তা জিজ্ঞাসা করলেন। অনুভব ধীর পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো।
আমেনা বেগম কাপড় পাশে রেখে আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন ছেলের। নিরবতা ভেঙে অনুভব বলে উঠলো,
“আচ্ছা আম্মু অতীত আকড়ে বাঁচা যায় না?”
আমেনা বেগম ধীর কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“দেখ বাবা মানুষের অতীত মানুষের মনে অনেকটা জায়গা ধরে থাকে। তাই বলে বর্তমান আর ভবিষ্যতকে অবহেলা করা কখনোই উচিত না। কারণ সবকিছুই অতীত হয়। আজ চলে গেলে পরেদিন আসবেই। আর পরেরদিন আসলে আজ অতীতের পাতায় চলে যাবে।”
আমেনা বেগম কিছুক্ষণ থেমে হাত বললেন,
“জীবনে অনেক কষ্ট আসবে, অনেক ভুল হবে। কিন্তু সেসব আঁকড়ে ধরে রাখলে নতুন কিছু গড়তে পারবে না। অতীত থেকে শেখো, কিন্তু সেটায় আটকে থেকো না।”
অনুভব চোখ বন্ধ করে বলল,
“কিন্তু মা, কিছু অতীত এমন হয়, যা ভুলতে গেলে মনে হয় নিজের একটা অংশ হারিয়ে ফেলছি।”
আমেনা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
“অতীত কখনোই তোমার থেকে আলাদা নয়, বাবা। এটা তোমার জীবনের অংশ। কিন্তু সেটাই তোমার পুরো জীবন নয়। নতুন গল্প গড়তে হলে, পুরনো পাতা বন্ধ করতেই হবে।”
অনুভব মায়ের কথাগুলো শুনে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। মায়ের এই কথাগুলো যেন তার মনের ভার একটু হালকা করলো।
———————–
আমায়রা বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই নূর দৌড়ে এলো তার কাছে। আমায়রা মুচকি হাসি দিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো। টুক করে একটা চুমু খেল নূরের গালে। নূরও চুমু খেয়ে আমায়রার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল,
“বার্বি ডল তোমার হাতে ওটা কি?”
আমায়রা হাসলো আসার সময় নূর, নাইমা, নেহা ওদের জন্যেও ফুচকা নিয়ে এসেছে সে।
আমায়রা ওকে নিয়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরে। হেল্পিং হ্যান্ড খালাকে প্লেটে রাখতে বলল। নূরকে রেখে সে গেল ফ্রেশ হতে। তার গায়ে সাদা শাড়িটা এখনো রয়েছে। মেকআপ গুলো সেখানেই তুলে ফেলেছিলো। আমায়রা একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সারাদিনের চাপে বেশ ক্লান্ত লাগছে। এমনিতে ঠান্ডার সময় শরীর ম্যাজম্যাজ করে তার উপর কাল থেকে কি হবে না হবে তা নিয়ে বেশ চাপ গেছে। সেদিন সুরাইয়া না তাদের কাছে না আসলে আমায়রা জানতেই পারতো না মেয়েটা তার ভাইকে কতটা ভালোবাসে। সে সুরাইয়ার চোখ স্পষ্ট তার ভাইয়ের জন্য অনুভূতি দেখেছে। বন্যাকে তো তার ভাই পেল না। সুরাইয়াকেই না হয় তার ভাইয়ের নামে করে দিতে একটু সাহায্য করবে। তার ভাই ওই মেয়েটার কাছেই সুখী থাকবে। আমায়রা এসব ভাবতে ভাবতেই ঠান্ডা পানি দিয়ে নিজের চোখ মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে নিলো।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোজা নিচে চলে গেল। খালা ফুচকা টেবিলে এনে রেখেছেন। নূর টেবিলে বসে না নাড়াচ্ছে। আমায়রা এগিয়ে গেল নূরের কাছে। আমায়রা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
“নাইমা আপু, নেহা ওরা কোথায় কিউটি?”
নূর পা নাচাতে নাচাতেই বলল,
“আম্মু রান্নাঘরে আর দুষ্টু পিপি রুমে।”
নাইমাকে ডাকতে আমায়রা রান্নাঘরে চলে গেল। নাইমাকে টেবিলে নিয়ে এসে দেখলো নেহা টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুচকার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেহা বলল,
“ছোট ভাবি এগুলো কি আমার জন্য এনেছো?”
নূর মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“না বার্বি ডল শুধু আমার জন্য এনেছে।”
নেহা ভ্রুকুচকে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেন রে আমি খেলে কি তোর কম পরবে নাকি?”
নূর চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“হুম পরবে তোমাকে দেওয়া যাবেনা। তুমি বেশি খাও দুষ্টু পিপি।”
আমায়রা এগিয়ে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা বাবা তোমরা ঝগড়া বাদ দিয়ে খাও তো। পরে কিন্তু মজা লাগবে না।”
নূর নেহার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কাটলো। নেহাও নূরকে ভেংচি কাটলো।
#চলবে
#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪২
রাতে খাবার টেবিলে বসে আছে সবাই। তখনি তাজওয়ার সাহেব বলে উঠলো,
“রায়ান আজ রাত এগারোটায় তুমি যে চট্টগ্রাম যাচ্ছো সবাইকে জানিয়েছো?”
সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে রায়ানের দিকে তাকালো। আমায়রার হাত থেমে গেল। সে তাকায়নি রায়ানের দিকে। কেনযেন বুকটা ধুকপুক করছে। রায়ান ভাতের প্লেটে হাত নাড়তে নাড়তে বলল,
“না বলা হয়নি এখনো।”
তাজওয়ার সাহেব ভ্রুকুচকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এখনো বলোনি কেন তুমি? আমি তো মনে করলাম তুমি আগেই বলে দিয়েছো। আসলে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ আছে তাই রাতেই ওকে যেতে হবে। কাল সকালে মিটিং আছে।”
সবাই জিনিসটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও দুইজন ব্যক্তি বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না। আবির আর আমায়রা। আবির চোখ ছোট ছোট করে তাকালো রায়ানের দিকে। সে কিছুই বুঝতে পারছেনা বিটকেলটার মতলব। শিহাব পালিয়ে গেল, এখন আবার সে নাকি হুট করেই অফিসের কাজে চট্টগ্রাম চলে যাবে।
আর অন্যদিকে আমায়রার অজান্তেই মন খারাপ হলো খানিকটা। তাকে কি কথাটা আগে বলা যেতনা। নিজের ভাবনাকে নিজেই গালি দিলো সে। তাকে কেন বলতে যাবে সে কে যে তাকে বলবে। কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটে এক তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো আমায়রার।
খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে গেল রায়ান। ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে গোছাতে লাগলো সে। দরকারি সবকিছু ব্যাগে বন্দি করে ঘড়ির দিকে তাকালো দশটা বেজে দশ মিনিট। আমায়রাকে রুমে আসতে না দেখে বিরক্ত হলো রায়ান। কোথায় তিনদিনের জন্য যাচ্ছে, যাওয়ার আগে বউকে একটু চুমুটুমু খাবে তানা। বউ আসছেই না। রায়ানের ভাবনার মাঝেই রুমে প্রবেশ করলো আমায়রা। আমায়রার ছোট মুখখানা দেখে মনে মনে বেশ হাসি পেল রায়ানের। রায়ান হুট করে দৌড়ে গিয়ে আমায়রাকে দরজার সাথে চেপে ধরে দরজা আটকে দিলো। আমায়রার সারামুখে পরপর কয়েকশত চুমু খেতে লাগলো সে।
আচমকা এমন হওয়ায় আমায়রা থমকে গেল। হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার। চোখ খিচে বন্ধ করে আছে সে। হৃদস্পন্দন ক্রমাগত বাড়ছে যেন মনে হচ্ছে সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসবে।
খানিকবাদেই কি হচ্ছে তা বোধগম্য হতেই চোখ খুলে ফেলল আমায়রা। জোরে ধাক্কা মেরে বসলো রায়ানকে। আচমকা ধাক্কা মারায় দুপা পিছিয়ে গেল রায়ান। রায়ান অবাক হলো না বরং মুচকি হাসি দিয়ে চটজলদি বললো,
“বউ আমার কালো রঙের হুডিটা বের করে দেও তো। আর হ্যাঁ কালো রঙের চাঁদরটাও দিবে সাথে।”
আমায়রা মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“পারবোনা আমি।”
রায়ান কপাল কুচকে তাকালো আমায়রার দিকে। কি যেন ভেবে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসলো সে। আমায়রা একটা কম্বল গায়ে দিয়ে ঠাস করে বেডে শুয়ে পরলো। রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেই হুডি আর চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। ফুল রেডি হয়ে তাকালো আমায়রার দিকে। গুটিসুটি মেরে মেয়েটা শুয়ে আছে। রায়ান আলতো হেসে আমায়রার দিকে এগিয়ে গেল। আমায়রার পাশে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো রায়ান। আমায়রা চোখ পিটপিট করছে। ঘুমায়নি সে। চুপ করে যে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে তা বুঝতে বাকি নেই রায়ানের।
রায়ান আলতো হেসে আমায়রা কপালে পড়ে থাকা ছোট চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে কপাল এক দীর্ঘ চুমু খেল। আমায়রা রায়ানের শীতল স্পর্শ অনুভব করতেই তার বুকে যেন তোলপাড় শুরু হলো। যা কারণ অজানা তার কাছে। কপালে চুমু খেয়ে চোখে দুইপাতাতেও চুমু খেয়ে রায়ান ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমার ওষ্ঠযুগলের স্বাদ না হয় ফিরে এসেই নিবো যমরানী। আল্লাহ হাফেজ।”
আমায়রা রায়ানের কথায় কেঁপে উঠলো। সারা শরীর ঘামছে তার ঠান্ডার মাঝেও। রায়ান মুচকি হাসি দিয়ে আমায়রার গলা অব্দি কম্বল টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রায়ান। রুমের লাইট অফ করে ধীর পায়ে রুম থেকে প্রস্থান করলো সে।
রাতের আবহাওয়ায় যেন এক অদ্ভুত ভারাক্রান্ততা। রায়ানের আচমকা চট্টগ্রাম যাওয়ার খবরটা আমায়রাকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলেছিল, যদিও সে প্রকাশ করেনি।রায়ানের ওই মুচকি হাসি আর বিদায়ের আগে শেষ স্পর্শ যেন তার হৃদয়ে অদ্ভুত এক উষ্ণতা রেখে গেল, যা একইসঙ্গে ব্যথা এবং আকাঙ্ক্ষায় ভরা। রায়ানের কথাগুলো যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল,
“তোমার ওষ্ঠযুগলের স্বাদ না হয় ফিরে এসেই নিবো যমরানী। আল্লাহ হাফেজ।”
আমায়রা চোখ মেলে অন্ধকার ঘরের দিকে তাকালো। তার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করতে লাগল। কান্না আসছে, কিন্তু কেন সেটা সে নিজেও জানে না। রায়ানের চলে যাওয়া তাকে কেন এতটা বেদনাহত করছে? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না সে। একদিকে রায়ানের প্রতি একরাশ অভিমান এসে ভীড় করলো তার ছোট মনটায়। তাকে আগে বললে কি হতো!
কান্না চেপে রাখতে রাখতে একসময় আমায়রা ধীরে ধীরে উঠে বসলো। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল গভীর রাতের নীরবতা। আকাশে তারাগুলো একরাশ নীরব সাক্ষী হয়ে যেন তার মনোবেদনার দিকে তাকিয়ে আছে। রায়ানের শীতল স্পর্শ, তার ফিসফিস করে বলা কথাগুলো, সেই কপালের আলতো চুমু বারবার যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ধীরে ধীরে বললো নিজ মনে বলে উঠলো,
“কেন এমন হচ্ছে জানা নেই আমার। কিন্তু আপনাকে আমার প্রয়োজন মিস্টার রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরী। খুব করে প্রয়োজন।”
————————-
রায়ান চোখ বুজে বসে আছে ইন্সপেক্টর ফাহাদ আহমেদের গাড়িতে। বাসা থেকে চট্টগ্রামের কথা বলে বের হলেও সে এখন মাওয়া ঘাটে যাচ্ছে। সেখানকার কাজ শেষ করে তবেই চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে সে। আহাদের বড় ভাই ইন্সপেক্টর ফাহাদ। ছোটবেলা থেকেই তারা চেনা পরিচিত। রায়ানকে চোখ বুজে থাকতে দেখে গাড়ি চালাতে চালাতে ফাহাদ বলে উঠলো,
“কিরে রায়ান শরীর খারাপ করছে নাকি?”
রায়ান আলতো হেসে বলল,
“না ভাই ভাবছিলাম আজকে পাপের শাস্তি কিভাবে দিবো।”
ফাহাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ও আসবে তো?”
রায়ান বাঁকা হেসে বলল,
“ও আসবেনা মানে ওর বাপও আসবে।”
গাড়ি তখন মাওয়া ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। রায়ান বাইরে তাকিয়ে দেখল অন্ধকারের মাঝে পদ্মা সেতু যেন একটা বিশাল অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ানের চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমায়রার ছোট্ট মুখখানা, অভিমান ভরা চোখগুলো।
খানিকক্ষণ পরেই গাড়ি মাওয়ার ঘাটে থামলো। গাড়ি থেকে নেমে রায়ান চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। হালকা বাতাসে তার গায়ের কালো চাদর উড়ছিলো। ফাহাদ তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“চল, আজকের মিশন শুরু করি।”
রায়ান মিশনের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তার মন যেনো অন্য কোথাও পড়ে আছে। আমায়রার অভিমানী মুখটা বারবার তার স্মৃতির ভেতর ভেসে উঠছে। হঠাৎ করে ফাহাদের গম্ভীর কণ্ঠ রায়ানের চিন্তাভাবনা ভেঙে দিলো,
“রায়ান, মন দিয়ে কাজ করবি তো? আজকের কাজটা কিন্তু সহজ হবে না।”
রায়ান চোখ সরু করে ফাহাদের দিকে তাকালো,
“মন তো দিয়েই করবো, ভাই। আজকের রাতেই হয় এপার না হয় ওপার হবে।”
ফাহাদ আর কিছু বলল না। দুজনেই পা বাড়ালো নির্ধারিত জায়গার দিকে। নদীর পাড়ে একটা পুরনো ঘাটে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন হুডি মাথায় দিয়ে অপেক্ষা করছিলো। রায়ান তার দিকে এগিয়ে গেলো। ঘন কুয়াশার মধ্যে সেই লোকটির মুখ ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না।
লোকটি নিচু গলায় বলল,
“সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এখন শুধু আপনার অনুমতির অপেক্ষা।”
রায়ান ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমাদের লক্ষ্য যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয়। মনে রাখবেন, আজকের রাতেই সব শেষ হয়ে যাবে।”
লোকটা রায়ানের কথায় সম্মতি দিলো। রায়ান পিছু ঘুরে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই আপনার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে তো!”
ফাহাদ শান্ত গলায় বলল,
“হুম সব সেট করে ফেলেছি চিন্তা করো না।”
রায়ান ভাবুক কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা তাহলে আমি যখন ইশারা করবো তখন আসবেন। তার আগে নয়।”
রায়ানের কথায় ফাহাদ সম্মতি দিলো। রায়ানের কথামতোই বাকি সবাই যে যার জায়গায় লুকিয়ে পড়লো। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
গভীর রাতের কুয়াশায় পদ্মার পাড় যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে ভেঙে দিচ্ছে দূরের নদীর ঢেউয়ের শব্দ। রায়ান একধরনের অদ্ভুত শান্ত কিন্তু দৃঢ় মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ানের ভাবভঙ্গি নির্লিপ্তি। ফাহাদ তাকে আরেকবার সতর্কতার সঙ্গে বলল,
“রায়ান, কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ। ভুল হলে বিপদ, সব শেষ হয়ে যেতে পারে।”
রায়ান মাথা নাড়ল। তার চোখে দৃঢ় সংকল্প।
“বিপদ আমার নতুন কিছু নয় ভাই। আমি জানি কী করতে হবে। শুধু সময়মতো অ্যাকশনে যেতে হবে।”
পেছন থেকে সেই লোকটি আবার ফিসফিস করে বলল,
“ওরা কাছে আসছে। আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। তবে সাবধান থাকতে হবে। কোনো ভুলচুক যেন না হয়।”
রায়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনছে। হঠাৎ অন্ধকার পেরিয়ে একটা বড় লঞ্চ ঘাটে এসে থামলো।
———————-
রাত গভীর হলেও আমায়রার ঘুম আসছে না। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার হৃদয় চেপে ধরে আছে। একটা অজানা ভয় আর এক ধরনের অভিমান একসঙ্গে মিশে গেছে তার মনে। রায়ান কেন তাকে এমন করে বিদায় জানাল? আর তার এই আকস্মিক চট্টগ্রাম যাওয়া তাকে এতটা অস্থির করে তুলছে কেন?
আমায়রা নিজের মনে বলে উঠল,
“রায়ান, আপনি কি ভালো আছেন? কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করুন।”
তার চোখ থেকে অজান্তেই একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। নিজের আবেগকে সামলাতে না পেরে সে বিছানায় শুয়ে এপাশঅপাশ করতে লাগলো । কিন্তু সেই অভিমান আর অস্থিরতা তাকে ঘুমাতে দিল না।
——————-
পদ্মার পাড়ে…
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দূর থেকে একদল লোককে ঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। রায়ান সেই ব্যক্তির দিকে ইশারা করল। সেই লোকটি গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে বলল,
“সব ঠিকঠাক আছে। আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি।”
রায়ান ঠান্ডা গলায় বলল,
“তাহলে শুরু করা যাক। কোনো ভুল যেন না হয়।”
একই সময়ে ফাহাদ আর তার দলও একদম প্রস্তুত হয়ে গেল। চারপাশে নিস্তব্ধতা। শুধু নদীর ঢেউয়ের শব্দ আর ঘন কুয়াশার মধ্যে পদ্মার পাড়ে যেন এক অদ্ভুত নাটকের মঞ্চ তৈরি হয়েছে।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। বেশি বেশি রিয়েক্ট কমেন্ট করবেন।)