অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০১

0
127

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১

বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে সরাসরি অসম্মতি জানালো কুঞ্জ। চৌধুরী পরিবারের সকলে চমকে উঠলো। কুঞ্জারি চৌধুরী, চৌধুরী পরিবারের বড় সন্তান। ছোটবেলা থেকেই শান্ত, নম্র-ভদ্র। বড়দের সম্মান করে এবং ছোটদের প্রতি অত্যন্ত বিনয়ী। মেনে চলে সকলের কথা। গুরুজনের কথার উপরে কথা বলা তো দূরের ব্যাপার কখনো উঁচু স্বরে কথাও বলে না। বাবাকে কুঞ্জারি যেমন ভক্তি করে ভালোবাসে তার চেয়েও দ্বিগুণ। বাবার পছন্দকে বরাবরই নিজের পছন্দ মনে করে। বাবার বাধ্যগত সেই মেয়ে সরাসরি বাবার মুখের উপর না করে দেওয়াতে হতবিহ্বল হলো সবায়। আজ কুঞ্জারি শুধু বাবার মতের বিরুদ্ধেই যায়নি শীতল স্বরে বাবার সাথে ঝগড়া করেছে। বাবা মেয়ের নীরব অগ্নিবাণে ভয় পেলো পরিবারের ছোট বড় প্রতিটি সদস্য। থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে চৌধুরী নিবাসে। থমথমে পরিবেশে বো’মা বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে বন্ধ হলো কুঞ্জারি চৌধুরীর ঘরের দরজা। কেঁপে উঠলো দ্বিতল চৌধুরী নিবাস সেই সাথে বাড়িতে অবস্থানরত সকলের বুক!

কিছুক্ষণ আগে,

-আ’ম সরি আব্বু। বিয়েটা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমে যেন বো’মা বিস্ফোরণ হলো। সবাই চমকে তাকালো বাড়ির বড় মেয়ের দিকে। মিসেস রাইমা চৌধুরী অবাক হয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। অবাক হলেন ড্রয়িং রুমে অবস্থানরত বাড়ির আট সদস্য। তবে অবাক হলো না আফজাল চৌধুরী। তিনি জানতেন মেয়ে এমন কিছু বলবে। সবার মাঝ থেকে ভরকে যাওয়া ভাবটা খানিক সরে গেলে তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
-কেনো সম্ভব নয়? কারণ উল্লেখ করো।
তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেলো কুঞ্জারির চোখেমুখে। ঠোঁট খানিক বাঁকিয়ে বলল,
-আমি ভেবেছিলাম কারণটা আপনি জানেন!

আফজাল চৌধুরী নিঃশব্দে হাসলেন। তার হাসি দেখলো না কেও। অথচ কুঞ্জারির চোখ এড়ালো না। আফজাল চৌধুরী আবার বলে উঠলেন,
-আমিও ভবতাম তুমি জানো এই কারণটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না!
-অন্য কারণও আছে।
-সেটায় জানতে চেয়েছি আমি তোমার থেকে।
-আপনার পছন্দ করা ছেলে অন্য মেয়ের সাথে কমিটেড আব্বু।
আফজাল চৌধুরী আবার হাসলেন। এবার ঠোঁটের আগায় ফুটে উঠলো সেই হাসি। কন্ঠে এলো তাচ্ছিল্যের সুর,
-আজকালকার ছেলে-মেয়েরা একটু আকটু অরকম হয়। আশা করি তোমার ভালো ধারণা আছে সে সম্পর্কে।

বাবার উত্তরে হাসলো কুঞ্জারিও। সে জানতো এই উত্তর টায় পাবে। আয়েশ করে সোফায় বসলো কুঞ্জ ওরফে কুঞ্জারি চৌধুরী। কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো বাবার দিকে। এরপর তাকালো অদূরে দাঁড়ানো তার দুই চাচাতো ভাইয়ের দিকে। ছোট বোন কুহু ঠিক তার সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বোনের দিকে চোখ বুলাতে পারলো না। গভীর একটা শ্বাস ফেললো কুঞ্জ। পরবর্তী বো’মাটা চৌধুরী নিবাসের ড্রয়িং রুমে ছুঁড়ে দিলো পরক্ষণেই।
-হি হ্যাজ ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ উইত দা গার্ল।

এবার যেন আকাশ ভেঙে পড়লো সবার মাথায়। কুঞ্জারির ছোট মা পাপিয়া চৌধুরী আর্তনাদ করে উঠলেন। মুখে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন মেঝোমা নওরীন চৌধুরী। কুহু দুহাতে খামচে ধরলো বোনের পিঠ। রাইমা চৌধুরী নির্বাক। কিছু বলার ভাষা সত্যি তার নেই। আজ তার মনে হচ্ছে পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে সে চেনে না। তার শান্ত মেয়ের হঠাৎ এমন ঝড়ো রূপ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে মেয়ের অগ্নিরূপ তার ভালো লাগলো। কুঞ্জারির দুই চাচা আকরাম চৌধুরী এবং আরিফ চৌধুরী মাথা নিচু করে আছেন। মেয়ের মতো ভাস্তির মুখ থেকে এমন কিছু শুনতে হবে আশা করেনি তারা। ওদিকে নুহাস আর পূর্ব অস্থির ভাবে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছে না এখানে থাকা ঠিক হবে কিনা। আফজাল চৌধুরী ধমকে উঠলেন,

-বড়দের সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই তোমার? ছোটরাও আছে এখানে। লাজলজ্জা কি সব খুইয়ে ফেলেছো?

কুঞ্জারির চোখেমুখে খেলে গেলো কৌতুক। ওর চোখ মুখ দেখে মনে হলো এতো মজার কথা আগে কখনো শোনেনি। বাবার চোখে চোখ রেখে কৌতুক করেই বললো কুঞ্জ,

-আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন আব্বু আমি মেডিক্যালের স্টুডেন্ট। এসব ব্যাপারে লাজলজ্জা আসলেই আমার কম। নেই বললেও চলে।

কেউ খেয়াল না করলেও আফজাল চৌধুরী ঠিকি খেয়াল করলেন মেয়ের তাচ্ছিল্য ভাব। তাচ্ছিল্য করার কারণটাও তার অজানা নয়। তবে সেদিকে গেলেন না আজ। তিনি কন্ঠ অত্যাধিক শীতল করে বললেন,
-বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে কুঞ্জ।
-আমি বিয়েটা করবো না আব্বু।

কুঞ্জের কন্ঠের শীতলতা যেন ছাড়িয়ে গেলো আফজাল চৌধুরীর স্বরকেও। এবার ভয় পেলো উপস্থিত মানুষ গুলো। আফজাল চৌধুরী চৌধুরী নিবাসের প্রধান কর্তা। তার কথার উপর একটা কথা বলার সাহস নেই আরিফ চৌধুরী বা আকরাম চৌধুরীরও। মুখের উপর কথা বলা তার পছন্দও নয়৷ আজ তারই মুখের উপর তার সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিলো তারই বড় মেয়ে। যে মেয়ে কিনা একটা জামা কিনতে গেলেও বাবা যা পছন্দ করে তাই নিয়ে নেয় বিনাবাক্যে! সে মেয়ের এমন ঠোঁটকাটা রূপ যেন আজকের চরম বিস্ময়!

আফজাল চৌধুরী রাগ প্রকাশ করেন না। তার রাগে আগুন নেই। তার রাগ প্রকাশ পায় শীতল ভাবে। মাথা ঠান্ডা রেখে খুন করার ক্ষমতা রাখেন তিনি। এই মুহূর্তেও তার চেহারায় রাগের কোনো আভাস ফুটে উঠলো না। শুধু তার কন্ঠস্বর হলো আগের চেয়েও শীতল।

-আমার কথার কোনো নড়চড় হয় না তুমি জানো। বিয়েটা তুমি করবে। এটায় আমার শেষ সিদ্ধান্ত।
-আমিও আপনার মেয়ে আব্বু। আমার কথার নড়চড় হবে কিভাবে?

পরিবারের সকলের ভয়ের মাত্রা বাড়ছে। সেই সাথে অবাক হওয়ার মাত্রাও। কুহু বোনের চেহারা দেখতে পারছে না। আব্বু সামনে না থাকলে সে একাবর তার বোনের চেহারাটা দেখতো। তার শান্ত বোনটা কিভাবে বাবার মুখে মুখে কথা বলছে?

-বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে কুঞ্জ। আর কথা বাড়াবে না। নিজের ঘরে যাও।

কুঞ্জ দাপটের সাথে উঠে দাঁড়ালো। সবায় যেন কলিজায় পানি ফিরে পেলো। যাক, এবার শেষ হবে আজকের এই শ্বাসরোধ করে দেওয়া আলোচনা। এমন দ্বন্দ্ব দেখে অভ্যস্থ নয় চৌধুরী বাড়ির মানুষজন। কিন্তু সবার আশায় গুড়ে বালি দিয়ে বলে উঠলো কুঞ্জ,

-আমি আপনার মেয়ে আব্বু। কিছুটা আপনার মতো। ভালো একজনকেই বাসবো; আজীবন। তবে আমি আবার আপনার মতো নই যে সেই ভালোবাসাকে স্বার্থের জন্য ধ্বংস করে দিব।

আর দাঁড়ালো না কুঞ্জ। হাঁটা দিলো নিজের ঘরের দিকে। দু’পা এগিয়ে আবার বলে উঠলো,

-আমি আম্মুর মতো হয়নি আব্বু। নিজের স্বামী পরনারীকে ভালোবাসে জেনেও সেই স্বামীকে সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসতে আমি শিখিনি। কারণটা বোধহয় আমি আফজাল চৌধুরীর মেয়ে।তবে বেশিদূর এগোতে পারলো না। তার আগেয় কানে এলো হীম শীতল স্বর,

-বিয়েটা না করলে তোমাকে আমি ত্যাজ্যকন্যা করে দিব।

রাইমা চৌধুরী অস্ফুট আওয়াজ করে তাকালেন তার স্বামীর দিকে। কুহু ‘আব্বু’ বলে চিৎকার করে উঠলো। পরক্ষণেই ফুঁপিয়ে উঠলো। ছোট মানুষ সে। সবে পা দিয়েছে সতেরোতে। কিশোরী বয়সের আবেগ। সমলে রাখা ভার। বড় বোন তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। সেই তাকে যদি ত্যাজ্যকন্যা করার কথা উঠে; কিভাবে সামলাবে আবেগ!

ক্ষাণিক আগে কুঞ্জের বলা কথা গুলো কারো বোধগম্য না হলেও আফজাল চৌধুরীর বলা কথা সবার বোধগম্য হয়েছে। এবং বুঝতে পারার পরই সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। মেয়েকে অত্যন্ত ভালোবাসে আফজাল চৌধুরী। সেই মেয়েকে সরাসরি ত্যাজ্য করে দেওয়ার কথা বলছেন তিনি নিজেই। কারো বিশ্বাস হচ্ছে না। আফজাল চৌধুরী নির্বিকার। তার সিদ্ধান্তে তিনি অটল। নির্বিকার ভঙ্গি সেটায় বলে দেয়।

বাবার কন্ঠ কানে আসতেই হো হো করে হেসে দেয় কুঞ্জারি চৌধুরী। পিছনে ঘুরে দাঁড়ায়। হাসিমুখে উত্তর দেয়,

-আপনি ত্যাজ্য করেন আর না করেন, আপনি বিয়ের কথা আর একটু আগালেই আমি চৌধুরী বাড়ি ছাড়বো আব্বু।

আর দাঁড়ালো না কুঞ্জ। দোতালায় নিজের ঘরে ঢুকে সশব্দে বন্ধ করে দিলো দরজা।

বোনের পেছন পেছনেই রুম ছেড়েছে কুহু। পূর্ব, নুহাস ও হাওয়া। সময় মতো কেটে পড়েছে। আরিফ চৌধুরী ইশারায় নিজের স্ত্রী কে উঠে আসতে বলে নিজ উঠে পড়লেন। এরপর একে একে চলে গেলো সবাই। শুধু বসে রইলেন আফজাল চৌধুরী আর তার সামনের সোফায় রাইমা চৌধুরী।

আফজাল চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিলিং এর দিকে। শান্ত ভাবের পেছনে মেয়ে তার কঠিন মনোভাব আড়াল করে রাখতো তা তিনি জানতেন। তবে মেয়ে যে এতো কঠোর হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। নিঃশব্দে একটু হাসলেন তিনি।মেয়েটা তো তারই। কঠোর তো হবেয়! আজ মেয়ে তার দুর্বল জায়গায় আঘাত করলো। কি সবলিল ভাবে বলে দিলো, ‘আমি আবার আপনার মতো নই যে সেই ভালোবাসাকে স্বার্থের জন্য ধ্বংস করে দিব।’ কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকলেন। নিজেকে একটু ধাতস্থ করলেন। এরপর তাকালেন স্ত্রীর দিকে। কড়া ভাবে বললেন,

-এখানে বসে কি করছো? মেয়ের কাছে যাও। তাকে বুঝাও। আমি যা বলি তাই করি সেটা তুমি ভালোভাবেয় জানো।

আফজাল চৌধুরী ভেবেছিলেন বাধ্য বউ তার প্রতিদিনের মতো উঠে যাবে। তার কথা শুনবে। কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন আজকে সব নিয়ম মতো হচ্ছে না। তার অতি বাধ্য মেয়ে আজ অবাধ্য হয়েছে। সেই রেশ ধরেই অবাধ্য হলো রাইমা চৌধুরীও। তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।

-কি বোঝাব মেয়েকে? তোর মায়ের মতো জীবন গড়ে নে। এমন কারো নামে নিজেকে লিখে দে যে অন্য কারো জন্য তার মন লিখে দিয়েছে বহু আগে। পঁচিশ বছর ধরে ভালোবাসা দিয়েও সে মনে পাওয়া যাবে না একটু ঠাই।
আফজাল চৌধুরী অবাক হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। চোখের পানি লুকাতে দৃষ্টি অন্যত্র সরালেন রাইমা চৌধুরী। ডান হাত দিয়ে অশ্রু মুছে কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন,
-আমি ওর মা। শত্রু নই। মানুষ শত্রুরও এমন ক্ষতি চায় না। আমি মা হয়ে কিভাবে চাই! আমি তো আপনার মতো পাষাণ নই!

রাইমা চৌধুরী উঠে চলে গেলেন। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকলো আফজাল চৌধুরী। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো, ‘আমি কি পাষাণ?’ উত্তর টা হ্যাঁ ই এলো। তিনি এবার নিঃশব্দে হসলেন না আর। হেসে উঠলেন সশব্দে!

#চলবে…?