#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৬
আকাশে ঘনকালো মেঘ। সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। দুপুরে কিছু সময়ের জন্য থেমেছিল। বিকাল থেকে আবার শুধু হয়েছে। বিকাল পাঁচটা। টিউশন শেষ করে শাহবাগ মেড়ো আসলো কুঞ্জ। এক্ষুনি হলে ফিরবে। সময়টা বিকাল হলেও কালো মেঘের কারণে মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশা ডাকবে ঠিক তখন পিছন থেকে ভেসে এলো পরিচিত স্বর,
-কুঞ্জলতা!
পরিচিত হতে না চাইলেও এই স্বর আপনা আপনি পরিচিতি পেয়ে গেছে। আজ শ্রাবণের বারো তারিখ। অর্থাৎ, অর্কের প্রথম বার প্রপোজ করার তিনমাস বারো দিন পার হয়ে গেছে। এই তিনমাসে অর্ক কম করে হলেও পনেরো বার প্রপোজ করেছে। আর বুঝানোর চেষ্টা তো চলছে অবিরাম। কতদিন মনে পাথর বেঁধে রাখা যায়? কুঞ্জ হাতঘড়িতে সময় দেখলো। মাগরিবের আজান দিবে সাড়ে ছয়টার পর। মানে হাতে আছে প্রায় দেড় ঘন্টা সময়। কুঞ্জ অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল,
-কোথাও বসবেন?
অর্ক কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কুঞ্জের দিকে। ‘তুহি কারে এন্ট্রি, দিল মে বাজি ঘান্টি’ গানটিকে সত্য প্রমাণ করে অর্কের মনের ঘন্টা বেজে উঠলো। খুব বলতে ইচ্ছে হলো,’এতদিনে মনের বরফ গলল আপনার কুঞ্জলতা?’ কিন্তু বললো না। আবার যদি মুড চেঞ্জ হয়ে যায় কুঞ্জের। অর্ক মৃদুস্বরে বলল,
-আপনি চাইলে বসতেই পারি।
-চলুন।
দুজনে গিয়ে একটা ক্যাফেতে বসলো। দুটো কোল্ড কফি অর্ডার দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে কফি দিয়ে গেলো। তবুও চুপ দুজন। কোন কথা বলছে না। অর্ক বলছে না ভয়ে। আর কুঞ্জ; কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। গভীরভাবে শ্বাস নিলো কুঞ্জ। গম্ভীর হয়ে বলল,
-নানুবাড়ি রেগুলার যাওয়া হয়?
-বছরে একবারের মতোন।
-ভালোয়া। তাহলে আপনার জানার কথা শিকদার বাড়ির সাথে চৌধুরী পরিবারের বনিবনা তেমন নেই। আমার ভাইদের হাতে কিন্তু আপনার কাজিনরা ভালোয় অপদস্ত হয়।
-জানি আমি।
মিনমিন করে বলল অর্ক। কুঞ্জ বলল,
-পারিবারিক এমন ঝগড়া ঝামেলার মধ্যে আপনার সাথে প্রেম করবো আমি? না মানবে আপনার পরিবার আর না আমার।
-শিকদার বাড়ি আমার নানুবাসা কুঞ্জ। আমার আব্বুর বাড়ি নয়। ঠিক কি কারণ আমি জানি না আম্মু চৌধুরী বাড়ির কাউকে পছন্দ করেনা। কিন্তু আমি আব্বুর মুখে চৌধুরী বাড়ির কথা অনেক শুনেছি। তার কোন সমস্যা নেই।
-আর আপনার আম্মু? মায়ের অপছন্দে বিয়ে করবেন?
-তিনি মা আমার। আমার সুখ বুঝবে না?
-কিন্তু আমি প্রেম ভয় পাই।
-চলুন বিয়ে করে ফেলি।
-সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ফাজলামি পছন্দ করিনা আমি।
-আমি মজা করছিনা কুঞ্জ।
কুঞ্জ এতক্ষণে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। তিনমাসে ছেলেটার সাথে শতবার দেখা হয়েছে। মায়া মায়া চেহারায় গলে গেছে সে। কিন্তু কাউকে মন দিয়ে সে হারাতে পারবে না। ভয় কাজ করে তার। কুঞ্জের ভাবনার মাঝে অর্ক বলে উঠলো,
-আজকেয় বিয়ে করবেন কুঞ্জ।
-প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই আমার কাছে।
অর্ক আলতো হাসলো। ধীর কন্ঠে বলল,
-আজকে শরিয়ত মতে বিয়ে করে ফেলি? এরপর আপনি যখন চাইবেন তখনই কাবিন করে ফেলবো হবে?
কুঞ্জ মৃদু হাসলো। অর্ক বুঝে নিলো তার কুঞ্জলতার মনের কথা। কল করলো দু’জন বন্ধুকে। তাদের মধ্যে একজন রিন্তির বয়ফ্রেন্ড। তাকে বলল রিন্তি সহ রিন্তির বান্ধবীদের নিয়ে আসতে। দু’পক্ষের বন্ধু-বান্ধবের উপস্থিতিতে কাজী ডেকে শরিয়ত মনে বিয়ে করে ফেললো তারা। অন্যরকম খুশি অনুভব করলো কুঞ্জ। আজ থেকে তারও একটা মানুষ হলো ভাবতেই খুশি লাগলো।
বিয়ের পর দারুণ সময় কাটতো তাদের। একসাথে ঘোরাঘুরি করা। অবসর একসাথে কাটানো। রাতজেগে কলে কথা বলা। দিনগুলো স্বপ্নের মতো মনে হতো কুঞ্জের। ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাওয়ার সেকি সুখ। আকাশ, বাতাস সবখানে সুখ আর সুখ।
কড়াইয়ে পিঁয়াজ, মরিচ আর তেল দিয়ে নাড়তে লাগলো কুঞ্জ। মিসেস তানহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মেয়েটার দিকে। নিজের ছেলের প্রেম কাহিনি শুনছেন তিনি। সাথে জহুরি চোখে পরখ করছে চৌধুরী বাড়ির মেয়েটাকে। সব কাজের হাত তার পটু। ভুল ধরার জো নেই। অথচ তিনি জানতেন চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা কখনো রান্নাঘরে যায় না। মিসেস তানহা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলেন না। আলতো স্বরে বলে উঠলেন,
-বাড়িতে তো তোমায় রান্নাঘরে যেতে দেয় না। কাজ শিখেছো কোথায়?
প্রথমবার মিসেস তানহা কুঞ্জের সাথে নরম সুরে কথা বলল। কুঞ্জ স্মিত হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-চৌধুরী বাড়ির মেয়েরা রান্নাঘরে যাবেনা এটা কোন নিয়ম নয়। এটা একটা অহংকার। বড় ঘরে জন্মে রান্নার ধার তারা ধারতো না। চৌধুরী বাড়ির মানুষজনও সেটা গর্বের সাথে নিত। আমি নেই নি। আমার মা আমাকে নিতেও দেয়নি। ছোটবেলা থেকে আম্মুর করা সব কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। বড় হওয়ার সাথে সাথে একটু একটু করে করতে করতে শিখে গেছি। আমি মনে করি জীবনে চলতে গেলে সব শিখতে হয়। পরনির্ভরশীল হওয়া কোন ভালো অভ্যাস নয়।
মিসেস তানহা মনে মনে ভীষণ খুশি হলেন সেই সাথে মেয়েটার মনোভাবে প্রতি শ্রোদ্ধাশীল হলেন। পরক্ষণেই প্রশ্ন করলো,
-তোমার মা তো অনেক বড় ঘরের সন্তান। সে কিভাবে শিখেছে এত কাজ?
-রান্না মায়ের শখ। তাই শিখেছে। নানিমণি নিষেধ করেনি। আর বাকি কাজ চৌধুরী নিবাসে এসে শিখেছে।
সরু চোখে তাকালেন তানহা। বললেন,
-তোমার ছোট বোন রাঁধতে পারে?
-ভাত, তরকারি কখনো রাঁধতে দেয়নি ওকে। তবে পায়েস, ক্ষীর, নুডলস, ফালুদা থেকে শুরু করে প্রায় সব রকম নাস্তা বানাতে পারে তবে এখনো পরিপক্ব নয়। মেঝমা নাহয় ছোটমা পরিমাপ বলে দেয় কোনটা কতটুকু নিতে হবে।
-কেন? তোমার মা বলে দেয় না?
-আমার মা আমাকে ছাড়া কাউকে রান্নার ব্যাপারে হেল্প করে না। হয় তিনি রান্নাটা একা করবেন অথবা অন্য কেউ শুরু করলে সে করবে।
-কেন?
কুঞ্জ শাশুড়ির দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-বাবার ভালোবাসাটা মা পায়নি। ও বাড়িতে মা’কে খারাপ কথা যেমন কেউ বলেনি ভালোবেসে আগলেও নেয়নি। মা চাপা স্বভাবের খুব। প্রথমে একটু মিশতে গিয়েও যখন কারো সাড়া পায়নি তিনি চুপসে গেছেন। একাকিত্বকে আপন করে নিয়েছিলেন। সঙ্গ চাইতেন তিনি কিন্তু আশানুরূপ পায়নি। মেঝমা আসার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়। এরপর দাদির জেদ শুরু হয় তার নাতি লাগবে। দাদির জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় আব্বু। কিন্তু মেনে নিতে পারেনি আম্মু। কথা বলা বন্ধ করে দেয় সবার সাথে। কারো প্রশ্নের জবাব দিতো না। সারাদিন একা একা থাকতো। আমি পেটে আসার পর নাকি ঘর থেকেও বের হতে চেত না। ঘরবন্দী হয়ে থাকতো। পেটের বাচ্চার সাথে একা একা কথা বলতো। বাচ্চার ক্ষতি হবে ভেবে আম্মুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানুবাসায়। সেখানে গিয়েও কোন পরিবর্তন হলো না আম্মুর। সম্ভবত অভিমানে ও বাসার কারো সাথেও আম্মু কথা বলতো না। দীর্ঘ নয় মাস একা একা থাকার পর জন্ম হয় আমার। অনেক গুলো মাস পর আম্মু সেদিন হেসেছিল। সেদিন থেকে আমাকে নিয়েই আম্মুর বেঁচে থাকা। আম্মুর পৃথিবী বলতে আমি। কুহুকে আম্মু ভালোবাসে আর দশটা মা যেমন করে নিজের সন্তানকে ভালোবাসে সেভাবে। আর আমাকে ভালোবাসে অন্যরকম ভাবে। আমি শুধু আম্মুর মেয় নই। আম্মুর একমাত্র বন্ধু, আম্মুর মন খারাপের সাথী, আম্মুর চোখের পানি মুছের দেওয়ার একমাত্র মানুষ। আমি আমার আম্মুর জন্য ভীষণ স্পেশাল।
কুঞ্জ থামলো। আলতো স্বরে বলল,
-নিজের মাঝে যেসব গুণ নেই বলে আম্মুর আফসোস হতো সেসব গুণ আম্মু আমাকে আয়ত্ত করতে শিখিয়েছে। তাই আমি একটু আলাদা। অন্যরকম। তবে আমি খুব কম সময় প্রকাশ করি আমি আলাদ।
কুঞ্জ চুপ হয়ে গেলো। নুডলস হয়ে এসেছে। বাটিতে উঠিয়ে নিলো কুঞ্জ। চামচ নিতে নিতে বলল,
-আপনার ছেলেকে দিয়ে আসি মা? বাকি গল্প পরে শুনলে হবে?
মিসেস তানহা মাথা নাড়লেন। বললেন,
-বিকেলে আমার ঘরে এসো।
কুঞ্জ স্মিত হেসে মাথা নাড়লো। অতঃপর নুডুলসের বাটি নিয়ে ঘরে গেলো।
মিসেস তানহা নিজের ঘরে এসে নিশ্চুপ বসে রইলেন। রাইমাকে সহ্য তিনি করতে পারতেন না সেটায় স্বাভাবিক। কিন্তু আজ হাঠাৎ বহু বছর আগে দেখা সেই মায়াবী মেয়েটার জন্য খুব মায়া হলো। সে নিজে ভালোবাসা হারানোর কষ্টে জর্জরিত হলেও তাকে ভালোবাসার আরও মানুষ ছিলো। একা সে ছিলো না। অথচ রাইমা? ইশ! কি ভীষণ এক ছিল মেয়েটা।
কুঞ্জ ঘরে ঢুকতেই অর্ক বলে উঠলো,
-বাপরে, বউ শাশুড়ির মিল হলো কখন?
কুঞ্জ ভ্রূ বাকিয়ে তাকালো। ভ্রূ নাচিয়ে বলল,
-মিলের কি দেখলে?
অর্ক প্রাণবন্ত হেসে বলল,
-রান্না করতে করতে সুখ দুঃখের গল্প করছেন।
কুঞ্জ হেসে ফেললো। বলল,
-তুমি কি করতে গিয়েছিলে বাইরে?
-এতক্ষণ হয় গিয়েছো। ফিরছো না। ভাবলাম আবার আমার প্রিয় দুই নারী না মারপিট শুরু করে। ওমা, গিয়ে দেখি তারা হেসে হেসে গল্প করে।
কুঞ্জ কথা বাড়ালে না আর। অর্কের হাতে নুডলসের বাটি দিয়ে পায়ের কাছে বসলো। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো ক্ষতস্থানে। মৃদুস্বরে বলল,
-ব্যাথা করে?
অর্ক মুচকি হাসলো। একহাতে কুঞ্জের মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-না তো। ব্যাথা করে না।
-সত্যি?
-আমার বউকে আমি মিথ্যা বলি?
কুঞ্জ হাসলো। উত্তর দিলো না। কিয়ৎকাল পরে আনমনে হেসে বলল,
-আজকে বিকেলে আপনাকে একা একা প্রেম বিলাস করতে হবে গো বর। শাশুড়ি আম্মার ঘরে বিকেলে আমার গল্প করার নিমন্ত্রণ।
অর্ক অসহায় হয়ে বলল,
-কিহহহ! এ তো রীতিমতো ষড়যন্ত্র।
কুঞ্জ খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসলো অর্কও। তার হাসিতে বিশাল প্রাপ্তির রেখা ঝলমল করছে।
#চলবে…?
#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৭
বিকেল বেলা। রোদের তেজ নেই। অর্কের রুমের জানালা দিয়ে এক টুকরো রোদ এসে পরছে বিছানায়। অর্ক চেয়ারে বসে বই পড়ছে। কুঞ্জ হাতে কফির মগ নিয়ে ঘরে এলো। অর্কের দিকে এগিয়ে দিলো মগটা। মুখে বলল,
-বারান্দায় বসবে?
কফিতে একবার চুমুক দিয়ে অর্ক বলল,
-নাহ, একা একা বারান্দায় বসে মজা নেই।
কুঞ্জ টেবিলে ফোন দুটো রাখলো। অর্কের দিকে তাকিয়ে বলল,
-বই পড়তে ভালো না লাগলে ফোন দেখিও। আর কিছু লাগবে? দিব?
অর্ক মুচকি হেসে বলল,
-আর বউকে লাগতো। দিয়ে যাও।
কুঞ্জ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো। অর্কের চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
-এমন ভাব করছো যেন বউ ছাড়া থাকনি কখনো।
অর্ক হাসলো জবাব দিলো না। বিনিময়ে কুঞ্জ মুচকি হাসলো। আসি বলে বের হলো ঘর থেকে।
অর্কদের ফ্লাটটিতে চারটি বেডরুম, একটি ড্রয়িং ও একটি ডাইনিং। ডাইনিং পার হয়ে তানহার রুমে যেতে হয়। কুঞ্জ নীরবে সেদিকে এগুলো। আলম সাহেব বিজনেসম্যান। ব্যবসায়িক কারণে আজ তার বাড়ি ফিরতে দেরি হবে; বলে গেছেন। অদিতি গেছে বান্ধবীর বার্থডে পার্টিতে। সেও ফিরবে রাতে। পুরো বাসায় তারা তিনজন মানুষ। কুঞ্জ শাশুড়ির রুমের সামনে এসে ভিতরে উঁকি দিলো একাবর। মিসেস তানহা বিছানায় বসে এক দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনেহয় গভীর ভাবে কিছু ভাবছেন। কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলল,
-মা, আসবো?
তাহনা হঠাৎ শব্দে চমকে গেলো কিছুটা। দরজার সামনে কুঞ্জকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
-ভিতরে আসো।
কুঞ্জ ভিতরে এলো। আশেপাশে চোখ বুলালো। শুনতে হাস্যকর লাগলেও সত্যি আজ প্রথম সে এ ঘরে পা দিলো। রুমটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। কুঞ্জ দেখলো মিসেস তানহা ফের উদাসীন হয়ে গেছেন। কুঞ্জ আলতো স্বরে বলল,
-মা আপনার চুলে তেল লাগিয়ে দেই?
মিসেস তানহা একপলক নিজের চুলের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই তাকালেন কুঞ্জের দিকে। তাদের সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক নয়। অনেক জড়তা ঘিরে আছে তাদের মাঝে। তাই চট করে তিনি বলতে পারলেন না সে হ্যাঁ দিয়ে দাও। তিনি চুপ করে তাকিয়ে রইলেন ছেলের বউয়ের দিকে। কুঞ্জ ব্যাপারটা বুঝলো। ছোট বাটিতে তেল ঢেলে নিয়ে আসলো। আলতো স্বরে বলল,
-বারান্দায় বসি মা?
মিসেস তানহা এবারো নিরুত্তর। শুধু বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসলেন মোড়ায়। কুঞ্জ চেয়ার নিয়ে বসলো তার পিছনে। হাতে তেল নিয়ে ধীরে ধীরে লাগলো চুলে। মিসেস তানহা উসখুস করছেন। চাইছেন কুঞ্জকে বলতে এরপর কি হলো বলো। কিন্তু বলতে পারলেন না সেই জড়তার কারণে। কুঞ্জ নীরবে একটু হাসলো। শাশুড়ির চুলে ফের একটু তেল বুলিয়ে বলতে লাগলো,
অর্ক আর কুঞ্জের বিয়ের তখন এক বছর হয়েছে প্রায়। একদিন একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এলো কুঞ্জের কাছে। কুঞ্জ রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলল,
-তোমার সাথে কিছু কথা ছিল মা। কাল একটু দেখা করতে পারবে?
-কিন্তু আপনি কে? আর কি ব্যাপারে কথা বলবেন?
আপনি কে প্রশ্নটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে তিনি জবাব দিলেন,
-অর্কের ব্যাপারে কথা বলবো।
কুঞ্জ একটু ভয় পেয়ে গেলো। অর্কের ব্যাপারে একটা অপরিচিত লোক কি বলবে তাকে? কি এমন বলবে যে এভাবে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে? কুঞ্জ শুকনো ঢোক গিললো। ঠিক হলো পরেরদিন বিকালে শাহবাগের একটা ক্যাফেতে দেখা করবে তারা। সেই অনুযায়ী কুঞ্জ অর্ককে বলে দিলো পরেরদিন না আসতে বিকালে। তার কাজ আছে। পরেরদিন বিকেলে কুঞ্জ আগে পৌঁছে গেলো নিদিষ্ট ক্যাফেতে। অপেক্ষা করতে লাগলো অজ্ঞাত ব্যাক্তির জন্য । সেই সাথে ভয়। কি বলবে সে! কিছুক্ষণ পর তার সামনের চেয়ারে একজন বয়স্ক লোক এসে বসলো। গভীর ভাবনায় থাকায় কুঞ্জ খেয়াল করেনি। কিন্তু খেয়াল করতেই অবাক হয়ে গেলো। অর্কের ফোনে ছবি দেখার সুবাদে কুঞ্জ জানে এই মানুষটি অর্কের বাবা৷ কুঞ্জ উঠে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দিলো। এরপর ভরকানো স্বরে বলল,
-আঙ্কেল আপনি এখানে?
-আমিই আসতে বলেছি তোমাকে মা।
-কোন সমস্যা আঙ্কেল?
আলম সাহেব আলতো হেসে বিরবির করে বললেন,
-মাশাল্লাহ। রাইয়ের মেয়ে রাইয়ের মতো সুন্দর।
কুঞ্জ বলল,
-কি বললেন আঙ্কেল?
-কিছু না মা। তোমার সাথে জরুরি কথা ছিল আমার।
-বলুন।
-অর্কের সাথে তোমার সম্পর্ক কতদিনের?
-প্রায় এক বছর।
-অর্ককে ভুলে যেতে পারবে না?
কুঞ্জ চমকে তাকালো সামনের দিকে। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-ভুলে যাব কেন?
আলম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর কুঞ্জকে একের পর এক জানালো আফজাল চৌধুরী, কাজল চৌধুরী এবং তানহা শিকদারের অতীতের সেই কাহিনি। কুঞ্জ মনোযোগ দিয়ে সব শুনলো। অবাক হলো। একটু দুঃখ পেলো। অতঃপর সুধলো,
-অতীতের সেই কাহিনির সাথে অর্ককে ভুলে যাওয়ার কি সম্পর্ক আঙ্কেল?
-তাহনার আফজালের উপর কতটুকু রাগ আমি জানি না। তবে তোমার দাদির উপর ওর ভীষণ রাগ। হাজার হোক চরিত্র নিয়ে কিংবা মা নিয়ে কথা বললে যে কেউ রাগবে। কিন্তু তাহনা রাগটা ভুলে যায়নি। বরং মনে গেঁথে নিয়েছে। সে চায় সেম কষ্ট তোমাকে দিতে। ও খুব করেই চাইতো আর্কের সাথে তোমার প্রেম হোক। এরপর বিয়ের সময় ঠিক ও যেভাবে কষ্ট পেয়েছে। তেমাকেও দিবে। তাই বলছি মা তুমি নিজে থেকে ভুলে যাও অর্ককে।
আলম সাহেবর কথা গুলো শুনে কুঞ্জ ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-কিন্তু আন্টি তো সেটা পারবে না। আমি তো ওনার ছেলের সাথে প্রেম করি না।
এবার ওয়াহিদ আলম ভ্যাবাচেকা খেলেন। কি বলে এই মেয়ে। তিনি কি এতদিন ভুল জানতেন? তানহা ভুল জেনে প্রতিশোধ নিতে এতো তৎপর হয়ে আছে? তিনি বললেন,
-মানে অর্কের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই?
-সেটা কখন বললাম?
-তাহলে?
-আমি তো অর্ককে বিয়ে করে ফেলেছি আঙ্কেল। এখন আন্টি কিভাবে রাজি না হওয়ার প্রতিশোধ নিবে?
ঠোঁট উল্টিয়ে কথাটা বলল কুঞ্জ। আলম সাহেবের হঠাৎ হাসি পেলো। মনে পড়ে গেলো ছোট বেলার কথা। রাইও এভাবে ঠোঁট উল্টাতো। মেয়েটাও হয়েছে তেমন। দেখলেই মায়া লাগে। তিনি কুঞ্জকে জিজ্ঞেস করলেন কি বলছে এসব। অতঃপর কুঞ্জ তাকে বিয়ের বিষয়ে সব খুলে বলল। আলম সাহেব বললেন,
-তাহলে আর কি। তোমাকে তাহনা কষ্ট দিবে খুব মা।
কুঞ্জ চমৎকার হাসলো। বলল,
-দেখ যাক কি হয়।
শাশুড়ির চুলে বেণি গেঁথে দিলো কুঞ্জ। এরপর তেলের বাটি সরিয়ে বসলো। আলতো স্বরে বলল,
-অতীতের কথা আমি বাবা থেকে শুনেছি। আব্বুর উপর একটু রাগ হয়েছিল শুনে। আগ্রহ থেকে লুকিয়ে আব্বুর ডায়েরি পড়েছি। জেনেছি আব্বু আপনাকে নিয়ে পালাতেও চেয়েছিল। কিন্তু সুযোগ পায়নি। তাই আব্বুর উপর রাগ হয়নি আর। দোষ কোথায় আব্বুর? নেই তো।
মিসেস তানহা জবাব দিলেন না। আসলেও দোষ নেই আফজালের। কি বা করতো আর সে? আলতো স্বরে বললেন,
-অর্ককে ছেড়ে দিয়ে আমাকে হারিয়ে দিতে পারতে। দাওনি কেন?
-জানেন আমার আম্মু হাসে খুব কম। কেমন উদভ্রান্তের মতো থাকে। হঠাৎ করে ভয় পায়। গভীর রাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদে। তার একটা বিশাল সংসার আছে। অথচ সত্যি বলতে তার কিছুই নেই। পাওয়ার মাঝে তার পাওয়া একটায়। তার মেয়ে। বেঁচেও আছে তাই। আমি আমার ময়ের মতো অসহ্য রকম একটা জীবন অন্য কাউকে দিতে চাইনি। আপনি অর্ককে জোড় করে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে সেও আব্বুর মতো হতো। আমি চাইনি সেটা হোক। কতটুকু কষ্ট আপনি আমাকে দিবেন মা? আমার মায়ের কষ্টের কাছে ওসব কিছু নয়। আপনি আমাকে বকলে আমাকে সামলে নিতে অর্ক আছে। আমার মায়ের কেউ ছিল না। সব কিছু জানার পর আমার জেদ ছিলো অর্ককে কোন কিছুর বিনিময়ে ছাড়বো না আমি। যত কষ্ট হয় হোক। আপনি নাহয় দু’টো কথায় শেনাবেন। তাতে কি? খুব ক্ষতি এতে হবে না।
মিসেস তানহা নীরবে শুনলেন সব। কিছু বললেন না। বলতে পারলেন না। কুঞ্জ ধীর পায়ে বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। সে জানে এখন মিসেস তানহাকে একা থাকতে দিতে হবে। তিনি সব কিছু ভাববেন। নিজের কাজের জন্য অনুশোচনা হবে তার। এ সময় বিরক্ত করা উচিত হবে না। কুঞ্জ আলতো হাসলো। যাক অবশেষে শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে অন্তত। বাকি কাজ সহজ হয়ে গেলো আরও অনেকটা। বিরবির করে বলল কুঞ্জ,
-আই মিস ইউ আব্বু। মিস ইউ আলট।
#চলবে?