#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২০
আফজাল চৌধুরী খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বসার মাঝে রাজকীয় ভাব৷ কুঞ্জ ঘরে প্রবেশ করে একপলক তার দিকে চাইলো। চেয়ার টেনে এনে বসল খাটের সামনে। আফজাল চৌধুরী মেয়ের করা প্রতিটি কার্যক্রম সূক্ষ্ম চোখে পরখ করলেন। কিন্তু বুঝতে দিলেন না। কুঞ্জ বসার আগেয় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কুঞ্জ বসে তার দিকে ফের চাইলো। ঠোঁট কামড়ে একটু হাসলো। কিছুক্ষণ পিন পতন নীরবতা বিরাজ করলো তাদের নাঝে। নীরবতা ভাঙল কুঞ্জ,
-কি বলবেন আব্বু?
আফজাল চৌধুরী মেয়ের দিকে ফিরলেন। কন্ঠে গম্ভীরর্যতা এতে বললেন,
-বেশ কয়েকমাস ধরে হলে থাকছো না শুনলাম।
-ঠিকই শুনেছেন।
-থাকছো কোথায়?
-আপনার অজানা হওয়ার কথা নয়।
আফজাল চৌধুরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-বিয়ে করেছো কবে?
-শরিয়ত অনুযায়ী তিন বছর আগে আর কাবিন সহ ছয়মাস আগে।
আফজাল চৌধুরীর হঠাৎ বুকে চিনচিন ব্যাথা হলো। তবুও নিজেলে সামলে গম্ভীর স্বরে বলল,
-এভাবে বিয়ে না করলে হতো না?
-স্বাভাবিকতা আমার জন্য বরাদ্দ ছিল না আব্বু।
আফজাল চৌধুরী চুপ রইলেন। কুঞ্জ আলতো হেসে নিজে থেকে বলল,
-আপনি কিন্তু পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আব্বু। আমি কিন্তু তা করিনি। আমি জানতাম আপনি সব জানেন, জানবেন।
আফজাল চৌধুরী অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। কুঞ্জ মিষ্টি করে হাসলো। বলল,
-আমি এটাও জানি আপনি আমাকে কিছু বলবেন না, ঠিক মেনে নিবেন।
আফজাল চৌধুরী রেগে গিয়ে মেয়েকে ধমক দিতে চাইলেন অথচ পারলেন না। কুঞ্জ তার চোখে চোখ রেখে হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-ভালোবাসা অন্যায় নয় সেটা আপনিও মানেন আব্বু। আপনি ভয় পাচ্ছিলেন তানহা মা আমাকে মেনে নিবে কি না। আর ভয় পাচ্ছিলেন তার মুখোমুখি হওয়ার। এতো ভয় পেলে তো হবে না আব্বু। আমি আপনার মতো করে আরও একজনের জীবনে কষ্ট দিতে চাইনি।
আফজাল চৌধুরী নীরবে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কিছু বললেন না। বলার ভাষা পেলেন না। কুঞ্জ আনমনে হাসলো। বলল,
-আপনার ধারণা ঠিক ছিলো আব্বু। তানহা মা আমাকে মানেনি। অনেক কথা শুনিয়েছেন। আমার আপত্তিও ছিল না অবশ্য। সব জেনে শুনে বাঘের খাচার লাফ দিয়ে তো অনুশোচনা করা যায় না তাইনা? আমার খারাপ লাগতো কখন আব্বু জানেন? তানহা মা’র দাদির উপর রাগ থাকতেই পারে, কিন্তু উনি যখন আপনাকে তার মাঝে টানতো তখন আমার খারাপ লাগতো। আপনার তো দোষ ছিল না আব্বু। তবুও কেন আপনাকে দোষী বানাবেন তিনি। দোষ যদি দিতেই হয় তবে তার নিজেকে দেওয়া উচিত না? সে আপনার হাত ধরেনি। দোষটা কিন্তু কিছুটা হলেও তার। সে যদি বলে সে তার পরিবার ছাড়তে পারতো না, তাহলে সেম কথাটা তো আপনিও বলতে পারতেন তাই না আব্বু? ঠিক এই জায়গায় এসে আমার আপনাকে ভালো লাগতো না আব্বু। আপনি এমন একজনকে ভালোবাসেন যে আপনাকে অকারণে দোষ দেয়। আপনার মেয়ের সামনে আপনাকে বেইমান বলে। সেই মানুষটাকে ভালোবেসে আপনি আমার আম্মুকে কষ্ট দেন আব্বু? অথচ আমার আম্মু কতশত কষ্ট বুকে আগলে রাখে। অভিযোগ করে না। আমি সহ্য করতে পারিনা আব্বু। সত্যি!
আফজাল চৌধুরীর ঠোঁট নড়লো একটু। কিন্তু কোন শব্দ বের হলো না। কুঞ্জ তাকে একটু সময় দিলো। কিছু সময় বাদে ফের বলতে লাগলো,
-আপনি তো ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট বোঝেন আব্বু, তবে আম্মুর কষ্ট বুঝলেন না কেন? মানুষটা আপনাকে ভীষণ রকম ভালোবেসে কি বাজে ভাবে হেরে গেলো আব্বু! আপনি কেন একটু খেয়াল করলেন না। তাকে একটু ভালোবাসলেন না আব্বু। কেন বাসলেন না? কেন?
আফজাল চৌধুরীর মাথার মাঝে ভোঁতা যন্ত্রণা শুরু করো। কুঞ্জের বলা প্রতিটি কথা তার কলিজাটা এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে বলে অনুভূত হলো। তিনি অনেক কিছু বলতে চাইলেন বলতে কিন্তু পারলেন না। একের পর এক ঢোক গিলতে লাগলেন। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো। এমন হচ্ছে কেন তার। কুঞ্জের বুঝি এতেও মন ভরলো না। আবার বলতে লাগলো,
-আপনি সত্যি নিষ্ঠু র আব্বু। আপনার আশেপাশে পঁচিশটা বছর একটা মানুষ একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভে ঘুরে বেড়ালো আর আপনি ফিরেও চাইলেন না। এতো পাষা*ণ আপনি আব্বু? কোনদিন জানতে চেয়েছিলেন আম্মু কি চায়? আম্মুর কি পছন্দ? মানুষ এক বছর একসাথে থাকলেও তার পছন্দ অপছন্দ জেনে যায় আব্বু অথচ আপনি পঁচিশ বছরেও জানেননি। একটা সাধারণ সংসার অন্তত আম্মুকে দিতে পারতেন আব্বু, তাও কেন দিলেন না? আমার আম্মু কি সেটা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না?
কুঞ্জ থামলো। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। জল গড়িয়ে পরবে পরবে ভাব। সেই জলভরা ছলছল নয়নে বলে উঠলো,
-জানেন আব্বু, আমি রাতের পর রাত আমার আম্মুকে হাসফাস করে কাটাতে দেখেছি। মধ্যরাতে তাকে পাশে না পেয়ে ব্যালকনিতে বসে তাকে চোখের জল ফেলতে দেখেছি। ছোট চাচ্চুরা যখন মেঝমা, ছোটমার পছন্দের কোন জিনিস আনে, আমার আম্মুকে তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে দেখেছি। আমি আমার আম্মুর এতো কষ্টের সামিল কেন হলাম আব্বু? আমি নুহাস, পূর্বের মতো আমার মায়ের ভালোবাসা দেখতে পারলাম না কেন আব্বু?
আফজাল চৌধুরীর শ্বাস বোধহয় থেমে গেলো। এত এত অভিযোগ কোনদিন কেউ করেছিল তার সামনে? না, কেউ করেনি। অথচ আজ করছে, তাও কে? তার কলিজার টুকরো মেয়ে। যাকে সে এমন ভাবে বড় করেছে যাতে কখনো তার অভিযোগ না থাকে। আজ সেই মেয়ে অভিযোগের বন্যা বয়ে দিচ্ছে। তার কলিজাটা ছিড়ে ফেলা বোধহয় বাকি ছিল! কুঞ্জ এবার সেটায় করলো। উঠে দাঁড়ালো সে। নয়ন বেয়ে আলগোছে পানি পড়ছে। আফজাল চৌধুরীর দিকে তাকালো একবার। হাসলো। চোখের পানি মুছলো তারপর বলল,
-বিশ্বাস করেন আব্বু, আপনাকে আব্বু হিসেবে আমি ভয়ংকর রকম ভালোবাসি, আর আমার আম্মুর স্বামী হিসেবে বিচ্ছিরি রকম ঘৃণা করি।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না কুঞ্জ। বাবার ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেলো। সিড়ি দিয়ে এক নিমেষে দোতালায় উঠে, নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। ডাইনিং এ বসা আটটা মানুষ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রাইলো কুঞ্জের যাওয়ান পানে। তার চোখের পানি বুকে কাঁপন ধরালো তাদের। খুব ভয়াবহ কিছু ঘটে গেছে বুঝতে পারলো সবাই। কুহুর মুখ পাংশুটে হয়ে গেলো। শক্ত করে সে নুহাসের হাত আগলে ধরলো।
আফজাল চৌধুরী এক দৃষ্টিতে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথাট শূণ্য হয়ে আছে। তিনি কিছু ভাবতে পারছেন না। শূণ্য মাথায় কিছু ভাবা যায়? বুকটা শুধু চিনচিন ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে বুকে পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। আচ্ছা কোন বাপ কি তার মেয়ের থেকে শুনেছে এভাবে? তার মায়ের স্বামী হিসেবে তাকে ঘৃণা করার কথা? আফজাল চৌধুরী পঁচিশ বছর আগে কেঁদে ছিলেন। সেবার শপথ নিয়েছিলেন আর কোনদিন কাঁদবে না, কিন্তু আজ সে কথা রাখতে পারলেন না। তিনি হু হু করে কেঁদে দিলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে একান্ন বছরের মানুষটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো রাইমার।
কুঞ্জ বালিশে মুখ চেপে অনেকক্ষণ কাঁদলো। চোখ মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে তার। নাকের ডগা ফুলে আছে। কাঁদতে কাঁদতে শুধু বারবার বলল সে,
-আ’ম সরি আব্বু। অনেক সরি। আমার আর কিছু করার ছিল না আব্বু। আ’ম সরি।
কান্না কিছুটা কমে আসলে সে মুখ তুললো। এলোমেলো পা ফেলে বারান্দায় গিয়ে বসলো। হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে নিজে নিজে বলতে লাগলো,
-তুমি একটু শাস্তি ডির্জাভ করো আব্বু। এই শাস্তি টা তাই তোমার। এরপরে আরও একজনের শাস্তি পাওয়া বাকি, যদিও তার শাস্তি একদম নগণ্য তবুও সি ডিজার্ভ ইট। দোষ তারও ছিল। তাই না আব্বু?
কুঞ্জ আনমনে হাসলো। বারান্দা ছুঁইছুঁই করে উঠা কাঠগোলাপের গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকলো বহুক্ষণ।
নিজের ঘরটা আজ অর্কের সহ্য হচ্ছে না। বারবার মনে হচ্ছে কি যেন একটা নেই। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অথচ ঘরের সসব আসবাবপত্র বিদ্যমান। কোনটায় সরানো হয়নি। সে হাসলো। আজ তার ঘরে যে বউ নেই। ফাঁকা তো লাগবেই। বউটায় তো তার ঘর পূর্ণ করে রাখে। অর্ক ফোন হাতে নিলো। কল দিতে গিয়ে আবার থেমে গেলো। ছয় মাস পর বাড়ি গিয়েছে আজ। এখন নিশ্চয় সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছে। কল দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে আর দিলো না। অপেক্ষা করতে লাগলো কলের। বউ তাকে কখন স্বরণ করে দেখা যাক।
আলম সাহেব বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করে বিছানায় এলেন। তার ধারণা ছিলো তানহা ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু দেখলেন সে জেগে আছে। আলম সাহেব বলে উঠলো,
-কি ব্যাপার, এখনো ঘুমাওনি কেন আজকে?
তানহা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করো থাকলেন। তারপর বললেন,
-আচ্ছা আফজালের কি আমার উপর অনেক রাগ? আফজালের রাগ না থাকলেও ওর বউয়ের তো রাগ আমার উপর তাই না? মেয়েটাকে যদি আর আসতে না দেয়?
আলম সাহেব ঠোঁট চেপে হাসলেন। ব্যাঙ্গ করে বলল,
-না আসলেই তো ভালো। তুমি তো আর তাকে মন থেকে মেনে নাওনি।
তানহা চোখমুখ লাল করে তাকালেন তার দিকে। কিছু বলল না। আলম সাহেব হাসলেন। মনে মনে বললেন,
-জাদু জানে তোর মেয়ে রাই! পাষা ণীর মন জয় করে ফেলেছে।
আলতো স্বরে বললেন,
-তোমার মেয়ে তোমাকে বলে গেছে না চলে আসবে। তাহলে আসবে। ভয় পাচ্ছ কেন?
মিসেস তানহা মৃদু কন্ঠে বলল,
-কি জানি? টেনশন হচ্ছে খুব। মেয়েটা না আসলে আমার ছেলেরা পাগল হয়ে যাবে না?
আলম সাহেব হাসলেন শব্দ করে। মিসেস তানহাকে ভরসা দিয়ে ঘুম পাড়ালেন। তারপর উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ডায়াল করলেন পরিচিত এক নাম্বারে, যার মালিক রাইমা চৌধুরী!
#চলবে…?
#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২১
ছয় মাস পর মেয়ে বাড়ি এসে দুদিন থেকেই চলে যাবে! মানতে পারলেন না নওরীন ও পাপিয়া। তাদের ঘোর আপত্তি। আবার সামনে ইদ। ইদে মেয়ে বাড়ি থাকবে না। তাই হয় নাকি? নুহাস আর পূর্বেরও মুখ ভার। আর বাকি রাইলো কুহু? সে তো কেঁদে ফেলেছে। সবার মান অভিমানে দিশেহারা বোধ করলো কুঞ্জ। ঠিক তখন তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলো রাইমা চৌধুরী। কুঞ্জের প্রিয় বন্ধু। মা তো অবশ্যই। রাইমা চৌধুরী মেয়েকে পাশে বসিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,
-মেয়ে এখন অন্য বাড়ির বউ। ও বাড়িতে ইদ করতে হবে না?
পাপিয়া চৌধুরী মুখ গোমড়া করে তাকালেন কুঞ্জের দিকে। বললেন,
-ওভাবে বিয়ে করলি কেন আম্মা? তোর বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন আমাদরে। এভাবে বিয়ে মানবো না। বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে নাকি কোন আয়োজন ছাড়া।
কুঞ্জ আলতো হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-শোন ছোটমা, ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে আমি করবো। বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে সব আয়োজন নিয়েই হবে এবং সবার আগেয় হবে। ওদের সিরিয়াল আসতে বহু দেরি।
নুহাস সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
-দেরি কেন আপা? হুয়াই দেরি। এখনি বিয়ে দাও করে ফেলি।
বড়রা মুখ চেপে হাসতে লাগলো নুহাসের কথায়। কুহু লজ্জায় লাল নীল বর্ণ ধারণ করছে। পূর্ব খুকখুক করে কেশে উঠলো পরক্ষণেই ঠাস করে চাপর মারলো নুহাসের পিঠে। ফিসফিস করে বলল,
-শা লা মুখে লাগাম দে।
হাসলো না কেবল কুঞ্জ। অপ্রস্তুত হলো না। ভেঙচি কেটে বলল,
-হু এখনি বিয়ে করবি তাই না? একদম জেলে পুরে দিয়ে আসবো।
-বিয়ের সাথে জেলের কি সম্পর্ক আপা?
-কোন সম্পর্ক নাই ভাই। তুই যাকে বিয়ে করবি তার বয়স জানি কতো?
নুহাস বলল,
-সতেরো…
বাকি কথা বলতে পারলো। না মাথা নিচু করে জিব কামড়ালো। পূর্ব ফের ফিসফিস করে বলল,
-বলছিলাম লাগাম দে মুখে, মাথাটা গেছে তোর? কুহু লজ্জায় মরেই গেলো বলে।
নুহাস আড়চোখে তাকালো কুহুর দিকে। কুহু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। মাথা নিচু। নুহাস আলতো হাসলে। এদিকে নুহাস বাকি কথা না বলায় হেসে দিলো কুঞ্জ। বলল,
-তারপর বল।
নুহাস মিনমিন করে বলল,
-না কিছু না আপা।
এবার হু হা করে হেসে দিলো সবায়। শুধু মুখ লুকিয়ে বসে রইলো নুহাস এবং তার প্রাণপাখি কুহু।
কারো দোষের শাস্তি স্বরূপ যদি তুমি তাকে শারীরিক শাস্তি দাও, তবে সেই আঘাতের চিহ্ন একদিন মুছে যাবে। সে পুনরায় তোমার উপর জেদ দেখিয়ে নতুন অন্যায়ে লিপ্ত হবে। অপরদিকে তুমি যদি তাকে তার দোষটা ভালো ব্যবহার দিয়ে ধরিয়ে দাও তবে একসময় সে নিজের কাজের জন্য অপরাধ বোধে ভুগবে। ঠিক এই অপরাধ বোধে ভুগছে তাহনা। কুঞ্জ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। অথচ তিনি কুঞ্জকে কষ্ট দিতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তার নিজেকে হীন মনে হয়। মানুষ যখন তার কাজের জন্য অনুশোচনা বোধ করে তখন সে নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যায়। এক ধরনের মানসিক অশান্তিতে ভোগে। ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরে। এই অনুশোচনা নামক অনলে দগ্ধ হচ্ছে আফজাল চৌধুরী। কুঞ্জ তার সামনে কিছু অভিযোগ তুলে ধরেছে কেবল। তিনি বুঝেছেন অভিযোগ গুলো যৌক্তিক। আর তাই তার অনুশোচনা হচ্ছে। কেন এমন করলেন ভেবে। শারীরিক শাস্তির তুলনায় মানসিক অশান্তি ভয়াবহ। আার আফজাল চৌধুরী সেটায় ভোগ করছেন গত দুদিন যাবত। তিনি এই দুদিন কাজে যান নি। ঘর থেকে তেমন বের হননি। সারাদিন একা একা থেকেছে। উদাসীন হয়ে কিছু ভেবেছে। কিন্তু সমাধান কিছু পায়নি। সময় পেরিয়ে গেলে সব কি ঠিক হয়? হয় না যে!
দুদিন বাবা বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ির পথে রওয়ানা হলো কুঞ্জ। সাথে তার দুই ভাই। কুহু মন খারাপ করে আছে। কুঞ্জ তাকে প্রমিস করেছে খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবে। তাই কান্না করেনি। রাইমা চৌধুরীর মন একটু খারাপ। আরও কটা দিন মেয়েকে যদি রাখতে পারতো। কিন্তু মেয়ের সামনে সেসব প্রকাশ করলেন না তিনি। কুঞ্জ সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িত বসলো। তবে বাবার ঘরে যায়নি ও। কুঞ্জ বাবাকে বেশিদিন কষ্ট দিতে চায় না। হাজার হোক বাবা তো! তাই বোধহয় একবারে সব দিয়ে নিচ্ছে।
মেয়ে চলে যাচ্ছে। আফজাল চৌধুরী জানেন। তার আশা ছিল মেয়ে যাওয়ার আগে কথা বলবে। সেদিনের পর আর মুখোমুখি হয়নি তারা। কিন্তু আফজাল চৌধুরীর আশায় গুড়ে বালি দিলো কুঞ্জ। যাওয়ার আগেও তার সাথে কথা বলল না। কিংবা বিদায়ও নিলো না। কুঞ্জ বাড়ি ছাড়লো বুকে চিনচিন ব্যাথা নিয়ে আর ওদিকে অভিমানে ঝাঁঝরা হয়ে গেলো এক বাবার বুক!
দিনের শেষ সময়। সন্ধ্যা হওয়ার আগ মুহুর্ত। চারদিকে নির্মল বাতাস। মিসেস তানহা বারান্দায় বসে আছেন আনমনে। অর্ক আর আলম সাহেব গরুর হাটে গেছে। অদিতি গেছে বান্ধবীদের সাথে। তিনি একা বাসায়। এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু বারান্দা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হলো। এই একলা সময়টায় তিনি কুঞ্জকে মিস করলেন। মেয়েটা তার গল্প করার সাথী হয়ে গেছে। ওই দূর টাঙ্গাইলের সখিপুর উপজেলার ছোট্ট সবুজ একটা গ্রাম। যে গ্রামে পরপর দুই দশকে জন্ম দুই নারীর। এখন তাদের সম্পর্ক শাশুড়ি-বউ। সেই গ্রাম, মাঠ, বিল কত কিছু নিয়ে কথা হয় তাদের! কুঞ্জ কৌতূহল নিয়ে তার সব কথা শোনে। তিনি উৎসাহ পান। আরও বলেন। কথারা যেন ফুরায় না আর। তার আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি ভাবনা ছেড়ে বের হলেন। অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। দরজা খুলতেই দেখলেন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে কুঞ্জ। তিনি অবাক হলেন। কুঞ্জ মৃদুস্বরে সালাম দিলো তাকে। তিনি সালামের উত্তর দিয়ে ঘরে নিয়ে এলো ওকে। সাথে কাউকে না দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
-একা এসেছো?
-না মা। ভাইরা এসেছিল। পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে বলে দাঁড়ায়নি আর।
কুঞ্জ অসহায় কন্ঠে বলল,
-কিছু মনে করবেন না মা প্লিজ।
মিসেস তানহা হেসে কুঞ্জের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আলতো স্বরে বলল,
-রাগ করবো কেন। ছোট ছোট ছেলে দু’টো। বেশি রাত হলে আমারও টেনশন লাগতো। সে যাক, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও তো। আমার ভীষণ চা’ র তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি চা বসায়। দু’জন একসাথে বসে চা খাব।
কুঞ্জ হাসলো। প্রপ্তিময় হাসি। মিসেস তানহা সামনে থেকে সরে যেতই বিরবির করে বলল,
-আমার শূণ্যের খাতাটা এবার প্রাপ্তি দিয়ে পূর্ণ হবে। অতীত দেয়ালে লেখা গল্প আমার প্রাপ্তি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, আজ সে দেখুক প্রাপ্তি আমার অঙ্গজুড়ে।
সূর্য ডুবে গেছে। ধরণীতে নেমে এসেছে আঁধার। মিসেস তানহা ও কুঞ্জ বারান্দায় বসেছে চায়ের কাপ হাতে। মিসেস তানহা চেয়ারে বসলেন। কুঞ্জ আয়েস করে বসলো নিচে। মিসেস তানহা কিছু বললেন না। তিনি জানেন কুঞ্জ এভাবে বসে আরাম পায়। মিসেস তানহা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
-বাড়িতে কেউ কিছু বলেছে?
-হু। বলছে এভাবে বিয়ে পছন্দ হয়নি।
-সে তো আমারও হয়নি। একমাত্র ছেলের বিয়ে আমার। সবায় মানলেই হয়ে যায়। ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে দেই।
-কারো সমস্যা নেই। আব্বু..
কুঞ্জ থেমে গেলো। মিসেস তানহা হেসে কথা পাল্টালেন। কুঞ্জ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলো মনে মনে। সে সত্যিই এ ব্যাপারে কথা বলতে চায় না।
একটু পরে অদিতি ফিরলো। কুঞ্জকে দেখে দ্রুত এসে জড়িয়ে ধরলো। চিৎকার করে বলল,
-ভাবিইই, মিস ইউ। দু’দিনয় মনে হচ্ছিল বাসা ফাঁকা ফাঁকা।
-ওমা কেন? সবায় তো ছিল।
-তুমি ছিলে না যে।
-আচ্ছা বাবা। এই যে চলে এসেছি। ফ্রেস হয়ে এসো। তোমার প্রিয় নুডলস পাকোড়া বানাচ্ছি।
-ওকে ভাবি।
অদিতি ছুটে গেলো রুমে। কুঞ্জ পা বাড়ালো রান্নাঘরের দিকে।
এশার নামাজের পর অর্ক আর আলাম বাড়ি ফিরলেন। দরজা খুলল অদিতি। আলম সাহেব ঢুকে গেলেন ঘরে। আর অর্ক জুতা খুলতে লাগলো। অদিতি বলল,
-মন ভালো ভাইয়া?
অর্ক ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওর দিকে। কিছু বলল না। অদিতি হিহি করে হাসলো। ফের বলল,
-মন খারাপ হলেও নো পরবলেম। ঘরে গেলেই মন ভালো হয়ে যাবে।
কথাটা বলেই অদিতি চোখ টিপলো। তারপর গুণ গুঙ করতে করতে নিজের ঘরের দিকে গেলো। অর্ক প্রথমে পাত্তা দিলো না ওর কথায়। এই মেয়ে কখন কি বলে ঠিক নেই। তার থেকেও বড় কথা এখন এসব পাত্তা দেওয়ার মুড নেই। বাবার সাথে এই গরুর হাটে গেলেই ওর মন মেজাজ সব খারাপ হয়ে যায়। বাবার যেটা পছন্দ সেটা ওর পছন্দ হয় না আবার ওর যেটা পছন্দ হয় সেটা বাবার হয় না। অর্ক চোখ মুখ গোমড়া করে জুতার ফিতা খুলল। হঠাৎ অদিতির কথাটা কানে বাজলো। রুমে গিয়ে মন ভালো হয়ে যাবে মানে? মানে! অর্ক চট করে বুঝে গেলো কি বুঝাতে চেয়েছে অদিতি। অর্ক আলতো হেসে পা চালালো ঘরের দিকে। দুই দিন! পাক্কা দুই দিন পর তার ঘরটা আজ পূর্ণ হবে। তার বউ এসে গেছে না? এখন আর মন খারাপ থাকে?
#চলবে…?