#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২২
বর্ষার শুরু। ঝিরঝির করে পড়তে থাকা বৃষ্টিরা জানান দিচ্ছে বর্ষার আগমন। মৃদু বর্ষণে ভিজে যাচ্ছে ধরণীতল। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরপুর বাতাস। কুঞ্জ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন কানে গুঁজে আছে। ওপাশ থেকে রাইমা চৌধুরী বলল,
-তুমি ভীষণ সুখি হবে কুঞ্জ। ওখানে তোমার কোন সমস্যা হবে না।
রাইমার কন্ঠে ঝরে পড়ছে আত্মবিশ্বাস। কুঞ্জ মায়ের আত্মবিশ্বাসী স্বর শুনে একটু হাসলো। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল,
-বেস্ট ফ্রেন্ডের উপর ভীষণ বিশ্বাস তোমার তাই না আম্মু?
রাইমা চৌধুরী শব্দ করে হাসলেন। বলে উঠলো,
-তুমি এতো চালাক হলে কি করে বলোতো!
কুঞ্জ উত্তর দিলো না। রাইমা চৌধুরী ফের বলল,
-আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে কুঞ্জ?
মায়ের দুষ্ট কন্ঠ শুনে এবার কুঞ্জ হেসে দিলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
-ওয়াহিদ আলম রব্বানী। শর্টকাটে রাবু। আমার একমাত্র শ্বশুর আব্বা। আরও পরিচয় দিতে হবে আম্মু?
রাইমা আগের মতো করে হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
-এই ইনফরমেশনটা তুমি কোথা থেকে কালেক্ট করেছো বলোতো।
-উমমম, সিক্রেট।
-বলা যাবে না?
-উহু, আপাতত না।
রাইমা আলতো হাসলো। প্রতিউত্তর করলো,
-আচ্ছা বেশ!
চৌধুরী নিবাসের নিচতলায়, সিঁড়ির ডান পাশের প্রথম ঘরটি বেশ বড়। ঘরের বাম পাশে পাশাপাশি সাজানো তিনটি বুক শেলফ। ডানপাশে জানালার ধারে একটা টেবিল। টেবিলের পাশে দুটো চেয়ার। আর পাশে আরও একটি বুক শেলফ। বাম পাশের দ্বিতীয় বুক শেলফের ডয়ার আফজাল চৌধুরীর। তিনি ছাড়া ওই ডয়ার কেউ খোলে না। জুরুরি কাগজ পত্র তিনি ওটায় রাখেন। চাবি তার কাছেয় থাকে, নাহয় কুঞ্জের কাছে। কয়েকদিন কাজে না গেলেও আজ জরুরি কাজে যেতে হবে। তিনি কিছু কাগল নেওয়ার জন্য ড্রয়ার খুললেন। খুলতেই তার চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো একটি ধূসর রঙের ডায়েরি। তিনি ভারী অবাকা হলেন। এই ডায়েরি তার নয়। সুতরাং এখানে থাকার প্রশ্নয় আসে না। তাহলে কার? কৌতূহল গ্রাস করলো তাকে। তিনি ডায়েরিটি হাতে নিলেন। কৌতূহল বশত প্রথম পেজ উল্টালেন। সেটা একটা ছোট কাগজে গোট গোট অক্ষরে লেখা,
“ডায়েরিটা পড়বেন আব্বু। ইচ্ছে হলে শুরু থেকে পড়তে পারেন আর নাহয় মাঝের একটা পেজে আর একটা কাগজ আটকানো আছে, সেখান থেকে শুরু করবেন। আপনার অনেক কিছু জানতে হবে।”
আফজাল চৌধুরী লেখাটার উপরে আদুরে হাত বুলালেন। মেয়ের লেখা তার। তিনি বুক তুলে নিলেন ডায়েরিটা। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখলেন। কাজ টা শেষ করে এসেই পড়বেন।
কাজ সম্পন্ন করে বিকালে বাড়ি ফিরলেন আফজাল চৌধুরী। নিজের ঘরের দরজা তিনি সচরাচর লাগান না। আজ লাগিয়ে দিলেন। রাইমা চৌধুরী অবাক হলেন। কি করবে এই লোক? আফজাল চৌধুরী ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় বসলেন। হাতে সেই ধূসর রাঙা ডায়েরি খানা। তিনি প্রথম পেজ খুললেন। সেখানে সুন্দর করে লিখা,
“রাইমা তালুকদার”
আফজাল চৌধুরী বুঝলেন ডায়েরিটা রাইমার। তার বুক কাঁপতে লাগলো। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগলো। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি পরের পেজ উল্টালেন,
১৯৯৭ সাল থেকে শুরু ডায়েরিটি লেখা। রাইমা তখন কলেজের ছাত্রী। কলেজ জীবনের কথা, তার ভালোলাগা, খারাপ লাগা নিয়ে লেখা। আফজাল চৌধুরী প্রতিটি পৃষ্ঠা মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। এরপর মাঝখানের দিকে একটি পেজে কুঞ্জের লেখা একটি কাগজ চোখে পড়লো,
“এখান থেকে পড়া শুরু করুন আব্বু!”
আফজাল চৌধুরী নড়েচড়ে বসলেন। নিশ্চয়ই এরপরে বিষয় গুলো গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েরির লেখার তারিখ পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৭ থেকে সালটা এবার ১৯৯৯ এসে ঠেকেছে। গল্পেটাও পরিবর্তন হলো। রাইমার নিজেকে নিয়ে লেখা ডায়েরিতে অন্য কারো নাম এলো।
“০৩ এপ্রিল ১৯৯৯,
বিয়ের কথা জোরদার হয়েছে এবার। সখিপুরের সেই চিরচেনা চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা এগুচ্ছে আমার।”
“০৮ এপ্রিল ১৯৯৯,
বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। মে মাসের ১২ তারিখে আমার বিয়ে। বাড়ির সকলে খুশি। সবার খুশিতে সামিল হলাম নিজেও। আনমনে কতশত ভাবনা আসছে। আমার কল্পনার সংসারের মতো সুখ থাকবে তো? মানুষটা আমায় ভালোবাসবে তো? নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হচ্ছি আর নিজেকে বকছি।”
“১৭ এপ্রিল ১৯৯৯,
যেই মানুষটার সাথে আমার বিয়ের কথা চলছে, সে অন্য নারিতে আসক্ত। জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে। নিজের কোন ইচ্ছে নেই তার। তার প্রেমিকার বাড়ি তাদের গ্রামেয়। মেয়েটা নাকি ভীষণ পাগলামি করছে। লোক মারফত এসব খবর বাড়ি এসেছে পৌছেছে। আমি বাবাকে বললাম বিয়েটা করবো না। এমন কারো জীবনে নিশ্চয় যওয়া যায় না যেখানে অন্য কেউ আগে থেকে আছে। কিন্তু কেউ শুনলো না আমার কথা। সবার একই কথা, বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অথচ তারা বুঝলো না অন্যতে মন থাকলে সংসার হয় না!”
” ০৬ মে ১৯৯৯,
আমার কাছের বন্ধুদের সব বলেছি। বাড়িতে এই কয় দিন মানানোর চেষ্টা করেছি খুব। কিন্তু আমার কথা মানতে সকলে নারাজ। আমার কথা শুনবেই বা কেন তারা? বিয়েটা হলে বাড়ির ব্যবসায় লাভ হবে, তাতে যদি মেয়ে অসুখী হয় হোক। টাকা আগে সুখ পরে!”
“১০ মে ১৯৯৯,
বন্ধুদের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি পালিয়ে যাব। আর যাইহোক কারো সম্পর্কের তৃতীয় ব্যাক্তি আমি হতে চাই না। তাই এই সিদ্ধান্ত। কাল হলুদ আমার। হলুদের আগেই এই বাড়ি ছাড়বো ইন শাহ আল্লাহ। ‘
” ১১ মে ১৯৯৯,
আজ আমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। ও ডায়েরি ভাবছো অনুষ্ঠান কিভবে সম্পন্ন হলো? আমি কি তবে ছাড়িনি এ বাড়ি? উহু ছাড়িনি। গতকাল সন্ধ্যায় আমার বান্ধবী রিমি জানালো আমার হবু বরের প্রাক্তনকেই পাগলের মতো ভালোবাসে আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড রাবু। রাবুর মুখের তার গল্প শুনেছিলাম অনেক। কিন্তু তাকে দেখা হয়নি। আরও জানলাম আমি বিয়ে না করলেও তাহনা নামের সেই মেয়েটার সাথে আফজালের বিয়ে দিবে না চৌধুরী পরিবার। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রইস খন্দকারের মেয়ের সাথে বিয়ের কথা এগোবে তারা, আমি বিয়ে না করলে। রইসের মেয়ে রেশমি ভালোবাসে অন্য একজনকে। আমি পালিয়ে গেলে যদি আফজাল তানহা মিলে যেতে পারতো তবে নিশ্চয় যেতাম। কিন্তু আমি পালিয়ে গেলে বরং আরও দু’জনের প্রেমের ইতি ঘটবে। কি দরকার? আর তারচেয়ে বড় কথা, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তাহনা একা হয়ে যাবে, সে সময় নিশ্চয় রাবুর প্রেম চোখে পড়বে ওর। ওদের সংসার হবে! সুখের সংসার। ছোট্ট অপরিচিত বোন তানহা, তোমার থেকে স্বর্ণ ছিনিয়ে নিলেও হীরা দিয়ে যাচ্ছি! যদিও ছিনিয়ে আমি নিচ্ছি না বোন। আমি নিরুপায় খুব! তবুও তুমি সুখি হবে দেখো।”
“১৩ এপ্রিল ১৯৯৯,
গতকাল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি আমি। পবিত্র বন্ধন। কিন্তু সংসার বোধহয় জুটবে না। বিয়ের রাতেয় তিনি বলে দিয়েছেন ভালোবাসতে পারবে না আমার। হাহ! ভাগ্য আমার! কল্পনায় সুখের সংসার বোনা আমার সুখ সইলো না। আমার বোধহয় কল্পনাতেয় সুখি হতে হবে। বাস্তবে সুখ আমার জন্য অরাধ্য!
আফজাল চৌধুরী অবাক হয়ে পড়ে গেলেন। নিজের মাঝে শূণ্য শূণ্য অনুভূতি হলো তার। মেয়েটা তার কথা, তানহার কথা ভেবেছে, রেশমি নামের মেয়েটার কথা ভেবেছে। ভাবেনি শুধু নিজের কথা। বিয়ের প্রথম দিকে তার মনে হতো রাইমা বিয়েটা না করলেই সে তানহাকে পেয়ে যেত। অথচ এখন বুঝতে পারছে কত বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার বাবা। টাকা টাকা করে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার, রাইমা কিংবা রেশমির বাবা-মা। সন্তাদের নিলামে তুলে ফেলেছিল তারা। যেন বেচা কেনার পণ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মেয়েটাকে অকারণে দোষারোপ করার জন্য মনটা বিষিয়ে উঠলো তার। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব বলে মনে হলো। রাইমাকে সে একটুও বুঝতে চাইলো না কেন? মেয়েটার দুঃখে আজ তার বিলীন হয়ে যেতে মন চাইলো খুব!
ফের ডায়েরিটা খুলতে যাবে তখনই দরজার টোকা দিলো পাপিয়া৷ উচ্চস্বরে বলল,
-ভাইজান, ঘুমায়ছেন? নাস্তা বানিয়েছি। খেয়ে যান। ও ভাইজান।
আফজাল চৌধুরী ত্রস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ালেন। ডায়েরিটা রাখলেন বেড সাইডের ভিতরে। এরপর ঘর থেকে বের হলেন। রাতে পড়বেন আবার। আরও কত অজানা বিষয় যে জানা বাকি!
#চলবে…?