অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-২৩

0
23

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৩

সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। সাথে বজ্রপাত। ঘরের জানালা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন আফজাল চৌধুরী। কাজলদিঘীতে অনবরত বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। তিনি মুগ্ধ হয়ে কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। বাতাসে নড়ছে গাছ গুলো। গাছের পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে অদ্ভুত এক শব্দ তৈরি করছে। শুনতে ভালো লাগছে। বেশ অনেকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন আফজাল চৌধুরী। বৃষ্টি থামার নাম নেই। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। আফজাল চৌধুরী বারান্দার দরজা বন্ধ করে ঘরে এলেন। বেড সাইডের ড্রয়ার খুলে বের করলেন ধূসর রঙের ডায়েরিটা। বিছানায় বসলেন। বিকালে যতখানি পড়েছিল তার পর থেকে ফের শুরু করলো,

“১৫ মে ১৯৯৯,
বিয়ে বৌভাত সকল অনুষ্ঠান শেষ। এখন শ্বশুড় বাড়িতে আমি। অনুষ্ঠানের সময় বাড়িতে অনেক মানুষ ছিলো। এখন কেউ নেই। বিশাল দ্বিতল ভবটিতে কয়েকটা মানুষের বাস। সারাদিন বাড়িতে ঘোরাঘুরি করা হলেও রাতে এক ঘরে বন্দী হয়ে যেতে হয়। সেই এক ঘরের মালিক আমাকে সহ্য করতে পারে না। ঘরে ঢুকতেই এমন ভাবে তাকায় যেন সে মহা বিরক্ত। নাটক, সিনেমার মতো আলাদা শুতে হয়না ঠিকই তবে দু’জনের মাঝে থাকে বিশাল দূরত্ব। বিছানার মাঝে যেন অদৃশ্য এক দেয়াল! সে মুখ ঘুরিয়ে থাকে অন্যপাশে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি তো কারো বিরক্তির কারণ হতে চাইনি! ভাগ্য এতো নির্মম কেন? আমার সুখের খাতা কি সুখ শূন্য!”

“২৬ আগস্ট ১৯৯৯,
ডায়েরি, ডায়েরি, ডায়েরি! কত গুলো দিন পর আবার তোমায় খুলে দেখলাম। যখন আমার লিখতে ইচ্ছে হয় তখন লিখি। এতদিন লিখতে ইচ্ছে হয়নি। একই জিনিস বারবার লিখতে কার ভালো লাগে? সেই একাকিত্ব! সেই বিরক্তি! সেই সব তো এক। এই বিশাল বাড়িটাতে আমি ভীষণ একা ডায়েরি জানো? যার নামে নিজেকে লিখে এ বাড়িতে এসেছি সে ঘুরেও তাকায় না আমার পানে, শাশুড়ী নিজের কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর অসুস্থ। ননদের বিয়ে হয়ে গেছে। দেবরাও বাড়ি থাকে না। সারাদিন একা একা অশরীরীর মতো ঘুরি আমি। মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে! তবুও কিছু করার নেই। এটায় আমার ঠিকানা কিনা!”

“০৭ অক্টোবর ১৯৯৯,
একাকিত্ব এতো ভয়াবহ কেন ডায়েরি? তুমি জানো?”

“১৮ নভেম্বর ১৯৯৯,
বহুদিন পর বাবা বাড়ি গেলাম। প্রায় সাত মাস পর কথা বলার মানুষ পেলাম। বান্ধবীরা সবায় এসেছে। শুনলাম রাবু আর তানহার বিয়ের কথা চলছে। কি যে খুশি লাগলো। যাক এবার তানহার দুঃখ কমবে। আচ্ছা? মেয়েটা কি আমাকে অভিশাপ দিয়েছে? কে জানে? দিলে দিক! তবুও সে সুখী হোক।”

“৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৯,
বছরের শেষ খুশির সংবাদ! কাল রাবু ও তানহার বিয়ে! মন খারাপ লাগছে, নিজের একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবো না বলে। আমার উপস্থিততে আনন্দ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংঙ্কা আছে বলে আমি যাব না। আবারও দোয়া, ওরা সুখী হোক।”

“১৭ এপ্রিল ২০০০,
আমি ছোটবেলা থেকে ভীষণ চুপচাপ। হুট করে কারো সাথে মিশে যাওয়ার স্বভাব আমার নেই। রাবু আমার আম্মুর বান্ধবীর ছেলে। ছোটকাল থেকে দু’ পরিবারের আসা-যাওয়া হয়। তাই ওর সাথে আমার দারুণ বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। আর যাদের সাথে রিশি, রিদি, রুবা, তাইফা ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির আশেপাশে। একসাথে বড় হয়েছি বলে ওদের সাথে মিশতে অসুবিধা হয় না আমার। আর কারো সাথে একদম ক্লোজ হয়ে মিশতে পারিনা আমি৷ অথচ চুপচাপ আমিটা এ বাড়িতে এসে সবার সাথে মিশতে চাইলাম। দশটা প্রশ্নের পর একটা উত্তর দেওয়া আমিটা নিজে দশটা কথা বলতে শুরু করলাম। আর আমার ভুমিকায় গেলো শাশুড়ি মা। তার সাথে দু’টো কথা বলতেই, তৃতীয় কথায় গিয়ে তিনি কাজের বাহানা দিতেন। উঠে যেতেন। আর যার জন্য এ বাড়িতে আসা সে তো মহা বিরক্ত। তবুও চেষ্টা করলাম। সে গোসলে গেলে শার্ট টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সে বের হয়ে একপলক তাকালো। হনহনিয়ে আলমারির সামনে গিয়ে অন্য শার্ট নিয়ে পরলো। হাহ! আমি হাসলাম। বোকা রাইমা! যে রাইমা নিজের কাজ ছাড়া অন্য কারো কাজে হাত দিত না হাজার বকা শুনলেও আজ সে নিজের ইচ্ছায় অন্যের কাজ করলো অথচ বুঝলো না কেউ।”

“১৬ মে ২০০০,
চেষ্টা করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এই মাসে কিছুই হলো না। আমি তো কম চেষ্টা করলাম না৷ কয়েকদিন ধরে আর ইচ্ছে করে না। বারবার মানুষটার ইগনোর আর সহ্য হয় না। আমার চুপচাপ স্বভাব আবার ফিরে আসছে। আগের থেকেও বেশি শান্ত হয়ে যাচ্ছি। এতদিন শাশুড়ি একবার ডাকলে দুবার মা উচ্চারণ করতাম। এখন আর ইচ্ছে হয় না। তিনি ডাকলে তাকায়। যে কাজের কথা বলে, চুপচাপ করি। এ বাড়িতে তো কাজ ছাড়া কেউ আমায় ডাকে না!”

“০২ জুলাই ২০০০,
কাল আমার মেঝ দেবরের বিয়ে। বাড়িতে উৎসব। অনেক মেহমান। আমার বাড়ির মানুষেরা এসেছে। ছোট বোনটা আসেনি। আমার মন খারাপ। ও আসলে একজন অন্তত কথা বলার মানুষ পাওয়া যেত! আমি খুব করে চাচ্ছি আমার জা টা যেন আমার সাথে মিশে। তাহলে অন্তত একাকিত্বটা কাটবে আমার।”

“২২ জুলাই ২০০০,
আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে। আলহামদুলিল্লাহ, অনেক শুকরিয়া। আমার জা মিষ্টি একটা মেয়ে। নাম নওশীন। আমার ওর সাথে কথা বলতে যেতে হয় না। সে নিজেয় আসে। আপা বলে ডাকে। সব কাজে সাহায্য করে। হুটহাট বিকেলে চা বানিয়ে এনে বলে,’আপা আসো তো গল্প করি।’ আল্লাহ যেন মেয়েটাকে সব সময় এমন রাখে।”

“১২ সেপ্টেম্বর ২০০০,
বিয়ের দেড় বছর হতে না হতেই আমার শাশুড়ি মার নাতি বা নাতনি চাই! ওনাকে কি করে বুঝাই ওনার ছেলে ফিরেও চায় না আমার দিকে!”

“০৬ অক্টোবর ২০০০,
ব্যাপারটা কথার কথাতেই থাকবে আশা করেছিলাম। কিন্তু তা হলো কই? বিয়ের দেড় বছর পেরুতেই তিনি বাচ্চার জন্য যা তা বলা শুরু করলেন! আমি হতাশ! তার ছেলেক হাজার কথা বললেন! আরও কত কি যে শুনতে হবে, কে জানে?

“১১ অক্টোবর ২০০০,
রাত তিনটে, ঘুম আসছে না। আসার সম্ভাবনা নেই। প্রিয় ডায়েরি জানো? আজ আমার স্বপ্ন পুরুষ আমাকে ছুঁড়ে দিয়েছে! হাহ! অথচ ভালোবাসার ছোঁয়া নয়।।বাধ্য হয়ে ছোঁয়া। আমার নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছে! এই দিনটাও দেখতে হলো?”

“২৩ মার্চ ২০০১,
আমার মাঝে ছোট্ট একটা প্রাণ বড় হচ্ছে। ভাবতেই ভালো লাগে তাই না? আমার ও লাগলো। আমি এতদিন কারো সাথে কথা বলতাম না। কারো অবশ্য কিছু যায় আসে না তাতে, নওরীন ছাড়া। মেয়েটা আমার রুমে আসে, তাকিয়ে থাকে। হুট করে জড়িয়ে ধরে আপা বলে ফুঁপিয়ে কাদে। আমি নীরবে দেখি। কিছু বলি না। বলতে হচ্ছে হয় না।”

“৩০ মে ২০০০১,
আমার পেটের সোনাটার পাঁচমাস চলছে। আমি শুধু তার সাথে কথা বলি। বাকি সবাইকে অসহ্য লাগে।”

“৪ জুন ২০০১,
আমাকে আমার বাবার বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। আমার চুপচাপ থাকাকে তারা ভাবে তাদের বাচ্চার ক্ষতি করবো। বোকা মানুষ! নিজের বেঁচে থাকার কারণকে কেউ কষ্ট দেয়?”

“২২ জুলাই ২০০১,
আমার ছোট দেবরের বিয়ে হয়েছে ১৫ দিন আগে। আমি যাইনি। অবাক করা বিষয় আজ নওরীন আর ছোট জা পাপিয়া আমায় দেখতে এসেছে। এই মেয়েটাও ভীষণ মিষ্টি। দু’জন এসে বকবক করে গেলো। আমি হ্যাঁ, না বলছি একটু। তবুও ভালো লাগলো।”

“১৮ সেপ্টেম্বর ২০০১,
ও ডায়েরি তুমি জান? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে লিখতে তবুও লিখবো। আজ কত খুশির দিন তুমি জানো? আজ আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে। এত সুন্দর দেখতে সে। চোখ ফেরানো দায়! আমি আজ কতগুলো দিন পর হাসলাম। আমার একটা সঙ্গী হয়েছে! হাসবো না? আমার একদম একান্ত একটা সঙ্গী! আমার মেয়ের কি নাম রাখবো ডায়েরি? কুঞ্জলতা দেখেছে? গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে ফুটে থাকা লাল রাঙা ফুল? আমার মেয়ের নাম হবে কুঞ্জ! কুঞ্জারি চৌধুরী। হাহ! চৌধুরী শব্দটা তার নামের পাশে দিতেই হবে। হাজার হোক ও বাড়ির মেয়ে যে। কিন্তু মেয়েটা আমার। একদম আমার। তাকে আমি অন্য রকম ভাবে গড়ে তুলবো।”

আফজাল চৌধুরী ২০০১ সালের সময়টা ভাবতে লাগলেন। কুহু হওয়ার সময় তিনি অনেকটা পাশে থেকেছেন রাইমার। কিন্তু কুঞ্জের সময়! ওই সময় মেয়েটা পুরো চুপসে গিয়েছিল। তার উচিত ছিল মেয়েটাকে আগলে রাখা। আর তিনি কি করেছেন! আগলে রাখা তো দূর, চোখের দেখাও দেখেননি। কত কষ্টে সময় পার করেছে মেয়েটা ইশ। আফজাল চৌধুরী ফের গাঢ় অনুশোচনায় পড়লেন!
রাত বাড়ছে। তিনি হাসফাস করছেন। নিজের প্রতি শত ধিক্কার! ঘুম আসছে না। আসবে বলেও মনে হলো না। তিনি এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলেন একটি ঝুম বৃষ্টিময় রাত”

#চলবে…?