অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-২৪

0
21

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_২৪

“২২ সেপ্টেম্বর ২০০১,
আজ কুঞ্জকে নিয়ে শশুড় বাড়ি আসলাম। অনেক দিন পর এই চৌধুরী নিবাসে পদার্পন। এবার আমার নিজস্ব সাথী আছে। আরও আছে নওরীন আর পাপিয়া। এবার কোন ভাবেয় একলা হবো না আমি। একাকিত্ব গ্রাস করবে না আমায়।”

“২৪ নভেম্বর ২০০১,
আমি এখন আফজাল চৌধুরীর বিরক্তির কারণ নই। এখন মেয়েকে নিয়ে রুমে ঢুকতেই তিনি খুশি হন। মেয়েকে নিয়ে খেলেন। অন্যপাশ ফিরে শোয় না আর। মেয়ের দিক হয়ে শোয়। আমার ছোট খাট কাজে সাহায্য করে। মেয়েকে নিয়ে রাখে। বাড়ির প্রতিটি মানুষ কুঞ্জ বলতে পাগল। আমার দুইমাসে বাচ্চাটাকে আমি বলি তুমি আম্মুর খুশির কারণ হয়ে এসেছো মা? মেয়েটা কি বোঝে কে জানে। কি সুন্দর করে হাসে!”

“১৩ মার্চ ২০০২,
ভেবেছিলাম বিরক্তির কারণ যখন আর নই, ভালোবাসাটাও হয়ে যাবে বোধহয়। বোকা রাইমা! ভালোবাসা কি হাতের মোয়া? হলো না আর। আজ ভীষণ রাগারাগি করলো মানুষটা। অপরাধ কি আমার? তার কাজে সাহায্য করা। আবার অনেক দিন পর তার চোখে নিজের জন্য বিরক্তি দেখলাম। জীবনের প্রতি গিভ আপ! আর আশা করবো না। আমার সব আশা আমার মেয়ে। আমার কুঞ্জারি! সুখের কিংবা শখের কুঞ্জারি!”

এরপর ডায়েরি জুড়ে মেয়েকে একটু একটু করে বড় করে তোলার গল্প। রাইমা তার কথা রেখেছিল। সবটুকু সুখ মেয়ের মাঝেই সে খুঁজে নিতে শিখে গিয়েছে। আফজাল চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এত অপরাধ বোধ তিনি কিভাবে কমাবেন? ডায়েরির শেষ পাতা গুলোয় আরো একবার চোখ বুলালেন তিনি। কোথাও তার নাম নেই। বলতে গেলে কারো নাম নেই। পুরো ডায়েরি কুঞ্জারি নামে সজ্জিত। রাইমা চৌধুরী সুখ, শখ, আাশা, শান্তি সব কুঞ্জারি! আফজাল চৌধুরীর মন খারাপ হলো। অবাধ্য মন আনমনে হলেও চাইলো ওই ধূসর রঙের ডায়েরিতে তার নাম আরও এবকার থাক। কিন্তু নাহ! আর নেই!

তিনি ইদানীং রাইমার আশেপাশে যেতে চান, কিন্তু রাইমা সরে যায়। তার ইচ্ছে হয় তাকে ডাকতে। কিন্তু কোথায় যেন খুব জড়তা। মুখ ফুটে বের হয় না কথা৷ অথচ বুকে জমা হওয়া কতশত কথা! ওই যে কথায় বলে না, ‘বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না।’ তার হয়েছে সেই দশা। ভিতরাটা পুড়ে যায়। অথচ না বলা কথা গুলো বলতে পারেন না। চারপাশের সব কিছু অসহ্য লাগে তার। নিজেকে আরও বেশি অসহ্য লাগে। নিজের প্রতি নিজে অভিযোগ জমান।

বহমান সময় অপেক্ষা করে না কারো জন্য। তাইতো প্রকৃতিতে বর্ষার রিমঝিম ধারার ইতি। প্রকৃতিতে এখন শরৎকাল। সাদা তুলোর মতো মেঘ আকাশে ঘুরে বেড়ার। দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। সামনে দূর্গা পূজা। পূজার বন্ধ দিয়েছে গত পরসু। বিকালে অর্কের বুকের সাথে মিশে শুয়েছিল কুঞ্জ। হুট করে উঠে বসলো। করে বসলে আবদার!
-আমি বাড়ি যাব।
অর্ক আকস্মিক ভরকে গেলো। অবাক হয়ে বলল,
-কোথায় যাবে?
কুঞ্জ ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
-বাড়ি যাব।
-হঠাৎ?
-যাব, যাব যাব। প্লিজ!
অর্ক উঠে বসলো। কুঞ্জের কপালে গভীর ভাবে অধর ছুঁয়ে দিলো। মৃদুস্বরে বলল,
-আচ্ছা নিয়ে যাব।
কুঞ্জ মৃদু হাসলো। অর্কের বুকে মিশে গেলো আবার। অর্কও আগলে নিলো তার বউ কে।

কুঞ্জ বাড়ি এলো পরেরদিন। অর্ক ওকে চৌধুরী নিবাসের সামনে নামিয়ে দিয়ে নানাবাড়ি গিয়েছে। কুঞ্জ বাড়িতে ঢুকতেই ছুটে টলো কুহু। সাথে রাইমা, নওরীন, পাপিয়া সাবাই। ভাইরা বাড়ি নেই। বাবা-চাচারাও নেই। রাইমা মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-আসার আগে বলবে না? অর্ক কোথায়?
-শিকদার বাড়িতে।
-তুমি যাবে না?
-কাল সকালে যাব।
-কালকেই ফিরবে শুনলাম।
-হুম। শাশুমার আদেশ।
কুঞ্জ হাসলো, হাসলো রাইমাও। কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেলো বাকি সবার। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে বলে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে? চারটা দিনও মেয়ে থাকতে দেয় না। পাপিয়া ননস্টপ বকে গেলো মিসেস তানহা কে। কুঞ্জ ফিক করে হেসে ছোট মায়ের বুকে মাথা গুঁজে বসে রইলো। পাপিয়া আলতো করে মাথায় হাত বুলালেন। কে বলবে এটা তার জায়ের মেয়ে? মনে হবে একদম তার নিজের মেয়ে।

রাতে নুহাস, পূর্ব বাড়ি ফিরলো। বোনকে দেখে তাদের খুশি যেন ফুরোয় না। বাড়ির সবার সাথে আড্ডা দিলো কুঞ্জ। গেলোনা কেবল আফজাল চৌধুরীর ঘরে। রাতরা ভীষণ মজায় কাটলো তার। সকাল এগারোটায় অর্ক কল করলো। সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কুঞ্জ রেডি হয়ে নিচে নামলো। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আফজাল চৌধুরীর ঘরে গেলো। আফজাল চৌধুরী কিছু জরুরি কাগজ দেখছিলেন। কুঞ্জ সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিষ্টি কন্ঠে ডাকলো,
-আব্বু!
আফজাল চৌধুরী চোখ তুলে তাকালেন। মেয়েটা দেখতে ঠিক মায়ের মতো। তবে সুন্দর আরো বেশি। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। উত্তর দিলেন না। দিতে পারলেন না। কুঞ্জ হাসলো।
-ভালো আছেন আব্বু?
আফজাল চৌধুরী ছলছল চোখে মেয়ের দিকে চাইলেন। বলতে চাইলেন, ‘আমি ভালো নেই কুঞ্জ। একটুও ভালো নেই। অপরাধ বোধ, অনুশোচনা, একাকিত্ব আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আমার চোখ ফেটে অশ্রুও আসে না। বুকটা হাহাকার করে। অথচ আমি বলতে পারি না। বুঝাতে পারি না। আমি বোধহয় মরে যাচ্ছি কুঞ্জ। শ্বাস নিতে বড় কষ্ট হয় আমার।’ কিন্তু বলতে পারলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাসিটা ঠিক ফুটে উঠলো না। কুঞ্জ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বিরবির করে বলল,
-আমি আপনার চোখে এই অপরাধ বোধটায় দেখতে চেয়েছিলাম আব্বু! আমি সফল। আর দুটো দিন আব্বু! আপনার কষ্ট কমিয়ে দিব আমি।
বাবার ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে গেলো কুঞ্জ। রইমা তার ব্যাগে কিছু ঢুকিয়ে দিচ্ছিলো। কুঞ্জ মায়ের সামনে গিয়ে বসলো। রাইমা হেসে ভ্রূ নাচালেন। ইশারায় বুঝালেন,
-কি?
কুঞ্জ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। তারপর তার আলমারির সামনে গেলো। কাপড়ের ভাজ থেকে বের করলো আর একটা ডায়েরি। কালো মলাটে আবৃত ডায়েরিটা। মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। ডায়েরিটা দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর বাড়িয়ে দিলো মায়ের দিকে। মৃদুস্বরে বলল,
-আমি চাইবো খুব মনোযোগ দিয়ে তুমি ডায়েরিটা পড়। ওতে লেখা প্রতিটা শব্দের গভীরতা অনুভব করো। ট্রাস্ট মি আম্মু, তুমি যদি কথা গুলোর গভীরতা বুঝতে পারো তাহলে তুমি হবে ভীষণ সুখি মানুষ। তোমার মতো সুখি আর কাউকে পাবে না তুমি।
রাইমা চৌধুরী ডায়েরিটা হাতে নিলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলল,
-আম্মু ট্রাস্ট ইউ কুঞ্জ।
কুঞ্জ হাসলো। ডায়েরির টপিকে গেলো না আর। মায়ের বুকে মাথা রেখে হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
-আসি আম্মু? পরেরবার এসে যেন তোমায় সুখি দেখি।
-আমি তো সুখি।
-আরও পেশি সুখি, ধরে নাও এমন সুখ যা তুমি আগে পাওনি।
রাইমা চৌধুরী হেসে বলল,
-আচ্ছা বেশ। এবার চলো, ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে।
একসাথে নেমে গেলো তারা।

অর্ককে দেখে রাইমা এগিয়ে গেলো। অর্ক মুচকি হেসে সালাম দিলো। রাইমা সালামের উত্তর দিয়ে অর্কের মাথায় হাত বুলালেন। কুশলাদি বিনিময় শেষে খুব আদুরে স্বরে বললেন,
-সব সময় ভালো থাকবেন আব্বু। আমার জগতের সবটুকু সুখ আপনার নামে লিখে দিয়েছি, তাকে ভালো রাখবেন। সে খারাপ থাকলে অনেক গুলো মানুষ খারাপ থাকে আব্বু। বলতে পারেন চৌধুরী নিবাসের প্রতিটা প্রাণ তার দুঃখে আধমরা হয়ে যায়। এতো গুলো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তাকে ভালো রাখবেন।
অর্ক অবাক হয়ে তাকালো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পৌড়া রমণীর দিকে। তাকালো তার পিছনে দাঁড়ানো আরও দুই রমনী, এক কিশোরী কন্যা আর দুই যুবকের দিকে। সবার চোখ তার পানে নিবদ্ধ। অর্ক বুঝলো যে মেয়েটাকে সে আকাশের মতো ভালোবাসে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলো সেই মেয়েটাকে আকাশসহ পুরো পৃথিবীর সমান করে ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসা কম হওয়ায় আফসোস হলো অর্কের। আবার তার প্রিয় নারীকে এতো গুলো মানুষ ভালোবাসে বলে সুখ অনুভব হলো। সে রাইমার চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
-আমার সবটুকু দিয়ে তাকে আমি ভালো রাখবো মা। এটা এক মায়ের কাছে করা আমার প্রমিস।
রাইমা হাসলেন। তিনি নিশ্চিন্ত এবার। সবার থেকে বিদায় দিয়ে কুঞ্জ চলে গেলো। রাইমা নিজের ঘরে এলেন। মেয়ের দেওয়া ডায়েরিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন। কার ডায়েরি বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। তার মেয়ে হলে ঠিক বুঝে যেত। মেয়েটা ভীষণ চালাক। রাইমা হাসলে। ডায়েরিটার উপর একবার হাত বুলিয়ে খুলল। নামধাম কিছু লেখা নেই। রাইমা চৌধুরী ভ্রূ কুঁচকালেন। ডায়েরি লিখবে অথচ নাম লিখবে না? এ কেমন কথা। তিনি আরও পেজ উল্টালেন। প্রথমে অনেক গুলো পেজ ফাঁকা। আরও অবাক হলো রাইমা। ভাবলেন কিছু লেখা নেই বুঝি। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ের কথা মনে পড়লো। মেয়ে বলেছে মানে নিশ্চয়ই লেখা আছে। তিনি একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলেন। অবশেষে প্রায় বারোটা পেজ উল্টানো শেষে কাঙ্ক্ষিত লেখা পেলেন। লেখাটা শুরু কিছুটা এভাবে,

“~গ্রামের উত্তরের মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যওয়া দুইবেণি করা এক মিষ্টি মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হলাম, তারপর বুঝি প্রেম হলো! কে জানে? শুধু জানলাম আমি ডুবে গেলাম। কূল পেলাম না কেথাও।…. ”

এভাবে লিখে যাওয়া আফজাল চৌধুরী আর তানহা শিকদারের প্রেমের কাহিনি। রাইমা মনোযোগ দিয়ে পড়লো। মেয়ের কথা অনুযায়ী গভীর ভাবে অনুভব করতে লাগলেন সব। কিন্তু কোথায় সুখ বুঝতে পারলেন না। এমন সুন্দর প্রেম দেখে তে তার বুক জ্বলছে। না না, সে তানহাকে হিংসে করেনি। কিন্তু খারাপ তো লাগেয়, তাই না?

এরপর তাদের বিয়ের কাহিনি এলো, তারপর কুঞ্জের আগমনের সুখবর, আর তারপর রাইমার বাবা বাড়ি চলে যাওয়া….তারপর থেকে যা লিখা সব অবিশ্বাস্য লাগলো রাইমার। হাত পা কাঁপতে লাগলো। মনোযোগ সরে যেতে চাইলো। কিন্তু তিনি সরালেন না। ঝাপসা চোখে পড়তে লাগলেন। জানার বাইরেও কত কিছু থাকে ডায়েরিটা তার বাস্তব প্রমাণ।

#চলবে…?