অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৪

0
86

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৪

এগারোটা পনেরোর দিকে বাস রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কুঞ্জারি জানালা দিয়ে মুখ বের করে দুই ভাইয়ের দিকে তাকালো। থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। কুঞ্জারি মৃদু হাসলো। হাতের ইশারায় কাছে ডাকলো তাদের। দুই ভাই এগিয়ে এলো জানালার পাশে। হাত বের করে নুহাসের চুল এলোমেলো করে দিলো কুঞ্জ। মৃদুস্বরে বলল,
-কুহুকে দেখে রেখ নুহাস।
নুহাস নিচে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। বোনের দিকে তাকালো না। কুঞ্জ পূর্বের দিকে হাত বাড়ালো। হেসে বলল,
-আর তুই ওদের দুজনের খেয়াল রাখবি। মনে থাকবে?
পূর্ব বোনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। নয়নযুগল ছলছল করলো বোধহয়। আস্তে বলল,
-রাখবো বড় আপা। তুমি নিজের যত্ন নিও।
কুঞ্জ কথা বললো না। হাত সরিয়ে নিলো। বাস ছেড়ে দিলো তখনই। কুঞ্জ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভাই দুটো কিছু একটা আন্দাজ করেছে নিশ্চিত। তাই এতো মন খারাপ। কুহু অভিমান করেছে। আসার সময় কথা বলেনি। এতক্ষণ নিশ্চয়ই কেঁদে ভেসে দিয়েছে সব। তবুও চিন্তা নেই। নুহাস সামলে নিবে তার আবেগি বোনকে। আর পূর্ব তো আছেয়। বয়স একই হলেও পূর্ব বুঝদার অনেক। সামলে নিবে সব কিছু। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই অবাক হলো কুঞ্জ। কেক, বিস্কুট, চকলেট, চিপস সাথে পানি। কখন রাখলো এসব? কুঞ্জারি টের পায়নি। দ্রুত জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভাইদের দেখতে চাইলো। কিন্তু হায়! বাস তখন অনেকটা দূর এসে গেছে। নুহাস, পূর্বকে দেখাচ্ছে বিন্দর মতো। আনমনে হাসলো ভাইদের কান্ড দেখে। টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে ঢাকার শাহবাগের দূরত্ব খুব বেশি নয়। প্রায় আড়াই ঘন্টা লাগে যেতে। এতটুকু সময়ের জন্য এতো খাবার লাগে না। কিন্তু তার ভাই গুলো সব সময় এমন ভাব করে যেন বোন কোন বিদেশ বিভুইয়ে যাচ্ছে!

সৌদিয়া বাসটি যখন শাহবাগে থামলো তখন ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা প্রায় দুটো ছুঁয়েছে। বাস থেকে নেমে আশেপাশে তাকালো কুঞ্জ। হাতের ডান দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো শুভ্র শার্ট পরিধেয় এক শ্যাম পুরুষের মাঝে। বলিষ্ঠ শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাত দিয়ে ফোন ধরে আছে কানে। কালো ঘড়ি সমবেত বা’হাতটা পকেটে গুঁজে রাখা। কথা বলার মাঝে ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকালো পরক্ষণেই হেসে ফেললো। ঠোঁট কামড়ে ধরে মৃদু হাসিটা কুঞ্জের ঠিক বুকে এসে লাগলো। কুঞ্জ ফিসফিস করে বলল,
-এভাবে হাসবে না। একদম না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
ঠিক তখন মানুষটা ফোন পকেটে রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। কুঞ্জকে দেখে ফের ঠোঁট কামড়ে হাসলো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো প্রেয়সীর সামনে।
-আসলেন তবে! আমি ভাবলাম আপনি বোধহয় ফিরছেন না।
-আমি কখনো কথা দিয়ে তার খেলাপ করি না।
কথা বাড়ালো না সে। খপ করে হাত ধরলো কুঞ্জারির। মৃদুস্বরে বলল,
-তর্ক পরে করা যাবে কুঞ্জলতা। আগে তোমার মনোবাসনা পূরণ করি চলো।
আগে আগে সে আর পিছে কুঞ্জ। একটা দোতালা ভবনের সামনে গিয়ে থামলো তারা। উপরে বড় করে লেখা ‘কাজী অফিস’। কোন কথা না বলে ভিতরে প্রবেশ করলো তারা।

সকল কাগজপত্র দিয়ে অফিসিয়াল কাজ গুলো সেরে ফেলার পর কাজী সাহেব ওদের দিকে তাকালো। সন্দিহান স্বরে বলল,
-পালিয়ে বিয়ে?
কুঞ্জা হাসলো। মানুষটা হেসে উত্তর দিলো,
-শরীয়ত মতে বিয়ে আরো তিন বছর আগে হয়ে গিয়েছে চাচা। এখন শুধু কাবিননামাটা দরকার।
কাজী নামের মানুষটা অবাক হলো। বলল,
-বিয়ে পড়াতে হবে না তাহলে?
-আপনার যদি সন্দেহ থাকে অবশ্যই পড়াবেন।
আর কথা বলল না কেউ। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। আজকালকের ছেলেমেয়েদের উপর বিশ্বাস নেই। তিনি গম্ভীর স্বরে একজন হুজুর কে ডাকলেন; বললেন বিয়ে পড়িয়ে দিতে। সকল কাজ শেষ হলো দ্রুত। কাবিননামা কুঞ্জের দিকে এগিয়ে দেওয়া হলো সাইন করার জন্য। কুঞ্জ একপলক বরের সাইন করা নামটা দেখলো। ওয়াহিদ অর্ক; আজ থেকে মানুষটা কাগজে কলমেও ওর। একদম একান্ত ব্যাক্তিগত।

কাজী অফিস থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলে দু’জন। মনে অন্যরকম অনুভূতি। অর্ক হেসে বলল,
-দ্বিতীয়বার বিয়ে করে তোমার অনুভূতি কেমন বউ? দ্রুত বলো।
অর্কের দুষ্টমিতে হেসে ফেললো কুঞ্জ। হাসতে হাসতে বলল,
-অনুভূতি একদম পানসে, একটা নিরামিষ মানুষকে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।’
কথাটা বলে চোখ টিপল কুঞ্জ। অর্ক দাঁড়িয়ে গেলো। চোখ পাকিয়ে বলল,
-কি বললে তুমি? আমি নিরামিষ!
-অবশ্যই তুমি নিরামিষ। তুমি হলে রাগী, গম্ভীর টিচার। রোমান্টিক হবে কিভাবে?
অর্ক হাসলো। এবার সে চোখ টিপে বলল,
-তুমি চাইলে এই মুহুর্তে তোমাকে দেখাতে পারি ওয়াহিদ অর্ক আমিষ নাকি নিরামিষ।
হো হো করে হেসে উঠলো কুঞ্জারি। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি জমে গেলো। তবুও হাসি থামলো না। অর্ক ভ্রু কুঁচকে বলল,
-এভাবে হাসছো কেন? আমি কি হাসির কথা বলেছি? লজ্জা পাওয়ার কথা বলেছি, তুমি লজ্জা পাবে। হাসছো কেন? আশ্চর্য তো!
-জোক অফ দা ইয়ার! হাসবো না? ওয়াহিদ অর্ক শাহবাগের রাস্তায় তার রোমান্টিকতা দেখাবে। ও মাই গড। বলি পলাশী থেকে শাহবাগ কত দূরে যেন? বুয়েটের ছেলেপেলেরা দেখলে রাগী টিচারের মান থাকবে তো?
অর্ক অসহায় ভাবে বলল,
-আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হাসছো? তুমি কি বুঝবে বউ পাশে নিয়ে তাকে আদর না করার কষ্ট।
আবার হেসে ফেললো কুঞ্জ। হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি ঝরলো এবার। অর্ক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। কুঞ্জলতার মতো উজ্জ্বল হাসি মেয়েটার। কুঞ্জের হাসি থামলে অর্ক বলল,
-দুপুরে খাওয়া হয়নি। খাওয়া দরকার। চলো।
তারপর দুজন গিয়ে বসলে একটা রেস্তোরাঁয়। ভাত, ভাজি আর গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলো। বাইরে এসে অর্ক শুধালো,
-এখনি হলে ফিরবে? বিকাল অবধি থাকো?
তার কন্ঠ অনুরোধ। কুঞ্জারি দ্বিমত করলে না। দুজন গিয়ে বসলো একটা পার্কের বেঞ্চে। অর্ক বলল,
-কি হয়েছে বলবে আমাকে?
-কি হবে?
অর্ক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে। আলতো স্বরে বলল,
-তুমি বলছো কিছু হয়নি?
কুঞ্জ অর্কের চোখে দৃষ্টি ফেললো তবে রাখতে পারলো না বেশিক্ষণ। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
-বাবা বিয়ের কথা বলছিল। অনেকদূর কথ এগিয়েছিল। ঝগড়া করেছি বাবার সাথে। তিনি কষ্ট পেয়েছেন। তাই মন খারাপ।
অর্ক চুপ থাকলো। কিছুক্ষণ পর বলল,
-আঙ্কেল কখনো আমাদের সম্পর্ক মানবে না তাইনা কুঞ্জ?
-মানবে।
কুঞ্জ হাসলো। তার হাসিতে রহস্যের ছোঁয়া। বলল,
-কি ঠিক করলে? আন্টিকে বলছো তবে?
-হ্যাঁ বলবো।
-মানবে আন্টি?
অর্ক তাকালে কুঞ্জের দিকে। হেসে বলল,
-তুমি আজকে জার্নি করে এসেছো। তোমার রেস্ট দরকার। আজকে রেস্ট করো। কালকে একবারে বাসায় যাচ্ছো। একটু রাগরাগি করবে হয়তো কিন্তু বউ যখন এত আদুরে ফেলে দিতে পারবে না নিশ্চয়।
কুঞ্জ হাসলো। জবার দিলো না। মনেমনে শুধু বলল,
-আমাকে তিনি ফেলে দিবে এটা যেমন সত্য তেমনি আগলেও নিবে না অর্ক। তবে আফসোস নেই। জেনে-বুঝে আগুলে ঝাপ দিয়ে আফসোস করা পাপ। শুধু তোমার জন্য কষ্ট লাগছে। তুমি ভেঙে যেও না যেন।

মাগরিবের সময় হয়ে এলো। দূর হতে ভেসে আসছে আজানের সুর। পার্কের বাচ্চাদের বাসায় ফেরার সময় হয়েছে। হইহই করতে করতে বেরুচ্ছে তারা। কুঞ্জেরও ফেরার সময় ঘনিয়ে এলো। অর্ক মায়ামায়া করে তাকালো। হাসলো সুন্দর করে,
-তোমাকে আজ ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না কেন কুঞ্জলতা? বউ তো আগেও ছিলে তাবুও আজ কেন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে?
কুঞ্জ মুচকি হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-আজকে বোধহয় আমাকে নতুন বউদের মতো সুন্দর দেখাচ্ছে তাই।
অর্ক হেসে ফেললো। কুঞ্জারির নাক টেনে বলল,
-আপনাকে বরাবরই নববধূর মতো সুন্দর লাগে ম্যাডাম।
অর্ক উঠে দাঁড়ালো। দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলো মেডিক্যালের সামনে। কুঞ্জারি ভিতরে যাওয়ার আগে তাকালো স্বামীর দিকে। অর্ক চমৎকার হাসলো। কুঞ্জারি হুট করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। ফিসফিস করে বলল,
-এতে বেশি ভালোবাসো কেন? এতো ভালোবাসলে আমাকে আঘাত করতে তোমার কষ্ট হবে যে!
– কি বল…

অর্ককে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো কুঞ্জারি চৌধুরী।

#চলবে…?