অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৫

0
155

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৫

সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যা নেমে এলো ধরণীতলে। দিঘির জলে সূর্যের শেষ আলোকছটা প্রতিফলিত হচ্ছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত পরিবেশ। তাদের নীড়ে ফেরার তাড়া। শুধু ঘরে ফেরার আগ্রহ নেই দিঘির জলে পা ভিজিয়ে বসে থাকা এক সপ্তদশী কন্যার। উদাস দৃষ্টি তার। আশেপাশে কি হচ্ছে তার প্রতি নেই কোন কৌতুহল। শূন্য দৃষ্টিতে আকাশ দেখছে একমনে। তার পাশে এসে বসেছে কেউ সেটাও খেয়াল করলো না। সপ্তদশীর ধ্যান ভাঙলো পাশে বসা মানুষটার ডাকে। নুহাস মৃদুস্বরে ডাকছে,
-কুহেলিকা!
কুহু চমকে উঠে। দ্রুত পাশ ফিরে নুহাসকে দেখতে পেলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,
-নুহাস ভাইয়া তুমি এখানে! কখন এলে?
– তুই যখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলি তখন।
আবার কুহুর মন খারাপ হয়ে গেলো। ঝগড়া করতে ইচ্ছে হলো না। বিষাদ নেমে এলো চেহারায়। ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল,
-বড় আপা আর আসবে না তাইনা নুহাস ভাইয়া। বাবার উপর রাগ করে বড় আপা আমাদের সবায়কে ছেড়ে চলে গেলো।
নুহাস কুহুর পাশ ঘেঁষে বসলো। কুহুর একটা হাত নিহের হাতের মুঠোয় নিয়ে দাম্ভিক স্বরে বলল,
-আমাকে বিশ্বাস করিস?
কুহু ভরকে গেলো। আলতোভাবে বলল,
-কি বলছো এসব! বিশ্বাস করবো না কেন?
নুহাস কুহুর চোখে চোখ রাখলো। মৃদুস্বরে বলল,
-বড় আপা কারো সাথে রাগ করে চলে যায়নি। আপার পরীক্ষা তাই গেছে। তবে আবার এ বাড়িতে আসার ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না।
আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরলো কুহু। অস্থির হয়ে বলল,
-কেন নুহাস ভাইয়া? কেন বলা যাচ্ছে না? আপা যদি রাগ না করে তবে আসবে না কেন? বলো।
কুহু কেঁদে ফেললো। নুহাস আলতো ভাবে তার মাথা নিজের বক্ষপিঞ্জরে আগলে নিল। শন্ত স্বরে বলল,
-আসবে না কখন বললাম। আপা কি সিদ্ধান্ত নিবে আপায় ভালো জানে। কাউকে বলে না তো। কাঁদছিস কেন পাগলি। আপা তোকে না দেখে থাকতে পারবে? তোর জন্য হলেও আসবে।
কুহু ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
-সত্যি?
নুহাস হাসলো। শব্দহীন হাসি। আলতো করে চুমু খেলো কুহুর মাথায়। মৃদুস্বরে বলল,
-একদম সত্যি। এবার কান্না থামা। নাহয় আমি আপাকে বলে দিব কিন্তু। আপা রাগ করলে ভালো হবে?
কুহু দ্রুত চোখ মুছে ফেললো। ফোলা চোখ গুলো পিটপিট করে বলল,
-কখন কেঁদেছি? দেখো চোখে পানি আছে? তুমি মিথ্যা বলবে কেন নুহাস ভাইয়া?
কুহুর বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেললো নুহাস। চারপাশে তখন আঁধার ঘনিয়ে আসছে। কুহুকে নিয়ে ফিরে এলো চৌধুরী নিবাসে।

ডা. মিলান হলের ১১১ নম্বর রুমে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত বিছায় শুয়ে ছটফট করছে কুঞ্জ। এখন গভীর রাত। চারদিকে শুনশান নীরবতা। কোলাহল নেই। রুমের বাকি চার সদস্য ঘুমে কাতর। অথচ কুঞ্জ ঘুমাতে পারছে না। কালকে কি হবে ভেবে হাত-পা শিউরে উঠছে। আবার বাবা জানলে কি তান্ডব ঘটাবে তাও অজানা নয়। মা কে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে নিজের নতুন জীবনের কথা। মা কিছু বলবে না ঠিকই তবে একটু মন খারাপ হবে তার। কুঞ্জ এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু জানালো না ভেবে অভিমান করবে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কুঞ্জ। কাল থেকে তার জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। অনেক আঘাতকে প্রতিহত করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে খুব করে প্রার্থনা করলো যেন তাকে ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দেয়। কোনো প্রতিকূল পরিবেশ যেন তাকে দুর্বল না করে। ধীরে ধীরে ভাবনায় মশগুল থাকা কুঞ্জ পারি জমালো ঘুমের দেশে।

সময়টা দুপুর। মিসেস তানহার এই সময়ে ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস। দুপুরের খাবার খেয়ে তিনি নিজের শোবার ঘরে চলে যান। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটলো না। তিনি সবে রুমে গিয়ে ঔষধ খেলেন। ঠিক তখনই দরজার বেল বেজে উঠলো। ওয়াহিদ আলম তখন বাথরুমে। মেয়েকে কয়েকবার ডেকেও সারা পেলেন না। বাধ্য হয়ে তিনি দরজা খুলতে গেলেন। পিনহোল দিয়ে ছেলেকে দেখে অবাক হলেন। ছেলে বাসায় ফিরে সন্ধ্যার পর। আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরেছে দেখে খুশি হলেন। দরজা খুলতেই ছেলেকে দেখতে পেলেন তিনি। তবে একা নয় অর্ক। সাথে লাল তাঁতের শাড়ি পরিহিত একটা মেয়ে। মেয়েটা মিসেস তাহনার অপরিচিত নয় বরং খুব পরিচিত। অজানা আশাঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো তার। তবুও নিজেকে বুঝ দিলেন। ছেলে তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে পারে না। কিন্তু তার সব শঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে ছেলে হাসি মুখে বলে উঠলো,
-পুত্রবধূকে বরণ করবে না মা? বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখবে আর কতক্ষণ।
মিসেস তানহা চোখ বড় বড় করে ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি অনুভব করলেন তার মাঝে ভয়াবহ পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। রাগে শরীর কাঁপছে তার। মাথায় খু*নের নেশা চাপছে। অসহ্য বোধ হচ্ছে চারপাশের সবকিছু। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারাতে চাইলেন না তিনি। ছেলে দিকে চেয়ে দরাজ স্বরে বললেন,
-তোমার থেকে আমি কখনো এটা আশা করিনি অর্ক।
এক মুহুর্ত দাঁড়ালেন না তিনি আর। হনহনিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। অর্ক বেশ কয়েকবার মা বলে ডাকলো। কাজ হলো না। অর্ক অসহায় ভাবে চাইলো কুঞ্জের পানে। কুঞ্জ তাকে মায়ের সাথে যেতে বলল। অর্ক ঘরের দরজায় নতুন বৌ রেখে ছুটলো মায়ের পিছনে।

কুঞ্জ দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। তাকে অশান্ত লাগছে না। মুখভঙ্গি দেখে বোঝা যা সে জানতো এমন কিছু হবে। স্ত্রীর চিৎকার শুনে বাইরে এসেছিলেন ওয়াহিদ আলম। অদিতিও নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এলো। মায়ের দরজার সামনে ভাইকে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক দৌড় দিলো মেইন দরজার দিকে। দরজার সামনে এসে থামলো। কুঞ্জকে দেখে হেসে ফেললো। এরপর ছুটে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মৃদু হেসে বলল,
-ফাইনালি আমাদের বাসায় পার্মানেন্টলি শিফট হওয়ার জন্য থ্যাংকিউ মিসেস ওয়াহিদ অর্ক।
ননদিনীর কথা শুনে হেসে ফেললো কুঞ্জ। আলতো হেসে বলল,
-মোস্ট ওয়েলকাম বার্বিডল।
আলম সাহেব ততক্ষণে ঘটনা বুঝতে পেরেছেন। দরজার সামনে আসলেন তিনি। কুঞ্জারির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বিনিময়ে চমৎকার করে সালাম দিলে কুঞ্জ। আলম সালামের উত্তর দিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-মায়ের মতো আক্কেল জ্ঞান হারালি নাকি অদি? মেয়েটাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! ছেলেরও দেখো কান্ড। বউ বাইরে রেখে মায়ের আজাইরা রাগ ভাঙাচ্ছে।
কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে আদুরে স্বরে বলল,
-তুই ভিতরে আয় মা। ঘরের লক্ষ্মী কে এতক্ষণ চৌকাঠে দাঁড় করিয়ে রাখতে নেই।
শ্বাশুড়ি বরণ করলো না। তবে শ্বশুর ও ননদের অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করলো কুঞ্জারি চৌধুরী উহু কুঞ্জারি ওয়াহিদ!

প্রায় এক ঘন্টা যাবত মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও লাভ হলো না। মিসেস তানহা দরজা খুললেন না। ক্লান্ত অর্কের তখন বউয়ের কথা মনে পড়লো। দ্রুত দরজার দিকে এগোতে নিয়ে দেখলো বসার ঘরে তার বাবা, বোন আর বউ গল্পের আসর জমিয়েছে। গল্প বলছেন আলম সাহেব। মনোযোগী শ্রোতা কুঞ্জ এবং অদিতি। গল্পের মাঝে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠছে দু’জন। সাথে তাল মেলাচ্ছেন আলাম সাহেব নিজেও। অর্ক অবাক হলো। অদিতি কুঞ্জের পূর্ব পরিচিত হলেও ওয়াহিদ আলমকে আজ প্রথম দেখছে সে। তবুও কি সাবলীল ভবে মিশছে। আর আলম সাহেবও এই অল্প সময়ের মধ্যে তার বউকে মেয়ের মতো তুই তুই করে বলছে। অবাক হলো অর্ক। সেই সাথে স্বস্তি পেলো। মায়ের দিকের ঝড়টা সামলে নিবে এই দুজন। আর মা দুই বা তিন দিন একটু ঝামেলা করবে। এরপর তো ঠিক হয়ে যাবে সব। অথচ ওয়াহিদ অর্ক ধারণাও করতে পারেনি ঝড়ের তান্ডব সবে শুরু!

#চলবে…?