অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৬

0
71

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৬

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো তবুও মিসেস তানহা দরজা খুললেন না। আর না কোন কথা বললেন। অর্ক দিশেহারা বোধ করলো। কি করবে মনস্থির করতে পারলো না। মায়ের বদ্ধ দরজার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বসার ঘরে গেলো। বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-অদি ওকে ঘরে দিয়ে আয়।
এরপর তাকালো বউয়ের দিকে। বলল,
-ফ্রেস হয়ে নাও।
কুঞ্জ সম্মতি দিলো। ননদিনীর সাথে চলে গেলো রুমে। অর্ককে কোনকিছু বলল না। একা ছেড়ে দিল। রুমে ঢুকে অদিতি বলল,
-ফর্ম নাও দিস ইজ ইওর রুম। কেমন লাগলো?
কুঞ্জ চারদিকে চোখ বুলালো। ঘরে আসবাবপত্রে মাঝে আছে খাট, একটা টেবিল, আলমারি আর ডেসিন টেবিল। ঘরের সব জিনিস পরিপাটি করে সাজানো। কুঞ্জ জানে অর্ক গুছানো স্বভাবের। তাই অবাক হলো না। ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে খারাপ লাগলো না কুঞ্জের। মৃদু হেসে বলল,
-ভীষণ ভালো লেগেছে।
-তাহলে ফ্রেস হয়ে নাও।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে সায় জানালো। অতিদি চলে গেলো। কুঞ্জ ঘুরে ঘুরে রুম দেখলো কিছু সময়। এরপর চলে গেলো বারান্দায়। বারান্দায় যেতেই মন ভালো হয়ে গেলো তার। টবে সুন্দর বেশ কিছু গাছ লাগানো। ফুটে আছে বুনো লাল গোলাপ। আলতো ছুঁয়ে দিলো গাছ গুলোকে। এরপর ফ্রেস হতে গেলো।

সূর্যাস্তের সময় হয়ে এলো। তবুও মিসেস তানহা নির্বিকার। ক্লান্ত অর্ক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে সোফায়। আলম সাহেব সামনে বসে আছেন। তবে কথা বলছে না কেউ। কুঞ্জ ধীর পায়ে স্বামীর কাছে গেলো। আলতো স্বরে বলল,
-চা করে দেই? মাথাব্যথা কমবে একটু।
অর্ক চোখ তুলে তাকালো। এতো টেনশনের মাঝেও মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বুকে বয়ে গেলো প্রশান্তির হাওয়া। মৃদুস্বরে বলল,
-দাও।
কুঞ্জারি চমৎকার হাসলো। তারপর শ্বশুরের দিকে ফিরে বলল,
-বাবা আপনাকেও চা দেই?
আলম সাহেব খুশি হলেন খুব। তার কন্ঠে উৎফুল্লতা ভর করলো। আনন্দিত গলায় বললেন,
-দে মা। আমি কিন্তু চিনি কম খাই।
কুঞ্জারি মাথা নাড়লো। অদিতি কে ডাকলো। দু’জন মিলে চা বানালো। স্বামী কে চা দিয়ে শ্বশুরকে চা দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো কুঞ্জারি। আলম সাহেব তাকালেন তার দিকে। বললেন,
-কিছু বলবি মা?
কুঞ্জ মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলল,
-মা দরজা খুলছে না। রাতের রান্নাটা আমি করি বাবা?
দ্বিমত করলো না আলম সাহেব। সায় জানালো। খুশিমনে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো কুঞ্জারি। ননদ ভাবি মিলে শুরু করলো রন্ধনযু*দ্ধ। অদিতির কাজ কোথায় কি আছে তা কুঞ্জারিকে বলে দেওয়া আর ভাবিকে সঙ্গ দেওয়া। কাজটা করে ভীষণ মজা পাচ্ছে সে। হাসিখুশিতে রান্না প্রায় শেষের পথে এলো।

তখন রাত সাড়ে আটটা। মিসেস তানহা রান্নাঘরে বাসন কোসন নাড়াচাড়ার শব্দ শুনতে পেলেন। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। তাই শুনতে পাননি। ঘরে এসে শুনতে পেলেন। প্রায় নিভে যাওয়া রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। দরজা খুলে হনহন করে বের হয়ে গেলেন তিনি। বসার ঘর পেরুতেই শুনতে পেলেন ছেলের স্বর। ডাকলো তাকে। তবে পিছে ফিরলেন না তিনি। রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। রান্নাঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে আবারও খু*নের নেশা চাপলো তার মাথায়!

কুঞ্জারির রান্না প্রায় শেষ। ভাত, রুই মাছের ঝোল, পালং শাক হয়ে গেছে। টেবিলে সাজিয়ে রেখে এসেছে। এখন মনোযোগ দিয়ে চিংড়ি ভুনা করছে। খুন্তি দিয়ে নাড়ছে। হঠাৎ অতিদির কথা থেমে যাওয়ায় অবাক হলো কিছুটা। ননদিনী কে কিছু জিজ্ঞেস করবে ঠিক তখনই চোখে পড়লো রসুইঘরের সামনে ভয়ংকর রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্বাশুড়ির পানে। কুঞ্জের সাথে চোখাচোখি হতেই হুংকার দিলেন তিনি,
-এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হয় আমার রান্নাঘরে ঢোকার।
রাগে, দুঃখে ফেটে পড়লেন তানহা। প্রতিটি গৃহিণী মেয়ের কাছে রান্নাঘর অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের জীবনের বিরাট একটা সময় তারা কাটায় এই স্থানে। বলা যায় এটা তাদের অফিস। অন্য কেউ এসে সেই রান্নাঘরে নিজের আধিপত্য প্রকাশ করা মানে সংসারের গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে যাওয়া। মিসেস তাহনা ঠিক এটায় মানতে পারলেন না। যে মেয়েকে তিনি ছেলের বউ হিসেবে মানে না সেই মেয়ে কিনা তার রান্নাঘর দখল করে ফেলেছে। তিনি কুঞ্জারির দিকে হিং*স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে গেলেন বসার ঘরে। চিৎকার করে বললেন,
-ওই মেয়েকে আমার রান্নাঘরে যাওয়ার অনুমতি কে দিয়েছে। বলো তোমরা, কে দিলো এতো সাহস ওকে।
অর্ক মাকে সামলানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। কুঞ্জারি টেবিলে চিংড়ি ভুনার বাটি রাখলো। তানহা তার দিকে গেলো। ছুড়ে ফেললো চিংড়ির বাটি টা। কাচের বাটি ভাঙার শব্দ হলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো সবায়। তিনি পুনরায় চিৎকার করে বলল,
-এই মেয়ে তুমি কোথায় পেলে এত সাহস? রান্নাঘরে ঢুকেছো কার অনুমতি নিয়ে।
কুঞ্জ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শ্বাশুড়ির দিকে কিছুক্ষণ। শান্ত স্বরে বলল,
-আপনার ছেলে দিয়েছে অধিকার। কারো থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। বাড়ির বউ হিসেবে এটা আমার অধিকার।
কুঞ্জারির সাহস দেখে অবাক হলেন মিসেস তানহা। অর্ক বেশ কয়েকবার বলেছিলো তার প্রেমিকা স্ট্রং খুব। শক্ত পারসোনালিটি। তিনি মনেমনে ভাবতেন দেখবো কেমন শক্ত থাকতে পারে তোর প্রেমিকা। কিন্তু কুঞ্জের এমন শান্ত স্বর শুনে তিনি বুঝলেন মেয়েটা আসলেই শক্ত। পাথরের মতো মনে হয়। এই মেয়েকে ভাঙতে তার ভলোয় কাঠখড় পোড়াতে হব! তিনি আাবর কিছু বলতে চাইলেন। তার আগে অর্ক করুণ স্বরে বলল,
-কুঞ্জকে আমি ভালোবাসি তুমি তো জানতে মা। তাহলে কেন মেনে নিচ্ছ না?
মিসেস তানহা ছেলের দিকে তাকালেন। পরক্ষণেই চোখ পড়লো কুঞ্জারির উপর। তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,
– প্রেম করা আর বিয়ে করা এক?
তিনি ভাবলেন তার কথার মানে বুঝলো না মেয়েটা। অথচ কুঞ্জ বুঝলো কথাটা তাকে বলা হয়েছে। কুঞ্জ স্মিত হাসলো। তাকালে শ্বাশুড়ির চোখের দিকে। আলতো স্বরে বলল,
-আমি কখনো আপনার ছেলের প্রেমিকা ছিলাম না মা।
সবায় থমকে গেলো কুঞ্জারির কথায়। প্রশ্নবোধক চাহনি সবার। ছেলের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন মিসেস তানহা। অর্ক হালকা স্বরে উত্তর দিল,
-কুঞ্জ প্রেম করতে চায়নি মা। আমি তাই জোর করে বিয়ের কথা বলি ওকে। এরপর শরীয়ত মতে বিয়ে করি। কাবিননামাটা শুধু আজকে নেওয়া হলো।
মিসেস তানহা হতবিহ্বল হলেন। ছেলের দিকে ক্রুর চোখে তাকিয়ে হনহন করে চলে গেলেন নিজের ঘরে। অর্ক পুনরায় ছুটলো মায়ের পিছনে। এবার দরজা বন্ধ করলো না মিসেস তানহা। অর্ক ভিতরে এলো। তানহা চুপ থাকলেন অনেকটা সময়। অতঃপর বললেন,
-তুমি তিন বছর আগে মেয়েটাকে বিয়ে করেছো?
মাথা নিচু করে নরম স্বরে উত্তর দিল অর্ক,
-জ্বি মা
-মেয়েটাকে ছুঁয়েছো তুমি?
মিসেস তানহার স্বরে আতঙ্ক। মায়ের স্বর কানে আসতেই চমকে মায়ের দিকে তাকালো অর্ক। মা কি বোঝাতে চাইছে বুঝলো। মাথা নিচু করলো পুনরায়। বলল,
-না মা। বিয়ে হলেও আমাদের সম্পর্ক প্রেমিক প্রেমিকার মতো ছিল।
-আমি এই বিয়ে কখনো মানবো না অর্ক। তাকে ফিরে যেতে বলো।
অর্ক আবার অসহায়বোধ করলো। মাকে কিভাবে বোঝাবে মাথায় আসলো না। আলতো স্বরে বলল,
-আমি কুঞ্জকে ভালোবাসি মা। ও চলে গেলে আমি ভালো থাকবো না।
মিসেস তানহা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। অর্ক বিভিন্ন উপায়ে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু হায়। সফল হলো না কোন উপায়। অতীতে পাওয়া সেই কষ্টের কালো দাগ কি মুছে যায়? প্রতিশোধের নে*শায় পাগল তানহা। অর্কের ছেলেভুলানো কথায় তার মন ভরলো না।

রাত এগারোটা। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে সব। বাতাসে শাড়ির আঁচল এলোপাতাড়ি ভাবে উড়ছে। কুঞ্জ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশপানে। অর্ক ঘরে ফেরেনি। ফিরবে বলে আশা রাখলো না কুঞ্জ। তার থেকে অর্ককে কেড়ে নেওয়ার সংকল্প করেছেন মিসেস তানহা। প্রতিশোধের নে*শায় মেতেছেন তিনি। কুঞ্জের মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কল দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। কুঞ্জ নিজের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখে খুব কম। আজও রাখলো না। ঘর থেকে ফোন নিয়ে পুনরায় বারান্দায় এলো। আম্মু দিয়ে সেভ করা নাম্বারটায় ডায়াল করলো। রিং হলো দু’বার। এরপর রিসিভ হলো। কুঞ্জ গভীর আবেগ নিয়ে ডাকলো,
-আম্মু!
ওপাশে পিনপতন নীরবতা। শোনা গেলো অস্থির শ্বাস। কুঞ্জ হাসলো। বুঝলো তার মা কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। কুঞ্জ সময় দিল। চুপ থাকলো। রাইমা ধীর কন্ঠে বলল,
-কেমন আছো কুঞ্জ?
-যদি বলি ভালো নেই তোমার কি কষ্ট হবে আম্মু?
-মায়েরা সব বোঝে কুঞ্জ! তুমি ভালো নেই আমি জানি।
-কেন ভালো নেই সেটা জানো আম্মু?
দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিলো রাইমা চৌধুরী,
-জানি।
কুঞ্জ হতবাক হলো। কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলল,
-কি জানো তুমি আম্মু।
রাইমা চৌধুরী হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন,
-তুমি ভাবছো আমি মন খারাপ করবো? আম্মু একটুও মন খারাপ করিনি কুঞ্জ। বরং তুমি অন্যকোন সিদ্ধান্ত নিলে কষ্ট পেতাম। আমার মতো আরো একজনের প্রেমবিহীন সংসার হবে মেনে নিতে পারতাম না। তোমার কষ্ট হবে জানি। কিন্তু স্বামীর ভালোবাসা পাবে। অর্ক তোমাকে কষ্ট দিবে না কখনো।
কুঞ্জ চমকালো এবার। অস্ফুট স্বরে বলল,
-তুমি সব জানো আম্মু!
রাইমা চৌধুরী হাসলেন। আলতো স্বরে বললেন
-যখনই একা লাগবে আম্মুকে কল দিবে। আম্মু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি কুঞ্জ। তোমাকে বুকে নিয়ে আম্মু বাঁচতে শিখেছি।
কুঞ্জের কান্না পেলো খুব। কাঁদলোও। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
-কুঞ্জ লাভ’স ইউ মোর আম্মু!

মিসেস তানহা নানা বাহানায় অর্ককে আটকে রাখছেন। তিনি কোন ভাবেয় ওই মেয়ের সাথে ছেলেকে থাকতে দিবেন না। অর্ক হাসফাস করছে। কুঞ্জের জন্য মায়া লাগছে। মেয়েটা নতুন জায়গায় গেলে ঘুমাতে পারে না। স্বামী হয়ে কি দায়িত্বহীন সে! বউয়ের কাছে যেতে পারছে না। অর্কের নিজেকে অমানুষ মনে হলো।

#চলবে…?