অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-০৭

0
74

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৭

রাতের তমসা কেটে ভোরের আলো ফুটছে চারদিকে। পাখিরা নীড় ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে খাবারের সন্ধানে। তাদের কলরব শোনা যাচ্ছে। আযানের সুমধুর ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘুম ছুটে গেলো তার। এলোমেলো ভঙ্গিতে উঠে বসল। চোখে ঘুম নিয়ে আশেপাশে তাকালো। কোথায় আছে বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ মনে পড়লো না কিছু। এরপর একে একে সব মনে পড়লো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো কুঞ্জ। রাতে যত দেরি করে ঘুমাক না কেন সকালে উঠার অভ্যাস তার। শিখিয়েছে বাবা। বাবাকে মনে পড়লো খুব। কুঞ্জের মন খারাপ হলো। মন খারাপ নিয়ে অজু করে এলো। নামাজ শেষ করে ঘর থেকে বের হলো। শ্বশুর বসে আছে সোফায়। কুঞ্জ তার সামনে গিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিলো। আলতো স্বরে বলল,
-চা করে দিব বাবা?
আলম সাহেব হাসলেন। খুশি হয়ে বললেন
-দাও মা।
কুঞ্জ আবার রান্নাঘরে গেলো। চা করে এনে শ্বশুর কে দিল। আলম সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-বাড়ির কারো সাথে কথা হয়েছে মা?
কুঞ্জ তখন রান্নাঘরের সব কিছু গুছিয়ে নিজের জন্য এক কাপ চা নিয়ে বের হয়েছে। কুঞ্জ থমকালো। শান্ত চোখে তাকালো আলম সাহেবের দিকে। উত্তরের বদলে ছুড়ে দিল প্রশ্ন,
-আপনার ডাক নাম কি রব্বানি বাবা? ছোট করে রবু ডাকা হয়?
আলম সাহেব পুত্রবধূর প্রশ্নে হতবিহ্বল হলেন। বাকশক্তি লোপ পেলো তার। কথা বলতে পারলেন না। কুঞ্জ রহস্যময় হাসলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে।

আলম সাহেব কতক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলেন তিনি জানেন না। যখন হুস ফিরলো দ্রুত চলে গেলেন ঘরে। ফোন হাতে নিয়ে ছুটলেন ছাদের দিকে। ছাদে পৌঁছে ডায়াল করলেন রাই নামে সেভ করা নাম্বার টায়। ফোনটা কানে ধরে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তার হাত কাঁপছে। শুধু হাত নয় বুকের ভিতর থেকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ আসছে। কল রিসিভ হলো অল্প সময় পরে। অপর পাশের মানুষটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলম সাহেব বলে উঠলেন,
-তুই কি কুঞ্জকে আমার ব্যাপারে কিছু বলেছিস রাই?
-না। তোকে নিয়ে কোন কথা আমার কখনো কুঞ্জের সাথে হয়নি।
-তাহলে কুঞ্জ কি করে জানলো আমার ডাকনাম।
-কি বলছিস এসব? কুঞ্জ কি করে জানবে?
একটু আগে কুঞ্জের করা প্রশ্ন, রহস্যময় হাসি সব খুলে বলল আলম সাহেব। রাইমা চৌধুরী হাসলেন। বললেন,
-কুঞ্জ যেহেতু এতটুকু বলেছে তারমানে আরো অনেক কিছু জানে রবু।
-সেটা ভালো নাকি খারাপ?
-সময় হলে জানবি। মেয়ে আমার ভীষণ চালাক। সে কিভাবে নিবে সেটায় ঠিক করে দিবে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ।
কল কাটলেন রাইমা চৌধুরী। আলম সাহেব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মেয়েটা কিভাবে জানলো মাথায় এলো না। প্রার্থনা করলেন তিনি কুঞ্জ যেন ভুল না বোঝে তাকে।

আজ শুক্রবার। সবার ছুটি। সকাল আটটায় রান্নাঘরে ঢুকলেন মিসেস তানহা। রান্নাঘরে কারো আসার চিহ্ন নেই। খুশি হলেন তিনি। যাক মেয়েটাকে রান্নাঘর থেকে সরাতে তো পেরেছেন। একদিন বাড়ি থেকেও সরাবেন। তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট পাবে এই মেয়ে। আপাতত একটুকুতে খুশি থাকলেন।

মা কে রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত হতে দেখে দ্রুত নিজের ঘরে গেলো অর্ক। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। স্বস্তির শ্বাস ফেলে তাকালো বিছানার দিকে। বউ তার গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। বেড সাইডের উপরে চায়ের কাপ। কলাপাতা রঙরের শাড়ির আঁচলটা ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অর্ক ধীর পায়ে বউয়ের পাশে বসলো। অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। কি মায়া মায়া চেহারা। দেখলেয় তো আদর করতে ইচ্ছে হয়। মা কেন মানছে না তবে? অর্ক ভাবলো না আর। সর্দপনে বউয়ের কপালে এঁকে দিলো ভালোবাসার পরশ। কুঞ্জ নড়ে উঠলো। এরপর পিটপিট করে চোখ খুললো। অর্ককে দেখে মুচকি হাসলো। ঘুম ঘুম চোখে জড়ানো কন্ঠে বলল,
-গুড মর্নিং।
অর্ক হাসলো। মৃদুস্বরে বলল,
-গুড মর্নিং বউ। উঠলে কেন? ঘুমাও।
-ঘুম শেষ তো।
-উহু শেষ না। ঘুমাও আর একটু। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। যাব না। ঘরেয় আছি।
কুঞ্জ মুখ ফুটে না বললেও অর্ক বুঝেছে বউ তার সঙ্গ চায়। তাই ঘুম বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। অর্কের কথায় মৃদু হাসলো কুঞ্জ। মাথা নেড়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করলো।

রাইমা, নওরীন, পাপিয়া রান্না করছে। শুক্রবারে রান্না হয় অনেক। আজকেও বিশাল আয়োজন। কাজের কোন ফুরসত পাচ্ছে না তারা। কুহু রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। পাপিয়া ভাস্তিকে দেখে বলল,
-ছোট আম্মার কিছু লাগবে?
কুহু ইতস্তত করলো। মৃদুস্বরে বলল,
-কিছু লাগবে না ছোটমা।
-তাহলে?
কুহু চুপ থাকলো। নওরীন এগিয়ে এলো। আলতো স্বরে বলল,
-কি বলবি বল। কেউ বকবো আমরা তোকে?
মেঝমায়ের আদুরে স্বরে স্বাভাবিক হলো কুহু। ধীর কন্ঠে বলল,
-আজকে পায়েস আমি রাঁধি মেঝমা?
নওরীন হাসলেন। বললেন,
-আয়। আমি বলে দিব। তুই করবি। চলবে?
কুহু হাসলো। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
-দৌড়াবে মেঝমা।
মেঝমায়ের তদারকিতে পায়েস বসালো কুহু। নওরীন বলে দিলো নাড়তে হবে অনেক। না নাড়লে নিচে আটকে যাবে। কুহু শুনলো। নাড়তে লাগলো। কোনভাবে রান্না খারাপ হওয়া যাবে না।

নুহাসের ক্ষুধা লেগেছে। রান্না শেষ হতে দেরি হবে আজ জানে। রান্নাঘরের দিকে গেলো যদি কোন শুকনো খাবার পাওয়া যায়। রান্নাঘরের দরজায় এসে চোখ আটকে গেলো কোথাও। কালো থ্রিপিচ পরিহিত মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার। ওরনা গলায় ঝুলিয়ে রাখা। ধবধবে ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। নুহাস চোখ ফিরাতে পারলো না। অস্থির দৃষ্টি মেলে ভেজা ঢোক গিললো। রাইমা ও কে দেখে বলে উঠলো,
-কিছু লাগবে আব্বু?
রাইমার কথা শুনে কুহু তাকালো দরজার দিকে। নুহাস ভাইকে দেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। আগুনের আঁচে লাল হওয়া গাল দুটো যেন আরো লাল দেখালো। নুহাস হাসলো। বিরবির করে বলল,
-তোমার মেয়েকে লাগবে বড় আম্মু।
রাইমা শুনতে পেলো না। ভ্রূ কুঁচকে বলল,
-কি বললে নুহাস?
নুহাস দ্রুত উত্তর দিল,
-কিছু না বড় আম্মু। বলছিলাম খিদে পেয়েছে। শুকনো খাবার পাওয়া যাবে?
কুহু তড়িঘড়ি উত্তর দিল,
-পায়েস তো হয়ে গেছে প্রায় নুহাস ভাইয়া। তুমি ডাইনিং এ বসো। আমি আনছি।
নুহাস মাথা নাড়লো। মুখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে বসলো চেয়ারে। গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো বসে। নওরীন একবার ছেলের দিকে তাকালো একবার ভাস্তির দিকে তাকালো। মেয়েটা কি তাড়াহুড়ো করছে। যেন ক্ষুধা নিজের লেগেছে। নওরীন হাসলেন। বললেন,
-কার জন্য পায়েস রাঁধলি কুহুমণি।
কুহুর মুখটা চুপসে গুলো। মিনমিন করে বলল,
-তোমাদের সবার জন্য।
নওরীন হাসলেন। কুহুর গাল টেনে দিয়ে বলল,
-হয়েছে আর বলতে হবে না। যার জন্য রেঁধেছিস সে খিদায় মরে যাচ্ছে। বাটিতে উঠিয়ে নিয়ে যা।
কুহু বুঝলো ধরা পড়ে গেছে সে। কথা বাড়ালো না দ্রুত পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বের হয়ে গেলো। একটু এগুতেয় শুনতে পেলো তার তিন মায়ের হাসি। পরক্ষণেই শোনা গেলো পাপিয়ার আফসোসে সুর,
-তোমাদের দু’জনের আর একটা ছোট মেয়ে নেই কেন? আমার ছেলেকে বিয়ে দিব কই?

নুহাস পায়েস মুখে দিয়ে তাকালো প্রেয়সীর দিকে। কুহু উৎকন্ঠা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুহাস হাসলো। নাক কুঁচকে বলল,
-ছ্যাহ! কি রেঁধেছিস এগুলো? এদিকে আয় তোর মুখে দেই।
কুহুর মুখ পাংশুটে হয়ে গেলো। একটু এগিয়ে আসলো নুহাসের দিকে। নুহাস এক চামচ পায়েস তুলে দিল কুহুর মুখে। কুহু খেলো। চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-ঠিক আছে তো। তুমি মিথ্যাে বললে কেন?
-তোকে খাওয়ানোর জন্য।
কুহু চোখ পিটপিট করে তাকালো। নুহাস ফিক করে হেসে দিলো। আলতো স্বরে বলল,
-এঁটো খাবার খেলে ভালোবাসা বাড়ে।
কথাটা বলেয় চোখটিপ দিলো নুহাস। কুহু লজ্জা পেলো। ছুটে চলে গেলো সেখান থেকে।

রোদের তেজ কমে এসেছে বহুগুণ। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। ঘন্টা খানিক পড়ে ডুবে যাবে। নামবে তিমির। সময়টা গ্রীষ্মের বিকেল। বসার ঘরে শ্বাশুড়ি তার ছেলেকে বুঝাচ্ছে কুঞ্জকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। অর্ক পাল্টা যুক্তি দাড় করাচ্ছে। মা-ছেলের তর্ক বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। হঠাৎ শোনা গেলো অদিতির চিৎকার। কুঞ্জ নিজের ছুটে গেলো ঘরের দরজায়। শোনা গেলো অদিতির অতিষ্ঠ স্বর,
-স্টপ ইট আম্মু। কি শুরু করেছো তুমি? তুমি না বলতে আজ তুমি মানুষের সাথে যেমন ব্যবহার করবে কাল মানুষও তোমাকে সেই একই ব্যবহার ফিরে দিবে। তাহলে কেন এমন করছো বলো? তোমার নিজের একটা মেয়ে আছে। আজ তুমি যা করছো কাল তোমার মেয়ের সাথে অন্য কেউ করবে। ভালো লাগবে তোমার?
মিসেস তানহা কিছুটা ভরকালেন। ভাবলেন কিছু সময়। কিন্তু প্রতিশোধের নে*শা তাকে ভাবতে দিলো না। তিনি চিৎকার করে বললেন,
-আমার মেয়ে ওই মেয়ের মতো পালিয়ে বিয়ে করবে না।
অদিতি একটু শান্ত হলো। মাকে বুঝাতে চাইলো। আলতো স্বরে বলল,
-বিয়েটা যেভাবে হোক হয়েছে মা। ভাই কুঞ্জ আপুকে চায়। সংসার করবেও ভাই। তাহলে আমাদের কি কোন সমস্যা সৃষ্টি করা উচিত হচ্ছে মা?
মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন মিসেস তানহা। উঠে দাঁড়ালেন। দরাজ স্বরে বললেন,
-আমার ছেলের বউ আমি কাকে বানাবো সেটা তোমার মতামত শুনে আমাকে ভাবতে হবে না অদিতি। পরের মেয়ের জন্য এত দরদ দেখাতে হবে না তোমার।
নিজের ঘরে চলে গেলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললো বসার ঘরে অবস্থানরত তিনজন। শুধু মৃদু হাসলো অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কুঞ্জারি ওয়াহিদ।

#চলবে…?