অতুলনীয়া পর্ব-০১

0
80

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

১.
নিজের স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নিজেরই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী নয়নাকে দেখে অবাক হয়ে গেল ফাতেমা। কখনো ভাবতেই পারেনি সে যে তার স্বামী এবং বান্ধবী মিলে তাকে এভাবে ধোকা দেবে। ফাতেমা নয়নাকে অতিক্রম করে নিজের স্বামী সোহেলের সামনে গেল। সোহেলের সামনে গিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
‘কেন করলে তুমি এমন? কি দোষ ছিল আমার?’

সোহেল চুপ করে রইল। এরমধ্যে ফাতেমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে ফারিয়া দৌড়ে চলে এলো সেখানে। এসেই বলে উঠল,
‘আব্বু, তুমি আর নয়না আন্টি এমন বর-বউ সেজে আছ কেন?’

ফাতেমা এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। চোখের জল ফেলতে থাকে সোহেলের সামনেই। যা দেখে হয়তো সোহেলের মন কিছুটা গলে। তাই সোহেল বলে,
‘লেট মি এক্সপ্লেইন..’

ফাতেমা ইশারা করে সোহেলকে থামিয়ে দেয়। অত:পর নিজের মেয়ে ফারিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
‘এতদিন শুধু আমাদের মেয়ের দিকে তাকিয়ে তোমার পর*কীয়ার কথা জেনেও চুপ ছিলাম। কিন্তু আর নয়। এবার তুমি সব মাত্রা অতিক্রম করে ফেলেছ। এবার আমাকে আর তুমি আটকে রাখতে পারবে না। আমার মেয়ের জন্য এতদিন মুখ বুজে সব সহ্য করেছিলাম কিন্তু আর নয়। এবার আমার মেয়ের জন্যই আমি ঘুরে দাঁড়াব।’

একথা বলেই নয়নার সামনে যায় ফাতেমা। সপাটে চ’ড় বসিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি আমার স্বামীর যার সাথে সম্পর্ক চলছে সেটা তুই। তোকে আমি কত বিশ্বাস করতাম নয়না। সোহেল কারো সাথে প’রকীয়া করছে এটা জানতে পেরেই আমি সবার প্রথমে তোকেই বলেছিলাম। অথচ তুই সেই সময় আমাকেই বলেছিলি আমি ভুল ভাবছি। তখন সোহেলের হয়ে কত কথা বলেছিলি। এখন বুঝতে পারছি এসবের কারণ৷ খুব না বড় বড় কথা বলতি তুই? নিজের পায়ে দাঁড়ালে নাকি বিয়ে করার প্রয়োজন হয়না। তো বিজনেস টাইকুন মিস সরি মিসেস নয়নার কি এটাই মোটিভ ছিল যে সে অন্য কারো স্বামীকে কেড়ে নেবে?’

‘ফাতেমা!’

‘এই চুপ। একদম উঁচু গলায় কথা বলবি না। তুই ভালো করেই চিনিস আমি মানুষটা কেমন। সেই স্কুল থেকেই তো আমায় চিনিস তুই। আমার জিনিসে অন্য কেউ নজর দিলে তার কি অবস্থা করি সেটাও জানিস। তোকেও এত সহজে ছেড়ে দেব ভাবিস না। আমি প্রকৃতির প্রতিশোধের আশায় বসে থাকব না নয়না। তোকে আর তোর স্বামীকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দেব।’

বলেই ফাতেমা ফারিয়াকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে যায়। ফারিয়া পেছন থেকে উপহাস করে বলে,
‘কি করবি তুই আমাদের? কি ওয়কাত আছে তোর? আমি একজন বিজনেস টাইকুন, সোহেল একজন উকিল আর তুই কি? সামান্য একজন গৃহিনী।’

ফাতেমা পেছন ফিরে তাকিয়ে আত্মবিশ্বাসী হেসে বলে,
‘এই সামান্য গৃহিনী তোর কি করে সেটাই শুধু দেখ।’

এমন সময় সোহেল বলে ওঠে,
‘এত বড় বড় কথা তুমি কিভাবে বলছ? এই বাড়ি থেকে বেরোনোর পর তো রাস্তায় থাকতে হবে। কারণ আমার মনে হয়না, তুমি তোমার বাবার বাড়িতে যাবে বলে!’

ফাতেমা একটু বিচলিত হয়ে পড়ে। সত্যিই সে তার বাবার বাড়িতে যেতে পারবে না। কারণ তার বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছে। তার ভাই-ভাবি তাকে একদমই পছন্দ করে না। তারা যে তাকে আশ্রয় দেবে না এটা সে ভালো করেই জানে। তবে ভেঙে পড়ার মেয়ে তো ফাতেমা নয়। তাই সে হাসি মুখেই বলে,
‘আমাকে নিয়ে তোমাকে এত ভাবতে হবে না। আর যাই হোক না কেন, আমি আমার মেয়েকে এই নরকে রাখব না।’

বলেই ফাতেমা নিজের রুমে যায়। রুমে আগে থেকেই সবকিছু সাজানোই ছিল। ফাতেমা আগে থেকেই জানয় এমন কোন দিন আসবে তার জীবনে। ২ মাস আগেই ফাতেমা বুঝতে পেরেছিল সোহেল তাকে ধোকা দিচ্ছে। তখনই নয়নার সাথে যোগাযোগ করে সে। ফাতেমার আপন বলতে এক নয়নাই ছিল। কারণ বাপের বাড়ির কেউ তার পাশে নেই। নয়না ছাড়া তার আর কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবও নেই। এইজন্য নয়নাকে নিজের সব গোপন কথা শেয়ার করত। সোহেলের ব্যাপারে খোঁজ নিতেও সে নয়নাকে বলেছিল। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত লুকিয়ে থাকলে আর কি তাকে পাওয়া যাবে? নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে সে হাসে। আজ ফাতেমা কেঁদেছে সোহেলের জন্য নয় নয়নার জন্য। মা-বাবাকে হারানোর পর নয়নাই তো তার আপন ছিল। আর সেও এভাবে ধোকা দিল।

ফাতেমা সব সাজানো জিনিস পত্র নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতে যাবে তখনই ফারিয়া বলে ওঠে,
‘আম্মু, আমরা কোথায় যাব?’

ফাতেমা ফারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘আমরা অনেক সুন্দর একটা যায়গায় যাব মামনি। যেখানে সবকিছু অনেক সুন্দর হবে।’

ফারিয়া ভাবুক হয়ে কিছুক্ষণ ভাবে। অত:পর বলে,
‘আব্বু কি নয়না আন্টিকে বিয়ে করেছে?’

ফাতেমা কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। তার এই অবুঝ, সরল মেয়েটাকে এই পৃথিবীর জটিল সমীকরণ কিভাবে বোঝাবে সে?

ফাতেমার ভাবনার মধ্যেই ফারিয়া বলে,
‘আই হেইট আব্বু। আব্বু এটা একদম ঠিক করে নি। তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যাব আম্মু।’

ফাতেমার বুকটা গর্বে ফুলে যায় তার মেয়ের কথা শুনে। ফাতেমার মনে হয় তার মেয়েকে সে একদম ঠিকভাবে মানুষ করতে পেরেছে। ফারিয়াকে বুকে জড়িয়ে সে বলে,
‘তুমি একদম চিন্তা করো না, মামনি। তোমাকে আমি অনেক ভালো একটা জীবন উপহার দেব। সমাজকে দেখিয়ে দেব একজন মায়ের শক্তি কতোটা।’

২.
ফাতেমা ফারিয়াকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় সোহেল তার সামনে এসে বলে,
‘যাওয়ার আগে একবার ভেবো দেখো, নিজের কথা না ভাবলে আমাদের মেয়ের কথা ভেবো।’

‘আমাদের নয়, ফারিয়া শুধু আমার মেয়ে। ওর উপর তোমার আর কোন অধিকার নেই। তুমি তো উকিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স পেপারস রেডি করে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি সাইন করে দেব।’

সোহেল ফাতেমাকে আটকাতে যাবে তখনই নয়না তাকে আটকে বলে,
‘এই আপদ গুলোকে তুমি যেতে দাও তো। আমরা নতুন করে আবার আমাদের ফ্যামিলি গড়ে তুলব।’

ফাতেমা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,
‘সব কিছুকে এতটা সহজ ভাবিস না নয়না। তোদেরকে আমি সুখী হতে দেব না। আমার জীবনের সুখ কেড়ে তোরা সুখী হতে পারবি না। এটা ফাতেমার প্রতিজ্ঞা।’

নয়না বলে,
‘আরে যা যা! তুই কি করতে পারবি দেখে নেব।’

ফাতেমা আর কোন বাক্যব্যয় না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে সে চিন্তায় পড়ে যায় এখন কোথায় যাবে। তখনই হঠাৎ কিছু একটা মনে করে নিজের ফোন বের করে কল করে শ্রেয়াকে। শ্রেয়াও তার একজন বান্ধবী।নয়নার মতো তার সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না, অনেকদিন থেকে তার সাথে যোগাযোগও নেই। তবে ফাতেমা জানে শ্রেয়া তাকে সাহায্য করবে। কারণ মেয়েটা অনেক ভালো মনের। ফোন করার কিছুক্ষণ পরেই শ্রেয়া ফোনটা রিসিভ করে বলে,
‘বল, ফাতেমা। কেমন আছিস?’

‘তুই আমায় মনে রেখেছিস?’

‘এত সহজে কিভাবে ভুলব? তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টকে কি ভোলা যায়? আমাদের ভার্সিটির মধ্যে তোর সিজিই তো সবথেকে বেশি ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম তুই অনেক ভালো কোন যায়গায় যাবি। কিন্তু সেই তো গৃহিনী হলি।’

ফাতেমা আফসোসের সুরে বলে,
‘সেটাই তো সবথেকে বড় ভুল করেছি জীবনে। এখন সেই ভুল শুধরে নিতে হবে। আচ্ছা তুই কি এখন নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছিস?’

‘হ্যাঁ, আমি এখন নিজের একটা কফিশপ করেছি এবং একজন সাকসেসফুল ওম্যান হতে পেরেছি।’

‘তোর ওখানে আমাকে ক’টা দিন আশ্রয় দিবি?’

‘হ্যাঁ, কেন নয়। কিন্তু তোর আশ্রয়ের কি প্রয়োজন?’

‘সে অনেক কথা। ফোনে বলা সম্ভব নয়। আমি তোর ওখানে গিয়ে তারপর তোকে সব বলছি।’

‘ঠিক আছে, আয়।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨