অতুলনীয়া পর্ব-০৩

0
57

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

শ্রেয়ার গাড়ি এসে থামলো একটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সামনে। শ্রেয়া গাড়ি থেকে নেমে ফাতেমাকেও বললো গাড়ি থেকে নামতে। ফারিয়ার ঘুমও ততক্ষণে ভেঙে গেছে। সে চুপচাপ নিজের মায়ের কোলে বসে ছিল। ফাতেমা নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘বলেছিলাম না তোমায় একটা নতুন যায়গায় নিয়ে আসব। এখন থেকে আমরা কিছুদিন এই আন্টির সাথে থাকব। তারপর নিজেদেরও একটা ব্যবস্থা করে নেবো।’

ফারিয়া কিছু বলে না। তবে চুপ থেকেই সে তার মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে এটা বোঝায়। ফাতেমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। যদি তার একার ব্যাপার হতো তাহলে এভাবে অন্যের কাছে আশ্রয় নেওয়ার আগেও দশবার ভাবতো। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলেও নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিত না। তবে সে একজন মা। একজন মা হিসেবে নিজের সন্তানের কথা ভাবতে হবে। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই শ্রেয়ার সাহায্য নিতে হলো।

ফাতেমা ফারিয়াকে কোলে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। শ্রেয়া ভীষণ উৎসাহী হয়ে পাশেই একটা কফিশপের দিকে ইশারা করে ফাতেমাকে বলল,
‘এই দেখ ফাতেমা, এটা আমার কফিশপ। আমার স্বপ্ন, যেটা আমি পূরণ করতে পেরেছি।’

শ্রেয়ার এই উচ্ছাস দেখে ফাতেমার অনেক ভালো লাগে। সাথে কিছুটা আফসোসও হয় নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারার জন্য। যদি পারত, তাহলে আজ হয়তো সেও এমন খুশি থাকত। ফাতেমা কফিশপের কাছাকাছি যায়। বেশ ভালোভাবেই ডেকোরেট করা। শ্রেয়া ভীষণ আগ্রহ নিয়ে ফাতেমার কাছে নিজের কফিশপের বর্ণনা দিতে থাকে। যখন তার মনে পড়ে ফাতেমা অনেকক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে আছে তখন জিভ কে’টে বলে,
‘সরি, আমি খেয়ালই করিনি তুই দাঁড়িয়ে আছিস। চল আমাদের বাসায় চল। সেখানে গিয়ে বাকি কথা হবে।’

ফাতেমা সামনে থাকা ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তোরা কি এই ফ্ল্যাটেই থাকিস?’

‘হ্যাঁ, এটাই তো আমার সুবিধা। ফ্ল্যাটের পাশেই কফিশপ। এই ফ্ল্যাটের দশতলায় আমি আর আম্মু থাকি আর এগারো তলায় আমার ভাইয়া, ভাবি আর তাদের ছেলে থাকে।’

ফাতেমা বলে,
‘ওহ আচ্ছা। আমি আসায় তোর কি খুব প্রব্লেম হলো?’

‘ধুর, কি যে বলিস না। আমার কোন প্রব্লেম হয়নি।’

‘তোর প্রব্লেম না হলেও তোর ফ্যামিলির বাকি সবার তো প্রব্লেম হতে পারে।’

‘বাকিদেরও প্রব্লেম হবে না। আম্মু তো তোকে দেখে অনেক খুশি হবে দেখিস।’

‘আর তোর ভাইয়া-ভাবি?’

‘ওদের কথা বাদ দে। ওরা এমনিতেও আমাদের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। ওরা ওদের ফ্ল্যাটে থাকুক, আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে। তো চল।’

ফাতেমা সায় জানায়।

৫.
নয়না গোসল শেষে একটা তোয়ালা গায়ে পেচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়। তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে সোহেল। নয়না মুচকি হেসে সোহেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
‘এভাবে কি দেখছ?’

‘তোমাকে দেখছি। কি নিখুঁত সৌন্দর্য্য তোমার। এই সৌন্দর্য্যই তো আমাকে বিমোহিত করেছে।’

নয়না সোহেলের কোলে বসে পড়ে। সোহেলের চুলে হাত বুলিয়ে বলতে থাকে,
‘আমি ফাতেমার থেকেই সুন্দরী বলো?’

‘সেটা আর বলতে। তবে জানো ফাতেমা আগে তোমার থেকেও বেশি সুন্দরী ছিল। এইজন্য তো আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আমি দেখছি ওর সৌন্দর্য কমতে শুরু করেছে৷ আর ফারিয়ার জন্মের পর থেকে তো ফাতেমা আগের থেকে অনেক সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। আগে ওর কত সুন্দর ফিগার ছিল আর এখন….’

নয়না হেসে বলে,
‘এইজন্যই বুঝি তুমি আমার প্রেমে পড়েছ?’

‘হ্যাঁ, তুমি এখন ফাতেমার থেকে অনেক সুন্দরী।’

নয়না তৃপ্তির হাসি হাসে। অবশেষে তার উদ্দ্যেশ্য সফল হয়েছে। নয়নার মনে সবসময় ফাতেমার জন্য হিংসা ছিল৷ যদিও ফাতেমা নয়নাকে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড, নিজের বোনের মতো দেখত কিন্তু নয়নার দিক থেকে অনুভূতিটা অন্যরকম। নয়নার এখনো মনে পড়েছে স্কুল-কলেজের দিনগুলো। ফাতেমা দেখতে তার থেকেও বেশি সুন্দরী ছিল, পড়াশোনাতেও ছিল ফাস্ট ক্লাস। এজন্য সবাই নয়নার থেকে বেশি ফাতেমাকেই পছন্দ করত। এজন্য নয়না ফাতেমাকে একদমই সহ্য করতে পারতো না। তবুও তার সাথে ভালো ব্যবহার করত, যা আদতে তার নাটক ছিল। তবে নয়না সবসময় চেয়েছিল ফাতেমার ক্ষতি করতে, ফাতেমাকে কষ্ট দিতে। এজন্য সে ফাতেমার অগোচরে তার অনেক ক্ষতি করেছে যা ফাতেমা জানতেও পারেনি। ফাতেমা ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের আর নয়নার বাবা একজন ধনী ব্যবসায়ী। এটাই ছিল নয়নার একমাত্র দিক যেদিক দিয়ে সে এগিয়ে। কিন্তু এটা তার জন্য যথেষ্ট ছিল না। সে সব দিক দিয়ে ফাতেমার থেকে এগিয়ে যেতে চেয়েছিল।

এজন্যই তো সোহেলের সাথে ফাতেমার বিয়ের পর নয়না সোহেলের ব্রেনওয়াশ করে ফাতেমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। সেসময় নয়না সোহেলকে এটাই বুঝিয়ে ছিল যে ফাতেমা অনেক সুন্দরী তাই সে এভাবে বাইরে পড়াশোনা করলে প*রকীয়ায় জড়িয়ে যেতে পারে। সোহেলও নয়নার ভালো বন্ধু ছিল। তাই নয়নার কথা তাকে প্রভাবিত করেছিল।

তবে ফাতেমার পড়াশোনা বন্ধ করেই নয়না সম্পূর্ণ শান্তি পায়নি। সে চেয়েছিল ফাতেমাকে আরো অসহায় করে দিতে। ফাতেমার পড়াশোনা বন্ধ করতে পারলেও ফাতেমাকে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী দেখে নয়না জ্বলত ভীষণ। ঈর্ষায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেল যে শেষপর্যন্ত সোহেলের দিকে নজর দিলো। নয়নার একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল যে, ফাতেমা এবং সোহেল দুজনেই তার বন্ধু। এজন্য দুজনেই তার সাথে নিজেদের অনেক কথা শেয়ার করত। ফাতেমা আর সোহেলের কথায় একসময় নয়না বুঝতে পারে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই সুযোগটারই সৎ ব্যবহার করে সে।

ফারিয়ার জন্মের পর থেকে সন্তান আর সংসার সামলানোর চাপে ফাতেমার সৌন্দর্যে মলীনতা দেখা দেয়। আর এটাই সোহেলকে তার প্রতি উদাসীন করে তুলেছিল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নয়না সোহেলকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে।

নিজের এসব কুকীর্তি ভেবেই হাসতে থাকে নয়না। তার আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,
‘দেখ ফাতেমা, আজ আমি তোর থেকে সব কেড়ে নিয়েছি। তোকে সম্পূর্ণ ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছি।’

৬.
ফাতেমা আর ফারিয়াকে নিজের বাসায় নিয়ে এলো শ্রেয়া। শ্রেয়ার মা শাবানা বেগমকে তাদের ব্যাপারে সব খুলে বলেছে শ্রেয়া। সব শুনে শাবানা বেগমের ভীষণ মায়া হয় ফাতেমার জন্য। ফারিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বলেন,
‘তোমার স্বামী এতটা কুলাঙ্গার কিভাবে হলো মা? এই বাচ্চাটার কথাও একবার ভাবলো না!’

ফাতেমা শান্ত রইলো। তার যে নিজেরও কিছু বলার নেই। শাবানা বেগম ফাতেমাকে আশ্বাসের সুরে বললেন,
‘তুমি একদম চিন্তা করো না মা। আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি যতদিন ইচ্ছা তুমি আমাদের বাসায় থাকতে পারো। শ্রেয়া তুই ওদেরকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দে। ওরা যতদিন ইচ্ছা এখানেই থাকুক।’

ফাতেমা কৃতজ্ঞতা সূচক দৃষ্টিতে তাকায় শাবানা বেগমের দিকে। বলে,
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি। আপনারা আছেন জন্যই আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে নিশ্চিত হতে পারলাম। আপনাদের এই ঋণ যে আমি কিভাবে শোধ করব।’

‘পাগলী মেয়ে! তোমায় একদম চিন্তা করতে হবে না এসব নিয়ে। তুমি তো আমার কাছে শ্রেয়ারই মতো। যাও, তোমরা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। অনেক ধকল গেছে তোমাদের উপর দিয়ে।’

শ্রেয়া ফাতেমা আর ফারিয়াকে গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। তাদের রুমটা দেখিয়ে দিয়ে বলে,
‘ তোরা আপাতত এখানেই থাক।’

ফাতেমা আবারো শ্রেয়ার হাত ধরে বলে,
‘তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রেয়া।’

‘আরে বারবার এভাবে ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমি কিন্তু রেগে যাব।’

এই বলে একটু থেমে আবারো বলে,
‘তুই তোর স্বামী এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রীর একটা ব্যবস্থা কর। ওরা তোর প্রতি যেই অন্যায় করেছে তার শান্তি ওরা না যতক্ষণ পাচ্ছে আমি ততক্ষণ শান্তি পাবো না।’

ফাতেমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
‘শান্তি তো আমিও পাবো না। কিন্তু এতোটা অধৈর্য হলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় সবটা করতে হবে।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨