অতুলনীয়া পর্ব-১০

0
72

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল জজ সাহেব কি বলেন তা শোনার জন্য। জজ সাহেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেন,
‘বাচ্চা যেহেতু মায়ের কাছে থাকতে চায় তাই আমরা বাচ্চার মতামতকেই সম্মান জানাই। ফারিয়া জান্নাত নিজের মা ফাতেমা খাতুনের কাছেই থাকবে।’

নয়না তখনই বলে ওঠে,
‘কিন্তু আমি যে আপনাকে প্রমাণ দিলান যে, ফাতেমা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নয়৷ ওর কাছে থাকলে ফারিয়ার কোন খেয়ালই ঠিকভাবে রাখতে পারবে না।’

জজ সাহেব জানান,
‘এক্ষেত্রে আমি ওদের খোরপোষের দায়িত্ব মিস্টার সোহেলকে নিতে বলতে পারি। কিন্তু দেশের আইন অনুসারে, বাচ্চা ১৮ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকবে। আইনের বাইরে আমার কিছু করার নেই।’

তখনই ফাতেমা দাঁড়িয়ে বলেন,
‘আমার প্রাক্তন স্বামীর কোন সাহায্যরই আমার দরকার নেই। আমার মেয়েকে দেখে রাখার জন্য আমি একাই যথেষ্ট।’

ফাহিমও পাশ থেকে বলে,
‘আমি আমার বোনের পাশে আছি। আর্থিক দিক দিয়ে ওদের কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।’

জজ সাহেব এবার চূড়ান্ত ভাবে বললেন,
‘তাহলে তো সব সমস্যা মিটেই গেল। আমার মনে হয়না এই কেস আরো চালিয়ে নিয়ে যাবার কোন মানে আছে। কোর্ট বাচ্চার কাস্টডি মাকেই দিচ্ছে।’

এই বলে তিনি কোর্টের কার্যক্রমের মুলতবি টানেন। নয়না পরাজিত হওয়ার এই গ্লানি মানতে পারে না। ফাতেমার দিকে রক্তিম চোখে তাকায়। ফাতেমা নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে কেঁদে ফেলে। অবশেষে কোর্টে একজন মায়ের শক্তির জয় হয়েছে। পরাজিত হয়েছে সকল অপশক্তি।

নয়না সোহেলের সামনে গিয়ে বলে,
‘চলো এখান থেকে। এই সব আদিক্ষ্যেতা আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’

‘হুম, চলো।’

যাওয়ার সময় ফাতেমার মুখোমুখি হতেই ফাতেমা তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
‘দেখলে তো তোমরা একজন মায়ের শক্তির কাছে কিভাবে তোমাদের হেরে যেতে হলো।’

নয়না দাঁড়িয়ে গেল। ঘুরে তাকিয়ে ফাতেমার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
‘যত খুশি হওয়ার হয়ে নে। তবে মনে রাখিস, এক মাঘে কিন্তু শীত যায় না। সময় আমারও আসবে। আমি এত সহজে তোকে সুখী হতে দিবো না। দুঃখের স্বাদ তোকে অন্বেষণ করতেই হবে।’

ফাতেমা স্থির থেকে বলে,
‘দুঃখের পালা বোধহয় এবার তোদের শুরু হবে। এমনটা আমার মনে হয়। বাকিটা তো সময় এলেই জানা যাবে।’

১৯.
কয়েক দিন পর,
ফাতেমার দিনগুলো এখন বেশ ভালোই যাচ্ছে। ফারিয়াকে নিজের কাস্টডিতে নেওয়ার পর থেকে সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। পড়াশোনাও শুরু হয়েছে আবার। সাথে শ্রেয়াকে তার রেস্টুরেন্টের কাজে সাহায্যও করছে। যে তার বিপদে পাশে ছিল তাকে তো আর ছেড়ে দিতে পারে না। সবমিলিয়ে তার দিন ব্যস্ততার মধ্যে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে। তবে সবকিছুর মধ্যে সে কেন জানি বর্তমানে একটু অন্য চিন্তায় মগ্ন। নয়না আর সোহেল মিলে তার থেকে ফারিয়াকে আলাদা করার চেষ্টা করছে এটা জানার পর থেকে ফাতেমার মধ্যে প্রতিশোধ স্পৃহা বাড়ছে। এমনিতেই সে কথা দিয়েছিল তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য উপযুক্ত শাস্তি দেবে এখন সেই ইচ্ছাটা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এজন্য ফাতেমা দুজন মানুষের সাহায্য নিতে চাইছে। একজন হলো সোহেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাব্বি, আরেকজন নয়নার অফিসের কর্মচারী মিস্টার ফয়সাল হক। রাব্বি সোহেলের বন্ধু হলেও ফাতেমার প্রতি করা অন্যায় সে মেনে নিতে পারে নি। তাছাড়া রাব্বির স্ত্রী রাবেয়ার সাথেও ফাতেমার বেশ ভালো সম্পর্ক। তাই রাব্বি ফাতেমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেয়েছে সোহেলকে শায়েস্তা করার ব্যাপারে। বলা বাহুল্য, রাব্বি নিজেও সোহেলের মতোই একজন আইনজীবী।

ফাতেমা দুপুরে যখন বেলকনিতে বসে চা খাচ্ছিল তখন রাব্বি ফাতেমাকে ফোন কল করে। ফাতেমা ফোনটা রিসিভ করে কিছুক্ষণ ভালো মন্দের খোঁজ খবর নেয়। এরপর রাব্বি বলে,
‘আমি সোহেলের সম্পর্কে কিছু গোপন কথা জানতে পেরেছি যা আপনার কাজে লাগতে পারে।’

‘জ্বি, বলুন।’

‘সোহেল সম্প্রীতি একটা কেইস হাতে নিয়েছে। আর এই কেইসের ব্যাপারে প্রথমে আমার সাথেই যোগাযোগ করেছিল আসামীপক্ষ। তারা আমাকে মোটা অংকের টাকাও অফার করেছিল এই কেস লড়ার জন্য কিন্তু আমি এই কেস লড়িনি। কারণ তারা আমায় কোর্টে মিথ্যা প্রমাণ পেশ করতে বলেছিল যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাছাড়া কেইসটা বেশ সেনসিটিভ। ঢাকা শহরের একজন বড় বিজনেসম্যানের ছেলের বিরুদ্ধে একজন সাধারণ দিনমজুরকে গাড়ি চাপা দিয়ে মে-রে ফেলার কেইস। ঘটনার সময় অনেক মানুষ সাক্ষী ছিল যে গাড়ি ওনার ছেলেই চালাচ্ছিল। কিন্তু উনি এখন এমন ভাবে কেইস সাজাতে চাইছেন যেন গাড়িটা ওনার ছেলে নয় ড্রাইভার চালাচ্ছিলেন। আ এই কেইসটা কিন্তু কোন সাধারণ কেইস নয়। ইতিমধ্যেই জনমনে কেইসটা নিয়ে অনেক চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’

ফাতেমা রাব্বির সব কথা মনযোগ সহকারে শোনে। সবটা শুনে সে অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে পারে। এর পূর্বেও সোহেলের সাথে সংসার করার সময়ে তার কানে এমন অনেক কথা উঠেছিল যে সোহেল টাকার বিনিময়ে মিথ্যা প্রমাণ দিয়ে অনেক কেইস লড়ে। তবে সোহেল সেইসময় ফাতেমাকে এমন ভাবে সব বুঝিয়েছিল যে তার মনে হয়েছিল এসব গুজব ছাড়া আর কিছু নয়। তবে এখন সে বুঝতে পারছে, সোহেল আসলেই এমন জঘন্য একজন লোক। যদি সোহেলের এসব অপকর্ম সামনে আসে তাহলে সে নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে। তাই ফাতেমা রাব্বিকে বলে,
‘ভাইয়া, আপনি দয়া করে এই বিষয়ে আরো খোঁজ খবর নেন। আমি এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে চাই।’

“জ্বি, আমি চেষ্টা করব।”

ফাতেমা ফোন রেখে দেয়। অতঃপর কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বলে,
‘তোমার পাপের ঘড়া বুঝি পূর্ণ হয়ে গেল সোহেল। এবার তোমার শাস্তি শুরু হলো বলে।’

২০.
সোহেল ফোনে কারো সাথে ভীষণ জরুরি কথা বলছিল। এমন সময় নয়না তার সামনে চলে আসে। নয়নাকে দেখে সোহেল ফোন রেখে দেয়। অতঃপর নয়নাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার গালে চুমু খেয়ে বলে,
‘তুমি নিশ্চয়ই এখনো ফারিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমার উপর রেগে আছ?’

নয়না কোন কথা বলে না। এমন সময় সোহেল হঠাৎ করে একটা ডায়মন্ড নেকলেস নয়নার গলায় পড়িয়ে দেয়। নয়না ভীষণ শকড় হয়ে যায়। সোহেল মৃদু হেসে বলে,
‘কি এখনো আমার উপর রাগ করে থাকবে?’

নয়না উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘ওয়াও, এই নেকলেসটা কত্ত সুন্দর! আমার তো ভীষণ পছন্দ হয়েছে। ধন্যবাদ সোহেল। কিন্তু তুমি হঠাৎ এত টাকা কোথায় পেলে?’

সোহেল হেসে বলে,
‘একটা নতুন কেইস হাতে পেয়েছি। হেব্বি মালদার পার্টি। সেখান থেকেই তো অনেকগুলো টাকা পেয়েছি। কেইসটা জেতাতে পারলে আরো টাকা পাঠাবো। আপাতত তোমার জন্য এটা কিনে আনলাম। আরো টাকা পেলে ভাবছি তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাব।’

‘সত্যি?’

“হুম, সত্যি। আমি তো ভাবছি তোমার সাথে সুইজারল্যান্ড যাব। যাবে তো তুমি?”

“কেন নয়।”

বলেই নয়না সোহেলকে জড়িয়ে ধরে।


ফাতেমা আজ এসেছে সোহেলের বিপরীতে যিনি কেইস লড়বেন সেই উকিলের সাথে দেখা করতে। কারণ সোহেলকে শায়েস্তা করার জন্য এখন ফাতেমার তার সাহায্যের ভীষণ প্রয়োজন পড়েছে। ফাতেমা অফিসে প্রবেশ করার সময় হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। তখনই দুটো হাত তাকে আগলে নেয়। ফাতেমা জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। আরেকটু হলেই অনেক বিপদে পড়ে যেত সে।

“আপনি ঠিক আছেন তো?”

হঠাৎ এমন পুরুষালি কন্ঠে ফাতেমা চমকে ওঠে। সামনে তাকাতেই দেখতে পারে একজন অচেনা পুরুষকে। যিনি দেখতে চমৎকার। বেশ লম্বা, ফর্সা
এবং সুঠাম দেহ। পড়নে তার উকিলের ড্রেস। ফাতেমা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনিই কি..’

‘হ্যাঁ, আমিই এডভোকেট প্রত্যুষ চৌধুরী।’

ফাতেমা প্রত্যুষ চৌধুরী নামটা কয়েকবার আওড়ায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨