অতুলনীয়া পর্ব-১৩

0
361

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ১৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমার দিনগুলো এখন বেশ ভালোই যাচ্ছে। সোহেল এবং নয়না দুজনেই এখন জেলে। তাই তার জীবনে কোন বিপদ-আপন তৈরি করার মতো মানুষ নেই আপাতত। সে বেশ দেদারসে জীবন অতিবাহিত করছে। নিজের পড়াশোনা সামলাচ্ছে, মেয়েকেও সামলাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যস্ত জীবন!

আজ সকালে ফাতেমার দিন শুরু হলো নামাজ দিয়ে। নামাজ আদায় করে ফাতেমা চলে এলো শ্রেয়াদের বাসার রান্নাঘরে। শাবানা বেগম সকালে উঠেই রান্নাঘরে প্রবেশ করেছেন। ফাতেমা তাকে এভাবে রান্নাঘরে দেখে বলে,
‘আন্টি আপনি এত সকালে রান্নাঘরে?! কোন বিশেষ কিছু আছে কি আজ?’

শাবানা বেগম মুখে হাত দিয়ে ফাতেমাকে চুপ করার ইশারা করেন। ফাতেমা চুপ করতেই তিনি বলেন,
‘আজ শ্রেয়াকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। তাই এত আয়োজন। তুমি আবার ওকে কিছু বলো না আবার। কেমন?’

ফাতেমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। শাবানা বেগম বলতে থাকেন,
‘মেয়েটার তো বয়স হচ্ছে বলো। সামনের বছর ২৮ এ পা দেবে। ওর মতো বয়সে আমি দুই ছেলে-মেয়ের মা হয়ে পাকা গিন্নি ছিলাম।আর ও এখনো বিয়েই করছে না। আমি জোর না করলে হয়তো করবেও না। তুমি তো জানো মা, ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। ওর বাবার মৃত্যুর পর ওর দায়িত্ব যে এখন আমার কাঁধেই। ওর ভাই…সে তো থেকেও নেই। একই ফ্ল্যাটে থাকি অথচ দেখেছ কোনদিন আমাদের খোঁজ নিতে? শুনলাম গতকাল নাকি বউ-বাচ্চাকে নিয়ে মালদ্বীপ ঘুরতে গেছে। সে যাক গে, আমার এসব নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। ছেলে বড় হয়েছে এখন সে যা করার করুক। আমার মেয়েকে নিয়ে তো আমাকেই ভাবতে হবে। জন্ম যখন দিয়েছি তখন ওর দায়িত্ব তো আমারই। এখন শুধু একটা সুযোগ্য পাত্রের হাতে মেয়েটাকে তুলে দিতে পারলেই আমার শান্তি।’

ফাতেমা মৃদু হেসে বলে,
‘চিন্তা করবেন না আন্টি। দেখবেন, শ্রেয়ার জন্য আপনি অনেক ভালো পাত্র খুঁজে পাবেন।’

‘জানো, আজ যে আসছে সেই ছেলেটা শহরের একজন নাম করা উকিল। সকলের মুখে তার অনেক প্রশংসা। আমার খালাতো বোনের মাধ্যমে ছেলেটার খোঁজ পেয়েছি। সেই ছেলে নাকি তার স্বামীকে ভাসুরের সাথে জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলা কেইসে সাহায্য করেছিল। পরে ওর পরিবারের সাথেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে পরিচিতির খাতিরে। ঐ ছেলের মা’ই নাকি ছেলের জন্য কোন শিক্ষিত সুযোগ্যা মেয়ে খুঁজছে। তখন উনি ছেলেটার মাকে আমার শ্রেয়ার কথা বলেন। আমাকেও জানান এই ব্যাপারে। দুই পরিবারই দেখা-সাক্ষাতের ডেট ফাইনাল করি তবে গোপনে। এখন দেখা যাক শ্রেয়া কি রিয়্যাক্ট করে।’

‘আপনি চিন্তা করবেন না, আন্টি। আমি আছি তো। দরকার পড়লে আমি শ্রেয়াকে বোঝাবো যেন ও এই সম্মন্ধে রাজি হয়ে যায়।’

শাবানা বেগম প্রসন্ন হন। ফাতেমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
‘তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি জানি, তুমি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না।’

২৫.
সোহেলের জেলে কাটানোর মাস দুয়েক অতিবাহিত হয়েছে। জেলে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। কত আয়েশের জীবন ছিল আর আজ কি অবস্থা। সোহেলের কাছে নয়নার জেলে যাওয়ার খবরও পৌঁছে গেছে। সব মিলিয়ে সে এখন বিরক্ত। নয়নার ভরসায় ছিল, যে নয়না তাকে বাঁচাবে। অথচ এখন সেই নয়নাই জেলে।

সোহেল এখন যেন এই অবরুদ্ধ কারাগারেই নিজের ভবিষ্যৎ মেনে নিয়েছে। তবে ভাগ্য বোধহয় তার জন্য আশার আলো বাকি রেখেছিল।

আজকে হঠাৎ করে একজন পুলিশ অফিসার এসে সোহেলকে বলে,
‘আপনার জামিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

সোহেল খুশি হয়ে বলে,
‘সত্যি? কে করেছে আমার জামিনের ব্যবস্থা?’

‘আমি।’

বলেই তার সামনে এসে দাঁড়ায় এক মহিলা। সোহেল যেন চিনতে পারে মহিলাকে। কাছে আসতেই আরো পরিস্কার হয়। অস্ফুটস্বরে বলে,
‘মিস নেহা মির্জা!’

‘জ্বি, আমি।’

‘আপনি লন্ডন থেকে কবে ফিরলেন?’

‘কিছুদিন আগেই। তোমার এরেস্টের খবরে আমার আর মন টিকল না লন্ডনে! তাই চলে এলাম।’

সোহেল লজ্জা পায় যেন। খানিক লাজুক হেসে বলে,
‘আমি কিন্তু আপনাকে আশা করিনি?’

‘আশা না করতেই তো মানুষ কত কি পেয়ে যায়। এই যেমন তুমি তো নয়নাকেও আশা করো নি লাইফে, তবে পেয়ে গেলে! বরাবরই তোমার বড়লোক পরিবারের দিকে নজর, সাথে সুন্দরী বউ! যাইহোক, আমি তোমাকে এখান থেকে বের করার জন্য জামিনের ব্যবস্থা করেছি তবে তুমি আমাকে খুব ভালো করেই চেনো তাই জানো আমি কোন কারণ ছাড়া তোমার জামিনের ব্যবস্থা করিনি।’

‘হ্যাঁ, সেটা তো আমি বুঝতেই পারছি। তো বলুন এই জামিনের বদলে আপনি আমার কাছে কি চান?’

‘বেশি কিছু চাই না। শুধু এটুকুই চাই যে তুমি নয়নাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে বিয়ে করো!’

সোহেল বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। এ কি বলছে নেহা!

নেহা বলে,
‘কি অবাক হলে তো?! এমন কিছু আশা করো নি, তাইনা?’

সোহেল কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে,
‘কিন্তু আপনি তো বিবাহিত। লন্ডনের কোন এক শিল্পপতিকে..’

‘ডিভোর্স হয়ে গেছে! আর যুক্তরাজ্যের প্রচলিত আইন অনুসারে এখন আমার স্বামীর অর্ধেক সম্পত্তির মালিক আমি। কত ক্ষমতা বুঝতেই পারছ। যাইহোক, আমি জানি তুমি নিজের প্রোফিট টা খুব ভালোই বোঝো। তো বলো, কি করবে?’

সোহেল বাকা হেসে বলে,
‘আমি আপনার সব শর্তে রাজি। এই জেলে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। এবার একটু জেলের বাইরের বাতাস খেতে চাই।’

নেহা মির্জা হাসে। বড়ই তৃপ্তির সে হাসি।

২৬.
ফাতেমা এলো একটা গ্রোসারি শপে। ফারিয়া স্ন্যাকস খেতে খুব পছন্দ করে। তাই ওর জন্য ওর পছন্দের কিছু স্ন্যাকস কিনছিল। গ্রোসারি শপ থেকে বেরোতেই হঠাৎ করে তার সাথে দেখা হয়ে গেল প্রত্যুষ চৌধুরীর। প্রত্যুষ চৌধুরী যেন ফাতেমাকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে। ফাতেমা মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
‘কেমন আছেন? অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’

‘আমিও। এখানে কোন কাজে এসেছিলেন?’

‘না, আসলে আমি একটা যায়গায় যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমার জন্য দোয়া করবেন।’

‘দোয়া কেন?’

‘আমি নতুন জীবনে পা রাখতে চলেছি মনে হয়। নট শিওর, বাট ফ্যামিলি যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে..আই থিংক আমার সিঙ্গেল লাইফ খুব শীঘ্রই ইতি ঘটবে।’

ফাতেমা মৃদু হেসে বলে,
‘বাহ, এটা তো অনেক ভালো খবর। আপনাকে অনেক অনেক অভিনন্দন। আশা করি, আপনার জীবন ভালো হবে সামনে। আমার দোয়া রইল।’

‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’

‘ধন্যবাদ দেয়ার দরকার নেই। আপনার কাছে তো আমি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ। জানি না, কোনদিন এই ঋণ শোধ করতে পারব কিনা।’

‘এমন ভাবে বলবেন না। আপনাকে সাহায্য করতে পেরে আমি কৃতার্থ। আপনার মতো এত চমৎকার ব্যক্তিত্বের নারী আমি খুব কমই দেখেছি কিংবা বলতে গেলে দেখিই নি। আপনার ব্যক্তিত্ব আমায় ভীষণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল। কম কেইস তো লড়িনি, বাঙালি বধূ তথা মা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল তারা ভীষণ পতিভক্ত এবং ভীরু হয়। লড়াই শব্দটা তাদের ডিকশিনারিতে থাকেই না! তবে আপনি একদম অন্যরকম। লড়াকু স্বভাবের এক মুগ্ধতায় মোড়ানো নারী। যাকে পড়তে গেলে পাতায় পাতায় মুগ্ধ হতে হবে। এত মনের জোর আপনার, এত সাহসিকতার প্রশংসা না করলেই নয়। আপনার জীবনে ভালো কিছু হবে দেখবেন!’

‘দেখাই যাবে। আমার জন্য মনে হয় আপনার দেরি হচ্ছে।’

‘না, তেমন না। তবে আমায় যেতে হবে। বিদায়।’

‘বিদায়।’

অতঃপর দুজনে চলে গেলো ভিন্ন দিকে। ভিন্ন দুই পথে। যে পথ কখনো এক হবার নয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨