অতুলনীয়া পর্ব-১৮

0
60

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমার জ্ঞান ফিরলে সে নিজের চোখের সামনে ফারিয়া আর শ্রেয়াকে দেখতে পায়। ফারিয়া তো ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে। শ্রেয়া উৎকন্ঠার সাথে বলে ওঠে,
‘তুই ঠিক আছিস তো? আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম যে তোর আবার কি হলো, হঠাৎ এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলি।’

‘আমি ঠিক আছি।’

শ্রেয়া ফাতেমাকে বিশ্রাম নিতে বলে ফারিয়াকে নিয়ে চলে গেলো। এদিকে ফাতেমা বসে বসে নুহাশ খন্দকারের বলা কথাগুলো ভাবছিল। ফাতেমা বুঝতে পারছে সে খুব বড় ঝামেলায় পড়তে চলেছে। কারণ সোহেলের কেসে লোকটা তাকেই অপরাধী ভাবছে। হয়তো ফাতেমার বিরুদ্ধে এখন তদন্ত শুরু করবে। ফাতেমা একটু ঘাবড়ে যায়। তবে নিজেকে সামলে নেয়। এখন তাকে একদম দূর্বল হলে চলবে না। নিজের মেয়ের জন্য হলেও শক্ত থাকতে হবে। তাছাড়া যে অপরাধ সে করেই নি তার শাস্তি ভোগের জন্য ভয় কেন করবে? ঐ লোকটা যদি তদন্ত করে তো করুক। তবে সে যেহেতু দোষী নয় তাহলে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাবে না। এটা ভেবে আপাতত নিজেকে বুঝ দেয় ফাতেমা। তবে তার ভেতর থেকে খটকা একদম দূর হচ্ছিল না৷ ফাতেমার সবথেকে বড় ভাবনা তো এটা নিয়ে যে সোহেলকে কে খু**ন করল। সোহেল যেহেতু একজন উকিল সেহেতু তার অনেক শত্রুই থাকতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ করে থাকতে পারে। এমনটাই ভাবছিল ফাতেমা। কিন্তু সে জানে না আসল সত্যটা অন্য কিছু। যেটা হয়তো সে ধারণাও করতে পারবে না। কারণ সে যে অনেক কিছুই জানে না।

৩৫.
নয়না জেলে বসে গুনগুন করে গান গাইছিল। তার পাশে বসে থাকা অন্য এক মহিলা কয়েদি বিরক্ত হয়ে বলে,
‘এসব গুনগুন করা বন্ধ কর তো। এমন প্যানপ্যানানি আমার একদম সহ্য হয় না।’

নয়না তার কথায় কোন পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো গুনগুন করতে থাকে। এরমধ্যে থানার একজন পুলিশ অফিসার আছে নয়নার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে। তিনি নয়নাকে আলাদা একটা চেম্বারে নিয়ে যান। নয়না চেম্বারে ঢুকেই নিজের হাবভাব পুরো বদলে নেয়। পুলিশ অফিসারের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে বলে,
‘টাকা পেয়ে গেছ তো?’

পুলিশ অফিসার প্রসন্ন হয়ে বলে,
‘জ্বি, ম্যাডাম। আপনার সই করে দেওয়া চেকের মাধ্যমে আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে আমি টাকা উত্তোলন করেছি।’

‘তাহলেই বুঝতেই পারছ, আমাকে সাহায্য করলে আখেরে লাভ তোমারই হবে।’

‘তা আর বলতে। তবে জানেন, সেদিন রাতে না আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আপনার ফিরতে এত রাত হচ্ছিল। আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আর ফিরবেনই না।’

‘নয়না কথা দিয়ে কথা রাখে। আর তাছাড়া এত বোকা আমি নই যে ফেরারি আসামী হবো। জেলে ফিরে এসে তো আমার লাভই হয়েছে। কেউ আমাকে সন্দেহও করছে না।’

অতঃপর নয়না নিজের চুলের মধ্যে সযত্নে লুকিয়ে রাখা একটা অডিও ক্লিপ বের করে পুলিশ অফিসারের হাতে দিয়ে বলে,
‘আপনি আরো ৫ লাখ পাবেন। তবে তার বিনিময়ে আপনাকে তেমন কিছু করতে হবে না। শুধু কোনভাবে এই অডিও ক্লিপটাকে কাজে লাগাতে হবে।’

‘কি আছে এই অডিও ক্লিপে?’

‘নিজেই শুনে নিন।’

পুলিশ অফিসার অডিও ক্লিপটা একটা রেকর্ডারে ভড়ে প্লে করতেই শুনতে পায়,
‘ফাতেমা…তুমি..আমায় মে*রো না প্লিজ। যেতে দাও আমায়। আমি জানি, আমি তোমার কাছে অনেক অপরাধ করেছি। সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আমায় মেরো না প্লিজ।’

তারপরই শুনতে পাওয়া যায় একটা বিকট চিৎকারের আওয়াজ। যা শুনে গা শিউরে ওঠে। পুলিশ অফিসার ঢোক গিলে বলে,
‘আমায় ঠিক কি করতে হবে?’

‘আপনাদের থানাতেই নিশ্চয়ই সোহেল ইসলাম নামের একজনের খু**নের কেস চলছে।’

‘জ্বি।’

‘আপনাকে বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু এই ক্লিপটাকে সোহেলের ফোনের রেকর্ডিং থেকে পেয়েছেন এটা বলে চালিয়ে দিতে হবে৷ তারপর যা হওয়ার সেটা এমনি এমনিই হবে।’

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করেন,
‘এই খু** টা তো সেই রাতেই হয়েছিল যেদিন আপনি থানা থেকে বেরিয়েছিলেন। তাহলে কি আপনিই…’

নয়না বাকা হেসে বলে,
‘এত গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনাকে এর থেকে ১০ লাখ দিয়েছি, আজ আরো ৫ লাখ দিলাম। আপনি এই টাকা নিয়েই খুশি থাকুন না। কে কোথায় কাকে মা**রল এসব জেনে কি করবেন? এসব পুলিশের কাজ করে আর কত বেতন পান! তা দিয়ে সংসার চলে বলুন?’

পুলিশ অফিসার চুপ হয়ে যান। নয়না বলেন,
‘যা যা বলছি করতে পারবেন তো?’

‘জ্বি, ম্যাম। আমি পারবো।’

‘গ্রেইট। এখন যান কাজে লেগে পড়ুন।’

পুলিশ অফিসার মূলত জেরা করার নাম করে নয়নাকে নিয়ে এসে এসব করল। এমনটা অস্বাভাবিক নয়। টাকার কাছে সবাই গোলাম। বিভিন্ন থানায় হরহামেশাই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। যা আমাদের সমাজের কালো অধ্যায়।

নয়না নিজের অভিসন্ধির ব্যাপারে ভেবে মৃদু হেসে বলে,
‘একেই বলে এক ঢিলে দুই পাখি স্বীকার। প্রথমে ঐ সোহেলকে শেষ করেছি এবার ফাতেমাকেও দূর করব। আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল এবার তোর যাবজ্জীবন হবে রে ফাতেমা। আমার সাথে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ফল বুঝবি। তোর ভাবনা যেখানে শেষ সেখান থেকেই আমার ভাবনা শুরু। তুই তো এটাও জানিস না যে, ১০ বছর আগে তোর মা-বাবার মৃত্যুটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। আমার বাবা-মা সবসময় ব্যবসার কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকত। আমাকে একদম সময় দিত না। আর অন্যদিকে তোর মা-বাবাকে নিয়ে তুই এত হ্যাপি ছিলি। তোর কোন খুশিই যে আমার সহ্য হয়না। সেই সেদিন রাতে ফাকা রাস্তা দেখে আমি তাদের উপর গাড়ি চালিয়ে দিয়েছিলাম। সেইসময় সিসিটিভিও ছিল না। তাই সত্য আজও অজানা সবার কাছে। তবে সোহলেকে মা*রার আমার কোন ইনটেনশন ছিল না। কিন্তু ওর খুব শখ ছিল আমাকে ঠকিয়ে আমার বড় বোনকে বিয়ে করার। ওর এই ইচ্ছা আমায় রাগিয়ে দিয়েছিল। আর আমার বড় বোন নেহা মির্জা। তার তো আমি এমন ব্যবস্থা করেছি যা কেউ ভাবতেও পারবি না।’

বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

৩৬.
ফাতেমা উঠে বসে শ্রেয়ার বৌভাতের মূল আয়োজনের ওখানে আসে। সেখানে এসেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় মিস্টার কবির রিজভীর। যিনি একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। তিনি ছিলেন ফাতেমার বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ফাতেমার মা-বাবার মৃত্যুর কেসটা তদন্তও করেছিলেন। যদিও কোন সুরাহা করতে পারেন নি উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে।

ফাতেমাকে দেখে তিনি এগিয়ে আসলেন কথা বলতে। ভালো মন্দের খোঁজ খবর নিলেন। ফাতেমাও বেশ হাসি মুখেই কথা বলল। একপর্যায়ে কবির রিজভী বলে উঠলেন,
‘তোমার মা-বাবার কেসের কোন সুরাহা করতে পারলাম না। এই জিনিসটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। তোমার বাবা আমার কত ভালো বন্ধু ছিলেন।’

ফাতেমা বলে,
‘আপনি এমন বলবেন না আঙ্কেল। আপনি তো কম চেষ্টা করেন নি। যাইহোক, আমার আল্লাহর উপর ভরসা আছে যে বা যারা আমার বাবা-মার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারা শাস্তি পাবেনই।’

‘তাহলে তোমারও মনে হয় এটা কোন সাধারণ দূর্ঘটনা নয়, একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড?’

‘জ্বি, অবশ্যই। কারণ সেই সময় একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। যদিও তিনি মাতাল জন্য তার কথা কেউ তেমন গ্রাহ্য করেন নি। তবে তার ভাষ্যমতে একটা গাড়ি ইচ্ছাকৃত ভাবে আমার মা-বাবাকে ধাক্কা দেয় যখন তারা রাতে শপিং শেষে ফিরেছিল। তবে তিনি মাতাল থাকায় গাড়ির নাম্বার প্লেইট দেখেন নি। নাহলে হয়তো একটা সুরাহা হতো।’

এভাবে কথাবার্তা শেষ করে ফাতেমা ফারিয়ার কাছে গিয়ে বলে,
‘ফারিয়া, চলো আমরা এখন যাই। তোমার মামা-মামী অপেক্ষা করছেন। তুমি আজ প্রথমবার মামা বাড়িতে যাবে।’

ফারিয়া ভীষণ খুশি হয়। ফাতেমা শ্রেয়া, শাবানা বেগম সবার থেকে বিদায় নেয়। অতঃপর বের হতে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨