অতুলনীয়া পর্ব-২০

0
60

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমাকে জেলে আনা হয়েছে। ফাতেমাও মানিয়ে নিয়েছে এই বাস্তবতার সাথে। তবে কাকতালীয় ভাবেই হোক বা যেভাবেই ফাতেমাকে যেই লকাপে রাখা হয়েছে সেখানেই ছিল নয়না। ফাতেমাকে দেখে যেন নয়না পরিতৃপ্তি পায়। ফাতেমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
‘আরে..ম্যাডাম ফাতেমা আপনি এখানে! আপনাকে তো এখানে একদম আশা করিনি। এত আদর্শবাদী, সৎ মানুষ আপনি। এই জেলে আপনি কি করছেন?’

বলেই অট্টহাসি দেয়। বলে,
‘আমাকে জেলে পাঠিয়েছিলি তাই না? আজ দেখ ভাগ্য তোকেই জেলে এনে দাঁড় করিয়েছে।’

ফাতেমা নয়নার এসব কথার কোন প্রতিক্রিয়া জানায় না। নয়নাকে নিজের মতো বলতে হয়। অনেকক্ষণ নয়না বকবক করার পর সে বলে,
‘হয়েছে তোর কথা বলা শেষ? তাহলে এবার আমিও কিছু বলব তুই শুনে নে। আমি জানি আমি কোন অন্যায় করিনি এইজন্য আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই। যে কোন অন্যায় করে না তার সাথে খারাপ কিছু হতে পারে না। আমার সাথেও হবে না। দেখবি সব সত্য সামনে আসবে।’

নয়নাঃতুই বসে বসে ঐ স্বপ্নই দেখ। তুই তো সোহেলকে খু**ন করেছিস। তাই তো তোকে আজ জেলে আসতে হয়েছে।

ফাতেমা কৌতুহলী হয়ে বলে,
‘তুই কিভাবে এই জেলে বসে সোহেলের মৃত্যুর খবরটা পেয়ে গেলি? আর এত নিশ্চিত হয়েই বা কিভাবে বলছিস যে খু**নটা আমিই করেছি? আর সবথেকে বড় কথা হলো এটাই যেই সোহেলকে এত ভালোবেসে বিয়ে করলি তার মৃত্যুতে তোর তেমন কোন প্রতিক্রিয়াই নেই! এসব তো আমার হজম হচ্ছে না!’

ফাতেমার কথা শুনে নয়না সামান্য ঢোক গিলে বলে,
‘কি বলতে চাইছিস তুই?’

ফাতেমাঃআমি কি বলতে চাইছি সেটা তুই খুব ভালোই বুঝেছি পেরেছিস। আর যদি নাও বুঝে থাকিস সময়ের সাথে ঠিক বুঝে যাবি।

নয়না আর কথা বাড়ায় না৷ সে তো ভেবেছিল জেলে আসার পর ফাতেমা অসহায় হয়ে ভেঙে পড়বে। কিন্তু এখন দেখছে ফাতেমা তো ফাতেমাই। তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া এত সহজ নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ফাতেমা ততোই অপরাজেয় হয়ে উঠছে। ভয়হীন এবং আত্মবিশ্বাসী। এটা নয়নাকে পীড়া দিচ্ছিল। সে কি তবে সবসময় ফাতেমার কাছে এভাবেই পরাজিত থেকে যাবে? ভাবতেই রাগে নিজের চুল ছি’ড়তে ইচ্ছে হলো।

৩৯.
শ্রেয়া ও প্রত্যুষ জেলে এসেছে ফাতেমার সাথে দেখা করতে। কিন্তু নুহাশ তো তাদের সাথে দেখা করতে দিতে রাজিই ছিল না। কারণ এটা নাকি বেআইনি। পরবর্তীতে প্রত্যুষ অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে। কোর্টে যোগাযোগ করে জানায় সে ফাতেমার হয়ে কেস লড়বে তাই যেন তাকে ফাতেমার সাথে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কোর্ট পারমিশন দেওয়াতে নুহাশের আর কিছু করার থাকে না। অগত্যা তাকে রাজি হয়ে যেতেই হয়। তবে শ্রেয়া দেখা করার অনুমতি পায়না। এজন্য সে হতাশায় ডুবে যায়। প্রত্যুষ শ্রেয়াকে ভরসা দিয়ে বলে,
‘তুমি একদম চিন্তা করো না শ্রেয়া। আমার উপর ভরসা রাখো। আমি তোমার বান্ধবীর হয়ে কেইস লড়ব এবং সে যদি নির্দোষ হয় তবে অবশ্যই তাকে জেল থেকে বের করে আনব। এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’

শ্রেয়া ভরসা করে তার স্বামীর উপর। তার মনে হয় তার স্বামী পারবে সবটা ঠিক করে দিতে। ফাতেমাকে আবার ফিরিয়ে আনতে। তার এখনো মনে পরে ছোট্ট ফারিয়া কিভাবে তার কাছে এসে নিজের মায়ের জন্য কাঁদছিল। ফাহিম, মোহনা প্রত্যুষকে অনুরোধ করেছে ফাতেমার হয়ে কেইস লড়ার জন্য। প্রত্যুষও রাজি হয়ে গেছে।

প্রত্যুষ গিয়ে ফাতেমার সাথে দেখা করে। প্রত্যুষকে দেখে ফাতেমা খুশি হয়। প্রত্যুষ বলে,
‘কখনো ভাবি নি আপনাকে এই অবস্থায় দেখতে হবে। আপনার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কত সুন্দর পার্সোনালিটির মানুষ আপনি। আর শেষপর্যন্ত কিনা আপনাকে খু*- এর মামলায় ফেসে যেতে হলো!’

ফাতেমাঃআমরা সবসময় যা ভাবি তার ব্যতিক্রম ঘটনাই বেশি ঘটে।

প্রত্যুষঃযে প্রমাণের ভিত্তিতে আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেটা আমি দেখেছি। ঐ অডিও ক্লিপে আপনার প্রাক্তন স্বামী সোহেল আপনার নাম নিয়েছিল। কিন্তু এর কারণ কি হতে পারে? আপনি যদি সত্যিই এই কেইসের সাথে জড়িত না থাকেন তাহলে এসবের মধ্যে আপনার নাম কেন এলো?

ফাতেমা কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
‘অনেক বড় কোন গড়বড় আছে। আমি বিষয়টা নিয়ে কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি একটা কাজ করুন এই কেইসের যিনি তদন্ত করছিলেন মানে ইন্সপেক্টর নুহাশ খন্দকার ওনার সাথে কথা বলুন। আমার মনে হয়, পারলে উনিই এই কেইসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন। ওনার হাতে এই ক’দিনে কিছু প্রমাণ তো অবশ্যই এসেছে যা থেকে এই কেইসের ব্যাপারে কোন না কোন ক্লু অবশ্যই পাওয়া যাবে।’

প্রত্যুষ চৌধুরী বলেন,
‘একদম ঠিক বলেছেন আপনি৷ এই কথাটা আমার মাথায় আগে কেন আসেনি। আমি নুহাশের সাথেই কথা বলব।’

৪০.
প্রত্যুষ চৌধুরী নুহাশ খন্দকারের সাথে কথা বলে জানতে পারে নেহা মির্জার ব্যাপারটা। এটা তার মনে সন্দেহ জাগায়। তবে বিষয়টা নিয়ে সে বেশি দূর এগোতে পারে না।

এরমধ্যে কোর্টে দুই বার হেয়ারিং হয়৷ এবং এই দুই দিনে প্রত্যুষ চৌধুরী ফাতেমার পক্ষে তেমন কোন প্রমাণ জোগাড় করতে পারে নি যা তাকে সাহায্য করবে। অপরদিকে বিপরীত পক্ষের উকিল ফাতেমার বিপক্ষে শক্তপোক্ত প্রমাণ জাহির করে চলেছে। যার ফলে কেইস এখন অনেকটাই হাতের বাইরে। প্রত্যুষ তেমন আশা দিতে পারছে না। ফাহিম-মোহনাও একদম ভেঙে পড়েছে এসব ব্যাপার নিয়ে। তবে ফাতেমা এখনো স্থির আত্মবিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে। আজও সকালে জোহরের নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল। তার বিশ্বাস আল্লাহর উপর থেকে এক চুলও নড়েনি। ফাতেমা বিশ্বাস করে সত্যকে ছাই চাপা দিয়ে বেশিদিন রাখা যাবে না। এক দিন না একদিন ছাই উড়িয়ে সত্যটা প্রকাশিত হবেই।

৪০.
একটি অন্ধকার বদ্ধ ঘরে নেহা মির্জাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তার উপর তার চোখ কালো কাপড়ে বাধা। হাত-পাও বেঁধে রেখেছে চেয়ারের সাথে। নেহা মির্জা জানে না তাকে কে এভাবে বন্দি করে রেখেছে। সেদিন সোহেলের ঐ বিভৎস লাশ দেখার পর তার মাথা ঘুরে সে পড়ে গিয়েছিল। অজ্ঞান হওয়ার পর যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে নিজেকে এই বন্ধ ঘরে আবিষ্কার করে। নয়না অট্টহাসি নিয়ে তাকে বলেছিল,
‘আমার উপর প্রতিশোধ নিতে এসিছিলি না তুই! এবার দেখ তুই নিজে কিভাবে শেষ হয়ে যাবি। সোহেলকে আমি ইতিমধ্যেই শেষ করে দিয়েছি আর এবার তোর পালা।’

প্রতিদিন নেহা মির্জাকে এখানে একজন মানুষ এসে খাবার দিয়ে যায়। নেহা খেতে না চাইলে জোর করে তার মুখে খাবার পুড়ে দেয়। এই বন্দিজীবন আর পছন্দ হচ্ছে না নেহার। সে মুক্তি চায় এই নারকীয় জীবন থেকে। এই জন্য নেহা মির্জা ঠিক করেছে আর যাইহোক না কেন আজ সে এখান থেকে পালাবেই। তাকে কেউ আটকাতে পারবে না। আজ ঐ লোকটা খাবার নিয়ে আসতেই নেহা মির্জা তাকে কথার জালে ফাসানোর চেষ্টা করে। অনেক টাকার লোভও দেয় তাকে ছাড়ার জন্য। কিন্তু লোকটি কোন প্রতিক্রিয়া ছাড়াই নেহা মির্জাকে খাবার খাইয়ে দিতে থাকে। নেহা নানাভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করে শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয় হাল ছেড়ে দেয়। লোকটা তাকে খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। নেহা হতাশ হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। এই জীবন থেকে বুঝি আর তার মুক্তি নেই। কান্না পাচ্ছে ভীষণ।

নেহার এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ আবার কেউ এসে দরজাটা খুলে। নেহার মনে হয় ঐ লোকটা হয়তো আবার ফিরে এসেছে। নেহার কানে গোলাগুলির আওয়াজও আসে। এ পর্যায়ে সে বেশ ভয় পেয়ে যায়। এমন সময় কেউ এসে নেহার হাতের বাধন খুলে দেয়। অতঃপর নেহা নিজের চোখের বাঁধন খুলে হতবাক হয়ে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি!’

লোকটা হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, আমি। কেন অবাক হয়েছ?’

নেহা সত্যিই ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবতে থাকে এটা কিভাবে সম্ভব। এ কিভাবে এখানে এলো?

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨