অতুলনীয়া পর্ব-২২

0
50

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

সোহেলের মৃত্যুর রহস্যটা এখন দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সেদিন প্রত্যুষ চৌধুরী সেই হুডি পড়া লোকটাকে ধাওয়া করলেও তার কোন সন্ধান সে পায় নি। কিন্তু তার মনে একটা খটকা ঠিকই তৈরি হয়েছিল। সেজন্য প্রত্যুষ এই কেইসটাকে নিয়ে আরো বিষদে গবেষণা করছে। যদি ঘটনা এমন হয় যে পুরো কেইসটাই একটা মিথ্যার উপর তৈরি তাহলে তো ফাতেমা একদম নিরপরাধ। তাকে শুধু শুধু এই কেইসের মধ্যে ফাসানো হচ্ছে এবং খুব সম্ভবত এটা অনেক প্ল্যান করে করা হয়েছে। প্রত্যুষ চিন্তা করছিল কিভাবে সব রহস্য দূর করবে। অনেক ভেবে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে একা একা কিছু করতে গেলে এখন সে হয়তো সফল হবে না। তার এই কাজে কারো সাহায্যের প্রয়োজন। এমনটা ভাবতেই নুহাশের চেহারাটা ভেসে উঠল প্রত্যুষ চৌধুরীর সামনে। অতঃপর সে নিজেই বলে উঠল,
“এখন নুহাশ ভাইয়াই শুধুমাত্র পারে আমায় সাহায্য করতে। আমায় এখন নুহাশ ভাইয়ার কাছেই যেতে হবে।”

৪৩.
নুহাশ আজ ছুটি নিয়েছে। আজকের দিনটা তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আজ তার স্ত্রী অর্পার জন্মদিন। অর্পা বেঁচে থাকতে খুব ধুমধাম করে এই দিনটা পালন করত নুহাশ। তবে ৩ বছর আগে অর্পার আকস্মিক মৃত্যুতে বদলে যায় সবকিছু। যার কারণে এখন দিনটা আর নুহাশের কাছে সুখের নয় বরং শোকের। এই দিন অনাথ আশ্রমে যায় নুহাশ। সেখানে গিয়ে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে, সাথে তাদের জন্য অনেক উপহারও নিয়ে যায়।

আজও অনাথ আশ্রমে এসেছে নুহাশ। বাচ্চারা তাকে দেখেই খুশিতে মেতে ওঠে। নুহাশের হাত থেকে উপহার পেয়ে তো তারা আরো বেশি খুশি হয়। তাদের এই খুশি দেখে নুহাশ খন্দকারের মনেও খুশির সঞ্চার হয়। অর্পাও যে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটার এমন দূর্ভাগ্য যে তার কোনদিন মা হবার ক্ষমতা ছিল না৷ এইজন্যই তো নিহাকে এই অনাথ আশ্রম থেকেই দত্তক নিয়েছিল তারা দুজনে। নিহাকে নিয়ে খুব সুন্দর চলছিল তাদের সংসার। তারপর এক দমকা হাওয়া এসে সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। বদলে দিলো সব কিছু। নুহাশ সেইসব কথা চিন্তা করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে। অতীত নিয়ে ভেবে আর লাভ নেই৷ এখন ভবিষ্যতের চিন্তা করতে হবে৷ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে যা করা দরকার তাই করতে হবে। নিহাকে নিয়ে বাকিটা জীবন খুব সুন্দর করে কা’টিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখে সে।

অনাথ আশ্রম থেকে বের হতেই প্রত্যুষের সম্মুখীন হয় নুহাশ। প্রত্যুষ যেন তার জন্যই অপেক্ষাতে ছিল। নুহাশকে দেখামাত্র ছুটে এসে বলে,
“ভাইয়া, আমি জানতাম তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। তোমার সাথে ভীষণ জরুরি কথা আছে।”

“কি বলবি বল?”

“ফাতেমার কেইস সম্পর্কিত কিছু কথা।”

“হুম।”

“আমি সোহেলকে দেখেছি!”

“হোয়াট! কি বলছিস টা কি তুই? সোহেল তো মা*রা গেছে। তাহলে তুই ওকে দেখেছিস এই কথার মানে কি?”

প্রত্যুষ নুহাশকে সব কথা খুলে বলে। সব শুনে নুহাশ প্রত্যুষকে বলে,
“আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা বেশ জটিল। আমি আগেও এটাই ভেবেছিলাম। তবে আমাদের হাতে সময় খুব কম। যা করার দ্রুত করতে হবে।”

“তাহলে আমাদের নেক্সট প্ল্যান কি?”

“তুই যেখানে সোহেলকে দেখেছিলি আমায় সেখানে নিয়ে চল। তাহলে কোন না কোন ক্লু হয়তো পাবো।”

প্রত্যুষ চৌধুরী বলে,
“হ্যাঁ, সেটাই ঠিক হবে। যদিও আমি খোঁজ নিয়েছি নিজের মতো কিন্তু তুমি তো পুলিশ তাই এই ব্যাপারে তুমি আমার থেকে ভালো বুঝবে।”

“হুম, চল। ফাতেমা খাতুন যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তার সাজা হওয়া আটকানো৷ আমি যদিওবা প্রথমে ওনাকে দোষী ভেবেছিলাম কিন্তু পরে নানা ঘটনার পর দেখলাম ওনার আসলে তেমন কোন দোষ নেই৷ তাই ওনাকে সাহায্য করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।”

৪৪.
বস্তি এলাকার আশেপাশে এসে বিভিন্ন মানুষকে সোহেলের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে নুহাশ এবং প্রত্যুষ। কিন্তু কেউ তার ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারছে না। তাই দুজনকেই বেশ হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। অনেকক্ষণ অনেক জনকে বলার পর প্রত্যুষ চৌধুরী বলে,
“আমার মনে হয় না, এখানে খুঁজে আর লাভ হবে৷ চলো আমরা বরং অন্যভাবে ট্রাই করি।”

নুহাশ হার মানতে চাইলো না। সামনে থাকা একটা চায়ের দোকান দেখিয়ে বলল,
“এই চায়ের দোকানটা এখনো বাকি আছে। চল জিজ্ঞাসা করেই দেখি। যদি কোন সূত্র পাই।”

নুহাশ ও প্রত্যুষ এগিয়ে গেলো চায়ের দোকানের পাশে। নুহাশ চায়ের দোকানিকে সোহেলের ছবি দেখিয়ে বলল,
“দেখুন তো, এনাকে চেনেন কিনা? কোথাও কি দেখেছেন?”

তিনি ছবিটা ভালো ভাবে দেখে বলল,
“না, সাহেব। আমি তো দেখি নি এনাকে কোথাও।”

এমন সময় চা খেতে আসা একজন মধ্যবয়সী লোক ছবিটা দেখে বলে,
“আরে! এই লোকটাকে তো আমি দেখেছি!”

নুহাশ ও প্রত্যুষ একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের চোখেই আশা ফুটে উঠল। নুহাশ জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় দেখেছেন এনাকে চাচা? একটু মনে করে বলুন তো।”

লোকটা বলে,
“আমি একজন রিক্সাওয়ালা। রিক্সা চালিয়ে জীবনযাপন করি। তো কালকেও রিক্সা চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ এই লোক দৌড়ে দৌড়ে এসে আমার রিক্সায় এসে উঠে বসে এবং আমায় বলে জলদি রিক্সা চালানো শুরু করতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কই যাবেন উনি বললেন, জাহান্নামে। তারপর বিশ্রী কিছু গালিও দিলেন আমায়। আমিও রিক্সা চালানো শুরু করলাম।”

প্রত্যুষ চৌধুরী অস্থির হয়ে বলল,
“উনি কোথায় নেমেছিলেন জানেন আপনি? আমাদের নিয়ে যেতে পারবেন সেখানে?”

“হ্যাঁ, কেন নয়।”

নুহাশ খন্দকার বলে,
“তাহলে আমাদের এখনই নিয়ে চলুন।”

রিক্সাওয়ালা চা খাওয়া শেষ করে ওদের দুজনকে নিয়ে রিক্সায় চেপে বসল। অনেকটা দূরে গিয়ে একটা ঘিঞ্জি গলির সামনে এসে বললেন,
“উনি এই গলিতেই ঢুকেছেন।”

নুহাশ খন্দকার রিক্সাওয়ালার হাতে এক হাজার টাকার নোট দিয়ে বলল,
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”

এরপর দুজনে মিলে গলিতে ঢুকল। বিভিন্ন বাড়িতে খুঁজতে লাগল সোহেলকে। সব বাড়িতে খোঁজ নেওয়া শেষে বাকি রয় আর একটা বাড়ি। এখন শুধু সেই বাড়িতেই খোঁজ নিতে হবে। নুহাশ এবং প্রত্যুষ দুজনেই একপ্রকার নিশ্চিত যে সোহেল যদি কোথাও থাকে তাহলে এই বাড়িতেই আছে। এজন্য দুজনে চরম প্রস্তুতি নিলো। নুহাশের কাছে আত্মরক্ষার জন্য সবসময়ই বন্দুক থাকে। নুহাশ প্রত্যুষের হাতে একটা বন্দুক দিয়ে নিজের কাছে একটা রেখে দিলো। অতঃপর প্রত্যুষকে বললো,
“তুই সামনের গেটে গিয়ে ডাক দে। আমি পেছনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। আজ ওকে হাতেনাতে ধরবোই।”

প্রত্যুষ মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নুহাশও পিছনের দিকে যায়। প্রত্যুষ কিছুক্ষণ দরজা ধাক্কা দেয়। কিন্তু দরজা খোলার নামগন্ধ নেই। অনেকক্ষণ পর কেউ এসে দরজা খুলে দেয়। এটা আর কেউ নয়, সোহেল নিজেই। প্রত্যুষকে দেখেই সোহেল তৎক্ষণাৎ দরজা লাগিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু সেগুড়ে বালি। যেই না সে পিছনের দরজা গিয়ে খুলছে ওমনি নুহাশ খন্দকার তার মাথায় বন্দুক ধরে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“তোমার খেলা শেষ মিস্টার সোহেল হোসেন। অনেক নাটক করেছ, আর না। এবার তোমার সব অন্যায়ের শাস্তি ভোগার জন্য তৈরি হও। একটা নিরপরাধ মেয়েকে ফাসিয়েছ তুমি। এবার তাকে মুক্তি দিয়ে তোমায় জেলে ভড়ব। হ্যান্ডস আপ।”

সোহেল হাত দুখানা তোলে। সেও বুঝে যায় তার আর পালানোর পথ নেই। এখন তার সব কীর্তি সবার সামনে আসবে। সব রহস্যের উন্মোচন ঘটবে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨