অতুলনীয়া পর্ব-২৮

0
61

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমার জীবনে সমস্যা যেন শেষ হতে চায়না। একটার পর একটা সমস্যা লেগেই গেছে। এই যেমন নয়নার সমস্যা মিটে যেতেই তার জীবনে এসে জমা হয়েছে আরেকটা সমস্যা। ইদানীং ফারিয়া ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ সময় গায়ে জ্বর থাকে, পেটেও নাকি ব্যাথা। প্রথমে ফাতেমা সামান্য জ্বর ভেবেছিল কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সমস্যাটা জটিল। তাই ফাতেমা ভাবছে আজ ফাতেমাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাবে। কারণ এছাড়া ফারিয়াকে বাঁচানোর আর কোন উপায় যে তার হাতে নেই।

ফারিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে এলো ফাতেমা। ডাক্তারঃঅনুস্কা চৌধুরী একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তিনি ফারিয়ার বিভিন্ন চেকআপ করলেন। অতঃপর ফাতেমাকে বললেন,
“আমি যেটা সন্দেহ করছি সেটা না হলেই খুশি হবো। আপাতত আপনি সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখুন আর প্রার্থনা করুন যেন বড় কোন অসুখ নাহয়।”

“আপনি কি সন্দেহ করছেন ডাক্তার চৌধুরী? আমার মেয়ের বড় কোন অসুখ হয় নি তো?”

“দেখুন, আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের সব কিছুই ভীষণ স্পর্শকাতর। তবে আমি আপনাকে এখনই নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছি না। আগে রিপোর্ট আসুক..রিপোর্ট দেখার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।”

ফাতেমা ফারিয়াকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে। ফারিয়া যে এই ক’দিনের অসুস্থতায় ভীষণ ভাবে নেতিয়ে পড়েছে। ফাতেমা ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,”তোর কিছু হবে না, মা। তুই যে এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। আমি তোর কোন ক্ষতি হতে দেব না,কিছুতেই না।”

এমন ভাবনা থেকেই ফাতেমা ফারিয়াকে আরো জোরে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে। অতঃপর বাসার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকে যেন ফারিয়ার তেমন কোন বড় অসুখ না হয়। এটা যেন সামান্য কিছু হয়। যেটার চিকিৎসা করে ভালো করা সম্ভব নয়। নাহলে যে এই পৃথিবীতে ফাতেমা একদম একা হয়ে পড়বে। মেয়ে ছাড়া যে সে অনেক বেশি অসহায়। তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার মেয়ে।

ফাতেমা ফারিয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরে তাকে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে,”চিন্তা করিস না,তোর মা সবসময় তোর পাশে আছে। আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও তোকে বাঁচতে হবে।”

৫৫.
নুহাশ খন্দকার পড়েছে মহা ঝামেলায়৷ তার মা নাজমা খাতুন অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাকে নিয়ে সবসময় এখন হাসপাতালে যাওয়া আসা করতে হয়। তার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। নাজমা খাতুন এই ব্যাপারটা জানার পর থেকে আহাজারি করে চলেছেন। তার মনে হচ্ছে তার কিছু হয়ে গেলে এই সংসারটা ভেসে যাবে। এজন্য তিনি বেঁচে থাকতেই তার দুই ছেলের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে চান। নাজমা খাতুনের ছোট ছেলে নাঈম মায়ের বাধ্য ছেলে। তাই তাকে নিয়ে তার কোন চিন্তা নেই। তবে নাজমা খাতুনের মূল চিন্তা তার বড় ছেলে নুহাশ খন্দকারকে নিয়ে। নাজমা খাতুন চান নুহাশ আবার নতুন করে জীবনটা শুরু করুক। কিন্তু নুহাশ তো একদম যাকে বলে নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই এসব কথা শুনতে নারাজ। তাই নাজমা খাতুন আজ অন্য উপায় বের করলেন। ভালো কথা বলে যখন ছেলেকে রাজি করানো যাবে না তখন অন্য ভাবে কাজ করতে হবে। তার মুখে ক্রুর হাসি। এবার ছেলেকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে হলেও তিনি রাজি করাবেন।


রাতে নুহাশ খন্দকার বাড়ি ফেরার পর তার ছোট ভাই নাঈম খন্দকার এসে তাকে বলে,
“জানো ভাইয়া, মা ভীষণ জেদ করে বসে আছে। ডাক্তার বলেছে মাকে নিয়মিত ওষুধ খেতে। কিন্তু মা ওষুধ খাচ্ছেই না।”

নুহাশ ফোস করে শ্বাস নেয়। এমনিতেই একটা জটিল কেইস নিয়ে তার জীবন জেরবার তার উপর এখন এসব নতুন ড্রামা। তার আর সহ্য হচ্ছে না এসব। নুহাশ তার মায়ের ঘরে প্রবেশ করেই বলে,
“মা..তুমি এসব কি ড্রামা করছ? সারাদিন নাকি ওষুধ খাওনি? এসবের মানে কি?”

“আমি তোর মা। আমার উপর একদম চড়া গলায় কথা বলবি না। তুই আমার কথা শুনিস যে আমি তোর কথা শুনব?”

নুহাশ এবার একটু নরম স্বরে বলে,
“তুমি কি চাও মা?”

“আমি চাই, তুই আবার নিজের জীবনটা নতুন করে শুরু কর। আবার বিয়ে কর তুই।”

“বিয়ে কি আমাকে করতেই হবে?”

“তোর ইচ্ছে..কিন্তু তুই রাজি না হলে আমিও ওষুধ খাবো না।”

“বেশ, তুমি যখন আদাজল খেয়ে পড়েছ আমাকে বিয়ে দেবার জন্য তখন আমি তোমার ইচ্ছাই পূরণ করি। তবুও তুমি এসব পাগলামী বন্ধ করো।”

“সত্যি তুই বিয়ে করবি?”

“না করে উপায় আছে?”

বলেই নুহাশ ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো। সে ঘর থেকে বেরোনোর পর ঘরে প্রবেশ করলো নাঈম। নাঈমকে দেখেই নাজমা খাতুন হেসে বললেন,
“পরিকল্পনা সফল। দাওয়াই কাজ করেছে। এবার তুই জলদি তোর বড় ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে দে।”

এদিকে নুহাশ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বসে পড়ে। হঠাৎ অর্পার মুখশ্রী ভেসে ওঠে তার সামনে এবং সে ঘামতে থাকে।

৫৬.
ডাক্তার অনুস্কা চৌধুরীর সামনে বসে আছে ফাতেমা। সে আজ এসেছে ফারিয়ার রিপোর্ট নিতে। অনুস্কা চৌধুরী হতাশ হয়ে রিপোর্ট দেখছেন। ফাতেমার শ্বাসক্রিয়া যেন বন্ধ হবার উপক্রম। ফাতেমা বলে,
“কি হয়েছে ডাক্তার? আমার মেয়ের কি বড় কোন সমস্যা হয়েছে?”

অনুস্কা চৌধুরীঃযেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই ঠিক। আপনার মেয়ের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে।

ফাতেমা হতবাক। এত বড় ধাক্কার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তাহলে কি তার সব প্রার্থনা বিফলে গেল। ফাতেমা নিজের চোখের জল মুছে বললো,
“না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এখন কি উপায় আছে ডাঃচৌধুরী?”

“যা অবস্থা তাতে কিডনি প্রতিস্থাপন করা ছাড়া কোন উপায় নেই।”

ফাতেমা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“আপনি প্রয়োজনে আমার কিডনি নিয়ে আমার মেয়েকে বাঁচান।”

অনুস্কা চৌধুরীঃদেখুন..এভাবে কিছু হয় না। মানুষের দুটো কিডনি আছে। এরমধ্যে একটা কিডনি নিয়েই আজীবন বেঁচে থাকা সম্ভব সুস্থভাবে। তবে সমস্যাটা সেটা নয়। সে কেউ এভাবে কিডনি দিতে পারে না। এজন্য টিস্যু মিস করতে হয়। এছাড়া নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ টিস্যু দিতেও পারে না।

ফাতেমার কাছে সবটা এলোমেলো লাগছিল। সে বলে,
“আপনি আমার কিডনি চেক করে দেখুন আমার মেয়ের সাথে মেলে কিনা। যদি মেলে তাহলে আমার কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করুন।”

“আপনি একটু ধৈর্য ধরুন। আমি ব্যবস্থা করছি।”


ফাতেমা হতাশ মুখে বসে আছে ডাক্তার অনুস্কার সামনে। তার কিডনির টিস্যুর সাথে ফারিয়ার টিস্যু মেলে নি। ফাতেমা বড্ড হতাশ। ডাক্তার অনুস্কা চৌধুরী বলেন,
“এতে অবাক হবার কিছু নেই। কিডনির টিস্যুর ব্যাপারটা রক্তের গ্রুপের মতো নয় যে ফ্যামিলির সাথে মিল থাকবে। বরঞ্চ এক্ষেত্রে আত্মীয় সম্পর্কহীন মানুষের সাথে টিস্যু মিলে যায়। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, বাংলাদেশী আইন অনুসারে নিকটাত্মীয় ছাড়া আর অন্য কারো টিস্যু নেয়া সম্ভব নয়।”

“তাহলে এখন উপায়?”

“জানি না।”

ফাতেমা পুনরায় হতাশ। এমন সময় একজন নার্স এসে বলে,
“ম্যাডাম ফারিয়া জাহানের কিডনির টিস্যুর সাথে তো একজনের টিস্যু মিলে গেছে। কিছু দিন আগে যে একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন চেক করতে।”

“কি বলো? তাই নাকি?”

ফাতেমা যেন আশার আলো খুঁজে পায়। বলে,
“কে তিনি?”

“নামটা তো ঠিক মনে নেই।”

অনুস্কা চৌধুরীঃমিলে গেলেও তো কিছু করার নেই। কারণ ওনার সাথে ফারিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। তাই বাংলাদেশের আইন অনুসারে কিডনি ট্যান্সপ্ল্যাট সম্ভব নয়।

ফাতেমার মনে জাগ্রত হওয়া আশার আলোটা যেন আবার নিভে যায়। সে এখন সম্পূর্ণ পথভ্রষ্ট। কি করা যাবে সামনে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। তাহলে কি এখন নিজের মেয়েকে তার হারাতে হবে? নাকি আল্লাহ কোন পথ বের করে দেবেন?

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨