#অতুলনীয়া
#পর্বঃ২৯
#লেখিকাঃদিশা_মনি
ফাতেমা আজ যে সত্য জানতে পারল সেটা জানার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফারিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন বেশি ভালো না এবং আর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে ফারিয়াকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এই খবর জানার পর ফাতেমা দিশেহারা। মেয়েকে নিয়েই তার জীবন। সেই মেয়ের জীবনই এখন কিনা এমন ঝুঁকির মধ্যে!
ফাতেমার হাতেও এখন যেন কোন উপায় নেই। কারণ ফাতেমা, তার ভাই ফাহিম এবং মোহনা এদের কারো সাথে ফারিয়ার কিডনির টিস্যু মেলে নি। এখন তার একমাত্র ভরসা সোহেল। এমন হতে পারে যে সোহেলের সাথে মিলল। কিন্তু সোহেল কি রাজি হবে ফারিয়াকে কিডনি দিতে? ফাতেমার মনে সন্দেহ। অনেক ভাবল এই বিষয়টা নিয়ে। অনেক ভেবে সে দেখলো সোহেল মানুষ হিসাবে যেমনই হোক সে তো ফারিয়ার জন্মদাতা পিতা। তাই নিজের মেয়ের এই অবস্থার কথা শুনে নিশ্চয়ই সে কিডনি দিতে দ্বিমত পোষণ করবে না।
এই বিষয় নিয়ে ফাহিমের সাথে কথা বললো ফাতেমা।
ফাতেমাঃভাইয়া, ফারিয়াকে বাঁচানোর জন্য এখন আমার হাতে আর কোন উপায় নেই। এখন হয়তো কেবলমাত্র সোহেলই আমাদের এরকম পরিস্থিতি থেকে বের করতে পারে।
ফাহিমঃএসব তুই কি বলছিস ফাতেমা? তুই আবার ঐ শয়তানটার কাছে সাহায্য চাইতে যাবি?
ফাতেমাঃএছাড়া যে আমার কাছে আর কোন উপায় নেই ভাইয়া। আমার মেয়ের জীবনটা তো আমাকে বাঁচাতে হবেই!
ফাহিমঃশোন, তুই এত চিন্তা করিস না। আমি কোন না কোন উপায় বের করছি।
ফাতেমাঃআর তো মাত্র এক সপ্তাহ। এর মাঝে আর নতুন কি উপায় পাওয়া যাবে?
এরইমধ্যে মোহনা উপস্থিত হয়ে বলে,
“কিন্তু সোহেলের সাথে যে ফারিয়ার কিডনির টিস্যু মিলবে এমনটাও তো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।”
ফাতেমা অসহায় কন্ঠে বলল,
“কিন্তু একটা শেষ চেষ্টা তো করতে হবে ভাবি। মানুষ যখন ঢুবে যেতে ধরে তখন তো খড়কুটো আগলেই বাঁচতে চায়।”
ফাহিম বলল,
“তুই যা ভালো মনে করিস কর। আমি আর তোকে বাঁধা দিব না। যদি ফারিয়াকে বাঁচানোর জন্য এছাড়া আর কোন উপায় না থাকে তাহলে তাই করা হোক।”
ফাতেমার চোখে জল। পরিস্থিতি কেন আবার তাকে এমন জায়গায় এসে দাঁড় করালো?
৫৭.
নুহাশ খন্দকার উদাস মনে থানা থেকে বের হলো। মায়ের জোরাজুরিতে এবার হয়তো তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করতেই হবে। নুহাশ খন্দকার মোটেও এই জন্য প্রস্তুত নয়। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে নয়। জোরে একটা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে গাড়িতে চড়ে বসলো নুহাশ। এখান থেকে এখন হাসপাতালে যেতে হবে। কিছুদিন আগে নিজের কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিল তার রেজাল্ট আজ আসবে।
নুহাশ খন্দকার হাসপাতালে উপস্থিত হলো। তারপর ডাক্তারের চেম্বারে এলো। ডাক্তার নুহাশের হাতে তার রিপোর্ট তুলে দিয়ে বললো,
“আপনার কিডনিতে কোন সমস্যা নেই।”
নুহাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এমন সময় একজন নার্স এসে বললো,
“স্যার, ফারিয়া জাহানের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আপনি কাইন্ডলি একটু ওর কেবিনে চলুন।”
ফারিয়া নামটা কেমন জানি চেনা চেনা মনে হলো নুহাশের। সে মনে করার চেষ্টা করলো কোথায় নামটা শুনেছে। এদিকে ডাক্তার সাহেব নার্সের কথা শুনে চলে গেলেন ফারিয়াকে দেখতে। ফারিয়াকে কিছুদিন ধরে হাসপাতালেই ভর্তি রাখা হয়েছে।
নুহাশ খন্দকার নিজের কৌতুহল মেটানোর জন্য ডাক্তারের পেছনে গেল। ফারিয়াকে দেখামাত্রই তো সে চূড়ান্ত অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বললো,
“এই মেয়েটা তো…মিস ফাতেমা খাতুনের মেয়ে। ওর কি সমস্যা হতে পারে?”
নুহাশ খন্দকার সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই নার্স তার পাশে এসে বলে,
“জানেন মেয়েটার বয়স মাত্র ৫ বছর। এখনো ওর দুনিয়ার অনেক কিছু দেখা বাকি। কিন্তু…ওর মায়ের ও ছাড়া আর কেউ নেই জানেন? আমার তো ওর মায়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগে। মেয়েকে ছাড়া কিভাবে বাঁচবেন? নিজের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য কত চেষ্টা করছেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ওনার আপনজনদের কারো সাথেই টিস্যু মিলে নি। তবে একটা ব্যাপার, আপনার সাথে কিন্তু এই মেয়েটার কিডনির টিস্যু ম্যাচ করেছে। কিন্তু..তাতে কি ফায়দা? আপনি তো এই মেয়েটার কেউ নন। তাই আইন অনুসারে আপনি ওকে কিডনি দিতেও পারবেন না।”
নুহাশ খন্দকার নার্সের দিকে একপলক তাকিয়ে আবার ফারিয়ার দিকে তাকায়। তার মাথায় এখন কিছু চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।
৫৮.
ফাতেমা এসে উপস্থিত হয়েছে সোহেলের কারাগারের সামনে। সোহেল ফাতেমাকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রয়। উঠে বসে সে বলে,
“আরে..আমি কি স্বপ্ন দেখছি? ফাতেমা তুমি এখানে কি করছ? হঠাৎ এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ার কারণ?”
ফাতেমা অসহায় সুরে বললো,
“আমার তোমাকে প্রয়োজন সোহেল।”
সোহেলের অবাক হবার পালা। কপট হেসে বললো,
“কি বললে আবার বলো? তোমার আমাকে দরকার! হাউ ফানি!”
“আমাদের মেয়ের অবস্থা ভালো না, সোহেল। ওর..ওর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে এক সপ্তাহের মধ্যে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা না গেলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কিন্তু আমার বা আমার পরিবারের কারো সাথে ওর কিডনির টিস্যু মেলে নি। তুমি তো ওর বাবা, তোমার সাথে মিলতে পারে।”
“তো? আমি কি করব? আমার নিজের জীবনের অনেক মায়া। আমি নিজের কিডনি কাউকে দিতে পারব না।”
“তুমি এরকম কথা কিভাবে বলছ সোহেল? ও আমাদের মেয়ে। আর তাছাড়া একটা কিডনি দিয়ে খুব সুন্দরভাবে আজীবন বেঁচে থাকা যায়।”
“আমাদের না, ও শুধু তোমার মেয়ে। আর এই কথাটা তুমিই আমাকে বলেছিলে।”
“আজ এই বিপদের দিনেও তুমি এমন করবে সোহেল?”
“না, আমি এমন করতে চাই না। আমারও ইচ্ছা করছে ফারিয়াকে বাঁচাতে। কিন্তু এতে আমার কি লাভ?”
“লাভ? কি লাভ চাও তুমি নিজের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য?”
“লাভ ছাড়া তো পৃথিবীতে কিছুই হয়না।”
“তো বলো না কি চাও তুমি।”
“বেশি কিছু না। শুধু এটুকুই চাই যে,তুমি আমার উপর থেকে সব কেইস তুলে নেও। আমাকে এই জেলের বাইরে বের করো। আর..”
“আর কি?”
“ফারিয়ার সব অধিকার ছেড়ে দাও। কারণ আমি চাই, ফারিয়া সুস্থ হবার পর ও আমার সাথে থাকুক।”
“সোহেল..এসব কি বলছ তুমি? আমার মেয়ের থেকে তুমি আমাকে আলাদা করবে?”
“এখন তুমিই ভেবে দেখো কি করবে। নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চাইলে তুমিই কোন ব্যবস্থা করো,আমি ওকে কিডনি দিতে পারবো না।”
ফাতেমা অসহায়। মেয়েকে যে তার বাঁচাতেই হবে। তাই অশ্রুসজল চোখে বলে,
“বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে। তোমার উপর থেকে আমি সব কেইস তুলে নেব। আমার মেয়েকেও আমি তোমার অধিকার দিয়ে দেব। শুধু তুমি আমার মেয়েটাকে বাঁচাও কিডনি দিয়ে। আমি আর কিছু চাই না কিছু না।”
“বেশ, আমার পছন্দ হয়েছে তোমার প্রস্তাব।”
✨
ফাতেমা উদাস মনে জেল থেকে বের হয়ে এলো। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়েকে কি তাহলে তার হারাতেই হবে? কিন্তু এছাড়া যে তাকে বাঁচানোর আর কোন উপায়ও নেই ফাতেমার হাতে। ফাতেমা এখন অনেকটাই অসহায়। এমন হতাশার মাঝেই হঠাৎ কোথা থেকে যেন নুহাশ খন্দকার এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তাকে দেখে ফাতেমা থমকে গেল কিছুক্ষণের জন্য। নুহাশ খন্দকার হালকা শ্বাস ফেলে বললো,
“আমার আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে মিস ফাতেমা।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨