অতুলনীয়া পর্ব-৩১

0
54

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩১
#লেখিকাঃদিশা_মনি

বিয়ের পর নুহাশের হাত ধরে খন্দকার বাড়িতে পা রাখল ফাতেমা। এখন থেকে এখানেই তার নতুন সংসারের ভীত রচনা করতে হবে। বাড়িতে প্রবেশ করেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল ফাতেমা। আজ থেকে তার জীবনের সম্পূর্ণ নতুন একটা অধ্যায়েরও সূচনা ঘটল। কখনো ভাবে নি সে, এভাবে দ্বিতীয় বার জীবনকে সুযোগ দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুযোগটা দিতেই হলো, তাও নিজের মেয়ের জন্য।

এদিকে ফাতেমাকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে নাজমা খাতুন বেশ খুশি। নিজ দায়িত্বে ফাতেমাকে গোটা বাড়ি ঘুরে দেখাতে লাগলেন। হঠাৎ একটি ছবির সামনে এসে তিনি থেমে গেলেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ফাতেমা খুটিয়ে দেখতে লাগলো ছবিটা। শাড়ি পরিহিতা, শুভ্র বর্ণের এক অতীব সুন্দরী মহিলা। বয়স ২৫-২৬ হবে৷ নাজমা খাতুন বলে উঠলেন,
“এটা নুহাশের প্রথম স্ত্রী অর্পা শেহেনাজের ছবি। মেয়েটা বড্ড ভালো ছিল। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল..”

বলেই চোখের জল মুছলেন তিনি। ফাতেমা গতকালই নুহাশ খন্দকারের থেকে তার প্রথম স্ত্রীর ব্যাপারে জেনেছে। যতদূর শুনেছে কোন এক দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে এর থেকে বেশি কিছু সে জানে না৷ এরই মাঝে নিহা ছুটে চলে এলো সেখানে। আচমকা ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি তো এখন থেকে আমার নতুন মা, তাই না। আমাকে আদর করবে না?”

ফাতেমা কোলে তুলে নিলো ছোট্ট নিহাকে। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“অবশ্যই করবো।”

নাজমা খাতুন ফাতেমাকে বলেন,
“নিহাকে নুহাশ ও অর্পা অনাথ আশ্রম থেকে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওর প্রতি ভালোবাসার কোন কমতি রাখে নি। একদম নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করেছে। আশা করি, তুমিও এই মাসুম মেয়েটিকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসা দেবে ফাতেমা।”

ফাতেমা সহাস্যে বলে ওঠে,
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। নিহাও এখন থেকে আমার মেয়ে। আমি ওকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসা দেব যতটা আমি ফারিয়াকে দেই। আমি আল্লাহর কাছে ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ যে উনি আমাকে নিহার মতো এত মিষ্টি বাচ্চার মা বানিয়ে দিলেন।”

ফাতেমার এমন কথায় সন্তুষ্ট হলেন নাজমা খাতুন। নাঈম দূর থেকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিল ফাতেমা। সেই দৃষ্টি ফাতেমার নজর এড়ায় না। ফাতেমা যতদূর জানে, এই ছেলেটা নুহাশের ছোট ভাই মানে সম্পর্কে তার দেবর। এর আগে তার সাথে কোনদিন সাক্ষাৎ হয়নি। তার এমন অদ্ভুত দৃষ্টি তাই ফাতেমার কাছে যথেষ্ট অস্বস্তির কারণ হয়।

৬১.
আজ ফারিয়ার কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ডেট। স্বাভাবিক ভাবেই সকাল থেকে ভীষণ চিন্তায় ছিল ফাতেমা। সকল আইনি জটিলতা কাটিয়ে আইনত নুহাশ এখন ফারিয়ার বাবা। তাই এখন তাকে কিডনি দিতেও কোন আইনি বাধা নেই।

অটিতে অপারেশন চলছে আর বাইরে ফাতেমা বসে প্রহর গুণছে। তার পাশেই বসে ফাহিম এবং নাঈম। নাঈম ফাতেমাকে ভরসা দিয়ে বলে,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না, ভাবি। দেখবেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

ফাতেমা নাঈমের দিকে একটু তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কেন জানি ছেলেটাকে তার কাছে ভীষণ অদ্ভুত লাগে। তার কথাবার্তা, আচরণ কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়। ফাতেমার সাথে কথা বলার সময় এমন ভাবে কথা বলে যেন কত দিনের পরিচিত। অথচ ফাতেমা তার সাথে এখনো সেভাবে কথা পর্যন্ত বলে নি।

এরইমধ্যে অটি থেকে একজন ডাক্তার বের হয়ে আসে। তিনি বের হতেই সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরে। ফাতেমা জানতে চায়,
“ভেতরের অবস্থা কেমন?”

ডাক্তার উত্তরে বলেন,
“সবকিছু একদম ঠিকঠাক। অপারেশন সাকসেসফুল। আর কয়েক ঘন্টা পড়েই ওনাদের জ্ঞান ফিরবে। আপনারা চাইলে তখন দেখা করতে পারবেন।”

ফাতেমা আশংকামুক্ত হয়। তার মানে সব বিপদ এখন কে’টে গেছে। ফাতেমা মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায়৷ নাঈম বলে ওঠে,
“দেখেছেন ভাবি, আমি বলেছিলাম না সব ঠিক হয়ে যাবে। আলটিমেটলি কিন্তু সব কিছু ঠিকই হলো।”

বলে রহস্য জনক ভাবে হাসে। যেই হাসি ফাতেমাকে বেশ অবাক করে। তবে ফাতেমা সেদিক থেকে নজর হটিয়ে নজর দেয় ফারিয়ার দিকে। মেয়েটার বিপদ কে’টে গেছে। নুহাশ খন্দকারও একদম ঠিক আছে। আপাতত এসব কিছুই তার স্বস্তির কারণ। কোন একটা অঘটন ঘটে গেলে সে নিজের কাছে ভীষণ ভাবে অপরাধী হয়ে যেত। তবে সৃষ্টিকর্তা এমনটা হতে দেন নি।

ফাহিম বলে,
“তুই তো সকাল থেকে কিছু খাসনি। চল কিছু খেয়ে নিবি।”

“হ্যাঁ, চলো।”

ফাহিম নাঈমকেও আসতে বলে। নাঈম এক কথায় রাজি হয়ে যায়।

৬২.
২ মাস পর,
দেখতে দেখতে দুই মাস অতিবাহিত হয়েছে। ফাতেমা এবং নুহাশ দুজনেই এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ফাতেমা-নুহাশের সংসারও এখন আর চার-পাঁচটা এরেঞ্জ ম্যারেজ ঘটা ফ্যামিলির মতোই। স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বিদ্যমান তাদের মাঝে। না তো মাখোমাখো ভালোবাসা আর না তো ঝগড়া-ঝামেলা।

নিহা ও ফারিয়াকে দেখে মনেই হবে না তারা নিজেদের বোন নয়। সারাদিন ভীষণ ভাবে মিলেমিশে থাকে দুজনে। নাজমা খাতুনও এসব দেখে খুশি৷ যাক, অবশেষে সংসারে আবার শান্তি ফিরে এসেছে।

তবে আজকের দিনটা একটু অন্যরকম। আজ অর্পার মৃত্যুবার্ষিকী। ২ বছর আগে এই দিনেই অর্পার মৃত্যু ঘটেছিল। এই ক”দিনে অর্পার ব্যাপারে অনেক কথাই জেনেছে ফাতেমা। অর্পা ছিল ভীষণ স্বাধীনচেতা এবং সাহসী একজন সাংবাদিক। যে ছিল সত্যের পথে অবিচল। অকুতোভয় অর্পা কখনোর অন্যায়ের সাথে আপোস করত না। অর্পা ছিল একটি অনাথ মেয়ে, যে মামার সংসারে বড় হয়। একই ভার্সিটিতে পড়ার সুবাদে নুহাশের সাথে পরিচয় থেকে প্রণয় এবং তার পরবর্তীতে দুজনে গাটছড়া বাধে। তাদের সংসারও ছিল ভালোবাসায় ভরপুর। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে না অতিরিক্ত সুখ মানুষের সহ্য হয়না। এক নারী পাচার চক্রের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ এবং তাদের এই অন্যায় সবার সামনে আনার চেষ্টার মাশুল দিতে হয় অর্পাকে। অকালে নিজের প্রাণটা দিতে হয় তাকে।

অর্পার ব্যাপারে সব শুনে তার প্রতি ভীষণ শ্রদ্ধাবোধ জাগে ফাতেমার৷ এমন সাহসী নারীই তো সমাজের অতুলনীয়া ব্যক্তিত্ব। যাদের জন্য এই পাপে ভরা সমাজ এখনো টিকে আছে। তবে অধিকাংশ সময় অন্যায় জিতে গিয়ে হারিয়ে দেয় ন্যায়কে। এক্ষেত্রেও তারই প্রতিফলন ঘটেছে।


নুহাশ খন্দকার এমনিতে সারাদিন ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও আজ ব্যতিক্রম। অর্পার কথা মনে করে আজ তার মন এতটাই ভারাক্রান্ত যে থানায় না গিয়ে সে বাসায় বসে আছে। কোন কিছুই আর ভালো লাগছে না। অর্পার ছবির দিকে তাকিয়ে সে ভারাক্রান্ত সুরে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দিও অর্পা। তোমার মৃত্যুর দুই বছর পরেও আমি তোমার খু**নিদের খুঁজে বের করতে পারিনি, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে পারিনি। আমি একজন ব্যর্থ স্বামী, একজন ব্যর্থ পুলিশ অফিসার যে তার স্ত্রীকে ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে পারে না।”

এমন সময় ফাতেমা রুমে প্রবেশ করে। সে এসেই নুহাশ খন্দকারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আপনি চিন্তা করবেন না, অন্যায় কোনদিন চাপা থাকে না। অর্পা আপুর সাথে যা হয়েছে তার সবকিছুই একদিন সবার সামনে আসবে। সবাই একদিন সত্যটা জানবে দেখে নিয়েন।”

“জানো, ফাতেমা। যারা অর্পাকে খু**ন করেছে তাদের আমি আইনের হাতে তুলে দিতে চাই না, নিজের হাতে তাদের শাস্তি দিতে চাই। তারা ভীষণ জঘন্য মানুষ। তারা যে শুধু অর্পাকেই মে**রেছ তাই না। তারা আরো অনেক অন্যায় করেছে। এটা এমন এক চক্র যারা দেশের হাজার হাজার নারীকে বিদেশে পাচার করে এমনকি অনেক শিশুকেও। তুমি ভাবতে পারছ কতটা জঘন্য এরা। আর এই সবকিছুর আড়ালে আছে মিস্টার এক্স নামের একজন। যাকে কেউ কখনো দেখেনি, কেউ তার ব্যাপারে কিছু জানে না। অথচ সেই পর্দার আড়ালে এত জঘন্য কাজ করে বেড়াচ্ছে।”

ফাতেমা নুহাশের সব কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। তবে ফাতেমা শুধু আরো না, আরো একজন তাদের সব কথা আড়াল থেকে শোনে। যারা তারা বুঝতেও পারে না। সঠিক সময় ছায়াটি সরে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨