অতুলনীয়া পর্ব-৩২

0
54

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ফাতেমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে অর্পার ছবির দিকে। নুহাশ সারাটা দিন অর্পার কথা ভেবে দুঃখবিলাস করছে। স্ত্রী হিসেবে ফাতেমার এতে খারাপ লাগার কথা কিন্তু তার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। কারণ অর্পাকে সে হিংসা করে না। যেই মানুষটা আর এই পৃথিবীতে নেই তাকে শুধু শুধু হিংসা করে কি হবে? তাছাড়া নুহাশ খন্দকার তো আর সবসময় অর্পা অর্পা করেন না। আজ অর্পার মৃত্যুবার্ষিকী শুধু সেই কারণেই এমন করছে।

ফাতেমা নিজের রুমে এসে চুপ করে শুয়ে রয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বের হতেই নাঈমের সাথে দেখা। নাঈম বরাবরের মতো অদ্ভুত ভাবে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ফাতেমা নাঈমকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে নাঈম ফাতেমার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার আছে ভাবি।”

“হ্যাঁ, বলো।”

” কথাটা যদিও অর্পা ভাবির ব্যাপারে তবে আমার মনে হয় এই কথাটা আপনারও জানা প্রয়োজন।”

ফাতেমা মনযোগ দিলো নাঈমের দিকে। নাঈম বলল,
“অর্পা ভাবির জীবনের শেষ দিনগুলো একদম সুখের ছিল না। যেদিন ভাবির মৃত্যু হয় সেদিন ভাবি আমাকে বলেছিল, আমাদের ঘরের ড্রয়ারে আমার লেখা ডায়েরি রয়েছে। আমার মনে হয়, আমি খুব শীঘ্রই বড় একটা বিপদে পড়তে চলেছি। আমার কিছু হয়ে গেলে তুমি ঐ ডায়েরিটা পড়ো। তাহলে অনেক সত্য সম্পর্কে জানতে পারবা।”

ফাতেমা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“তো পরে তুমি ঐ ডায়েরি পরে কি জানতে পেরেছিলে?”

নাঈম হতাশ গলায় বলে,
“পরবর্তীতে আমি আর ডাইরিটা পড়তে পারিনি। কারণ ঐ ড্রয়ারের চাবিটা ভাইয়ার কাছে। ভাইয়াকে আমি বলেছিলাম চাবির কথা। কিন্তু ভাইয়া আমায় দেয় নি। বলেছিল,ব্যাপারটা ভাইয়া দেখে নেবে। কিন্তু এতগুলো দিনেও ভাইয়া ভাবির মৃত্যুর কেইসের কোন সমাধান খুঁজে পায়নি অথচ ভাবি বলেছিল ঐ ডায়েরি পড়লেই সব ক্লিয়ার হবে।”

ফাতেমার কাছেও ব্যাপারটা খটকার লাগলো। নুহাশ খন্দকারকে দেখে তো মনে হয় তিনি নিজের প্রথম স্ত্রীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তখনও কিরকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ লাগল তাকে নিজের প্রথম স্ত্রীর খু**নিদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু প্রমাণ যদি তার হাতেই থাকে তাহলে সে কেন কিছু করছে না।

ফাতেমা ভাবলো এবার সে সত্যটা বের করেই আনবে৷ যে করেই হোক অর্পার লেখা সেই ডায়েরিটা সে খুঁজে বের করবেই এবং সেখান থেকে সত্য উদঘাটন করবে।

“আচ্ছা,আমি যদি তোমার ভাইয়ের কাছে সরাসরি চাবিটা চাই সে কি দেবে?”

ফাতেমার প্রশ্নের জবাবে নাঈম বলে,
“আমি এবং মা অনেকবার চেয়েছি কিন্তু ভাইয়া দেয়নি। কারণ ভাইয়ার ভাষ্যমতে ঐ ড্রয়ারে সে ভাবির স্মৃতি যত্ন করে রেখেছে। তাই সে চায়না ওসব অন্য কেউ হাত দিক।”

ফাতেমার এবার কেমন জানি অনুভূতি হলো। তাহলে সেও সরাসরি চাইলে তাকে না করে দেবে। কৌশলে ড্রয়ারের চাবি খুঁজে তারপর যা করার করতে হবে ভেবে নিলো ফাতেমা।

৬৩.
ফাতেমা নুহাশের রুমে এসে তন্নতন্ন করে অর্পার ড্রয়ারের চাবি খুঁজছিল৷ কিন্তু কোন লাভ হলো না। ফলাফল শূণ্য দেখে ফাতেমা হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। এমন সময় নুহাশ খন্দকার রুমে এলো। রুমের এমন এলোমেলো অবস্থা দেখে বললো,
“ঘরের এমন অবস্থা কেন?”

“আমি ঘর পরিস্কার করতে এসেছিলাম।”

“পরিস্কার করতে এসে তো গোটা ঘরটা নোংরা করে দিলে।”

তাচ্ছিল্য হেসে বললো নাঈম। ফাতেমা বললো,
“আমি এক্ষুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি।”

বলে সামনে আগাতে গিয়ে হোচট খেতে পরে যেতে লাগলো। এমন সময় নুহাশ তাকে ধরে ফেলল। দুজনে একে অপরের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। সময় যেন থেমে গেছে। দুজনের হৃদস্পন্দন দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগলো।

ফাতেমা স্বাভাবিক হয়ে উঠে দাঁড়ালো। নুহাশ খন্দকার বলল,
“দেখে চলবেন তো। এক্ষুনি কি বড় বিপদ হতে যাচ্ছিল।”

ফাতেমা দুঃখ প্রকাশ করে। নুহাশ রুম থেকে বের হবার সময় ফাতেমা লক্ষ্য করে নুহাশ খন্দকার দেয়ালে টাঙানো অর্পার ছবির পেছনে কিছু একটা রেখে দেয়। ব্যাপারটা ফাতেমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। নুহাশ খন্দকার রুম থেকে বেরিয়ে গেলে তার মনে এটা নিয়ে খচখচানি শুরু হয়।

“উনি কি লুকিয়ে রাখলেন ছবিটার পেছনে? ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে তো।”

ফাতেমা কৌতুহল বশত বাধানো ছবিটা হাতে নিয়ে তার পেছনে একটা বাক্সের মতো কিছু দেখতে পায়। সেটা খুলতেই আলাদিনের চিরাগের মতো হাতে পেয়ে যায় একটি চাবি। ফাতেমা উৎফুল্ল হয়ে বলে,
“অবশেষে চাবিটা পেয়েই গেলাম।”

অতঃপর ফাতেমা ভালো ভাবে চেক করে আশেপাশে কেউ আছে কিনা। কেউ নেই দেখে অর্পার ড্রয়ারটা খুলল। একটু খুঁজতেই অর্পার ডায়েরিটা পেয়ে গেল। ডায়েরি হাতে পেয়েই পড়তে শুরু করে দিলো।

৬৪.
ডায়েরি~~~
গত দেড় বছরে শহর থেকে ৪০ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। অথচ পুলিশ তাদের কাউকে খুঁজে পায়নি। আমি নিশ্চিত এই কেসগুলো কোন সাধারণ কেস নয়। এর পেছনে রয়েছে কোন বিশাল এক চক্র। আর এই চক্রের ব্যাপারে অনেক তথ্যই আমি জানতে পেরেছি। যেমন এই চক্রের প্রধান মিস্টার এক্স। আমি আমার স্বামী ইন্সপেক্টর নুহাশ খন্দকারকে এই ব্যাপারে বলেছি। কিন্তু সে আমার কথাগুলো একদম পাত্তা দিতে চায়না। তবে আমি হেরে যাওয়ার পাত্রী নই৷ যেই ৪০ জন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছিল তাদের সবার পরিবারের সাথে আমি কথা বলি। তাদের মধ্যে অধিকাংশ মেয়েই সহজ-সরল প্রকৃতির। যারা নিজ এলাকায় ভদ্র মেয়ে হিসেবেই চেনে। তাদের কোন প্রেমিক বা এরকম কিছু নেই৷ এসব জানার পর আমি আরো শিওর হয়ে যাই।

এরইমধ্যে আমার ফোনে কয়েকজন হুমকির ম্যাসেজ দেয়। বলে আমাকে শেষ করে দেবে কিন্তু আমি এসব কিছুকে পাত্তা দেই না। যখন আমি নুহাশকে এইসব ব্যাপারে বলি তখন ও আমাকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলে। আমি অবাক হয়ে যাই। আমার যেই স্বামীকে আমি ন্যায়পরায়ণ বলে জানতাম সে আমাকে এসব থেকে দূরে থাকতে বলছে। এসব আমি মেনে নিতে পারলাম না। আমি নিজের ইনভেস্টিকেশন থামালাম না। ধীরে ধীরে আরো নতুন অনেক তথ্য পেলাম। এসব ভালো মেয়েদের কে বা কারা মিষ্টি কথা বলে ভুলিয়ে নেয়। তারপর তাদেরকে দেখা করার কথা বলে নির্জন স্থানে ডাকে। তারা সেখানে গেলেই লোক লাগিয়ে অপহরণ করায় এবং তাদের নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। তবে এসবের পেছনে যেই মিস্টার এক্স রয়েছে সে সবথেকে বেশি জঘন্য। আমি যতদূর শুনেছি এই মিস্টার এক্স মেয়েদেরকে মানুষই মনে করে না, ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার করে। ৮ থেকে ৮০ সব ধরনের মেয়ের প্রতি তার হিংস্র নজর। এই খবর আমি নিশ্চিত হই যখন জানতে পারি দুটো ৫ বছর বয়সী বাচ্চা এবং তিনজন ষাটোর্ধ নারীর লাশ এই দুই নারীর লাশ ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যাদেরকে মৃত্যুর আগে ধ*ণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেকে নিখোঁজ ছিল। আমি এটা জেনে অবাক হই সে এসব কিছু চলছিল আইনের চোখ ফাকি দিয়ে। কিন্তু আদৌ কি এটা সম্ভব? আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে যে এসবের পেছনে আইনের লোকরাও জড়িত। তাদের সাহায্য ছাড়া এটা কিছুতেই সম্ভব না। আর এই ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে আমি যা জানলাম তা অবিশ্বাস্য ছিল। আমার স্বামী, নুহাশ খন্দকার, যাকে আমি এত বিশ্বাস করতাম সেও কিনা এই জঘন্য কাজের সাথে জঘন্য।

“কি পড়ছ তুমি?”

নুহাশের গলার সুরে পড়া থামিয়ে চমকে তাকিয়ে রইলো ফাতেমা। সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। নুহাশ এতটা জঘন্য। এখন কি সেও নুহাশের কাছে ধরা পড়ে যাবে? নুহাশ খন্দকার কি তারও সেই অবস্থা করবে যেমনটা অর্পার সাথে করেছিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨