অতুলনীয়া পর্ব-৩৭

0
48

#অতুলনীয়া
#পর্বঃ৩৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নুহাশ ফাতেমার সামনে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তোমার সাথে যা হয়েছে সবকিছুর দায় আমার। আরো ভালো ভাবে বলতে গেলে তোমার জীবনে গত কয়েক বছর থেকে ঘটা সব ঘটনার পেছনেও আমি রয়েছি, জীবন তোমার কিন্তু প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে।”

ফাতেমা বুঝতে পারছিল না নুহাশের এসব কথার অর্থ। নুহাশ এবার নিজের সব চক্রান্তের কথা ধীরে ধীরে বলতে লাগল,
“আমার বাবা নাহিদ মির্জা ছিলেন এই নারী পাচারকারী চক্রের মূল হোতা। তার জঘন্যতার উদাহরণ যদি আমি দিতে চাই তো বলতে হবে, আমার এবং নাঈমের মাকেও সে পাচার করে দিয়েছিল। আর নাজমা খাতুন..তিনি হলেন আমার বাবার এক আজ্ঞাবহ দাসী, তার স্বামী রওশান খন্দকার ছিল বাবার ডানহাত। মাকে বিদেশে পাচার করার পর বাবা রওশান খন্দকার আর নাজমা খাতুনের হাতে আমাদের দুই ভাইয়ের দায়িত্ব তুলে দেন। আমার বয়স তখন ছিল পাঁচ আর নাঈমের আড়াই। আমরা দুই ভাই ছোট থেকেই এসব পাপের সাম্রাজ্য দেখে বড় হয়েছি। অন্য বাচ্চাদের বাবা ছোট থেকে তাদের নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দেয় আর আমাদের বাবা আমাদের দিয়েছিল অপরাধের শিক্ষা৷ অন্যায় করার শিক্ষা।”

ফাতেমা আতকে ওঠে। একটু থেমে বলে,
“নেহা, নয়না ওদের সাথে আপনাদের সম্পর্ক কি?”

নেহা মির্জা হলো রওশান খন্দকার এবং নাজমা খাতুনের আসল মেয়ে। আমাদের পালন করার বিনিময়ে তারা নিজেদের মেয়েকে আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনের সু্যোগ চেয়েছিল। আর নয়না আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তান।

ফাতেমা হতবাক হয়ে যায় এসব কথা শুনে। নুহাশ ফাতেমার অবাক হওয়া মুখশ্রী দেখে বলে,
“এখনই এত অবাক হয়ো না এখনো অনেক অবাক হওয়া বাকি আছে।”

ফাতেমা হঠাৎ বলে ওঠে,
“আমার বাবার মৃত্যুর পেছনেও কি…”

নুহাশ হেসে বলে,
“তাহলে তুমি এতটাও বোকা নও। হ্যাঁ, একদম ঠিক ধরেছ। আমিই ছিলাম তোমার বাবার মৃত্যুর পেছনে। আমাদের বাবা ভীষণ চতুর ব্যক্তি ছিলেন। তার পথের সম্ভাব্য সকল কাটা তিনি উপড়ে ফেলতে পছন্দ করতেন। তোমার বাবা ছিল একজন গোপন সিআইডি অফিসার, যিনি এই নারী পাচারকারী কেসের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাদের এই ব্যবসা সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে গেছিলেন। তাই তাকে পথ থেকে সরানোর দায়িত্ব দেয়া হয় নয়নাকে।”

“এজন্যই তাহলে নয়না আমার বাবা-মাকে মে*রে ফেলেছিল?”

“হুম। শুধুমাত্র তোমাকে ঈর্ষা করে তোমার মা-বাবাকে নয়না খু*ন করবে এটা তুমি ভাবলে কি করে? এতটাও বোকা তোমায় ভাবিনি।”

ফাতেমার কাছে অনেক কিছুই এখন দিনের আলোর মতো পরিস্কার হতে থাকে। ফাতেমা বলে ওঠে,
“তাহলে সোহেলকেও…”

“আবারও ঠিক আন্দাজ করেছ। সোহেল আমাদেরই লোক। আমরাই ওকে পাঠিয়েছিলাম তোমাদের উপর নজরদারি করার জন্য, কারণ আমাদের মনে হয়েছিল যেহেতু তুমি সিআইডি অফিসার ফজলুল করিমের সন্তান তাই আমাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ তোমার কাছে থাকতেই পারে।”

ফাতেমা মলিন হাসে। আজকে তার পুরো জীবনটাই একটা ধাঁধা মনে হচ্ছে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ছিল কিছু কুচক্রী মানুষের চক্রান্ত। ভাগ্যের এই পরিহাস দেখে তার ভীষণ কান্না পায়। তবে সে কাঁদে না। এখনো যে তার অনেক কিছু জানা বাকি আছে।

নুহাশ আবারো বলতে শুরু করে,
“কিন্তু যখন বুঝতে পারি তুমি কোন কাজের নও তখন সোহেলকে বলি তোমার সাথে এই মিছে সম্পর্ক টেনে আর লাভ নেই। কিন্তু কোন কারণ ছাড়া তো আর ডিভোর্স সম্ভব নয়। তাই নয়নার সাথে পরকীয়ার নাটক তৈরি করতে হলো।”

ফাতেমা চুপচাপ চেয়ে আছে নুহাশের দিকে। নুহাশ দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে বলে,
“তবে পরে দেখলাম তুমিও আমাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারো। যেভাবে তুমি সোহেল আর নয়নার পেছনে আদাজল খেয়ে পড়লে তাতে তোমাকে আমরা সমূহ বিপদ মনে করি। এজন্য সোহেলের মিথ্যা মৃত্যুর কেস সাজিয়ে তোমাকে ফাসাতে চাই। কিন্তু এবারও ঐ প্রত্যুষ সোহেল অব্দি পৌঁছে যায়। তাই আমি নতুন পরিকল্পনা করি, সোহেলকে বলি ধরা দিতে। সব আমার পরিকল্পনা মতোই হয়। কিন্তু এরমধ্যে ঘটে যায় নতুন সমস্যা। নয়না হঠাৎ করেই বেকে বসে। ছোটবেলা থেকেই ওর উদ্দ্যেশ্য ছিল এই নারী পাচারকারী চক্রের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা, সবকিছু ওর হাতের মুঠোয় আনা। মূলত ওর মায়ের প্রনোদনায় ও এমন স্বপ্ন দেখত। তাই আমি ওকে কৌশলে জেলে পাঠাই। আর ও ক্রমশ আমার মুখোশ খোলার ভয় দেখায়। আমাদের কথা সবাইকে জানিয়ে দেবে বলে, তখন ও আমাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। তাই আমার ফেভারে থাকা কিছু পুলিশ অফিসারের সাহায্যে ওকে জেল থেকে বার করি। তারপর ও চলে যায় তোমাকে মা*রতে। ওর উদ্দ্যেশ্য ছিল তোমাকে শেষ করে এরপর আমাদের সব কুকীর্তি সবার সামনে ফাঁস করে দেবে কিন্তু এটা তো আমি হতে দিতে পারি না। তাই আমিও কৌশলে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দিলাম।”

ফাতেমা হতবাক হয়ে বললো,
“তাহলে নয়নাকে আপনি..”

“হ্যাঁ, আমিই ওর এই হাল করেছি।”

ফাতেমা হেসে বললো,
“যাক! অন্তত একটা ভালো কাজ করেছেন।আর নিহা, অর্পা আপু ওদের এই হালের পেছনেও আপনার হাত আছে তাই তো?”

“অর্পাকে মা*রার পেছনে আমারই পরিকল্পনা ছিল। ও ছিল একজন দূর্ধর্ষ সাংবাদিক। শুধু তাই নয়, ওর আরো একটা পরিচয় আছে, ও তোমার ফুফাতো বোন।”

ফাতেমা প্রতিক্রিয়াবিহীন। তার মানে সে এসব কিছু খুব ভালো করেই জানে। ফাতেমা বলে,
“আমি জানি। অর্পা আপুকে ছোট থাকতে দেখেছিলাম কিন্তু তার চেহারার গঠন মনে ছিল। আব্বু বলতো আমার ফুফাতো বোন একদম তার মতোই সাহসী। ফুফার সাথে পারিবারিক ঝামেলার জন্য কথাবার্তা হতো না। তবে দূর থেকে আব্বু সব খোঁজ রাখতেন।”

“অর্পাকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করিনি৷ করেছিলাম নিজের স্বার্থের জন্য। কিন্তু যখন ও আমার স্বার্থের পথে বাঁধা হয়ে দাড়ালো, আমার এই অপরাধের সাম্রাজ্য সম্পর্কে জানতে পারল তখন তাকে পথ থেকে সরানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।”

“প্রথমবার অর্পা আপুর ছবি দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। আমি তখন থেকেই ভাবতাম আপনারা বেশি সুবিধার না। ফারিয়াকে কিডনি দেওয়ার ঘটনাটাও বুঝি মিথ্যা ছিল।”

“এটা সত্যি ছিল। তবে আমি নিজের কিডনি দেইনি। সোহেল দিয়েছে, আমি দিতে বলেছি তাই। আর এসব অতি কৌশলে করেছি। আমি একটা ফর্মুলায় ভীষণ বিশ্বাসী নিজের শত্রুকে নিজের হাতের নাগালে রাখতে হয়। তোমার ক্ষেত্রেও সেটা করেছি। যার জন্য এই নাটকের দরকার ছিল।”

“নিহাকে কেন মা*রলেন, ঐ বাচ্চা মেয়েটা কি দোষ করেছিল?”

“নিহাকে আমি মা*রিনি। ওকে নাঈম মে*রেছে। যাইহোক এসব মৃত্যু নিয়ে আমি ভাবি না। নিজের হাতে নিজের বাবা, স্ত্রীকে মেরেছি। সেখানে এই সাধারণ এক পালিত মেয়ের জন্য কেন দুঃখ পাবো?”

“এতটা অমানুষ আপনি?”

“এখন বুঝলে?”

“আপনার ধ্বংস হবে তাও আমার হাতে।”

“তাই নাকি? কিভাবে ধ্বংস করবে শুনি?”

বলেই হাসতে থাকে নুহাশ। ফাতেমা ছটফট করতে থাকে। নুহাশ বলে,
“গতকাল তোমাকে বিদেশে পাচার করতে চলেছি। তার আগে তোমাকে এক ঘন্টা সময় দেওয়া হবে, এই এক ঘন্টা তুমি সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে। চাইলে এই এক ঘন্টায় যা খুশি করো।”

ফাতেমা যেন একটা সুযোগ পেয়ে যায়। এই এক ঘন্টার মাঝে তাকে অতুলনীয় কিছু করে উঠতে হবে। যা তাকে করে তুলবে একজন সত্যিকারের অতুলনীয়া। এখন দেখার পালা ফাতেমা কি করতে পারে। কে হাসবে শেষ হাসি? ফাতেমার ন্যায় নাকি নুহাশের অন্যায়ের সাম্রাজ্য।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨